তাঁর ফ্ল্যাটে তেমন কিছুই নেই—শুধু বই আর বই। বসার ঘর, শোবার ঘরে বইপত্র ছড়িয়ে–ছিটিয়ে আছে এলোমেলোভাবে। তবে তিনি সেভাবে এখন আর বই পড়তে পারেন না। বললেন, ‘পড়তে না পারলেও ছুঁয়ে তো দেখতে পারি, বইয়ের পাতায় হাত ছোঁয়ালে কেমন যেন শক্তি পাই!’ উত্তরায় মানুষটির ঘরে ঢুকে টেবিলে রাখা বইয়ের স্তূপের পাশে তাঁকে যখন দেখলাম, তখন তিনি সকালবেলার চায়ে চুমুক দিচ্ছেন। শরীরটা একটু ভেঙে গেছে, দৃষ্টিশক্তি ক্ষীণ, কিন্তু কথা বলতে শুরু করলে টের পাওয়া যায়, তেজটা এখনো অটুট—তিনিই মোহাম্মদ রফিক; ১৯৮০–এর দশকে এরশাদবিরোধী আন্দোলনের সময় শাসকের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে যিনি লিখেছিলেন বিখ্যাত সেই পঙ্ক্তি, ‘সব শালা কবি হবে; পিপড়ে গোঁ ধরেছে, উড়বেই; বন থেকে দাঁতাল শুয়োর রাজাসনে বসবেই...।’
ষাট দশকের অন্যতম এই কবি আজ ৮০ বছরে পা দিলেন। ৮০তম জয়ন্তীর আগে ২১ অক্টোবর তাঁর কাছে প্রশ্ন রেখেছিলাম, দীর্ঘ একটা জীবন কাটাচ্ছেন। এই জীবনের সার্থকতা কী?
‘এ জীবনে আমার কোনো সার্থকতা নেই, এটাই আমার সার্থকতা। প্রচলিত অর্থে জীবনটাকে আমি সার্থক করে তুলতে চাইনি।’
এমন কাট কাট কথা বলা মোহাম্মদ রফিক উত্তরায় এখন একাই থাকেন। এ নিয়ে অবশ্য তাঁর কোনো অনুযোগও নেই, ‘একাকিত্বের বোধটাকে আমি অনেকটা জয় করতে পেরেছি। আমি নিজের ভেতরে সমাহিত থাকতে পছন্দ করি। এটাকে কেউ আমার আবেগহীনতাও বলতে পারে।’
তাহলে কবি মোহাম্মদ রফিক কি আবেগহীন মানুষ? কীর্তিনাশা, গাওদিয়া, কপিলা—এই কবিতার বইগুলোতে যিনি একদা ধরতে চেয়েছিলেন লৌকিক বাংলার আবেগ, তার আগে খোলা কবিতা নামের কাব্যগ্রন্থের মাধ্যমে এরশাদবিরোধী আন্দোলনে যিনি সঞ্চারিত করেছিলেন বিপ্লবী আবেগের স্ফুলিঙ্গ, তাঁকে আবেগহীন কি বলা যায়!
ষাট দশকে আইয়ুববিরোধী আন্দোলন করে কারাগারে গেছেন। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ করেছেন। পরে অধ্যাপনা করেছেন দীর্ঘদিন, সর্বশেষ জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগ থেকে অবসর নিয়েছেন ২০০৯ সালে। কিন্তু কবির তো অবসর নেই। কবিতায় তিনি এখনো সক্রিয়। নিয়মিতই পোস্ট করেন ফেসবুকে। যেমন দুদিন আগে ‘নাচ রে’ নামে এক কবিতায় লিখেছেন, ‘কাঁদালো মানুষ পশুপ্রাণী/ প্রকৃতি সাধন বায়ুস্রোত,/ ভুলেও ভাবিনি, ওরা রইল,/ সমূহ ধ্বংসের হেফাজতে...।’
আমাদের সঙ্গে আলাপেও আক্ষেপের সুরে একই কথা শোনা গেল বাগেরহাটে জন্ম নেওয়া এই কবির কণ্ঠে, ‘সফল হওয়ার বাসনায়, এক নম্বর হওয়ার জন্য আমরা সবকিছু নষ্ট করে ফেললাম। খারাপ লাগে, পৃথিবীটাকে ধ্বংসের মুখে রেখে আমি চলে যাব।’
চলে যাওয়ার কথা তবে ভাবেন মাঝেমধ্যে?
