বাবা ছিলেন প্রকৌশলী। তাঁর চাকরিসূত্রেই ছেলেবেলায় আমরা থাকতাম পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমানে। তারপর বাবা বদলি হয়ে আসানসোল এলেন। আমরাও কয়েক বছর ছিলাম, যদিও আমার দেশের বাড়ি (দাদাবাড়ি, নানাবাড়ি দুটিই) নোয়াখালীর (বর্তমান লক্ষ্মীপুর) রামগঞ্জে। এরপর ১৯৪৭ সালে দেশভাগের পর চলে এলাম যশোরে।
আসানসোল বা বর্ধমানের ঈদের কথা বিশেষ মনে নেই। ১৯৫৩ সালে আবার পরিবারসহ ঢাকা চলে এলাম। ঈদ উপলক্ষে মা আমাদের চার ভাই-বোনের সবাইকে কাপড় সেলাই করে দিতেন। তখন তো পাকিস্তানি শাসন, ফ্রক পরা যেত না। ছোট মেয়েদেরও পায়জামা পরতে হতো। একবার মনে আছে, যশোরে থাকতে আমার মা শারারা ড্রেস বানিয়ে দিল। বুকের নিচ থেকে কুঁচি, আবার পায়জামায় কুঁচি। তার ওপর নকশি সেলাইয়ে ফুল, লতাপাতা...কুঁচির শেষ মাথায়, ওড়নায় আবার লেস বসানো। সে এক হুলুস্থুল কাণ্ড! জামা দেখে মনটাই ভরে গেল। সেই জামা আলমারিতে উঠিয়ে রেখে রাতে আনন্দে ঘুম হয় না। বারবার উঠে খুলে দেখি, নকশার ওপর হাত বোলাই, ঘ্রাণ নিই। আবার রেখে দিই। ওটাই আমার ঈদের সেরা জামা। এখন যখন অনেকে শারারা–গারারার কথা বলে, আমি বুক ফুলিয়ে বলি যে আমি তো সেই ছোটবেলাতেই সেসব পরেটরে পুরোনো করে ফেলেছি! ঈদে বড়রা দিত সিকি, আধুলি। সেসব একটা থলেতে পুরে রাখতাম। গুনতাম। এটা–সেটা কিনতাম।
১৯৬৩ সালে আমার বিয়ে হলো। স্বামী ফখরুজ্জামান চৌধুরী ছিলেন অনুবাদক, গল্পকার। তাঁর প্রায় ৫০টি বই আছে। বাংলা সাহিত্যে অবদানের জন্য বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার (২০০৫ সালে) পেয়েছিলেন। বিয়ের প্রথম কয়েক বছর ঢাকাতেই ছিলাম। তখন সেমাই, পায়েস, পোলাও রান্না করতাম ঈদের দিন। মাঝেমধ্যে রেডিওতে রেসিপি শুনে রান্নার চেষ্টা করতাম। ছোট ভাইয়েরা ঈদে বাসায় আসত। নতুন পাঞ্জাবি পরে। মাঝেমধ্যে বিকেলে তাদের সঙ্গে মায়ের বাড়ি চলে যেতাম। কোরবানির ঈদ কাটত চাঁদপুরে, শ্বশুরবাড়িতে। নারায়ণগঞ্জ থেকে স্টিমারে উঠতাম। স্টিমারে উঠে কাঁচকলা দিয়ে ইলিশ মাছ খেতাম। সে কি ঘ্রাণ! ইলিশের ঘ্রাণে ম-ম করত স্টিমার। শ্বশুরবাড়িতে ঈদে দেবর, ননদেরা আসত। আমার ছোট দেবর আহমদ জামান চৌধুরী ছিলেন সাংবাদিক ও গীতিকার।
মুক্তিযুদ্ধের সময় স্বামীর চাকরিসূত্রে ময়মনসিংহে ছিলাম। ওখানে আমাকে সারা দিন গোলার পেছনে লুকিয়ে রাখত। লম্বা হয়ে শুয়ে থাকতাম। ওখানেই খাওয়াদাওয়া। মাঝেমধ্যে বের হয়ে কলপাড় থেকে দুই মগ পানি দিয়ে গোসল করেই আবার খড়ের গাদায় শুয়ে পড়তাম। সন্ধ্যা নামলে আস্তে করে ঘরে ঢুকতাম। মুক্তিযুদ্ধের সময় আবার ঈদ কিসের? খড়ের গাদায় লুকিয়ে আতঙ্ক নিয়েই কেটেছে।
