সম্প্রতি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ট্রেন্ডিং বা আলোচনায় আছে একটি বিষয়। তা হলো, নারী কিসে আটকায়। জনসংস্কৃতি তথা জনমানসের ভেতরে থাকা এই কথা কেন আবার চাউর হলো সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে? এ কথার মধ্য দিয়ে আমাদের মনোস্তত্ত্বের কোন দিকটি প্রতিফলিত হয়েছে?
সম্প্রতি ‘দাহাড়’ নামে একটি ভারতীয় ওয়েব সিরিজ ব্যাপক জনপ্রিয়তা পেয়েছে। সেখানে পুলিশ কর্মকর্তা অঞ্জলী ভাটিকে বিয়ে দিতে উদগ্রীব তাঁর মা। যখন তখন তিনি পাত্রের ছবি সাজিয়ে বসেন। অঞ্জলী ভাটির পরিবার নিচু জাত হওয়ায় পাত্র পাওয়াও মুশকিল। একবার ক্রমিক খুনির পেছনে সারারাত ছুটে ক্লান্ত মেয়ে সবে বিছানায় গেছে, তখনই তার মায়ের আবদার, পাত্র পছন্দ করার। ক্ষুব্ধ মেয়ে মায়ের সামনে ছড়িয়ে দেন ডজনখানেক বিকৃত লাশের ছবি। বলেন, এই মেয়েদের মায়েরাও যদি বিয়ে নিয়ে এত চাপ না দিত তাহলে তাদের পরিণতি এমন হতো না। সিরিজে দেখানো হয় নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারের নিম্নবর্ণের হিন্দু ও মুসলমান মেয়েরা—যাদের বয়স ত্রিশ ছুঁই ছুঁই—তাঁদের কত সহজেই প্রেমের ফাঁদে ফেলা যায়। পরিবারও তাঁদের পালিয়ে যাওয়া নিয়ে মোটেই বিচলিত হয় না; বরং অধিকাংশ ক্ষেত্রই ভাবে, কাঁধ থেকে বোঝা নেমেছে।
‘দাহাড়’–এর মতো আরেকটি সিরিজের কথাও বলি। ‘কালকূট’ নামে এই ভারতীয় সিরিজে পুলিশ ছুটছে এক তরুণীর মুখে যে ব্যক্তি অ্যাসিড নিক্ষেপ করেছে, তার পেছনে। এতে দেখানো হয়, সামাজিক অবমাননা থেকে বাঁচতে কীভাবে যৌন হেনস্তাকারীকেই বিয়ে করেন কেন্দ্রীয় চরিত্রের বোন। আরও দেখানো হয়, কীভাবে দু–তিন দিন বয়সী মেয়ে শিশুদের পায়ে পাথর বেঁধে ডুবিয়ে দেওয়া হয় জলাশয়ে।
নবজাতকদের মরদেহ জমতে জমতে তাঁদের হাঁড়ের ফসফরাস থেকে বিষাক্ত হয়ে পড়ে জলাশয়ের পানি।
নারীর প্রতি চরম বিদ্বেষের এমন চিত্রায়ন আজকাল অহরহই চোখে পড়ে পর্দায়। এ ঘটনাগুলো বাস্তবেরই প্রতিফলন। এ অঞ্চলে নারীর আর্থ–রাজনৈতিক অবস্থান এমনই যে জীবনের তাদের একমাত্র অর্জন ও অবলম্বন হলো বিয়ে। ঢাকাই সিনেমায় যুগের পর যুগ ধরে নায়িকা শাবানা আমাদের তা–ই দেখিয়েছেন।
নিজের যাবতীয় শখ–আহ্লাদ বিসর্জন দিয়ে স্বামী–সন্তান–সংসারের সেবায় নিয়োজিত অনুগত নারী চরিত্রকে প্রতিষ্ঠিত ও অনুসরণীয় করেছেন তিনি। অনেকে এটাকে কৌতুকের ছলে ‘শাবানা সিনড্রোম’ও বলে থাকেন। তবে তা আদতেই নারীর চরম পুরুষতান্ত্রিক উপস্থাপনকে জায়েজ করার কৌশল। রূপালি পর্দায় ‘আদর্শ নারী’র যে মতবাদকে নানা কায়দায়, বিচিত্র মোড়কে প্রচার করা হয়েছে তা দর্শকের নারীকে দেখার ভঙ্গিকে গড়ে দিয়েছে—এবং এখনও দিচ্ছে। নারী যতই আধুনিক, স্বাবলম্বী ও স্বকীয় বৈশিষ্ট্যের অধিকারী হোন না কেন, দিনশেষে আদর্শ ঘরনী না হয়ে উঠলে তাঁর সমস্ত অর্জন ম্লান হয়ে যায়। স্বামী, সংসার, সন্তান সামলাতে না পারলে তাঁর নারী সত্ত্বা পূর্ণতা পায় না। এই ন্যারেটিভ বা বয়ানকে অগ্রাহ্য করার ক্ষমতা এ অঞ্চলের সমাজব্যবস্থার এখনো হয়ে ওঠেনি; সম্ভবত তারা সেটা চায়ও না।
এ অঞ্চলে নারীর আর্থ–রাজনৈতিক অবস্থান এমনই যে জীবনের তাদের একমাত্র অর্জন ও অবলম্বন হলো বিয়ে। ঢাকাই সিনেমায় যুগের পর যুগ ধরে নায়িকা শাবানা আমাদের তা–ই দেখিয়েছেন। নিজের যাবতীয় শখ–আহ্লাদ বিসর্জন দিয়ে স্বামী–সন্তান–সংসারের সেবায় নিয়োজিত অনুগত নারী চরিত্রকে প্রতিষ্ঠিত ও অনুসরণীয় করেছেন তিনি। অনেকে এটাকে কৌতুকের ছলে ‘শাবানা সিনড্রোম’ও বলে থাকেন। তবে তা আদতেই নারীর চরম পুরুষতান্ত্রিক উপস্থাপনকে জায়েজ করার কৌশল।
