আজ ৩০ অক্টোবর কিংবদন্তি ফুটবল তারকা ম্যারাডোনার জন্মদিন। আর আসছে ২৫ নভেম্বর তাঁর মৃত্যুদিবস। ১১ নভেম্বর আবার বিশ্বখ্যাত রুশ ঔপন্যাসিক ফিওদর দস্তয়েভস্কির জন্মদিন। ভিন্ন জগতের এই দুই কিংবদন্তির মধ্যে অদ্ভুত সব অনৈক্যের ঐক্য আছে। সেসব নিয়েই এই লেখা।
‘আমি লোকটা অসুস্থ...বদ লোক একটা। পিত্তি জ্বালানো লোক।’ ‘নোটস ফ্রম আন্ডারগ্রাউন্ড’-এর এই লাইনগুলো পড়লে সবার আগে যে নাম মনে আসে, সেটি স্বয়ং লেখক ফিওদর মিখাইলভিচ দস্তয়েভস্কির। আর এরপরই দ্বিতীয় যে নামটির কথা মনে পড়ে, সেটি ডিয়েগো আরামান্দো ম্যারাডোনার। কীভাবে, সেটাই এই লেখায় বলার চেষ্টা করব।
তার আগে আরেকটা উদ্ধৃতিতে চোখ রাখতে পারি। ‘এক গ্রীষ্মে দুই কবি’ নামে এক লেখায় বুদ্ধদেব বসু লিখেছেন, ‘দস্তয়েভস্কিকে দেখামাত্র আমরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে বলে উঠি—দ্যাখো, এই যে মানুষ।’ এটুকু পড়ে ‘মানুষ’ বলার সময় দস্তয়েভস্কি ও তাঁর সৃষ্ট চরিত্রগুলোর পাশাপাশি সেই বুয়েনস এইরেসের ‘পিত্তি জ্বালানো’ লোকটার কথাও মনে পড়ে। যাঁকে আপনি ভালোবাসতে পারেন, ঘৃণা করতে পারেন কিন্তু এড়িয়ে যেতে পারেন না।
দস্তয়েভস্কির মৃত্যুর ৭৯ বছর পর জন্ম ম্যারাডোনার। একজনের জন্ম মস্কোর দরিদ্র শহরতলিতে আর অন্যজনের বুয়েনস এইরেসে। একজন অমর হয়েছেন সাহিত্যে, আরেকজন ফুটবলে। শিল্প-সংস্কৃতি ও রাজনীতি নিয়ে সচেতন ম্যারাডোনা কখনো দস্তয়েভস্কি পড়েছেন কি না, সে সম্পর্কে কিছু জানতে পারিনি। কিন্তু গভীরভাবে দস্তয়েভস্কি ও তাঁর চরিত্রগুলো এবং ম্যারাডোনা নিয়ে ভাবতে গিয়ে বারবার মনে হয়েছে, ম্যারাডোনা হচ্ছেন দস্তয়েভস্কির উপন্যাস থেকে সৃষ্ট কোনো চরিত্র কিংবা কখনো কখনো তিনি নিজেই দস্তয়েভস্কি হয়ে উঠেছেন। সম্পূর্ণ আলাদা ও মৌলিক দুটি চরিত্র হয়েও অদ্ভুত এক মিল। এ যেন অনৈক্যের ঐক্য।
উত্থান-পতনে ঠাসা দুজনের ব্যক্তিগত জীবন। একজন জীবনের শুরুতে ‘অভাজন’ লিখে একটুখানি আলোর ঝলক দেখবেন, কিন্তু তারপরই জীবন নিতে শুরু করে নির্মম এক প্রতিশোধ। মৃগীরোগ, ব্যর্থ প্রেম এবং সহলেখকদের দেওয়া যন্ত্রণা বিষিয়ে তুলেছিল জীবনকে। কিন্তু সেটা ছিল মাত্রই শুরু। এরপর সেই জীবনই রাজদ্রোহের অভিযোগে টেনেহিঁচড়ে তাঁকে নিয়ে গিয়েছিল ফায়ারিং স্কোয়াডের