‘এখনো বেঁচে আছি, এটাই তো বিস্ময়কর! চলে যাওয়ার জন্য আমি সব সময়ই প্রস্তুত। এখন কবিতা লিখলে তা আমার এক সহকারীর কাছে জমা রাখি। তাকে বলেছি, আমার মৃত্যুর পর মন চাইলে এগুলো ছেপো, না হয় ফেলে দিয়ো। এত লেখার আসলে কোনো অর্থ হয় না। তবু লিখলেই মনে হয়, বেঁচে আছি।’
কবিতাই মোহাম্মদ রফিককে বারবার বাঁচিয়েছে। কৈশোরে কৃষ্ণা নামের এক মেয়ের প্রেমে পড়েছিলেন। সেই প্রেমের আবেগ প্রকাশের জন্য অষ্টম শ্রেণিতে থাকাকালে প্রথমবার কবিতা লিখে যেন নতুন করে বেঁচে উঠেছিলেন। তারপর ১৯৬৪ সালে ওই মেয়ে যখন দেশান্তরি হলো, তখন তিনি ছাত্রনেতা, সবে জেল খেটে বেরিয়েছেন। ‘এই বিরহ, এই বেদনাবোধই সক্রিয় রাজনীতি থেকে সরিয়ে আমাকে কবি করে তুলল, একের পর এক কবিতা লিখতে থাকলাম। হয়তোবা আবারও বেঁচে উঠলাম!’
বৈশাখী পূর্ণিমা (১৯৭০) কাব্যগ্রন্থের মধ্য দিয়ে কবিতার মঞ্চে তাঁর অভিষেক। পরের কাব্যগ্রন্থগুলোতে স্বকীয় বাকভঙ্গিমায় আবহমান বাংলার ইতিহাস–ঐতিহ্যের পরম্পরায় ধরতে চেয়েছেন নশ্বর সমকালীনতাকেও। প্রথমা প্রকাশন থেকে ২০২০ সালে প্রকাশিত পিরিতে বসাবো বসত নামের কবিতার বইয়ে সেই যে বলেছিলেন, ‘শুক্লা দ্বাদশীর চাঁদে ভেসে/ জলজোছনায় বেহুলার/ দেহে ক্ষুব্ধ সাগরমোহনা...’, বাঙালি–পুরাণের এই বেহুলারা বর্ণিল স্বরে অজস্রবার জেগে উঠেছে মোহাম্মদ রফিকের কবিতার খাতায়। কারণ, অনেক ঘাটে ঘুরিয়ে–ফিরিয়ে জীবন তাঁকে এই সত্য শিখিয়েছে যে ‘নিজের দেশের পানে, “দেশে ফেরার খাতা”র দিকে না তাকিয়ে লেখা যায় না কিছুই।’
বাংলা একাডেমি পুরস্কার, একুশে পদক, প্রথম আলো বর্ষসেরা বই পুরস্কারসহ অজস্র সম্মাননায় অভিষিক্ত কবির কাছে শেষ প্রশ্ন ছিল, এ জীবন নিয়ে কোনো খেদ কি আছে?
বইয়ের স্তূপের মধ্যে বসে মৃদু হাসলেন তিনি, চোখের দৃষ্টি খানিকটা উদাস। তারপর আওড়ালেন রবীন্দ্রনাথ থেকে, ‘কী পাইনি তারি হিসাব মিলাতে মন মোর নহে রাজি।’