নন্দিত কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদের মৃত্যুদিন আজ। তিনি জ্যোৎস্না ভালোবাসতেন। চাইতেন, চান্নিপশর রাতে তাঁর মৃত্যু হোক।
২১ জানুয়ারি ১৯৮৬। হুমায়ূন আহমেদের সঙ্গে আমার প্রথম দেখা। তখন আমি ঢাকায় নতুন এসেছি। এ শহর চিনি না। যাচ্ছি এক লেখকের সাক্ষাৎকার নিতে। ভান ধরেছি সাংবাদিকের। সাংবাদিকেরা সাক্ষাৎকার নিতে টেপরেকর্ডার ব্যবহার করেন। আমার রেকর্ডার নেই, কিন্তু একজনের টু–ইন–ওয়ান আছে। আমি তাঁকে নিয়ে তাঁর টু–ইন–ওয়ানসহ আজিমপুর কবরস্থানের পাশে নিউ পল্টন লাইনের ছোট গলির ভেতর এক বাড়ির দোতলায় গিয়ে হাজির হই। হুমায়ূন আহমেদের সঙ্গে দেখা হয় আমাদের। তাঁর সাক্ষাৎকার নিই। সে সময় আমি বুয়েটে ভর্তি হওয়া, ক্লাস শুরুর অপেক্ষায় থাকা উচ্চমাধ্যমিক-উত্তর ছাত্রমাত্র। ঢাকায় এসে প্রিয় লেখককে কাছে থেকে দেখা আর তাঁর কাছ থেকে কিছু প্রশ্নের জবাব শোনাই ছিল আমার উদ্দেশ্য।
আগের দিন হুমায়ূন আহমেদের সঙ্গে টেলিফোনে কথা বলে একটা খাতায় কয়েক পৃষ্ঠাজুড়ে কতগুলো প্রশ্ন লিখে রেখেছিলাম আমি। হুমায়ূনের সঙ্গে সাক্ষাৎ হতেই টু–ইন–ওয়ান অন করে প্রশ্ন করতে শুরু করি। যেন ভাইভা বোর্ডে হাজির হুমায়ূন আহমেদ। আমি তাঁকে প্রশ্ন করছি, তিনি অনেক ভাবনাচিন্তা করে জবাব দিচ্ছেন।
জিজ্ঞেস করলাম, ‘বিদেশে থেকে না গিয়ে দেশে ফিরলেন কেন?’
‘ফিরলাম, যাতে আপনাদের জন্য এইসব দিনরাত্রি লিখতে পারি। না ফিরলে কে লিখত?’
‘লেখালেখির প্রতি অনুরাগ কখন থেকে?’
‘বানান করে করে প্রথম গল্পটি যেদিন পড়লাম, মনে হয় সেদিন থেকেই।’
‘প্রথম লেখা কীভাবে ছাপা হলো?’
‘নন্দিত নরকে লেখা খাতাটি বন্ধু আনিস সাবেত মুখপত্র পত্রিকার সম্পাদককে দিয়ে এলেন। সেটা ছাপা হলো। প্রথম লেখা ছাপানোর পেছনে কোনো মজার গল্প নেই। এরপর আহমেদ ছফা প্রথম বইটির জন্য প্রকাশক জোগাড় করলেন। খান ব্রাদার্স অ্যান্ড কোম্পানি।
‘দ্বিতীয়টা (শঙ্খনীল কারাগার)?’
‘প্রকাশক চেয়ে নেন।’
‘নন্দিত নরকে আর শঙ্খনীল কারাগার-এ পাত্রপাত্রীদের নাম একই কেন?’
‘নতুন নাম খুঁজে পাইনি।’
‘ওই দুটোর খোকা চরিত্রের সঙ্গে লেখকের ব্যক্তিজীবনের কী সাদৃশ্য আছে?’
‘আমি বোধ হয় অত ভালো নই। তবে আমিও মাঝেমধ্যে খোকার মতো হতে চাই। তা ছাড়া লেখকও খোকার মতো খানিকটা বোকা।’
‘এ দুটোর প্লট কী করে পেয়েছেন?’
‘মনে নেই। তবে আমি আগে কখনো প্লট ভেবে লিখতে বসি না। কোনো কিছু লেখার আগে কোনো দিনই আমি প্লট সাজিয়ে লিখতে বসি না। লিখতে লিখতেই পাত্র-পাত্রীরা এসে যায়, চরিত্র সৃষ্টি হয়, কাহিনি গড়ায়।’
‘নির্জনে লেখেন না?’
