কোলাজ: আমিনুল ইসলাম
কোলাজ: আমিনুল ইসলাম

এই হুমায়ূন! এই

আজ নন্দিত লেখক হুমায়ূন আহমেদের ১১তম মৃতুবার্ষিকী। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর পোড় খাওয়া মধ্যবিত্ত বাংলাদেশিদের চরিত্র হুমায়ূন আহমেদ ছাড়া আর কেউ এত সহজে লেখার পাতায় তুলতে পেরেছিলেন কি? এই লেখায় কেন করা হয়েছে এমন প্রশ্ন?

আমি প্রথম হুমায়ূন আহমেদ পড়ি ক্লাস এইটের দ্বিতীয় সাময়িক পরীক্ষার আগে আগে। সময়টা ১৯৯৫ সাল। আমার বন্ধু বাকিয়া তার বড় ভাইয়ের সংগ্রহ থেকে ‘পেন্সিলে আঁকা পরী’ বইটা স্কুলে আনে। স্কুলেই আমাদের আলাপ হয়, এটা বড়দের বই। আমরা তখন বেশ বড়, বলা যায় ইঁচড়ে পাকা। এই বই নিয়ে তখন বেশ সমালোচনা। কোনো এক পত্রিকায় রিভিউ এসেছে। নীতু আর আমি পড়েছি। নীতু আমাদের আরেক বন্ধু। প্রথম কাজ হলো, প্রচ্ছদ লুকিয়ে ফেলা। সবচেয়ে নিরাপদ ভেবে নীতুর ব্যাগে এই প্রচ্ছদ রাখা হলো। স্কুল ছুটির সময় বাকিয়া তার ব্যাগে প্রচ্ছদ নেবে। নীতুর মা যেহেতু তার ব্যাগ চেক করে, তাই সে বই নিল না। সে টিফিনের সময় পড়বে। বই নিলাম আমি। বাসায় গিয়ে আম্মাকে সাহায্য–সহযোগিতা করে চুপি চুপি বই খুলে বসলাম। বই খুলেই ধাক্কা। ‘পেন্সিলে আঁকা পরী’ বইটা যাঁদের পড়া আছে, তাঁরা খুব ভালো করে জানেন, ওই বয়সের বালিকা প্রথম বাক্য পড়ে কেন ধাক্কা খেয়েছিল। তবে যেহেতু আমি এর আগে আরও বড়দের বই পড়ে ফেলেছি, তাই ধাক্কা সামলে পাঠ্যবইয়ের চিপায় বই পড়ে ফেললাম।

আমি হুমায়ূন আহমেদকে চিনতাম সেই ছোটবেলা থেকে। এই বই পড়ার আগে তাঁর ‘শঙ্খনীল কারাগার’ ছবি দেখেছি, ‘কোথাও কেউ নেই’, ‘এইসব দিনরাত্রি’, ‘বহুব্রীহি’, ‘অয়োময়’—সব কটাই দেখে ফেলেছি। কিন্তু পাঠ এই প্রথম। আমাদের বাসায় যেহেতু পড়ার কোনো ছিরিছাঁদ ছিল না, তাই এর আগে আমি অবলীলায় বহু বড়দের বই পড়েছি। সেগুলো বেশির ভাগই বিদেশি আর দেশি ক্ল্যাসিক লেখকদের। কিন্তু একটা সত্যিকারের বড়দের বই একলা একলা নিজের সামর্থে জোগাড় করে পড়ার উত্তেজনাটা অনেক বেশি।

