একটি কবিতা কীভাবে কবিতা হয়ে ওঠে? কবিতার অর্থ বলতে আসলে কী বোঝায়? বিশ্ব কবিতা দিবসে আজ প্রশ্নগুলোর উত্তর খোঁজা যাক...
১৯৮০-র দশকের শুরুর ভাগে একদল তরুণ কবি কোমর বেঁধে নতুন কবিতা লিখতে নেমেছিলেন। অভূতপূর্ব উপলব্ধি নতুনতর ভাষায় ব্যক্ত করে কবিতায় একটি হুলুস্থুল কাণ্ড ঘটিয়ে দেওয়ার দুঃসাহস করেছিলেন তাঁরা। এক মন্থর সন্ধ্যায় বাংলা মোটরের চৌরাস্তায় জোহরা মার্কেটের এক সস্তা হোটেলের চায়ের টেবিলে খেলাচ্ছলে নতুন কবিতার একটা ইশতেহারও তাঁরা রচনা করেন। ইশতেহার লিখে কখনো কবিতা হয় না। কিন্তু যৌবনের নানা অতিরঞ্জন থাকে। যৌবনের সৌন্দর্যও হয়তো তাতেই। নিজেদের ছাপিয়ে নবীন সেই কবিরাও তখন অনেকখানি উপচে পড়েছিলেন। দূর থেকে তাকিয়ে তার অনেক কিছুকে আজ ছেলেমানুষী বলে মনে হবে। পাশাপাশি এ–ও হয়তো মনে হবে—সে সময় অনেক বাড়াবাড়ির পরও এবং সবকিছু খুব স্পষ্টভাবে বুঝে উঠতে না পারলেও—বাংলা কবিতার বেশ কিছু সমস্যা সেই কবিদল তখন অনুভব করতে পেরেছিলেন। সমসাময়িক বাংলা কবিতার ওপর যে মোটের ওপর তাঁরা শ্রদ্ধা হারিয়েছিলেন, সেটি নেহাৎ অবান্তর বা অকারণ ছিল না। নন্দনতাত্ত্বিক বা দার্শনিকভাবে কারণগুলো হয়তো অনতিতরুণ সেই কবিরা ঠিকঠাক বুঝে উঠতে পারেননি, কিন্তু কবিসুলভ সংবেদনশীলতা যে তাঁদের সঠিক সংকেত দিয়েছিল, গত দুই-আড়াই দশক ধরে বাংলা কবিতার ক্রমাগত পাল্টে যাওয়া ভাষা দেখে আজ তা-ই মনে হয়। কবিতার আজকের ভাষা আবার যে অন্ধগলির দিকে এগিয়ে যাচ্ছে, তা নিয়ে আমরা অন্যত্র আলোচনা করেছি।
ঠিক এক প্রজন্ম আগের কবিদের নিয়ে সেই কবিদলের আলাদাভাবে তেমন কোনো বিরোধ ছিল না, যেমনটা অনেকে বলে থাকেন। তাঁরা ভাবিত হয়ে উঠেছিলেন সে সময়ের বাংলা কবিতার পুরো অবয়বটি নিয়েই। তাঁদের মনে হয়েছিল, শামসুর রাহমান থেকে শুরু করে রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহ পর্যন্ত বাংলাদেশের কবিতার পুরো মূলধারার মধ্যে দশক-বিশেষে মৌলিক কোনো প্রভেদ আসলে নেই। নানাজনের নানা কবিতাকে একটি গুচ্ছে ধরে রাখার কোনো বিশেষ কৃতিত্ব যদি কাউকে দিতেই হয়, সেটি শামসুর রাহমানের। তিনি কবিতার এমন একটি ভাষা তৈরি করেছিলেন যা পরবর্তীকালের কবিতাকে প্রায় পুরোপুরি গ্রাস করেছিল। আলাদাভাবে পরবর্তী সময়ের কোনো একটি দশকের কবিতাকে দোষ দেওয়ার কিছু ছিল না। অল্প দু-চারজন যাঁরা কবিতায় নিজেদের কণ্ঠস্বর শোনাতে পারছিলেন, তেমন কবির সংখ্যা ছিল বিরল। নবীন কবিদলের মনে হচ্ছিল, যেসব কবিতা তখন লেখা হচ্ছে—হোক তা রাজনীতির বা প্রেমের, আশ্লেষের বা ধিক্কারের—সেগুলো নিজের মধ্যে কবিতার কোনো শর্ত তৈরি করতে পারছে না; কবিতার যোগ্য ভাষা থেকে সেসব চলে যাচ্ছে যোজন যোজন দূরে। এই একটা জায়গায় শামসুর রাহমান বা তাঁর পরবর্তী প্রজন্মের যেকোনো কবির ভাষা ও উপলব্ধির মধ্যে একটা বড় ঐক্য তাঁদের নজরে পড়েছিল। ঠিক এই জায়গাটিতেই নবীন সেই কবিরা বেঁকে বসেছিলেন; এবং তাঁদের কেউ কেউ চেয়েছিলেন, সকল তরুণ কবি যে যার জায়গাতে দাঁড়িয়েই এর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করুক।
কিন্তু কাকে বলে কবিতা? কী তার শর্ত? কেমন তার যোগ্য ভাষা?