সম্প্রতি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ট্রেন্ডিং বা আলোচনায় আছে যে বিষয়টি তা হলো, নারী কিসে আটকায়। কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো ও তাঁর স্ত্রী সোভি গ্রেগয়ের ট্রুডোর আলাদা থাকার ঘোষণার পরই আলোচনাটির সূত্রপাত। ১৮ বছরের দাম্পত্যর পর তিন সন্তানের এই পিতা–মাতা বৈবাহিক সম্পর্ক ছিন্ন না করে আলাদা থাকার ঘোষণা দিয়েছেন। এর জের হিসেবে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বইতে শুরু করে মিম, ট্রল আর পোস্ট–পাল্টা পোস্টের ঝড়। এর মধ্যে একটি পোস্টের বক্তব্য ছিল এমন, ‘জাস্টিন ট্রুডোর ক্ষমতা, বিল গেটসের টাকা, হাকিমির জনপ্রিয়তা, হুমায়ুন ফরিদীর ভালোবাসা, তাহসানের কণ্ঠ কিংবা হৃত্বিক রোশানের স্মার্টনেস। কোনো কিছুই নারীকে আটকাতে পারে নাই, বলতে পারবেন নারী কিসে আটকায়?’ এই ফেসবুক পোস্টে যেসব পুরুষের নাম নেওয়া হয়েছে তাঁরা সবাই–ই স্বনামধন্য; এবং তাঁরা কেউই ভিক্টিম নন। পারস্পরিক বোঝাপোড়ার ভিত্তিতেই তাঁরা সঙ্গীর থেকে আলাদা হয়েছেন বা বিচ্ছেদের পথ বেছে নিয়েছেন। তবে কেন কেবল নারীর প্রতি উঠল ‘আটকে না থাকা’ বা হাল ছেড়ে দেওয়ার অভিযোগ! আর এ অভিযোগের মাধ্যমেই দেওয়া হলো এমন পরোক্ষ ইঙ্গিত যে কোনো একটা কিছুর বিনিময়েই নারী সব সময় সম্পর্কে থাকেন।
যে কোন সম্পর্কেই নারী–পুরুষের কিছু নির্দিষ্ট সামাজিক ভূমিকা থাকে। ঐতিহ্যগতভাবে এবং যুগ যুগ ধরে পুরুষ বাইরে আর নারী ঘরের দায়িত্বে নিয়োজিত। ঘর ভাঙলে পুরোটা দায় তাই নারীর ওপরই বর্তায়।
তিনি স্বামী পরিত্যক্ত, নির্যাতিত কিংবা অসুখী হলেও সে দায় তাঁর। স্বামী বিচ্ছেদ চাইলেও সমাজ নারী প্রতিই আঙুল তোলে। এখন প্রশ্ন হলো, নারীর প্রতি কেন এই অসম প্রত্যাশা ও দাবি? এখানে আবার তুলতে হয় সেই ‘শাবানা সিনড্রোম’–এর কথা। শাবানা আমাদের দেখিয়েছেন, নারীকে হতে হবে ধরিত্রীর মতো সর্বংসহা। সবকিছু মেনে নিয়ে সবাইকে আপন করে নিতে হবে। আত্মত্যাগই হবে তার পরম ধর্ম। বিনিময়ে নারী পাবেন সংসারের প্রাণকেন্দ্র হওয়ার সম্মান।
২০২২ সালে প্রিন্স হ্যারির স্ত্রী ও অভিনেত্রী মেগান মার্কেলের পডকাস্টে অংশ নেন সোফি ট্রুডো। তাঁদের আলাপে উঠে আসে নারীর প্রতি প্রত্যাশার কথা; আর কীভাবে খোদ নারীরাই নিজেদের ওপর এই প্রত্যাশার বোঝা চাপান—উঠে আসে সে কথাও। সোফি বলেন, একজন নারীকে বহু ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে হয়। এ সময় বিষয়টির এর ব্যাখ্যাও দেন সোফি, ‘বিশ্বজুড়ে নারীরা এখনো পরিবারের প্রাণকেন্দ্র।
ঘরের কাজের বড় অংশের চাপ এখনো তাঁরাই সামলান। পরিবারের ভালো থাকায় যেমন বিনিয়োগ করেন, তেমনি সন্তাদের ব্যাপারে বেশির ভাগ সিদ্ধান্ত নেন তাঁরা। কিন্তু আমি মনে করি, ভেতরে ভেতরে আমরা সবাই সেই সিংহী, আমাদের সবার ভেতরেই সিংহীর শক্তি আছে এবং আমরা সবাই আসলে আমাদের প্রকৃত স্বাধীনতার জন্য ছটফট করি।’
পরিবারিক দায়িত্বের চাপে বাঘিনী আর সিংহীদের হারিয়ে যাওয়াটা হয়তো পুরুষতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থার দীর্ঘ ‘মেকানিজম’–এর অংশ। বলা যেতে পারে, এভাবেই নারী তথা একটি গোটা লিঙ্গকে অবদমিত করে রাখার প্রক্রিয়া সফল হয়েছে। সবকিছুর মূল রয়েছে আধিপত্য, শাসন ও শোষণ। আর এই শোষণযন্ত্র জারি রাখতে এবং শোষণযন্ত্রের জ্বালানী হিসেবে মাঝেমধ্যেই ‘নারী কিসে আটকায়’—এ ধরনের বয়ানের যোগানও দিতে হয়।