হুমায়ূন আহমেদ

এরপর ভাবলাম, হুমায়ূন আহমেদ শুধু বড়দের জন্যই লেখেন। হুমায়ূন আহমেদ যে ছোটদের জন্যও লেখেন, সেটা প্রথম জানলাম এসএসসি পরীক্ষার পর। আমাদের গল্পের বই পড়ার এত ভয়ানক নেশা ছিল যে আম্মা রীতিমতো কসম দিয়ে আটকেছিলেন আমাদের। প্রথমে আজীবন গল্পের বই পড়তে পারব না, তাতে আম্মার ক্ষতি হবে। এরপর দয়াপরবশ হয়ে বিকেল চারটা থেকে ছয়টা পর্যন্ত পড়ার অনুমতি দিলেন। আমার সব ভাইবোন খুব সৎ ছিল। তারা একদম কাঁটায় কাঁটায় আম্মার নিয়ম মানত। আমি ধুমায়া চুরি করে পড়ে আল্লাহকে বলতাম, ‘আল্লাহ, তুমি মাফ করে দিও। আম্মার কোনো ক্ষতি করো না।’ সেই নিষেধাজ্ঞা উঠল এসএসসির পর। আমাদের হাউস টিউটর আবদুল বারেক ভাই এসএসসি পরীক্ষা শেষ হওয়া উপলক্ষে অনেক বই দিলেন। আম্মাকে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের অনুরোধও করলেন। নিষেধাজ্ঞা উঠল; সঙ্গে অজস্র বই। ‘জাপানি রূপকথা’, ‘সেরা সত্যজিৎ’, হুমায়ূন আহমেদের ৫-৬টা উপন্যাসের সংকলন, ‘বোতল ভূত’, ‘নীল হাতি’, ‘পিপলি বেগম’সহ আরও অনেক অনেক বই। প্রথমেই ভদ্রতার পরাকাষ্ঠা হিসেবে ‘বোতল ভূত’, ‘নীল হাতি’, ‘পিপলি বেগম’ পড়ে নিলাম। এরপর ঝাঁপিয়ে পড়লাম উপন্যাস সমগ্রে। ‘নির্বাসন’ সম্ভবত প্রতিদিন একবার পড়তামই। আমি খুব ফাস্ট রিডার। সেই আমি প্রতিদিন একবার ‘নির্বাসন’ পড়ছি। একবেলা জরির জন্য কাঁদি, একবেলা আতর বউয়ের জন্য, কখনো আনিসের জন্য। কোনো কোনো দিন বড় চাচার জন্যও ভয়ানক কান্না পেত।

সেই সংকলনেই আরেকটি উপন্যাস ছিল; নাম ভুলে গেছি। সম্ভবত ‘অচিনপুর’। একটা ছেলে তার নানাবাড়িতে বড় হয়। মামা নাটক করে। নানার মৃত্যুর একটা দৃশ্য আছে। এরপর আর উপন্যাসটা পড়ার সুযোগ হয়নি, কিন্তু আমার মাথায় একলা ছেলেটা গেঁথে গেছে। অনেক অনেক দিন আগে আমরা একবার আমার আম্মার নানার বাড়িতে বেড়াতে গিয়েছিলাম। আম্মার আপন নানা নন, নানার বোনের বাড়িতে। গহিন এক চরে ব্রহ্মপুত্রের ধারে। সে সময় আমার প্রচণ্ড জ্বর এল। আম্মা ছাড়া আমরা সাহসী তিন ভাইবোন গিয়েছিলাম। আমার বাকি দুই ভাই-বোনকে শহরে আমার নানাবাড়িতে পৌঁছে দিলেন সেই বাড়ির লোকজন। কিন্তু আমি আটকে পড়লাম বাড়িটায়। জ্বরে চোখে কিছু দেখি না। যখন যখন টের পাই, কেউ একজন আমার মাথার কাছে বসে দোয়া পড়ছেন। পাশে একটা টিমটিমে কুপিবাতি। আর কী বাতাস, নদী থেকে আসা বাতাস। আমি সেই নদীতে খুব গোসল করেছিলাম। কোথা থেকে যেন পড়া কাঁসার থালা আনা হলো। সাড়ে ছয় বছরের আমার পিঠে সেই থালা লাগিয়ে কত মন্ত্র পড়া হলো।  থালাটা আমার চেয়ে অনেক বড়। আমার জ্বর নামে না। আমি শুধু ভাবি, কেউ আমাকে প্যারাসিটামল সিরাপ দেয় না কেন? আমার আম্মা কি জানে আমার জ্বরের কথা? তখন তো ফোন ছিল না। হুমায়ূন আহমেদ আমাকে ফিরিয়ে নিয়ে গেলেন সেই স্মৃতিতে। আমার মনে গেঁথে রইল সেই উপন্যাস।

একজন মানুষের মৃত্যুর ১১ বছর পরও তিনি বেস্ট সেলার আছেন, যাঁর নাটকের ভিউ ইউটিউবে সবচেয়ে বেশি হিট, তাঁকে বা তাঁর পরিবারকে নিয়ে যেকোনো লেখা মানুষ গোগ্রাসে পড়ে, সেই মানুষটাই আমরা সমালোচনা ছাড়া কিচ্ছু দিতে পারিনি।