‘আমার একটা বড় বাড়ি হলে চেষ্টা করে দেখতাম।’
‘বড় বাড়ির জন্য ইচ্ছা হয় না?’
‘মাঝেমধ্যে হয়।’
‘শুধু মধ্যবিত্ত নিয়ে লেখেন কেন?’
‘মধ্যবিত্তদেরই তো ভালো করে দেখেছি। সীমাবদ্ধ অভিজ্ঞতায় এর বাইরে লিখব কীভাবে?’
‘গল্প-উপন্যাস ছেড়ে নাটক লিখতে এলেন কখন?’
‘টাকার জন্য।’
‘এরপর সিরিজ নাটক লেখার ইচ্ছা আছে?’
‘আর্থিক ঝামেলায় পড়লে হয়তো লিখব।’
‘সিনেমার জন্য কাহিনি লেখার ইচ্ছা আছে?’
‘যদি কেউ মুক্তিযুদ্ধের ওপর ভালো ছবি করতে চায়, তাহলে লিখব।’
‘আচ্ছা, আপনি এত বেশি লেখার সময় কখনো আপনার লেখার মান সম্পর্কে সন্দিহান হন না?’
‘হ্যাঁ, আমি প্রচুর লিখি। আবার না লিখেও থাকতে পারি। প্রথম চারটি উপন্যাস প্রকাশের পর আমি সাত বছর কিছুই লিখিনি। আবার হয়তো একটা সময় আসবে, যখন কিছুই লিখব না।’
‘একঘেয়ে ঠেকায় একসময় যদি কেউ আপনার লেখা না পড়ে, তখন আপনি কী করবেন?’
‘কী আর করব? মন খারাপ করা ছাড়া কিছু করার আছে কি?’
‘অমরত্ব পাওয়ার বিন্দুমাত্র আশায়ও কি আপনি লেখেন?’
‘না। অমরত্ব মহাপুরুষদের জন্য। আমি মহাপুরুষ নই, সাধারণ মানুষ।’
‘আপনি কি নিজেকে কখনো জনপ্রিয় ঔপন্যাসিক বলে মনে করেন?’
‘যখন জানলাম, আমার একই বইয়ের প্রথম মুদ্রণ এক মাসে বিক্রি হয়ে গেছে।’
‘নিজের কাছে আপনার পরিচয় একজন লেখক, নাকি শিক্ষক?’
‘লেখক।’
‘উপন্যাসের শিরোনামে রবীন্দ্র-জীবনানন্দ থেকে ধার করেন কেন?’
‘এঁদের কাছ থেকে ধার করতে আমার লজ্জা লাগে না বলেই।’
‘আপনার জীবনের স্মরণীয় ঘটনা কোনটা?’
‘তিনটে উপন্যাস লিখে বাংলা একাডেমি পুরস্কার পাওয়াটা আমার কাছে একটা স্মরণীয় ঘটনা। না, না, এটা লিখবেন না, তাহলে লোকজন মনে করতে পারে, আমার গর্ব হচ্ছে। লিখুন, গুলতেকিনের (তখনকার স্ত্রী) সঙ্গে পরিচয়।’
‘দুঃখজনক ঘটনা?’
‘বাবার মৃত্যু।’
‘বাংলা সাহিত্যে কার কার লেখা আপনার প্রিয়?’
‘বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়, তারাঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়, বিমল কর, সতীনাথ ভাদুড়ী, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়।’
‘বাংলা সাহিত্য ছাড়া বিদেশি কোনো সাহিত্য পড়েন কি? প্রিয় কে?’
‘একসময় প্রচুর পড়েছি। এখনো পড়ি। প্রিয় হচ্ছেন জন স্টেইনবেক।’
‘বড় গল্প আর উপন্যাসের মধ্যে পার্থক্য কোথায়?’
‘জানি না।’
‘শঙ্খনীল কারাগার-এর মুখবন্ধে নন্দিত নরককে “গল্প” বলে উল্লেখ করলেন, অথচ এটা উপন্যাস হিসেবে বিবেচিত ও পুরস্কৃত। তাহলে গল্প বললেন কেন?’
‘আমাকে এসব জিজ্ঞেস করে লাভ নেই। এ–জাতীয় প্রশ্ন করা উচিত সাহিত্যের ছাত্রকে। আমি একবার একটি বইয়ের সমালোচনা লিখেছিলাম রোববার পত্রিকায়। পরে সবাই সেটাকে গল্প বলতে লাগল এবং আমিও সেটা আমার গল্পগ্রন্থে (আনন্দ বেদনার কাব্য) ঢুকিয়ে দিলাম।’
‘আপনাকে যদি উপন্যাসের সংজ্ঞা দিতে বলা হয়, তাহলে কীভাবে সংজ্ঞায়িত করবেন?’
