পুত্রবধূ টিয়া রহমানের সঙ্গে কবি শামসুর রাহমান
পুত্রবধূ টিয়া রহমানের সঙ্গে কবি শামসুর রাহমান

শামসুর রাহমানের মৃত্যুবার্ষিকী

আমরা বেঁচে রইলাম স্মৃতি নিয়ে

১৭ আগস্ট কবি শামসুর রাহমানের মৃত্যুদিন। তাঁকে নিয়ে লিখেছেন তাঁর পুত্রবধূ।

২০০৬ সালের ১৭ আগস্ট, আজ থেকে ১৭ বছর আগে আমার আব্বু কবি শামসুর রাহমান দুনিয়ার মায়া ত্যাগ করে চলে গেছেন। আব্বু আজ আমাদের কাছে নেই। কিন্তু আমাদের সঙ্গে না থাকলেও তিনি আমাদের মধ্যে বেঁচে আছেন। আমাদের বাড়ির প্রতিটি ঘরেই তাঁর স্মৃতি—এই তাঁর লেখার টেবিল, এই তাঁর বই। কোনো কোনো উদাস দুপুরে অচেনা কোনো নম্বর থেকে ফোন এলে মনে হয়, আব্বুর কথা জানতে ফোন করেনি তো কেউ! আব্বুর স্মৃতিগুলো এভাবেই দৈনন্দিন জীবনের ব্যস্ততার মধ্যে কোনো না কোনো মুহূর্তে প্রতিনিয়ত আমাদের নাড়া দিয়ে যায়। শ্যামলীর এ বাড়িতে কত না স্মৃতি রয়েছে আব্বুর। তন্দ্রাচ্ছন্ন ঘুমে এখনো মাঝেমধ্যে তাঁর পায়ের আওয়াজ শুনতে পাই, শুনতে পাই তাঁর মিষ্টি হাসির শব্দ। মনে হয়, এই তো বুঝি সেই আগের মতোই পায়চারি করছেন আব্বু। আমার চোখে ভেসে বেড়ায় তাঁর স্মৃতিগুলো।

আব্বুকে আমি প্রায় ১৫ বছর আমার পাশে পেয়েছি। তাঁকে নিয়ে আমি কী লিখব! তিনি বড় কবি ছিলেন, এটা সবাই জানে। আর আমি জানি ঘরোয়া এক শামসুর রাহমানকে, যিনি তাঁর নাতনি নয়না ও দীপিতাকে প্রাণের চেয়ে বেশি ভালোবাসতেন। একজন অতুলনীয়, অসাধারণ এক ভালো মানুষ ছিলেন আমার আব্বু।

এ বাড়ির প্রতিটি জায়গায় তাঁর ছবি রয়েছে। কোনো না কোনো ছবিতে কিছু না কিছু তিনি করতেন। যেমন কোনো ছবিতে দেখা যাচ্ছে, তিনি লেখালেখিতে ব্যস্ত, কোনোটিতে পড়ছেন, আবার কোনো একটা ছবিতে বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দিচ্ছেন চুটিয়ে। প্রকৃতির মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছেন, এমন ছবিও অনেক আছে আব্বুর। প্রতিটি ছবিই আমাদের কাছে আজও জীবন্ত মনে হয়। মনে হয়, ছবির মানুষটি এখনো আমাদের চারপাশে তাঁর স্মৃতিগুলোর মধ্য দিয়ে নিজের উপস্থিতি জানান দিচ্ছেন।

কবি শামসুর রাহমান।

আব্বুর লেখার ও শোবার ঘর ঠিক আগের মতোই আছে। ঘরটা এখনো আমরা আগের মতোই রেখেছি। তাঁর লেখার ঘরটি একদম সাদামাটা। ঘরে একটা কাঠের চেয়ার, একটা টেবিল আর তিনটি বুকশেলফ ছাড়া তেমন কিছুই আর নেই। অবশ্য বেশি কিছু ছিলও না। ছোট একটা খাট ছিল। ভেঙে যাওয়ায় সেটাই শুধু আমরা সরিয়েছি। আব্বুর লেখার টেবিলে সামনে আছে চারটি ছবি—দাদা-দাদি (কবির মা-বাবা) ও আম্মুর (কবির স্ত্রী) সঙ্গে ছবিগুলো। এসব ছবি তিনি একদম চোখের সামনে রাখতেন। আব্বুর শোবার ঘরের অন্য প্রান্তে আরও একটা দরজা আছে। ওটা দিয়ে বারান্দায় যাওয়া যায়। অনেক সময় বারান্দায় তিনি দাঁড়িয়ে থাকতেন। মুক্ত বাতাসে নিজের মতো করে ভাবতেন কিছু। হায়, আমাদের বাড়ির সবকিছুই আগের মতোই রয়ে গেল। আর আমরা বেঁচে রইলাম স্মৃতি নিয়ে। আব্বু, আম্মু, ভাইবোন, আত্মীয়স্বজন, আমি বা আমাদের মেয়েরা অথবা আব্বুর সঙ্গে আম্মুর আবেগময় সময়ে তোলা ছবিগুলো—এসব আমার কাছে খুবই জীবন্ত স্মৃতি। বিশেষত নয়না ও দীপিতার সঙ্গে তাঁর বেশি ছবি আছে। এই ছবিগুলোর মধ্যে অন্য রকম একটা মায়া, ভিন্ন এক প্রশান্তি জড়িয়ে আছে। কখনোই আমি এ মায়ার বন্ধন ছিন্ন করতে পারব না।

মাঝেমধ্যে আকাশ-পাতাল ভাবতে ভাবতে কত ভাবনা আসে। ভাবি যে আমাদের মায়ার টানে আব্বু হয়তো আবার আমাদের ডেকে উঠবেন, ভাবি যে তিনি হয়তো দরজার ওপাশেই দাঁড়িয়ে রয়েছেন!