নারীর যুদ্ধ কত রকম, কেন নারী হওয়া একটা যুদ্ধ?
কিছুদিন আগে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে একটা ভিডিও ভাইরাল হলো। একটা স্কুল বা কলেজপড়ুয়া মেয়ে বাসের আসনে বসে আছে। সামনের আসনের পেছনে মাথাটা ঠেকানো। তার পাশে দাঁড়ানো একজন পুরুষ, বয়স ত্রিশের কোঠায় হবে। মেয়েটির দেহের স্পর্শকাতর অংশে সে অনবরত চিমটি কাটছে। ভিডিওটা করেছে অপর পাশে বসা আরেকটি মেয়ে, যে পরবর্তীকালে বিবরণ দিয়েছে, কীভাবে সে ওই পুরুষকে পিটিয়েছে এবং অন্য যাত্রীদের সহায়তায় বাস থেকে নামিয়ে দিয়েছে। এ ধরনের ভিডিও আমি সাধারণত এড়িয়ে যাই। এটাও পুরোপুরি দেখতে পারিনি। ফেসবুকের পর্দায় বারবার অটো প্লে হওয়ায় দৃষ্টি সরিয়ে নেওয়ার সুযোগ পাইনি। একজন সাংবাদিক হিসেবে এর চেয়ে অনেক ভয়াবহ, সহিংস ভিডিও আমাদের প্রতিনিয়ত দেখতে হয়, বিবরণ পড়ে নৈর্ব্যক্তিকতা বজায় রেখে সংবাদ প্রকাশ করতে হয়। কিন্তু এই ভিডিও আমি কেন এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেছি?
কারণ, এই সহিংসতা এমন এক মানসিক অভিঘাতকে গোড়া ধরে টেনে আনে, যা অমোচনীয় ও প্রায় চিরস্থায়ী।
মার্কিন সংগীতশিল্পী ও গীতিকার বিলি এইলিশ। ৭টি গ্র্যামি ও ১টি অস্কারজয়ী এই তারকার বয়স ২২ ছুঁই ছুঁই। সম্প্রতি ‘ভ্যারাইটি’ সাময়িকীকে তিনি বলেন, ‘নারী হওয়া মানে কেবল একটা যুদ্ধ, চিরকাল।’ যুক্তরাষ্ট্রের এই সদ্য তরুণী, যাঁর খ্যাতি আকাশছোঁয়া, তাঁর জন্য যদি নারী হওয়া যুদ্ধ মনে হয়, তবে আফগানিস্তান, পাকিস্তান, ভারত কি বাংলাদেশে নারীদের অবস্থাটা কেমন, একটু ভেবে দেখুন। লেখার শুরুতে যে ভিডিওর কথা উল্লেখ করলাম, বেশির ভাগ নারীর জন্য এটা রোজকার ঘটনা। প্রতিনিয়ত গণপরিবহনে তাঁদের ওপরে চলে এ ধরনের যৌন সহিংসতা। প্রতিবাদ করলে অনেক সময় মৌখিক ও শারীরিক হেনস্তার শিকার হতে হয়। গণপরিবহন এড়িয়ে যাঁরা রিকশা বা সিএনজিতে চড়েন কিংবা নিজের পা দুটোকেই সম্বল করেন, তাঁদেরও রেহাই নেই। ইভ টিজিং বা ক্যাট কলিং, অর্থাৎ ইঙ্গিতপূর্ণ মন্তব্য ছুড়ে দেওয়া, গায়ে ধাক্কা দেওয়া বা ভিড়ের সুযোগে গায়ে হাত দেওয়া—এসব তো অহরহ ঘটেই। তবে সবচেয়ে উদ্বেগ-জাগানিয়া, এমনকি ভয় পাওয়ার মতো বিষয় হলো, এ সহিংসতাকে সহিংসতা হিসেবে স্বীকারই না করা।
খোদ নারীরাই এসব সহিংসতাকে মনের ভেতরে দাখিল হতে দেন না। পুরুষতান্ত্রিক ব্যবস্থায় এমন একটু-আধটু হবেই, এটা মেনে নিয়ে চলাই নারীর জীবন। বাড়ির বয়স্ক ব্যক্তিটি অযাচিত স্পর্শ করলে মা চুপ থাকতে বলেন। গণপরিবহনে হেনস্তার শিকার হলে সহযাত্রীরা বলেন মাফ করে দিতে। আর সঙ্গীর হাতে নির্যাতন তো নারীরা নিয়তি হিসেবেই মেনে নেন।