‘কোনোভাবেই করব না। আমি যদি জানতাম উপন্যাস কী, তাহলে তো নিজেই লিখতাম, যা লিখেছি, তার কোনোটিই কি সত্যিকার অর্থে উপন্যাস হয়েছে?’
‘ভবিষ্যতে পূর্ণাঙ্গ উপন্যাস লেখার কোনো পরিকল্পনা আছে?’
‘হ্যাঁ, মুক্তিযুদ্ধের ওপর বৃহৎ ক্যানভাসে একটা উপন্যাস লিখব এবং এ জন্য আমি পড়াশোনাও করছি।’
‘বঙ্কিম, শরৎ থেকে বর্তমানকালের উপন্যাসগুলোর ধারা অনেকখানি পরিবর্তিত; এর কারণ কী বলে আপনি মনে করেন?’
‘সময়ের প্রভাব। উপন্যাস তো সময়েরই ছবি। সময় বদলালে উপন্যাস বদলাবে।’
‘একটা সার্থক উপন্যাসে কী কী গুণ থাকা আবশ্যক?’
‘একটা সার্থক উপন্যাসে সমাজ ও কাল উঠে আসবে। লেখক একটি দর্শন দিতে চেষ্টা করবেন। উপন্যাস মানে তো শুধু গল্প নয়। গল্পের বাইরেও কিছু।’
‘সুন্দর গল্পের জন্য সুন্দর কাহিনিই কি অত্যাবশ্যক?’
‘না।’
‘আচ্ছা, সাহিত্য দিয়ে সমাজ সংস্কার কীভাবে করা যায়?’
‘জানি না। আমি নিজে সমাজ সংস্কারের কথা ভেবে কিছু লিখি না।’
‘যখন লেখেন, তখন আপনি কোন শ্রেণির পাঠকের কথা বিবেচনা করেন?’
‘সায়েন্স ফিকশনগুলো কম বয়েসি পাঠক-পাঠিকাদের জন্য লেখা। অন্য সব যখন লিখি, তখন কোন শ্রেণির পাঠকদের জন্য লিখছি, তা মনে থাকে না। যাদের ইচ্ছা হয়, পড়বে।’
‘আপনার লেখায় রাজনৈতিক কোনো বক্তব্য দেখা যায় না কেন?’
‘এখন থেকে দেখতে পারবেন।’
‘আপনি কি মনে করেন যে প্রত্যেক মানুষেরই রাজনীতি করা উচিত?’
‘অফ কোর্স। ইটস আ পার্ট অব আওয়ার লাইফ।’
‘ব্যক্তিগতভাবে আপনি কোন রাজনৈতিক আদর্শে বিশ্বাসী?’
‘আমি মনেপ্রাণে বিশ্বাস করি, প্রত্যেক মানুষের অধিকার সমান।’
‘বাংলাদেশের তরুণ লেখকদের মধ্যে কে আপনার প্রিয়?’
‘ইমদাদুল হক মিলন, মঞ্জু সরকার।’
‘প্রিয় ঔপন্যাসিক?’
‘সৈয়দ শামসুল হক। শওকত ওসমান। শওকত আলী।’
‘কবি?’
‘শামসুর রাহমান, নির্মলেন্দু গুণ।’
‘নাট্যকার?’
‘হুমায়ূন আহমেদ।’
‘কবিতা?’
‘জীবনানন্দ দাশের “আট বছর আগে একদিন”।’
‘নাটক?’
‘নৃপতি (নিজের লেখা, ফেব্রুয়ারিতে [১৯৮৬] প্রথম মঞ্চস্থ হবে)।’
‘নতুন লেখকদের জন্য আপনি কিছু বলুন।’
‘নতুন লেখকদের জন্য আমার একটাই কথা, পড়তে হবে, প্রচুর পড়তে হবে, সব লেখকের লেখা পড়তে হবে। তাতে ভাষার ওপর দখল আসবে। কোন লেখক কীভাবে চরিত্রগুলো নিয়ে ট্রিট করছেন, সেটাও পরিষ্কার হবে। আবার চোখ-কানও খোলা রাখা দরকার। যেমন কোন পেশার লোক কীভাবে কথা বলে, কীভাবে হাঁটে-চলে, এসবও দেখতে হবে। তা ছাড়া কবিতা পড়া থাকলে বোধ হয় ভাষার প্রতি দখলটা তাড়াতাড়ি আসে।’
এই সাক্ষাৎকার পর্ব ছিল দুই দিনের। প্রথম দিন আধা ঘণ্টার মতো কথা বলার পর তাঁর বাসায় এসে হাজির হন এক দাড়িওয়ালা কবি। আমি এই কবির ছবি দেখেছি বইয়ের পেছনের প্রচ্ছদে। ফলে তাঁকে চিনে ফেলি; নির্মলেন্দু গুণ। দুজনের আলাপ–সালাপে বুঝতে পারি, তাঁদের মধ্যে সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ। এখন তাঁরা আড্ডা দেবেন। তাই আমাকে বিদায় করা দরকার। হুমায়ূন আমাকে বলেন, ‘তোমার টেপরেকর্ডার বন্ধ করো।’
তাঁর কথামতো বন্ধ করলাম। এবার আমি হঠাৎ তাঁকে একটা প্রশ্ন করি, ‘স্যার, আপনি কি কবিতা লেখেন?’