এরপর সত্যিকার অর্থেই পরের ১০ বছর আমি বাংলাদেশের অন্য কোনো কবি-সাহিত্যিকের লেখা পড়িনি। শুধু হুমায়ূন আহমেদ পড়েছি। আমার জীবনের প্রথম পড়া গল্পটা ছিল আন্তন চেখভের, প্রথম উপন্যাস আল মাহমুদের ‘উপমহাদেশ’। এগুলো আমার বাপ পড়ে মাথার কাছে রাখত। আমি পড়তাম। এর মধ্যে পরিবার ও আশপাশের বন্ধুবান্ধবদের কল্যাণে সুনীল, সমরেশ, জুলভার্ন, চেখভ, বেলায়েভ সব পড়া হয়েছে। এমনকি ক্লাস ফোরে থাকতে খুশবন্ত সিংয়ের ‘দিল্লি’ বা ‘১৮৫৭’ নামে তাঁর যে উপন্যাস অনূদিত হয়েছিল, সেটাও পড়ে ফেলেছি। এই সব উচ্চমার্গীয় পাঠের বহু বছর পর আপনাদের ভাষায় ‘বাজারি লেখক’, ‘সস্তা লেখক’ হুমায়ূন আহমেদকে কেন আঁকড়ে ধরলাম, সেই রহস্য আবিষ্কার করেছি ২০১০ সালের পর। তত দিনে প্রকাশিত হওয়া সব হুমায়ূন আহমেদ পড়া শেষ।

হুমায়ূন আহমেদ (১৩ নভেম্বর ১৯৪৮—১৯ জুলাই ২০১২)

‘অপেক্ষা’ পড়ে লেখককে গলা টিপে মেরে ফেলতে ইচ্ছা হয়েছিল। আমিও এখন পর্যন্ত অপেক্ষা করছি। ‘কৃষ্ণপক্ষ’ পড়ে মুহিবের জন্য হাউমাউ করে কেঁদেছি। আসলে স্বাধীনতার পর পোড় খাওয়া মধ্যবিত্ত বাংলাদেশিদের চরিত্র হুমায়ূন আহমেদ ছাড়া আর কেউ এত সহজে লেখার পাতায় তুলতে পেরেছিলেন কি? আমি যখন ‘ইখথিয়ান্ডার’ পড়ে এক উভচর মানবের জগতে চলে যাই, তাকে ভালোবেসে আবেগে আপ্লুত হই, তখন হুমায়ূন আহমেদই আমাকে টেনেহিঁচড়ে আমার পাশের বাড়ির ছেলেটার কাছে নিয়ে গেছেন। তিনি আনিসকে চিনিয়েছেন। এই যে সময়ের গল্প সময়ে বলতে পারার এক অসীম দক্ষতা আর সহজিয়া ভাষা—এই দুটোই আমাকে হুমায়ূনপ্রেমী করেছে। শুধু প্রেমিক নয়, বলতে পারেন আমি এক অন্ধ ভক্ত তাঁর। আমি যখন দুইপাতা লিখতে শিখলাম, চেষ্টা করেছি তাঁর মতো করে আমাদের গল্প বলতে। হুমায়ূন আহমেদের ছোট গল্প আমাকে বারবার নিজের মুখোমুখি করেছে।

বিশ্বাস করেন ভাই, হুমায়ূন আহমেদ নিয়ে এই সব কথাবার্তা আমার রসিকতাই লাগে। উনি যদি একটা বাজারের স্লিপও লিখে যান, তাহলে সেটাও তাঁর লেখা উচিত হয়েছে। উচিত-অনুচিত মাপার আপনি–আমি কে?