সামনে। কিন্তু সেখানেও খেল দেখিয়েছে নিয়তি। মৃত্যুর মুখ থেকে শেষ মুহূর্তে ফিরে এসেছেন কিন্তু ছাড় মেলেনি। সাইবেরিয়ার অন্ধকার কুঠুরিতে নিদারুণ শাস্তি ভোগ করেছেন। কিন্তু ওই যে শেষ পর্যন্ত যে মানুষের মধ্যেও একটু বেশি মানুষ। তাই হার মানেননি। ফিরে এসেছেন সেই মৃত্যুপুরী থেকে। নির্বাসনের সেই জীবন দস্তয়েভস্কির জন্য শাপে বর হয়েছে। আগুনে পোড়া খাঁটি সোনা হিসেবে গড়েছে তাঁকে। নিজের নির্বাসিত জীবন নিয়ে দস্তয়েভস্কি নিজেই লিখেছিলেন, ‘নির্বাসনের নিদারুণ অভিজ্ঞতার জন্য আমি আমার ভাগ্যকে বারবার প্রশস্তি জানিয়েছি। চার বছরের নির্বাসন আমার মনে, চিন্তায়, বিশ্বাসে, আমার সমগ্র অস্তিত্বে কী বিপুল বিবর্তন ঘটিয়েছে, আমি শত চেষ্টায়ও তা কোনোমতে বোঝাতে পারব না।’ তাঁর কথায় একটুও ভুল ছিল না। নির্বাসনে যাওয়ার আগে ও পরের সাহিত্যকীর্তির দিকে তাকালে বোঝা যাবে, সেখানে গিয়ে সত্যিকার অর্থেই নবজীবন লাভ করেছিলেন দস্তভয়েস্কি। নির্বাসন-পরবর্তী জীবনেই তিনি সৃষ্টি করেছিলেন অমর সব রত্ন। যেখানে ‘নোটস ফ্রম আন্ডারগ্রাউন্ড’, ‘ক্রাইম অ্যান্ড পানিশমেন্ট’, ‘দ্য ডেভিলস’, ‘দ্য ব্রাদার্স কারামাজভ’ বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
শুধু লেখকজীবনেই নয়, ব্যক্তিজীবনও নতুন নতুন রোমাঞ্চ উপহার দিয়েছে দস্তয়েভস্কিকে। জীবন যেমন তাঁকে অসংখ্য প্রেমে জড়িয়ে নিয়েছে। তেমনি লাঞ্ছনা, গঞ্জনাও তো কম দেয়নি। নিজের যৌন উন্মাদনা তাঁকে পরিচিত করেছিল ‘সাদ অব রাশিয়া’ হিসেবে। একের পর এক সম্পর্ক তাসের ঘরের মতো ভেঙে পড়তে দেখেছেন। এসব অভিজ্ঞতাই তাঁকে দিয়ে লিখিয়েছে, ‘এ পৃথিবীর মানুষ নিঃসঙ্গ, এ–ই তার অভিশাপ।’ এই নিঃসঙ্গতা তাঁকে সারা জীবন তাড়া করেছে। মারিয়া, পলিনা কিংবা আন্নারা জীবনের নানা পর্যায়ে তাঁকে সঙ্গ দিয়েছেন, অভিজ্ঞতা দিয়েছেন। কিন্তু এরপরও অনেকের হয়েও দস্তয়েভস্কি যেন কারোরই হতে পারেননি। তবে দ্বিতীয় স্ত্রী আন্না দস্তয়েভস্কিকে যে স্বস্তি ও ভালোবাসা দিয়েছিলেন, তা না পেলে তাঁর লেখকজীবন হয়তো পূর্ণতা পেত না এবং শেষ দিকের অমর সাহিত্যকীর্তিগুলোও তিনি শেষ পর্যন্ত লিখতে পারতেন কি না, সে শঙ্কাও থেকে যায়।