মাথা নাড়েন হুমায়ূন আহমেদ। না, লেখেন না।
বলি, ‘সবাই তো কবিতা দিয়ে লেখা শুরু করে। আপনি লেখেননি কেন?’
হুমায়ূন আহমেদ মিটি মিটি হাসেন। তাঁর এই হাসির মধ্যে একধরনের দুষ্টুমির আভা থাকে। যে কেউ এ রকম মুচকি হাসি দেখলে অভিভূত হয়ে যাবে, আমি নিশ্চিত। কিশোরী হলে তো কথাই নেই।
এবার তিনি কথা শুরু করেন। বলেন, ‘আমার প্রথম প্রকাশিত লেখা ছিল একটি কবিতা।’
‘কবিতা! নাম কী ছিল, স্যার?’
‘ফানুস।’
হুমায়ূন আহমেদের প্রথম লেখা বই (প্রকাশিত দ্বিতীয় গ্রন্থ) শঙ্খনীল কারাগার-এর মলাট খুলেই একটা সাদা পাতাজুড়ে চার লাইনের কবিতা পড়েছিলাম, ‘দিতে পারো এক শ ফানুস এনে, আজন্ম সলজ্জ সাধ, একদিন আকাশে ফানুস ওড়াই’। লাইনগুলো আমার মুখস্থ ছিল। ফলে আমি উচ্চারণ করি আর বলি, ‘স্যার, এই লাইনগুলো কি সেই কবিতার?’
তিনি মাথা নাড়েন।
আমি বলি, ‘পুরো কবিতাটা কি পাওয়া যাবে?’
‘যাবে না বোধ হয়। এটা ছাপা হয়েছিল ১৯৬৭ সালে। আমি তখন সেকেন্ড ইয়ারে পড়ি। লিখে পাঠিয়ে দিলাম দৈনিক পাকিস্তান-এর মহিলা পাতায়। কবির নামের জায়গায় লিখলাম আমার ছোট বোন সেফুর নাম।’
‘কেন স্যার?’
‘আরে, বোঝ না, মহিলাদের পাতায় লেখা অনেক কম যায়। ওখানে ছাপার সুযোগ বেশি। তাই নিজের নামে না দিয়ে বোনের নামে পাঠিয়েছিলাম। ছাপাও হয়েছিল।’
‘কবিতাটা কি এখন আছে?’
‘না, নেই। আমি এসব গুছিয়ে রাখতে পারি না।’
সেদিন কবিতা নিয়ে আমাদের আলাপ শেষ হয় এভাবেই। এরপর বহু বছর তাঁর সঙ্গে আমার দেখা হয় না। কিন্তু তাঁর লেখা গল্প-উপন্যাস বা নাটকের নাম যখন দেখি, তখন মনে হয়, এটা কোনো কবিতার লাইন যেন!
