‘নারী কিসে আটকায়’ বিষয়টি নিয়ে শোরগোল শুরু হতেই বিপরীত দিক থেকে শোনা যাচ্ছে, তাহলে পুরুষ কি আটকায় না? আমাদের জনসমাজ ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এখন উচ্চারিত হচ্ছে এ প্রসঙ্গও, আদতে কোথায় আটকায় পুরুষ?
কথাসাহিত্যিক নরেন্দ্রনাথ মিত্রের কালজয়ী ছোটগল্প ‘রস’। ২৫-২৬ বছরের জোয়ান পুরুষ মোতালেফ যখন ত্রিশের কোঠা ছুঁই ছুঁই মাজু বানুকে বিয়ে করে ঘরে তোলে, তখন চোখ কপালে ওঠে পাড়ার মেয়ে-বউদের। গল্পকার লিখছেন, ‘দজ্জাল মেয়ে মানুষের আঁটসাঁট শক্ত গড়নটুকু ছাড়া আর কী আছে মাছু খাতুনের যা দেখে ভোলে পুরুষেরা, মন তাদের মুগ্ধ হয়।’
ধীরে ধীরে গল্পের ভাঁজ খোলেন নরেন্দ্রনাথ। পরিচয় করিয়ে দেন ১৮-১৯ বছরের ফুলবানু চরিত্রটির সঙ্গে। ফুলবানুর বিবরণ দিতে গিয়ে এরপর তিনি লেখেন, ‘রসে টলটল করছে সর্বাঙ্গ, টগবগ করছে মন।’ সেই যুবতীকে বিয়ে করার টাকা জোগাড় করতে হবে। তাই গুরু রাজেক মৃধা, যার হাতে মোতালেফের গাছ থেকে রস নামানোর হাতেখড়ি, তারই বিধবাকে ভজিয়ে ঘরে আনে মোতালেফ। মাজু খাতুনের গুড় বানানোর গুণকে কাজে লাগিয়ে এক মৌসুমেই কামিয়ে নেয় প্রত্যাশিত টাকা। পরে মাজুকে তালাক দিয়ে ফুলবানুকে নিয়ে আসে ঘরে।
সবকিছু ভালোই চলছিল। কিন্তু বিপত্তি বাধে পরের শীতে। ফুলবানুর রস জাল দেওয়ার এলেম নেই, ধৈর্যও নেই। তাই মোতালেফের গুড় খেয়ে পুরোনো খদ্দেররা মুখ ফিরিয়ে নেন। তখন সম্মান খুইয়ে মাজুর কথাই বারবার মনে পড়ে মোতালেফের। এ গল্প নিয়ে ১৯৭৩ সালে ‘সওদাগর’ নামে হিন্দিতে একটি চলচ্চিত্র নির্মিত হয়, যেটাতে অভিনয় করেছিলেন অমিতাভ বচ্চন, নূতন ও পদ্মা খান্না। তাহলে গল্প আর সিনেমার প্রসঙ্গ সরিয়ে এবার আসা যাক মূল প্রসঙ্গে। করা যাক সেই প্রশ্ন, পুরুষ কিসে আটকায়? পুরুষ আদতে কোথায় আটকায়?
গল্প-উপন্যাসে সাহিত্যিকেরা নারীকে যেমন নানাভাবে এঁকেছেন, তেমনি এঁকেছেন পুরুষকেও। তাঁদের কেউ কখনো কখনো লেখায় পুরুষতন্ত্রের স্বরূপও উন্মোচন করেছেন। জনসমাজ ও জনসংস্কৃতির বাস্তবতা ঘেঁটে গল্প-উপন্যাসে তাঁরা দেখিয়েছেন কোথায়, কখন, কী পরিস্থিতিতে এবং কেন আঁতে ঘা লাগে পুরুষের। বস্তুত বিশ্বের সিংহভাগ রাষ্ট্র ও সমাজকাঠামো এখনো পুরুষতান্ত্রিক, অর্থাৎ কর্তৃত্বের সবটুকু জায়গা পুরুষের জন্য বরাদ্দ। আর কর্তা হয়ে উঠতে পুরুষের শিক্ষা শুরু হয় জন্ম থেকেই। আমাদের এ অঞ্চলে এখনো বেশির ভাগ পরিবারে অনাগত উত্তরাধিকারের কাঙ্ক্ষিত লিঙ্গ পুং। কারণ, পরিবারের হাল ধরবে সে, লাঠি হবে পরিবারের—আমাদের সাধারণ ধারণা এমনই। তো এ প্রত্যাশার ভার নিয়ে বড় হতে হতে একজন ছেলে শেখে পুরুষত্ব মানে যোগ্যতা নয়, লিঙ্গের বিচারে আধিপত্য। সে শেখে ঘরে ও বাইরে সে কর্তা। যেকোনো যুদ্ধে সেই অগ্রগামী সৈনিক। সে উপার্জনকারী, রক্ষাকারী ও পালনকারী। জনজাতির সামষ্টিক অবচেতনে প্রোথিত এই প্রজন্মান্তরের ধারণা থেকে সে নারীর সঙ্গী নয়, বরং কর্তা হয়ে ওঠে। তাই পুরুষকে ঘরে বেঁধে রাখাটা সামাজিক দায়িত্বও নারীর ওপরই বর্তায়। সম্ভবত এ কারণেই ঘর, কাজ সামাল দিতে পটু মাজু খাতুনের জন্যই শেষ পর্যন্ত মন পোড়ে মোতালেফের।