এ ছাড়া পাওনাদারেরা তো ছিলেনই। এমন নিঃসঙ্গ জীবনেও দস্তয়েভস্কির সঙ্গ ছাড়েননি পাওনদারেরা। সারাটা জীবন তাঁকে তাড়া করে বেড়িয়েছেন শকুনের মতো। অবশ্য দস্তয়েভস্কি নিজেও যে নির্দোষ ছিলেন, তা মোটেই নয়। মাত্র তিন হাজার রুবলের বিনিময়ে তৎকালীন শাইলকদের কাছে বন্ধক রেখেছিলেন পূর্বাপর সব সাহিত্যকীর্তি। তবে সব সহ্য করেও জীবনের কাছে আত্মসমর্পণ করেননি। বরং জীবনের ওপরই ঘুরিয়েছেন ছড়ি এবং জুয়ার টেবিলে বসে উড়িয়েছেন সেই জীবনকে। যেভাবে পেরেছেন টাকা এনে জুয়ার টেবিলে বসে নিজেকে ফতুর করেছেন। এ যেন জীবনকে তাঁর দেওয়া উপযুক্ত জবাব। আর এমন রোলারকোস্টার যাপনের ফাঁকে পাতার পর পাতা খরচ করে একটু একটু করে তিনি খুলে দেখিয়েছেন মানুষকে। এমন রুদ্ধশ্বাস জীবন নিয়ে কীভাবে তিনি একের পর এক মাস্টারপিস লিখে গেলেন, তা নিয়েও আলাদা একটা লেখা হতে পারে। মানুষকে তিনি যেভাবে তাঁর স্বরূপ দেখিয়েছেন, তা এতই মৌলিক যে তাঁর সামনে দাঁড়ালে আপনাকে আতঙ্কিত হতে হয়। তাঁর বইগুলো এবং চরিত্রগুলো অনেকটা আয়নার মতো। তবে তা আপনাকে প্রতিবিম্ব দেখাবে না। মানুষ হিসেবে আপনি যেমন, সেটাই ফুটে উঠবে সে আয়নায়।
তিনিই তো ‘ক্রাইম অ্যান্ড পানিশমেন্ট’-এ লিখেছিলেন, ‘প্রকৃতির নিয়ম অনুযায়ী মানুষকে সাধারণত ভাগ করা যায় দুটি শ্রেণিতে: নিম্নশ্রেণির অথবা সাধারণ মানুষ, অর্থাৎ যারা একমাত্র নিজেদের প্রতিরূপ পুনরুৎপাদনের উপযোগী বস্তু; এবং মানুষ বলতে যা বোঝায়, অর্থাৎ নিজ নিজ পরিবেশের মধ্যে নতুন কথা বলার ক্ষমতা যাদের আছে। বলাই বাহুল্য, এর মধ্যে অসংখ্য উপরিভাগ থাকতেই পারে, কিন্তু দুই শ্রেণির চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য অত্যন্ত স্পষ্ট।’
কিংবা উদাহরণ হিসেবে নিতে পারেন ‘দ্য ব্রাদার্স কারামাজভ’-এর এই কথাগুলো, ‘অস্তিত্বের রহস্য শুধু জীবন ধারণ করার মধ্যে নিহিত নেই। কিসের জন্য সে জীবন ধারণ করছে, তার মধ্যে নিহিত আছে।’ এই খোঁজই মূলত সব প্রতিকূলতার মধ্যেও সচল রেখেছিল তাঁকে।
দস্তয়েভস্কি শেষ পর্যন্ত মানুষকে নিয়ে যেতে চেয়েছেন সেই মৌলিক জায়গাটিতে, যেখানে সে ‘মানুষ’ হয়েছে। খুব কম মানুষই পেরেছিল সেই মূল বিন্দুটিতে পৌঁছাতে। আর তিনি যে মুহূর্তে নরকের দুয়ারে মানুষকে দাঁড় করিয়ে মানুষকে স্বর্গ দেখালেন, ঠিক সেই মুহূর্তে হয়ে উঠলেন ‘প্রফেট’। পুশকিনের মর্মর মূর্তি উদ্বোধনের