এন্ড্রু কিশোরকে বলা হতো ‘প্লেব্যাক সম্রাট’। বেশ কয়েক দশক ধরে বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের অসংখ্য জনপ্রিয় গানের গায়ক ছিলেন তিনি। তাঁর এ জনপ্রিয়তার পেছনের কারণগুলো কী ছিল, আজ এই সংগীতশিল্পীর প্রয়াণদিবসে প্রশ্নটির সুলুক সন্ধান।
এন্ড্রু কিশোর কুমার বাড়ৈ, রাজশাহীর বুলনপুর মিশন কম্পাউন্ড, মহিষবাথান হাসপাতাল কোয়ার্টার এবং সবশেষে কাজীরহাটা কোয়ার্টারে শৈশব-কৈশোর কাটিয়ে পরবর্তীকালে যৌবনে সংগীতজগতে প্লেব্যাক সম্রাট হয়ে ওঠা এই শিল্পীর সমধিক পরিচিতি এন্ড্রু কিশোর নামে। আদ্যোপান্ত পেশাদার সংগীতশিল্পী হিসেবে বাংলাদেশের সংগীতের ইতিহাসে তাঁর অসামান্য কীর্তি আজ উদ্যাপন এবং নিবিড় পাঠ দাবি করে।
এন্ড্রু কিশোর খ্যাতিমান মূলত চলচ্চিত্রের গানের জন্য। তাঁর অসামান্য জনপ্রিয়তা স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশের নাগরিক সংস্কৃতির বিবর্তন পাঠের একটি গুরুত্বপূর্ণ পাঠসূত্র বৈকি। দুঃখজনক হলো, এ সময়ের বিস্তৃত ইতিহাস এবং সমাজতাত্ত্বিক পাঠের ধারাবাহিক ও একাডেমিক প্রয়াস প্রায় হয়নি বলা চলে। যে কারণে প্রচলিত ধারণা মোতাবেক এন্ড্রু কিশোর যে প্রায় ১৫ হাজার গানে কণ্ঠ দিয়েছেন—এই তথ্যের সূত্র ধরে বেশি দূর এগোনো যায় না।
অগত্যা ভরসা তাঁর জনপ্রিয়তম গানগুলোর শ্রুতিপাঠ আর সংবাদ প্রতিবেদন। ‘বাংলাদেশের সিনেমার স্মরণীয় গান’ (গবেষণা, সংকলন ও সম্পাদনা: আসলাম আহসান, প্রথমা প্রকাশন) অবশ্য এই খামতির সমাধানে একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ। এন্ড্রু কিশোরকে পাঠ করতে গিয়ে তাঁর সমসাময়িক জগৎটাকেও পাঠ করা জরুরি। তাঁর সময়ের দিকে চোখ ফেরালেই দেখা যাবে, বাংলাদেশের সংগীতের একটা নতুন দিগন্ত নির্মাণপর্বের সারথিরা কী নিবিষ্টমনে বুনে চলেছেন নাগরিক গানের ভুবন।
এন্ড্রু কিশোর এবং তাঁর সমকালীন যুগের গান অসামান্য জনপ্রিয়তা পাওয়ার পেছনে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিক সম্ভবত এসব গানের ভেতর সময়ের সুর আর গল্পের সুনন্দ সহাবস্থান। অনেক জনপ্রিয় গান হয়তো এখন বিস্মৃত। কিন্তু সেই সময়ে সবার মুখে মুখে ফিরত। সজীব শিল্পের এই তো প্রক্রিয়া। সব গান ক্ল্যাসিক হয়ে উঠবে না, কিন্তু গুটিকয় ক্ল্যাসিক গানের জন্য বিচিত্র রকমের গানের বাজার ও চর্চার পরিসর তো জরুরি।
বহুল প্রচলিত এবং স্বীকৃত ‘আধুনিক গান’ তকমার পরিবর্তে সচেতনভাবেই ‘নাগরিক গান’ শব্দবন্ধ ব্যবহার করলাম সেই সময়ের প্রাসঙ্গিকতা বিবেচনায়। নাগরিক পরিসরের গান ‘আধুনিক’ হলে চিরায়ত বাংলা গান কি অনাধুনিক? এ প্রতর্ক নির্মাণে আদতে সচেতন কোনো সুসংহত পাঠ বিকশিত হয়নি। এ তর্ক আপাতত তোলা রইল। ফিরে আসি এন্ড্রু কিশোর প্রসঙ্গে। কিশোর নামোচ্চারণমাত্রই কিংবদন্তি কিশোর কুমারের নাম স্মরণে আসা অসংগত নয় মোটেও, এমনকি এন্ড্রু কিশোরের নামকরণের সময় তাঁর মায়ের কিশোর কুমারপ্রীতির চিহ্ন জুড়ে আছে।
