চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক ও ভাষাবিদ মাহবুবুল হক মারা গেছেন গতকাল ২৪ জুলাই দিবাগত রাত পৌনে দুইটায়। তাঁর কর্ম ও সঙ্গ নিয়ে স্মৃতিচারণা করেছেন তারিক মনজুর।
পিএইচডির ভাইভা দিচ্ছি। পরীক্ষা কমিটির আহ্বায়ক অধ্যাপক মাহবুবুল হক। আমাকে তিনি একটা একটা করে প্রশ্ন জিজ্ঞেস করছেন। তাঁকে খানিক মনঃক্ষুণ্ন মনে হচ্ছে। আমি যথাসম্ভব গুছিয়ে উত্তর দেওয়ার চেষ্টা করছি। বোঝার চেষ্টা করছি, আমার গবেষণায় কোনো ফাঁক রয়ে গেল কি না। থিসিসের কতটুকু বাড়তি আর কতটুকু ঘাটতি, মাঝেমধ্যে সে কথাও তিনি বলছিলেন। খুব ঠান্ডা মেজাজের মানুষ মাহবুবুল হক। প্রায় নিরুত্তাপভাবেই ভাইভা শেষ হচ্ছিল। হঠাৎ উষ্মা প্রকাশ করে তিনি বললেন, ‘বাংলা বানান নিয়ে আমিই প্রথম বই লিখেছি বাংলাদেশে। আমার কাজ আপনার গবেষণায় এল না কেন?’
আমি বিনীতভাবে বললাম, ‘বাংলা বানান নিয়ে নতুন প্রস্তাব যাঁরা করেছেন, তাঁদের অভিমত নিয়ে একটি অধ্যায় আমি করেছি। সেই অধ্যায়ে আপনার নাম নেই। কিন্তু আপনার কাজের কথা থিসিসের একাধিক জায়গায় উল্লেখ করা আছে।’
আমার উত্তরে মাহবুবুল হক খুব বেশি সন্তুষ্ট হননি। গবেষণায় তাঁকে হয়তো আরও বেশি ব্যবহার করতে পারতাম। আমার থিসিসে না থাক, মানতেই হবে যে বাংলা বানান নিয়ে তিনি রীতিমতো একটা আন্দোলনের সূচনা করেছিলেন। শুধু বই লেখা নয়, বাংলা বানানের নিয়ম নিয়ে বাংলাদেশ টেলিভিশনে তিনি প্রায় দুই দশক ধরে আলোচনা করেছেন। মাহবুবুল হক চাইতেন বাংলা বানানে শৃঙ্খলা আনতে। বিশেষ করে পাঠ্যবইয়ের বানান সমরূপ করতে।
১৯৯২ সালে বাংলা একাডেমি ‘প্রমিত বাংলা বানানের নিয়ম’ নামে ১৪ পৃষ্ঠার একটি পুস্তিকা প্রকাশ করে। এসব নিয়ম ১৯৮৮ সালে প্রণয়ন করা জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের নিয়মের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ। পাঠ্যপুস্তক বোর্ড তাদের সুপারিশ করা নিয়ম একত্র করে ‘পাঠ্যবইয়ের বানান’ (১৯৯২) নামে একটি শব্দ সংকলন গ্রন্থ বের করে। বইটির সম্পাদনা পরিষদে মাহবুবুল হক ছিলেন। পরে তিনি শিক্ষার্থীদের উপযোগী করে ‘পাঠ্যবইয়ে বাংলা বানানের নিয়ম’ (১৯৯২) নামে আরেকটি বই করেন। এই বই বিপুল পাঠকপ্রিয় হয়।
প্রথম আলোর ‘ভাষারীতি’ (২০০৯) বইয়ের সম্পাদনা পরিষদেও ছিলেন মাহবুবুল হক। জটিল বিষয়কে সরল ও পরিচ্ছন্নভাবে উপস্থাপন করতে পারতেন তিনি। এর প্রমাণ মিলবে এটিসহ তাঁর অন্যান্য ভাষাবিষয়ক কিংবা অভিধান ও কোষজাতীয় গ্রন্থে। ‘বিশ্ব তারিখ অভিধান’ (২০০০), ‘নজরুল তারিখ অভিধান’ (২০১১), ‘খটকা বানান অভিধান’ (২০১৭), ‘শেখ মুজিব তারিখ অভিধান’ (২০২৩) বইগুলোয় তাঁর পরিশ্রমের ছাপ স্পষ্ট। এ ধরনের অভিধানে বারবার বিভিন্ন সূত্র থেকে তথ্য মিলিয়ে নিতে হয়। সেই মেলানোর কাজ করতে গেলে নানা অসামঞ্জস্য পাওয়া যায়। সেগুলো সমন্বয়ের কাজও সহজ নয়।
বাংলা একাডেমি ২০১১ সালে দুই খণ্ডে ‘প্রমিত বাংলা ভাষার ব্যাকরণ’ প্রণয়ন করে। এ কাজে একাডেমির উদ্যোগে দুই বাংলার ভাষাপণ্ডিতদের এক করা হয়েছিল। এই ব্যাকরণ প্রকল্পে সহযোগী সম্পাদক হিসেবে কাজ করেছেন মাহবুবুল হক। বাংলা একাডেমির ব্যাকরণে তিনি বাংলা ভাষায় ব্যবহৃত মোট শব্দকে আটটি শ্রেণিতে ভাগ করে দেখিয়েছেন। অথচ এর আগপর্যন্ত বাংলা ব্যাকরণে পদকে সংস্কৃত ব্যাকরণের মতো করে পাঁচ ভাগে ভাগ করে আলোচনা করা হতো। বাংলা ভাষার প্রায়োগিক দিকটিকে তিনি বাংলা ভাষার মতো করেই ভাবতেন। তাই শব্দের গঠন অধ্যায়ে আলাদা করে সংস্কৃত উপসর্গ বা সংস্কৃত প্রত্যয়ের আলোচনা করেননি।