তাহলে বলুন তো, আমি কেন নওগাঁয় বসে রাজস্থানের গল্প লেখা ব্যক্তিকে আমার প্রিয় লেখক বলব? আমার প্রিয় লেখক হুমায়ূন আহমেদ। সব দিক থেকে সবকিছুতেই তিনি আমার প্রিয়। কেউ কেউ বলেন, হুমায়ূন আহমেদ শেষ জীবনে যা যা লিখেছেন, ‘হলুদ হিমু কালো র‍্যাব’ ধরনের উপন্যাস তাঁর লেখা উচিত হয়নি। গতকাল একটা পোর্টালে তাঁর ওপরে একটা লেখা পড়ছিলাম। তাতে দাবি করা হয়েছে, ‘হুমায়ূন আহমেদের উচিত ছিল না শেষ দিকের উপন্যাসগুলো লেখা। যত দিন তিনি বাংলাদেশি মধ্যবিত্ত নিয়ে লিখেছেন, তত দিনই তিনি লেখক ছিলেন।’ আমি হাসতে হাসতে খুন। এই রসিক বাঙালিকেই হুমায়ূন আহমেদ এঁকেছেন। যখন বইমেলায় হুমায়ূন আহমেদের শত শত কপি বই বিক্রি হতো, তখন তিনি ‘বাজারি লেখক’, যখন তিনি লেখক, চলচ্চিত্র নির্মাতা হিসেবে নিজেকে এই রসিক বাঙালির প্লেটের ভাত হিসেবে প্রমাণ করলেন, তখন তাঁরা পড়েছেন তাঁর কী লেখা উচিত হয়েছে, কী হয়নি। বিশ্বাস করেন ভাই, হুমায়ূন আহমেদ নিয়ে এই সব কথাবার্তা আমার রসিকতাই লাগে। উনি যদি একটা বাজারের স্লিপও লিখে যান, তাহলে সেটাও তাঁর লেখা উচিত হয়েছে। উচিত-অনুচিত মাপার আপনি–আমি কে?

মা আয়েশা ফয়েজের সঙ্গে তিন ছেলে—মুহম্মদ জাফর ইকবাল, হুমায়ূন আহমেদ ও আহসান হাবীব

একজন মানুষের মৃত্যুর ১১ বছর পরও তিনি বেস্ট সেলার আছেন, যাঁর নাটকের ভিউ ইউটিউবে সবচেয়ে বেশি হিট, তাঁকে বা তাঁর পরিবারকে নিয়ে যেকোনো লেখা মানুষ গোগ্রাসে পড়ে, সেই মানুষটাই আমরা সমালোচনা ছাড়া কিচ্ছু দিতে পারিনি। এখনো যখন মানুষকে দম্ভভরে বলতে শুনি ‘আমি হুমায়ূন পড়ি না, হুমায়ূন আহমেদ টিকবেন না’—বিশ্বাস করেন, ঘরের মেঝেতে গড়াগড়ি দিয়ে হাসি। বাকের ভাইকে ভুলতে পেরেছেন কেউ? ৯০ দশকের ছেলেপুলেরা বাকের ভাইয়ের চেইন কেনার জন্য হত্যে দিয়ে পড়েছে। হুমায়ূন আহমেদের কোনো পাঠক আনিসকে ভুলতে পেরেছেন? ‘অয়োময়’–এর ছোট মির্জা? নাটকের চরিত্রই ভুলতে পারেননি। এত বছরে বাংলাদেশের নাট্যজগতে কত কিসিমের বিপ্লব হয়েছে, তবু কেন মন শুধু বাকের ভাইয়ের জন্য কাঁদে? ‘হাওয়ামে উড়তা যায়ে’ গানটা বিশ্বের যেকোনো দেশে বাজলে কেন মনে হয় এইটা বাকের ভাইয়ের গান?

হিমু, মিসির আলী, নীলু, অরু, মুহিব, জরি, আনিস, মাজেদা খালা—সব আসলে আমরাই। আমাদের গল্প লেখা মানুষটা শান্তিতে ঘুমিয়ে আছেন তাঁর নুহাশ পল্লীতে। ‘অমানুষ’–এর সেই এপিটাফের মতো লিখতে ইচ্ছা করে, ‘এখানে একজন মানুষ ঘুমিয়ে আছে, তাকে শান্তিতে ঘুমাতে দাও’। তোমাদের এই আলোচনা–সমালোচনার পাহাড় তাঁর কাছে তুচ্ছ।

কোনো একদিন তাঁর সঙ্গে আমার দেখা হবে, যেদিন জ্যোৎস্না তাঁর শিয়রে ছায়া ফেলবে। আমি তাঁকে ডাকব ‘এই হুমায়ূন! এই,  গল্প লেখার সিক্রেটটা বলে দিয়ে যান প্লিজ…!’