হুমায়ূন আহমেদ কি কবি হতে চেয়েছিলেন? কবিতা লিখে তিনি বিখ্যাত হননি ঠিক, কিন্তু একসময় আবির্ভূত হয়েছেন গীতিকবি হিসেবে। কবিতা না লেখার খেদ মিটিয়েছেন অসাধারণ সব গান লিখে।
১৯৯৪ সালে প্রথম যখন সিনেমা বানালেন, ছবির নাম রাখলেন রবীন্দ্রনাথের গানের লাইন থেকে আগুনের পরশমণি। রবীন্দ্রনাথ আর হাসন রাজার গান ছিল সেই ছবিতে। এরপর ২০০০ সালে যখন নিজের পয়সায় বানালেন শ্রাবণ মেঘের দিন, সেখানে রশিদ উদ্দিন আর উকিল মুন্সির সঙ্গে নিজের লেখা তিনটে গান জুড়ে দিলেন। প্রতিভাবান হলে যা হয়, চলচ্চিত্রে প্রথমবারের মতো গান লিখে সে বছরই শ্রেষ্ঠ গীতিকারের জাতীয় পুরস্কার পেলেন।
২০০৮ সালের মার্চ থেকে ২০১২-এর ১৯ জুলাই হুমায়ূন আহমেদের মৃত্যুর আগপর্যন্ত তাঁর সঙ্গে আমার প্রায় প্রাত্যহিক যোগাযোগ ছিল। আমরা আড্ডায় বসতাম। তাঁর প্রায় সব আড্ডায় আবশ্যিক যে উপস্থিতি থাকত, তা ছিল মেহের আফরোজ শাওনের পাশাপাশি কোনো না কোনো গানের শিল্পীর। কুদ্দুস বয়াতি, বারী সিদ্দিকী, সেলিম চৌধুরী, ফজলুল কবীর তুহিন—প্রত্যেকেই ভালো শিল্পী। হুমায়ূন তাঁদের মানুষের কাছে পৌঁছে দিয়েছিলেন গানের অনুষ্ঠান আয়োজনের মাধ্যমে। আর শাওনের সঙ্গে হুমায়ূনের রোমাঞ্চকর সম্পর্কের সূচনাও হয়েছিল তাঁর গান শুনে। হুমায়ূনের জীবনের শেষ কয়েক বছর তাঁর সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ ছিলেন এস আই টুটুল। আমাদের আড্ডার শেষ ভাগে থাকত টুটুলের পরিবেশনা। এসব আড্ডায় আমরা শুধু হুমায়ূন আহমেদের লেখা গানই শুনতাম। হুমায়ূন কবি হতে চেয়েছিলেন। গান লিখে গীতিকবি হয়েছিলেন। বর্ষা, মেঘ, বৃষ্টি আর জ্যোৎস্না—তাঁর কবিতায় প্রাধান্য পেত এসব। জ্যোৎস্নাই ছিল সবচেয়ে বেশি। তাঁর একটা কবিতা বা গীতিকবিতার বইয়ের নাম গৃহত্যাগী জোছনা, যেখানে আছে, ‘প্রতি পূর্ণিমার মধ্যরাতে একবার আকাশের দিকে তাকাই/ গৃহত্যাগী হবার মতো জোছনা কি উঠেছে?’
এস আই টুটুলের কণ্ঠে হুমায়ূন আহমেদের সবচেয়ে প্রিয় গান ছিল, ‘ও কারিগর, দয়ার সাগর, ওগো দয়াময়,/ চান্নিপশর রাইতে যেন আমার মরণ হয়।’ এটাকে তিনি ‘মরণসংগীত’ বলে মনে করতেন।
একবার ২০১০ সালের এক মহা জ্যোৎস্না রাতে আলোয় যখন ভেসে যাচ্ছে চরাচর, হুমায়ূন আহমেদের শরীর খারাপ হলো। পরে আমাকে তিনি বলেছিলেন, ‘ভেবেছিলাম, আমার গান আল্লাহ কবুল করেছেন। এই জ্যোৎস্না রাতে তিনি আমাকে নিয়ে যাবেন।’
২০১২ সালের ১৯ জুলাই আমেরিকার আকাশে জ্যোৎস্না ছিল কি না, জানি না। তবে সে রাতে এই নন্দিত কথাকারের জীবন থেমে গেল। চন্দ্রকারিগরের কাছে ভিড়ল ধবলপঙ্খী নাও। দয়াময়ের কাছে তিনি আর্জি রেখেছিলেন, চান্নিপশর রাতে যেন তাঁর মরণ হয়। আর কবি হওয়ার আকাঙ্ক্ষায় কবিতায় উচ্চারণ করেছিলেন:
‘আমি সিদ্ধার্থের মতো গৃহত্যাগী জোছনার জন্যে বসে আছি।
যে জোছনা দেখামাত্র গৃহের সমস্ত দরজা খুলে যাবে—
ঘরের ভেতর ঢুকে পড়বে বিস্তৃত প্রান্তর।
প্রান্তরে হাঁটব, হাঁটব আর হাঁটব—
পূর্ণিমার চাঁদ স্থির হয়ে থাকবে মধ্য আকাশে।
চারদিকে থেকে বিবিধ কণ্ঠ ডাকবে—আয় আয় আয়।’
চান্নিপশর রাতে হুমায়ূন আহমেদ আসলে কবিই হয়ে যেতেন।