বিশ শতকের শেষার্ধে বাংলাদেশে কবিতার এই মূল স্বভাবটিই উল্টে গিয়েছিল। আর সেটি প্রধানত ঘটেছিল শামসুর রাহমানের নিবিড় পৌরোহিত্যে। তিনি কবিতার এমন একটি ভাষা উদ্ভাবন করেছিলেন যেখানে শব্দের আর কোনো প্রতিসরণের দরকার হয় না। কবিতার অন্তস্তল উঠে আসে তার উপরিতলে। এগুলো ‘বোঝার’ জন্য কবিতার শর্তের কাছে পাঠকের আর নিজেকে সমর্পণ করতে হয় না। উদাহরণ হিসেবে শামসুর রাহমানের বহুপাঠ্য ‘তোমাকে পাওয়ার জন্য, হে স্বাধীনতা’ কবিতাটিই পড়ে দেখা যাক। কবিতাটির কয়েকটি চরণ এ রকম: ‘তুমি আসবে ব’লে হে স্বাধীনতা,/সাকিনা বিবির কপাল ভাঙলো,/সিঁথির সিঁদুর মুছে গেল হরিদাসীর।/তুমি আসবে ব’লে হে স্বাধীনতা,/শহরের বুকে জলপাই রঙের ট্যাঙ্ক এলো দানবের মতো চিৎকার করতে করতে/তুমি আসবে ব’লে হে স্বাধীনতা,/ছাত্রাবাস, বস্তি উজাড় হলো। রিকয়েললেস রাইফেল/আর মেশিনগান খই ফোটালো যত্রতত্র।’ এই কবিতার শব্দ মূলতই তাদের ‘অর্থে’ সিদ্ধ। তাই এতে যে আবেগ জেগে উঠেছে, তা যতটা না কবিতার, তার চেয়ে অনেক বেশি ইতিহাসের। পাঠক হিসেবে আমরা নিজের অজান্তে ইতিহাসের আবেগকে এখানে কবিতার আবেগ হিসেবে গ্রহণ করছি।
একটি কবিতা কবিতা হয়ে ওঠার নানা শর্তই থাকতে পারে। কালান্তরে, এমনকি একই কালে সেসব শর্ত নিয়ে কবি ও পণ্ডিতদের মধ্যে বিতণ্ডারও শেষ নেই। মহত্তম কবিরা সেসব শর্ত পেরিয়ে গিয়ে কবিতার নতুন শর্ত তৈরি করেন; কখনো বা পুরোনো শর্তের স্তরান্তর ঘটান। সেসবের ব্যাখ্যানে যাওয়ার অবকাশ এখানে নেই। তবু একটি কবিতাকে যে প্রবন্ধ বা গল্প বা দস্তাবেজ হিসেবে না পড়ে কবিতা হিসেবেই আমরা পড়ে ফেলি, তার পেছনে আমাদের মনে—খুব সন্তর্পণে হলেও—কিছু শর্ত কাজ করে নিশ্চয়ই। সেসবের মধ্যে অন্তত যে শর্তটি পালন না করে কোনো রচনার পক্ষে আদৌ কবিতা হয়ে ওঠাই সম্ভব নয়, তা হলো অর্থ থেকে শব্দের প্রতিসরণ। আলোর প্রতিসরণের কারণে পানিতে ডোবানো লাঠি যেমন দৃশ্যত বেঁকে যায়, কবিতায় ঠাঁই পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে শব্দও তেমনই অভিধানের অর্থ থেকে সরে যেতে বাধ্য। এখানে কবির কাজ বড় বিপজ্জনক। চিত্রকর বা সংগীতশিল্পীর চেয়ে তার যাত্রাপথও ভিন্নতর ও দুর্গম। একজন চিত্রকর বা সংগীতশিল্পীর শিল্পবস্তুর মূল উপাদান রং বা স্বর স্বভাবগতভাবেই বিমূর্ত। এমনকি দৃশ্যমান জগতের প্রতিচিত্রণ না করে কিংবা অর্থময় শব্দের