মাহবুবুল হকের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা বোধ করি পাঠ্যবই রচনার ক্ষেত্রে। তিনি পাঠের গল্প-কবিতাকে উপলক্ষ করে শিক্ষার্থীদের ভাষা শেখানোর কৌশল নিয়েছিলেন। শিক্ষাক্রম প্রণয়ন ও পাঠ্যপুস্তক রচনার কাজে অন্তত দুই দশক ধরে তিনি জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের সঙ্গে কাজ করেছেন। প্রথম আলোর ‘ভাষা প্রতিযোগ’ করতে গিয়ে দেখেছি, পাঠ্যবই লেখার সূত্রে সারা দেশের স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীদের কাছে তিনি কতখানি জনপ্রিয় ছিলেন। ২০০৫ সালে প্রথম আলোর উদ্যোগে ভাষা প্রতিযোগ শুরু হয়। শুরু থেকেই তিনি এই আয়োজনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন।
ব্যক্তিমানুষ হিসেবে মাহবুবুল হক ছিলেন আন্তরিক। দেখা হলে সবার সঙ্গে খুব আন্তরিকভাবে কথা বলতেন, হাত মেলাতেন। তিনি ছিলেন পরিশ্রমী। যত দিন সুস্থ ছিলেন, সহজে কোনো কাজে ‘না’ বলতেন না। তিনি ছিলেন দায়িত্বশীল ও গোছানো। গোটা গোটা হরফে সুন্দর করে লিখে রাখতেন কাজ ও চিন্তাগুলো। তাঁর সঙ্গ ছিল আনন্দদায়ক। যাত্রাপথে ঝোলা থেকে টুক টুক করে টুকটাক খাবার বের করতেই থাকতেন। তিনি দারুণ চিন্তাও করতে পারতেন। যেমন ছেলের বিয়ের সময় পরিচিতজনদের ছোট ছোট লেখা আর টুকরো ছড়া-কবিতা-মন্তব্য নিয়ে প্রকাশ করেছিলেন ‘আনন বই’। জিজ্ঞেস করেছিলাম, নামটা ‘আনন বই’ কেন? মাহবুবুল হক হেসে বলেছিলেন, ‘ফেসবুকের বাংলা করলাম!’
বাংলা একাডেমি ২০১১ সালে দুই খণ্ডে ‘প্রমিত বাংলা ভাষার ব্যাকরণ’ প্রণয়ন করে। এ কাজে একাডেমির উদ্যোগে দুই বাংলার ভাষাপণ্ডিতদের এক করা হয়েছিল। এই ব্যাকরণ প্রকল্পে সহযোগী সম্পাদক হিসেবে কাজ করেছেন মাহবুবুল হক। বাংলা একাডেমির ব্যাকরণে তিনি বাংলা ভাষায় ব্যবহৃত মোট শব্দকে আটটি শ্রেণিতে ভাগ করে দেখিয়েছেন। অথচ এর আগপর্যন্ত বাংলা ব্যাকরণে পদকে সংস্কৃত ব্যাকরণের মতো করে পাঁচ ভাগে ভাগ করে আলোচনা করা হতো।
ভাষা ও সাহিত্যে গবেষণার জন্য মাহবুবুল হক ২০১৯ সালে একুশে পদক পান। এর আগে ২০১৭ সালে প্রবন্ধে বাংলা একাডেমি পুরস্কার পান। এ ছাড়া জীবনে অনেক সম্মান ও সম্মাননা লাভ করেন। মৃত্যুর বছরখানেক আগে তাঁকে শ্রদ্ধা জানিয়ে একটি সম্মাননাগ্রন্থ তৈরির পরিকল্পনা করা হয়। সেখানে মাহবুবুল হকের কাজ ও আগ্রহের ক্ষেত্রকে বিবেচনায় নিয়ে বিভিন্নজনের লেখা প্রকাশিত হয়। ২০২৩ সালে প্রকাশিত এই গ্রন্থে দেখা যায়, কত বিচিত্র বিষয় নিয়ে তিনি ভেবেছেন, কাজ করেছেন।
মাহবুবুল হকের লেখা বইয়ের সংখ্যা অন্তত ৫০ হবে। তাঁর বই বাংলাদেশের বাইরে ভারত ও রাশিয়া থেকেও বের হয়েছে। লেখার বিষয় হিসেবে তিনি আধুনিক সাহিত্য, ফোকলোর, অনুবাদ এগুলোও বেছে নিয়েছেন। তবে সবচেয়ে স্বস্তি পেতেন ভাষাবিষয়ক লেখায়। নিজেকে একজন ভাষাবিজ্ঞানী হিসেবে পরিচয় দিতে গর্ব বোধ করতেন। তাঁর মৃত্যুর মধ্য দিয়ে দেশ বাংলা ভাষার এক আধুনিক ভাষাবিজ্ঞানীকে হারাল।