জি, আপনি ঠিকই পড়ছেন। খোদ নারীরাই এসব সহিংসতাকে মনের ভেতরে দাখিল হতে দেন না। পুরুষতান্ত্রিক ব্যবস্থায় এমন একটু-আধটু হবেই, এটা মেনে নিয়ে চলাই নারীর জীবন। বাড়ির বয়স্ক ব্যক্তিটি অযাচিত স্পর্শ করলে মা চুপ থাকতে বলেন। গণপরিবহনে হেনস্তার শিকার হলে সহযাত্রীরা বলেন মাফ করে দিতে। আর সঙ্গী হাতে নির্যাতন তো নারীরা নিয়তি হিসেবেই মেনে নেন।
এ প্রসঙ্গে সম্প্রতি দেখা একটি সিনেমার কথা উল্লেখ করতে চাই। নারীর প্রতি বিদ্বেষ ও সহিংসতা যে কীভাবে ক্যানসারের মতো আমাদের সমাজে ছড়িয়ে আছে, সেটাই যেন চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয় সিনেমাটি। ‘ফেয়ার প্লে’ সিনেমাটির কেন্দ্রীয় চরিত্র এমিলি ও লুক। দুজন একই ফাইন্যান্স ফার্মে কর্মরত। সিনেমার শুরুতেই দেখানো এমিলিকে বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছেন লুক। সবাইকে চমকে দিয়ে এমিলির পদোন্নতি হয়। এমিলি এ পদোন্নতির যোগ্য তা কিছুতেই মানতে পারে না লুক। আর এখানেই আমরা দেখতে পাই, একজন নারীর কাছে পুরুষতান্ত্রিক সমাজের আকাঙ্ক্ষা হলো—সে জায়গা ছেড়ে দেবে, পুরুষের যেকোনো উদ্যোগকে সমর্থন দেবে, তাঁর কর্তৃত্ব মেনে নেবে। আর সেটা করতে ব্যর্থ হলেই সহিংসতার শিকার হবে, যা পুরুষের কাছে গ্রহণযোগ্য। সিনেমাটির নির্মাতা একজন নারী বলেই হয়তো তিনি এত সূক্ষ্মভাবে বিষয়টি তুলে ধরতে পেরেছেন।
এত কথা হঠাৎ কেন বলছি? কারণ, ২৫ নভেম্বর বিশ্বজুড়ে পালিত হয়েছে নারীর প্রতি সহিংসতা নির্মূলে আন্তর্জাতিক দিবস। একুশ শতকের প্রায় এক–চতুর্থাংশ পার করে ফেলেছি আমরা। এখনো নারীর প্রতি সহিংসতা ইতিহাসের সবচেয়ে বিস্তৃত ও দীর্ঘস্থায়ী মানবাধিকার লঙ্ঘন। জাতিসংঘ বলছে, বিশ্বে প্রতি ঘণ্টায় পাঁচজনের বেশি নারী বা বালিকা পরিবারের কোনো সদস্যের হাতে খুন হন। প্রতি তিনজনে একজন নারী জীবনে অন্তত একবার শারীরিক বা যৌন কিংবা উভয় নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। ৮৬ শতাংশ নারী এমন দেশে বাস করেন, যেখানে লিঙ্গভিত্তিক সহিংসতার বিরুদ্ধে কোনো আইনি সুরক্ষার ব্যবস্থা নেই। বাল্যবিবাহ পুরোপুরি বন্ধ করতেও আরও ২০০ বছর লেগে যেতে পারে বলে ভাবা হচ্ছে। এমন বিশ্বের অর্ধেক নাগরিককে যদি এমন পরিস্থিতিতে বাস করতে হয়, তবে একটা সভ্যতার পথে ঠিক কতটুকু এগোতে পেরেছি আমরা?