১৯৭৩ সালে চলে যাই চট্টগ্রামে। নৌকায় পার হয়ে আবার ট্রেনে করে যাওয়া...সেখানেই আমার ছোট মেয়ে জন্ম নেয়। তখন দেশে এত দুঃখ, কষ্ট...এর ভেতর আলাদা করে ঈদ সেভাবে টের পাইনি। মোটামুটি সত্তরের দশকজুড়ে দেশও যেমন ভাঙা-গড়ার ভেতর দিয়ে যাচ্ছিল, আমরাও একটু একটু করে পারিবারিকভাবে গুছিয়ে নিচ্ছিলাম। চট্টগ্রামের চকবাজার, লালখান বাজার, সার্কিট হাউসের রেডক্রস বিল্ডিংয়ের পাশে—এই তিন জায়গায় থেকেছি। সেখানেই আমি সাংস্কৃতিকভাবে বিকশিত হতে শুরু করি। লেখালিখি, থিয়েটার করতাম। চট্টগ্রাম পাবলিক স্কুলে চাকরি শুরু করি। ১৯৮০ সালে আবার ঢাকায় চলে আসি। মায়ের মতো আমারও একটা সেলাই মেশিন ছিল। কাপড় কিনে সেলাই মেশিনেই মেয়েদের কাপড় বানিয়ে দিতাম। পরে অর্থনৈতিক অবস্থা আরেকটু ভালো হলে ঈদে মেয়েদের জামাকাপড় কেনা শুরু করলাম।
আমার বড় মেয়ে দন্তচিকিৎসক। ডা. তানিয়া জামান। ওর ছেলে, মানে আমার নাতি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে। কীভাবে সময় চলে যায়, ভাবা যায়! বড় মেয়ে এখন কানাডার টরন্টো বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ায়।
ছোট মেয়ে জুবাইরা জামান। ও যুক্তরাষ্ট্রে একটা গিফট কোম্পানিতে চাকরি করে। কয়েক বছর আগে একবার যুক্তরাষ্ট্রে ঈদ করলাম। ওখানে বড় মেয়ে এসেছিল। গত বছর বড় মেয়ে আমার সঙ্গেই ঢাকায় ঈদ করল। ওরা বছরে একবার দেশে আসে। মাসখানেক থাকে। আমি কেন যেন দেশের বাইরে গিয়ে থাকতে পারি না। সব ভালো, সব ঠিক আছে, কিন্তু পারি না। ভালো লাগে না। দুজনেই দুই মহাদেশে টানে। কিন্তু বিদেশ আমাকে টানে না। ২০১৪ সালে স্বামীর মৃত্যুর পর থেকে তাই দেশে একাই ঈদ করি।
ঈদে এবার তেমন কাজ করা হয়নি। এখন তো নাটক থেকে আমার বয়সী চরিত্র উঠেই গেছে। মা, নানি, দাদি নাটকের পরিবার থেকে নাই হয়ে গেছে। এটা একটা সামগ্রিক ভাঙন। প্রেমিক, প্রেমিকা আর তৃতীয়জনে নাটক শেষ হয়ে যায়। একটা সিনেমা করেছি। হিমেল আশরাফের পরিচালনায় রাজকুমার। এখানে আমি শাকিব খানের দাদি।
যত দূর মনে পড়ে, আমি কখনোই ঈদে নিজের জন্য কেনাকাটা করিনি। বিনোদন অঙ্গনের কিছু শিল্পী, মেকআপ আর্টিস্ট আছেন, তাঁদের জন্য কিনি। কারও কারও বাচ্চার লেখাপড়ার খরচ দিই। কিছু বৃদ্ধাশ্রম আছে, ঈদের দিন সেখানে ভালো খাবারের ব্যবস্থা করি। আমাকে যাঁরা দেখে রাখেন, তাঁদের জন্য কেনাকাটা করি। এই তো। এইগুলো আসলে আমি বলতে চাই না। এখন তো অনেকে সকালে একটা পোশাক পরে, দুপুর-বিকেল-রাতের জন্য আবার আলাদা আলাদা জামাকাপড়। আমরা একটাতেই সুখী ছিলাম।
এখন সময় বদলে গেছে। চাহিদাও বদলে গেছে। ঈদ উপলক্ষে সাধারণত বিশেষ কিচ্ছু রান্না করি না। প্রতিদিন যা রান্না করি, তাই-ই। মাঝেমধ্যে মেহমান এলে তাঁদের জন্য করি। অনেকে ফোনটোন দেয়। আমার মতোই একজন একা মা আছে, রীনা রহমান। এবার ওকে বলেছি, আমার সঙ্গে ঈদ করতে। আমরা দুই বুড়ি একসঙ্গে ঈদ কাটাব।
অনুলিখন: জিনাত শারমিন