সময় তাঁর দেওয়া বক্তব্যের পরই হাজার হাজার জনতা দাঁড়িয়ে হর্ষধ্বনির মাধ্যমে তাঁকে দিয়েছিল এই ‘প্রফেট’ উপাধি। আর তাঁর মৃত্যুর পর অন্তিমযাত্রায় শামিল হয়েছিল ৩০ হাজার মানুষ। সে সময় কোনো জারের ভাগ্যেও জোটেনি এমন সম্মান। তাঁর মৃত্যুর খবর শুনে রুশ সাহিত্যের আরেক দিকপাল সন্ত লিও তলস্তয় বলেছিলেন, ‘আমি কোনো দিন মানুষটিকে দেখিনি। আমার সঙ্গে তার কোনো সম্পর্কও ছিল না। তথাপি আমি যখন তার মৃত্যুর সংবাদ পেলাম, অকস্মাৎ মনে হলো আমি একজন ঘনিষ্ঠ, অত্যন্ত অন্তরঙ্গ মানুষ হারিয়েছি। মানুষটি যে আমার কতখানি প্রয়োজনীয় ছিল, বুঝতে পারিনি।’ এখানে মনে পড়ছে ম্যারাডোনার মৃত্যুর পর পেলের দেওয়া সেই বার্তা। ফুটবলের রাজা বলেছিলেন, ‘আমরা একদিন স্বর্গে একসঙ্গে ফুটবল খেলব।’
দস্তয়েভস্কি মনে করতেন, নায়কের প্রতি পাঠকের করুণার উদ্রেক হলে তার অন্তর্নিহিত সত্য করুণার নিচে চাপা পড়ে যায়। তিনি সব সময় চেয়েছেন সাধারণ মানুষের মধ্যে থাকা অসাধারণ মানুষটাকে বের করতে। দস্তয়েভস্কির এমন চেষ্টা থেকেই যেন তাঁর মৃত্যুর প্রায় আট দশক পর বেরিয়ে আসেন ম্যারাডোনা। বুয়েনস এইরেসের নোংরা গলিঘুপচি থেকেই আসেন সেই সন্ত, সেই শয়তান।
দস্তয়েভস্কি ছিলেন চারিত্রিক দ্বৈত সত্তার অনন্য এক উদাহরণ। যার নীচতা-হীনতা, ঈর্ষা কিংবা ঘৃণার (যদিও এসব বৈশিষ্ট্য অপরের ক্ষতির নিমিত্তে কখনোই ছিল না; বরং সেগুলো ছিল আত্মবিধ্বংসী।) আগুন দস্তয়েভস্কিকে সারা জীবন পুড়িয়েছে। যা আপনাকে মনে করিয়ে দেবে দান্তের ‘ইনফার্নো’র নবম স্তরের কথা। যেখানে তাঁর মতোই আরেকজন শয়তানকে বন্দী করে রাখা হয়েছে। আর বিপরীতে তাঁর ভালোত্ব এতটাই শক্তিশালী ছিল যে এটি তাঁকে নিয়ে গেছে শ্রেষ্ঠত্বের চূড়ান্ত শিখরে। আর ভালো ও মন্দের এই তীব্র দ্বন্দ্বই তাঁকে বানিয়েছে মানুষের মধ্যে আরেকটু বেশি মানুষ। একই সঙ্গে সাদ ও প্রফেট। যেখানে জীবদ্দশাতেই তিনি দেখেছেন স্বর্গ-নরক দুটিই।
দস্তয়েভস্কি মনে করতেন, নায়কের প্রতি পাঠকের করুণার উদ্রেক হলে তার অন্তর্নিহিত সত্য করুণার নিচে চাপা পড়ে যায়। তিনি সব সময় চেয়েছেন সাধারণ মানুষের মধ্যে থাকা অসাধারণ মানুষটাকে বের করতে। দস্তয়েভস্কির এমন চেষ্টা থেকেই যেন তাঁর মৃত্যুর প্রায় আট দশক পর বেরিয়ে আসেন ম্যারাডোনা। বুয়েনস এইরেসের নোংরা গলিঘুপচি থেকেই আসেন সেই সন্ত, সেই শয়তান।