মুখাপেক্ষী না হয়েও একজন চিত্রকর বা সংগীতশিল্পী তাঁর জীবনব্যাপী শিল্পসাধনা চালিয়ে যেতে পারেন। হোয়ান মিরো বা মোহাম্মদ কিবরিয়া কিংবা মোৎসার্ট বা করিম খাঁর মতো মহত্তম উদাহরণ আমাদের সামনে আছে। কিন্তু কবির উপাদান যে শব্দ, একটি ভাষাভাষী গোষ্ঠীর প্রতিটি সদস্যের কাছে তার কতগুলো সুনির্দিষ্ট ‘মানে’ আছে। একজন কবি সেই ভাষিক গোষ্ঠীর বিপরীতে গিয়ে তার কবিতায় সেই ‘মানে’ থেকে শব্দকে সরিয়ে আনেন। একটি শব্দের নতুন দ্যোতনা তখন পাওয়া সম্ভব কেবল সুনির্দিষ্ট ওই কবিতাটিরই ভাষাবিন্যাসের অন্তর্জালে, ওই কবিতাটিরই নিজস্ব শর্তের ভেতরে। রহস্যময় এই ঘটনার কারণেই কবিতা তার বৈপ্লবিক কাণ্ডটি ঘটাতে সক্ষম হয়ে ওঠে। কবিতার মধ্য দিয়ে তার ভাষাভাষী জনগোষ্ঠীর অভিজ্ঞতার পরিমণ্ডলের মধ্যে উন্মেষ ঘটে ভাষায়-এখনো-দানা-না-বাঁধা নতুন উপলব্ধির। নতুন কবিতা মাত্রই তাই আমাদের যাপন ও সমাজ-রাষ্ট্রের বিদ্যমান ছকের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ।
কবিতায় শব্দের এই অর্থান্তর কীভাবে ঘটে, সেটি আরেক জটিল আলোচনার বিষয়। এখানে তা আলোচ্যও নয়। কোনো কোনো তত্ত্ববিশারদ সাম্প্রতিক দর্শনের দোহাই দিয়ে হয়তো বলবেন, কোনো শব্দের অর্থই তো স্থির নয়, স্থান-কাল-পাত্র ভেদে তার মানে পাল্টে পাল্টে যায়, ফলে ভাষা মাত্রেই কবিতা। সে আলোচনায় প্রবেশের পথও এখানে প্রশস্ত নয়।
যা হোক, কবিতার সঙ্গে ভাষার এই অভিনব সম্পর্কটি অল্প কথায় সামান্য বিশদ করা যাক। একটি গল্প বা প্রবন্ধ পড়ে মুগ্ধ হলে নিকটজনদের কাছে আমরা সেই রচনার সারকথাটি তুলে ধরি। এভাবে কোনো না কোনো রচনার সারকথা তুলে ধরার অভিজ্ঞতা আমাদের সবারই আছে। কিন্তু কোনো কবিতা—ধরা যাক জীবনানন্দ দাশের ‘বনলতা সেন’, যার মধ্যে এমনকি একটি কাহিনিরও মৃদু আভাস আছে—পড়ে মুগ্ধ হয়ে গল্প বা প্রবন্ধের মতো তার সারকথাটি কি আমরা বন্ধুদের কাছে তুলে ধরতে পারব? কেউ কি তার মর্মকথা এভাবে কখনো বলবেন যে, ‘কবি হাজার হাজার বছর ধরে পৃথিবীর নানা পথে পথে হাঁটছিলেন; তারপর নাটোরে গিয়ে বনলতা সেন নামে এক নারীর সঙ্গে তাঁর দেখা হয়...’ ইত্যাদি ইত্যাদি? কবিতার নিছক অর্থের ভাগটুকু এভাবে বলতে গেলে কবিতার অভিপ্রায় থেকে কীভাবে যেন তা সরে যায়। পুরো ব্যাপারটিই কেমন হাস্যকর হয়ে ওঠে। এভাবে অন্যের কাছে কোনো অর্থভাষ্য পৌঁছে দিতে না পারার এই স্বভাবের মধ্যেই নিহিত রয়েছে অন্য ভাষিক মাধ্যম থেকে কবিতার আলাদা হয়ে ওঠার বীজ। অন্যান্য ভাষিক মাধ্যমে—গল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধ বা বিজ্ঞাপনে—শব্দের কাজ বাহনের। অর্থের কাছে পাঠককে পৌঁছে দিয়েই সেখানে শব্দের দায়িত্ব শেষ। কিন্তু কবিতায় শব্দ একই সঙ্গে বাহন এবং গন্তব্য। তাই কোনো কবিতার অভিপ্রায় কারও কাছে পৌঁছে দিতে হলে শব্দে-শব্দে, পঙ্ক্তিতে-পঙ্ক্তিতে ধরে ধরেই আমরা সেটি উচ্চারণ করি। কবিতার সুনির্দিষ্ট বিন্যাসের মধ্যেই সে কবিতার প্রতিটি শব্দের নতুন রূপ, রং ও ঐশ্বর্য। সেখানেই তারা কবিতা। এর বাইরে শব্দগুলো নিতান্ত ব্যবহারিক।
বিশ শতকের শেষার্ধে বাংলাদেশে কবিতার এই মূল স্বভাবটিই উল্টে গিয়েছিল। আর সেটি প্রধানত ঘটেছিল শামসুর রাহমানের নিবিড় পৌরোহিত্যে। তিনি কবিতার এমন একটি ভাষা উদ্ভাবন করেছিলেন যেখানে শব্দের আর কোনো প্রতিসরণের দরকার হয় না। কবিতার অন্তস্তল উঠে আসে তার উপরিতলে। এগুলো ‘বোঝার’ জন্য কবিতার শর্তের কাছে পাঠকের আর নিজেকে সমর্পণ করতে হয় না। উদাহরণ হিসেবে শামসুর রাহমানের বহুপাঠ্য ‘তোমাকে পাওয়ার জন্য, হে স্বাধীনতা’ কবিতাটিই পড়ে দেখা যাক। কবিতাটির কয়েকটি চরণ এ রকম: ‘তুমি আসবে ব’লে হে স্বাধীনতা,/সাকিনা বিবির কপাল ভাঙলো,/সিঁথির সিঁদুর মুছে গেল হরিদাসীর।/তুমি আসবে ব’লে হে স্বাধীনতা,/শহরের বুকে জলপাই রঙের ট্যাঙ্ক এলো দানবের মতো চিৎকার করতে করতে/তুমি আসবে ব’লে হে স্বাধীনতা,/ছাত্রাবাস, বস্তি উজাড় হলো। রিকয়েললেস রাইফেল/আর মেশিনগান খই ফোটালো যত্রতত্র।’ এই কবিতার শব্দ মূলতই তাদের ‘অর্থে’ সিদ্ধ। তাই এতে যে আবেগ জেগে উঠেছে, তা যতটা না কবিতার, তার চেয়ে অনেক বেশি ইতিহাসের। পাঠক হিসেবে আমরা নিজের অজান্তে ইতিহাসের আবেগকে এখানে কবিতার আবেগ হিসেবে গ্রহণ করছি।
এ জাতীয় কবিতার ভেতরে আর ঢোকার প্রয়োজন হয় না। আর তা না করেও পাঠক দিব্যি সেটি ‘বুঝে’ তা থেকে এক ধরনের স্বাদ নিয়ে থাকেন। শামসুর রাহমানের নেতৃত্বে বাংলাদেশে কবিতার এ ভাষার প্রায় সার্বভৌম প্রতিষ্ঠা ঘটেছিল। এসব কবিতার জনপ্রিয়তার কারণ ছিল ‘সহজবোধ্যতা’ ও সুপাচ্যতা; ঢিলেঢালা গড়ন—অনেক যেমন বলে থাকেন—সম্ভবত নয়। তার মানে আবার এই নয় যে জনপ্রিয় কবিতা মাত্রেই অকবিতা। সে–ও আরেক ভিন্ন আলোচনার বিষয়।