যুগ যুগ ধরে যে কর্তৃত্বপরায়ণতার ভার তাঁর ওপরে রয়েছে, তা কি এত সহজে পিছু ছাড়ে? না, তা এত সহজে পিছু ছাড়ার নয়। কাজেই কেউ স্বীকার করুক আর না-ই করুক, অনেক ক্ষেত্রেই পুরুষের এখন এই দ্বৈরথের মুখোমুখি হতে হচ্ছে। বিশেষ করে অনুভূতি প্রকাশের ক্ষেত্রে। পুরুষের জন্য সংবেদনশীল হওয়া এবং অনুভূতির প্রত্যক্ষ প্রকাশের বিষয়টি একেবারেই অনুমোদিত নয়। বরং এটাকে তাঁর দুর্বলতা হিসেবে দেখার যে ঐতিহাসিক চল আমাদের সমাজে রয়েছে, তা তাঁদের মনোজগৎকে বোধ করি আরও জটিল করে তোলে
তাঁর মানে এই নয় যে এই সামাজিক ভূমিকার বাইরে পুরুষ বের হতেই পারছে না। অনেকেই পুরুষতান্ত্রিকতার পদ্ধতিগত শিক্ষার বাইরে নজর দিচ্ছেন, দিতে পারছেন এখন। রান্না, ঘরকন্নার কাজ, সন্তান প্রতিপালনের মতো ‘নারীসুলভ’ দায়িত্বগুলো অনেকেই নিষ্ঠার সঙ্গে এবং আনন্দ নিয়ে পালন করছেন। প্রেমিকা/স্ত্রীকে সমপর্যায়ের সঙ্গীর মতো দেখছেন। কিন্তু যুগ যুগ ধরে যে কর্তৃত্বপরায়ণতার ভার তাঁর ওপরে রয়েছে, তা কি এত সহজে পিছু ছাড়ে? না, তা এত সহজে পিছু ছাড়ার নয়। কাজেই কেউ স্বীকার করুক আর না-ই করুক, অনেক ক্ষেত্রেই পুরুষের এখন এই দ্বৈরথের মুখোমুখি হতে হচ্ছে। বিশেষ করে অনুভূতি প্রকাশের ক্ষেত্রে। পুরুষের জন্য সংবেদনশীল হওয়া এবং অনুভূতির প্রত্যক্ষ প্রকাশের বিষয়টি একেবারেই অনুমোদিত নয়। বরং এটাকে তাঁর দুর্বলতা হিসেবে দেখার যে ঐতিহাসিক চল আমাদের সমাজে রয়েছে, তা তাঁদের মনোজগৎকে বোধ করি আরও জটিল করে তোলে। আর সেই সঙ্গে পুরুষের কর্তৃত্বের জায়গাটা ধরে রাখার পথও একাকী এবং দ্বিধায় ভরা। কাজেই বিশ্বাসের জায়গাও একসময় ভঙ্গুর হয়ে ওঠে।
হয়তো এ কারণেই পুরুষের এই সামাজিক ও রাজনৈতিক অবস্থান তাঁকে নারী সঙ্গী নির্বাচনের ক্ষেত্রে ব্যক্তিগত আকাঙ্ক্ষার চেয়ে সামাজিক মর্যাদা ও পারিবারিক কর্তব্যের দিকে বেশি নজর দিতে বাধ্য করে। বলা বাহুল্য, পুরুষের আকাঙ্ক্ষাকে রূপ দিতে বড় ভূমিকা রাখে এই নিয়ামকগুলো। আবার বস্তুবাদিতাও পুংকেন্দ্রিক। ফলে পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় ভোক্তা হিসেবে পুরুষের কর্তৃত্বের প্রকাশ সর্বত্র। তাই নারী যৌন আবেদনময়ী; দ্রুতগতির গাড়ি বা সহিংসতা মানেই পুরুষত্ব—এ মতবাদের প্রতিষ্ঠা ঘটে। তবে এর বাইরেও যে পুরুষ আটকাতে পারে, সে বিষয়ে সন্দেহ নেই; সেই পরিধি দিন দিন ক্রমশও বিস্তৃত হচ্ছে।
অহংকে অতিক্রম করার পথ নারী-পুরুষ–নির্বিশেষে সবার জন্যই কঠিন। তবে পুরুষকে সেই পথ পাড়ি দিতে হয় দুবার। প্রথমে তাঁকে সমাজের গড়ে দেওয়া যে ‘পুরুষ’মূর্তি, সেটা আগে দেখতে হয়। দ্বিতীয় ধাপে সমাজের গড়া ‘পুরুষ’-এর সব চিহ্ন মুছে অনুসন্ধান করতে হয় নিজের প্রকৃত স্বরূপ। আদতে প্রত্যেক মানুষের ক্ষেত্রেই প্রথমত নিজের অহংকে চেনা লাগে। তাই পুরুষ আদৌ কিসে আটকায়, তা বোঝার জন্য তাঁর সময়ও একটু বেশি প্রয়োজন হয় বৈকি।