কিংবদন্তির নামের ছায়া পেরিয়ে নিজেই প্লেব্যাক শিল্পী হিসেবে আইকন হয়ে ওঠা এন্ড্রু কিশোরের সংগীতজীবনের ভিত তৈরি হয়েছে শৈশবে রাজশাহীতে ‘সুরবাণী’ সংগীত বিদ্যায়তনে। সেখানে ওস্তাদ আব্দুল আজিজ বাচ্চুর কাছে হাতেখড়ি এবং সংগীতের পাঠ নিয়েছেন এন্ড্রু কিশোর; এবং রাজশাহী থেকে আসা তাঁর সমসাময়িক শিল্পীদের প্রায় সবাই-ই। এক সাক্ষাৎকারে এন্ড্রু কিশোর নিজেই জানাচ্ছেন, ‘আমার ওস্তাদের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা সে অর্থে তেমন ছিল না। তবে তিনি কণ্ঠ নিয়ে চমৎকার স্টাডি করতেন।
যে কারণে কার কণ্ঠে কোন ধরনের গান মানাবে ভালো, তা তিনি বেশ ভালো বুঝতেন। যা এ সময়ে এসেও অনেকে পারেন না। রাজশাহী শহরে যত ভালো ভালো শিল্পী আছেন, সবাই-ই ওস্তাদজির ছাত্র।’ সুরবাণীতে সাংগীতিক পাঠ, প্রতিভার অনন্য স্ফুরণ আর বাংলা গানের একটা উজ্জ্বল পর্বের সারথিদের পেয়েছেন সহযাত্রী হিসেবে। একটু নিবিড়ভাবে দেখলেই দেখা যাবে সত্তরের দশক হতে নব্বইয়ের দশক পর্যন্ত বাংলা গানের একটা স্বকীয় ভিত্তি নির্মাণে একঝাঁক কীর্তিমান গীতিকার, সুরকার, সংগীতায়োজক ও শিল্পীদের সমাবেশ ঘটেছে। এরই সমান্তরালে বিকশিত হয়েছে চলচ্চিত্রাঙ্গন, যা একই সঙ্গে বাংলা গানের প্রসার, জনপ্রিয়তা, রুচির নির্মাণে মূল অনুঘটক হিসেবে কাজ করেছে।
মাহমুদুন্নবী, খুরশিদ আলম, বশীর আহমদ, সৈয়দ আব্দুল হাদী, সুবীর নন্দী প্রমুখের কাতারে জায়গা করে নিলেন এন্ড্রু কিশোর, সেটা তাঁর প্রতিভার গুণেই। ১৯৮২ সালে ‘বড় ভালো লোক ছিল’ ছবিতে ‘হায়রে মানুষ রঙিন ফানুস দম ফুরাইলেই ঠুস’ গানটির জন্য পেলেন জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পান। এরপর আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি।
জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পেয়েছেন মোট আটবার। কিন্তু শ্রোতাদের অসামান্য ভালোবাসা তাঁকে দিয়েছিল ঢের বেশি কিছু। ‘হায়রে মানুষ রঙিন ফানুস দম ফুরাইলেই ঠুস’ গানটির গীতকার কবি সৈয়দ শামসুল হক। তাঁর বেশ কিছু গান এরপর তুমুল জনপ্রিয়তা পেয়েছে। তবে গীতিকার হিসেবে সচরাচর তাঁর নাম উচ্চারিত হয় না। এ বড় অদ্ভুত ব্যাপার। গীতিকার আর গীতিকবি পরিচয়ের অহেতুক দ্বন্দ্বে বাংলা গানের অসামান্য গীতিকার অনেকেই আজ বিস্মৃত, গান বেঁচে আছে শুধু শিল্পীর নামে। অথচ এন্ড্রু কিশোরের অক্ষয় কীর্তির সঙ্গে এসব গানের গীতিকার, সুরকার, সংগীতায়োজক ও চলচ্চিত্র নির্মাতাদের ভূমিকা অনস্বীকার্য।
এন্ড্রু কিশোর উদ্যাপন তাই সৈয়দ শামসুল হক, গাজী মাজহারুল আনোয়ার, রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহ, আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুল, মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান, মনিরুজ্জামান মনির, আলাউদ্দিন আলী, শেখ সাদী খান, মোহাম্মদ রফিকুজ্জামান প্রমুখ কীর্তিমানেরও উদ্যাপন, অর্থাৎ এন্ড্রু কিশোরকে ছুঁয়ে অনায়াসে বাংলাদেশের গানের নতুন দিগন্ত নির্মাণপর্বের কুশীলবদের অনেকজনকেই পাঠের সূত্রে খুঁজে নেওয়া যায়।