ম্যারাডোনা, যাঁর সবকিছু মানুষের হলেও তাঁর বাঁ পা–টা ছিল ঐশ্বরিক। আর সে পায়ের জাদুতে গোটা দুনিয়াকে একাই মাত করে রেখেছিলেন। মেক্সিকান লেখক হুয়ান ভিলোরো লিখেছিলেন, ‘যখন তাঁর কাছে বল থাকত না, তখন সে মা দিবসে আদমের চেয়েও নিজেকে একা মনে করত।’ আর এই একাকিত্ব সন্ত ম্যারাডোনার ভেতরের দানবটাকেও যেন একই সঙ্গে জাগিয়ে দিত। নিজের ঐশ্বরিক ক্ষমতার টাল রাখতে না পারায় বেরিয়ে আসত মানবীয় হীন সত্তাগুলোও। যখন তাঁর মাদক নেওয়া, নিপীড়ন, এমনকি হাত দিয়ে গোল করাও হয়ে উঠত খুবই সাধারণ ঘটনা। দস্তয়েভস্কি যেমন সাইবেরিয়ার নির্বাসনে মানসিক পীড়ন দেখেছেন, ম্যারাডোনাও জ্বলেছেন একই রকম অনলে। ১৯৯৪ সালের বিশ্বকাপেই ডোপ টেস্টে পজিটিভ হয়ে কাঁদতে কাঁদতে বেরিয়ে গেলেন মাঠ থেকে। যেন স্বর্গ থেকে ঈশ্বরের আশ্চর্য পতন! অথচ আট বছর আগে আরেকটি বিশ্বকাপে সেই মানুষটি সবুজ মাঠে লিখেছেন অমর এক সাহিত্যকীর্তি, যা তাঁকে নিয়ে গিয়েছিল স্বর্গের চূড়ায়। পুরো গল্পটা যেন দস্তয়েভস্কির উত্থান-পতনের সেই যাত্রার ভিন্নভাবে ফিরে আসা।
ম্যারাডোনা আসলে কেমন, তা জানাতে গিয়ে তাঁর আত্মজীবনী ‘এল ডিয়েগো’র ভূমিকায় মার্সেলা মোরা যা লিখেছেন, তা অনেকটা এ রকম—ঈশ্বর থেকে রাজনৈতিক কৌশলী, সন্ত থেকে মাদক সেবনকারী আর ভিলেন থেকে নির্যাতিত—সবকিছুই যেন একবিন্দুতে মিলে যায়। ম্যারাডোনা এমনই। ভক্তরা যতই তাঁকে স্বর্গের দূত বানাতে চেয়েছেন, ম্যারাডোনা যেন ততই চেয়েছেন নিজেকে রক্তমাংসের একজন হিসেবে দেখাতে। ঠিক যেন দস্তয়েভস্কির বর্ণনায় উঠে আসা সেই মানুষ।
আর মানুষের মধ্যে আরও বেশি মানুষ খোঁজার এই তাড়না তাঁকে দেখিয়েছে জীবনের অনন্য সব রূপ। এ জন্যই হয়তো সারাক্ষণ অস্থির হয়ে ছুটেছেন এক হাতে স্বর্গ ও অন্য হাতে নরক নিয়ে। সেই স্বর্গ–নরকদের লোভই তাঁকে নিয়ে গিয়েছিল নেপলসে। যেখানে লেখা হবে ম্যারাডোনার জীবনের আরেকটি অভূতপূর্ব অধ্যায়। ইতালির বঞ্চিত এই শহরটি ম্যারাডোনা যাওয়ার আগপর্যন্ত পরিচিত ছিল কেবলই নোংরা ও মাফিয়াদের শহর। পাওলো রসির মতো তারকা সেই শহরে যাওয়ার সাহস করেননি৷ কিন্তু ম্যারাডোনা তো ম্যারাডোনাই। আত্মজীবনীতে ম্যারাডোনা লিখেছিলেন, ‘সত্যি কথা হচ্ছে, আমি আসার আগে কেউ নেপলসে আসতে চাইত না।’