কবিতা তার মৌলিক শর্তগুলো থেকে সরে এলে কী ঘটতে পারে, তারই উজ্জ্বল উদাহরণ বাংলাদেশে এক সময় জেগে ওঠা তালিকা-প্রণয়নের রীতিতে কবিতা লেখার জোয়ার। তালিকা-প্রণয়নের রীতিতে কবিতা লেখার শৈলীটিও জনপ্রিয় করে তুলেছিলেন শামসুর রাহমান। এ রীতিতে তাঁর সবচেয়ে জনপ্রিয় কবিতা দুটি হলো ‘স্বাধীনতা তুমি’ ও ‘তোমাকে পাওয়ার জন্য, হে স্বাধীনতা’। এ ধারায় এরপর বাংলা কবিতায় বান ডাকে। সেসবের মধ্যে শহীদ কাদরীর ‘তোমাকে অভিবাদন প্রিয়তমা’, রফিক আজাদের ‘ভালবাসা মানে’ বা আবিদ আজাদের ‘যে শহরে আমি নেই, আমি থাকব না’ বিপুলভাবে পাঠকনন্দিত হয়েছে। সত্যি করে বললে এর সূত্রপাত ষাটের দশকে। পেঙ্গুইন প্রকাশনীর কল্যাণে লিভারপুলের এক গৌণ কবি অ্যাড্রিয়ান হেনরির মাধ্যমে বাংলা কবিতায় এর আছর পড়ে। কিন্তু তারও বহু আগে ফরাসি কিন্নরকণ্ঠ কবি পল এলুয়ার এ শৈলীতে তাঁর আসল শক্তির চিহ্ন রেখে গিয়েছিলেন। এমন কি, শামসুর রাহমানের বিখ্যাত রচনা ‘দুঃখ’ লেখা হয়েছিল এলুয়ারেরই ‘লিবার্টি’ কবিতাটি ভেঙে।
আমাদের প্রশ্ন হলো, একটি সময়কালে একই ভাষার বিভিন্ন কবি কীভাবে প্রায় একটি অভিন্ন শৈলীতে কবিতা লিখে উঠতে পারলেন? একটি সুনির্দিষ্ট শৈলীর পক্ষে কি নানা কবির বিচিত্র কবিতাকে আদৌ আকার দিতে পারা সম্ভব? আসলেই কি এমন একটি অবস্থার কথা ভাবা যায়, যখন কোনো কবিতা রচিত হওয়ার আগেই তার কাঠামোটি হাজির থাকবে? অথচ এমন কাণ্ডই বাংলা কবিতায় ঘটেছিল।
চেক কবি মিরোস্লাব হোলুবের একটি লেখা তুলে দিয়ে এ রচনাটি শেষ করা যেতে পারে। অনুবাদ করে দিচ্ছি ‘কবির সঙ্গে আলাপচারিতা’ শিরোনামে তাঁর একটি কবিতার অংশবিশেষ:
তুমি কি কবি?
হ্যাঁ, আমি কবি।
কী করে বুঝলে?
কবিতা লিখেছি যে।
যদি লিখে থাকো, তাহলে কবি ছিলে। কিন্তু এখন?
আবার একদিন কবিতা লিখব।
সে দিন হয়তো আবার কবি হবে। কিন্তু কী করে বুঝবে সেটা কবিতাই হয়েছে?
সেটাও আগেরটার মতো কবিতা হবে।
তাহলে তো সেটা কবিতাই হবে না। একটি কবিতা শুধু একবারই হয়, পরের বার একই রকম আর কখনোই হয় না।
আমার বিশ্বাস, সেটা একই রকমের ভালো হবে।
এত নিশ্চিত তুমি হলে কী করে? কোনো কবিতার সার্থকতা তো ওই একবারই আসে। আর তা নির্ভর করে পরিস্থিতির ওপর, তোমার ওপর নয়।
আমার ধারণা, পরিস্থিতিটাও অবিকল একই থাকবে।
তা-ই যদি মনে হয়, তাহলে তো তুমি কবি ছিলেও না, কবি হবেও না।...
প্রথম প্রকাশ: প্রথম আলো, ১১ নভেম্বর ২০১১