এটি জরুরিও বটে। বাংলা চলচ্চিত্রের এই সংগীতময়তা স্রেফ যুগের উপহার নয়। উল্লিখিত কয়েকজন গীতিকার, সুরকার, শিল্পীর সঙ্গে চলচ্চিত্র নির্মাতা, কবি-সাহিত্যিকদের একটা নান্দনিক এবং বৌদ্ধিক সম্পর্কের যোগসূত্র বাংলা গান এবং চলচ্চিত্রে যে ফসলি বাতাস এনে দিয়েছিল, তা আজ বিচ্ছিন্ন দ্বীপে ঘুরপাক খাচ্ছে অনেকটাই।
পেশাদার শিল্পী হিসেবে, ফুলটাইম প্লেব্যাক আর্টিস্ট হিসেবে, সর্বোচ্চ পারিশ্রমিক পাওয়া শিল্পী হিসেবে এন্ড্রু কিশোরের যে সাফল্য এবং পরিচিতি, তা পরবর্তী যুগের শিল্পীরা নিজেদের গল্প করে তুলতে পারেননি কেন, তা ভেবে দেখা দরকার বৈকি। এন্ড্রু কিশোর এবং তাঁর সমকালীন যুগের গান অসামান্য জনপ্রিয়তা পাওয়ার পেছনে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিক সম্ভবত এসব গানের ভেতর সময়ের সুর আর গল্পের সুনন্দ সহাবস্থান। অনেক জনপ্রিয় গান হয়তো এখন বিস্মৃত। কিন্তু সেই সময়ে সবার মুখে মুখে ফিরত।
সজীব শিল্পের এই তো প্রক্রিয়া। সব গান ক্ল্যাসিক হয়ে উঠবে না, কিন্তু গুটিকয় ক্ল্যাসিক গানের জন্য বিচিত্রর কমের গানের বাজার ও চর্চার পরিসর তো জরুরি। এ সময়ের গানে পাশ্চাত্য সংগীতের নতুন সুর যেমন এসেছে, এরই সঙ্গে এই জনপদের বিচিত্র লোকজ গানের সম্ভার ঐকতানে বেজেছে।
নাগরিক পাটাতনের নির্মিত এসব গান ভাষার দিক থেকেও রবীন্দ্রযুগের ভাষার ওজস্বিতা অনেকটাই পেরিয়ে মননশীলতা, সহজিয়া ভাব, অকপট আলাপ আর স্বীয় ব্যক্তিগত, অনুচ্চারিত গল্পগুলোকে সুরের আলোয় মুক্তি দিয়েছে। এসব গানেই আবার কাব্যিক উৎকর্ষ, মরমি ভাব, রোমান্টিক আখ্যান, ঐতিহ্যিক বয়ান নবতর ছন্দে ও তুলনামূলক সহজ, সরল ভাষায় প্রকাশিত হয়েছে।
আর তাতেই সময়, সমাজ, শ্রেণির সীমা পেরিয়েছে—‘জীবনের গল্প আছে বাকি অল্প’, ‘হায়রে মানুষ রঙিন ফানুস, দম ফুরাইলে ঠুস’, ‘ডাক দিয়াছেন দয়াল আমারে’, ‘ভালো আছি ভালো থেকো’, ‘তুমি মোর জীবনের ভাবনা’, ‘আমার বুকের মধ্যখানে’, ‘বাবার মুখে প্রথম যেদিন শুনেছিলাম গান’, ‘আমার সারা দেহ খেয়ো গো মাটি’, ‘চাঁদের সাথে আমি দেবো না তোমার তুলনা’, ‘আমি চিরকাল প্রেমের কাঙাল’, ‘সবাই তো ভালোবাসা চায়’, ‘কী জাদু করিলা’, ‘পড়ে না চোখের পলক’, ‘ভেঙেছে পিঞ্জর মেলেছে ডানা’, ‘জীবন ফুরিয়ে যাবে ভালোবাসা ফুরাবে না জীবনে’ প্রভৃতি শিরোনামের গান।
এমন বিস্তৃত ভাবের তরঙ্গ পাঠ করে বাংলা গানের বাঁকবদলের চিহ্নগুলোর নতুন পাঠ হাজির করা যায়। আপাতত শুরুর গল্পেই ফিরি। রাজশাহীর সুরবাণী সংগীত বিদ্যালয় যে ভিত গড়ে দিয়েছিল এন্ড্রু কিশোর নামের এই অসামান্য শিল্পীর, আগামীর কিশোরদের হাতেখড়ির আয়োজন কি আজ আছে দূরের গ্রামে কিংবা উন্নয়নভুক প্রতিটি শহরে?
প্লেব্যাক সম্রাট এন্ড্রু কিশোরে প্রয়াণদিবসে তাঁর গান তথা বাংলাদেশের গানের ঐশ্বর্য, সম্ভাবনা ও সংকটের স্বরূপ পাঠের প্রস্তাব হোক আমাদের স্মরণার্ঘ্য।
দূরে কোথাও অলক্ষ্যে বাজুক:
‘আজ বড় সুখে দুটি চোখে জল এসে যায়
শতজনমের সাধনা আমার মরণেও যেন না হারায়।’