কিন্তু কেন নেপলসে এসেছিলেন ম্যারাডোনা? উত্তরটা তাঁর মুখ থেকেই শোনা যাক, ‘আমি নেপলসের দরিদ্র শিশুদের আদর্শ হতে চাই। কারণ, তারা আমার মতোই। বুয়েনস এইরেসে ছোটবেলায় আমি এমনই ছিলাম।’
শুধু শিশুদের নয়, ম্যারাডোনা হয়ে উঠেছিলেন গোটা নেপলসের আদর্শ। দুই হাত ভরে তিনি তাদের সাফল্য দিয়েছেন আর নেপলসবাসী তাঁকে দিয়েছে অন্তহীন ভালোবাসা। ম্যারাডোনার মৃত্যুর পর বুয়েনস এইরেস যতটা কেঁদেছিল, ততটাই কেঁদেছিল নেপলসও। তিনি ছিলেন শহরটির আত্মা, সেই বঞ্চিত মানুষগুলোর ঈশ্বর। যাদের কাছে দানব ম্যারাডোনার কোনো অস্বস্তিই যেন ছিল না। যেমন রুশদের কাছে ছিল না দস্তয়েভস্কিকে নিয়ে শ্রেষ্ঠত্বের কোনো প্রশ্ন। নেপলস শহরের মানুষের কাছে ম্যারাডোনা কেমন ছিলেন, তা নিয়ে ‘সকার ইন সান অ্যান্ড শ্যাডো’তে এদুয়ার্দো গালিয়ানো লিখেছিলেন, ‘নেপলসে ম্যারাডোনা হয়ে ওঠেন সন্ত ম্যারাডোনা। কেবল তা-ই নয়, সত্যিকারের সন্ত সান গিন্নারোর ম্যারাডোনায়ন করে ছাড়েন নেপলসবাসীর।’ গালিয়ানোর ভাষায়, ‘সন্ত গিন্নারো হন সন্ত গিন্নারমান্দো। রাস্তায় তাঁরা এই হাফপ্যান্ট পরা দেবতার (ম্যারাডোনা) ছবি বিক্রি করতেন, যাঁকে আলোকিত করে রাখতেন মাতা মেরি।’
আর বুয়েনস এইরেসে তাঁর নামে চালু করা হয় ধর্মও। এ যেন আক্ষরিক অর্থেই ঈশ্বরের প্রতিদ্বন্দ্বী। আর মানুষের মধ্যে ঐশ্বরিক হয়ে ওঠার এই চাপ সামলাতে পারেননি ম্যারাডোনা। ক্রুশবিদ্ধ হয়ে সারাক্ষণ যন্ত্রণায় অস্থির হয়েছেন, যেমনটা ‘ক্রাইম অ্যান্ড পানিশমেন্ট’–এ রাসকলনিকভ হয়েছিলেন কিংবা ‘নোটস ফ্রম আন্ডারগ্রাউন্ড’–এর সেই পিত্তি জ্বালানো লোকটা। এ যেন সেই একই আগুন, যাতে তাঁরা সবাই পুড়েছেন। এই যন্ত্রণা ও এই অস্থিরতাই মূলত একই সমতলে এনেছিল ম্যারাডোনা ও দস্তয়েভস্কিকে।
সেদিন এক বন্ধুর সঙ্গে সংখ্যাতত্ত্ব নিয়ে কথা হচ্ছিল। সে–ই বলছিল, ম্যারাডোনার মৃত্যু ও দস্তয়েভস্কির জন্ম একই মাসে হওয়ার মধ্যে সংখ্যার কোনো প্রভাব আছে কি না! লেখাটা লিখতে লিখতে মনে পড়ল, দুজনই মারা গেছেন ৬০ বছর বয়সে। জন্মদিনও দুজনের কাছাকাছি সময়ে (ম্যারাডোনার ৩০ অক্টোবর, দস্তয়েভস্কির ১১ নভেম্বর)। এমনকি দস্তয়েভস্কির জন্মমাসেই ম্যারাডোনার মৃত্যু। এটা কি শুধুই কাকতাল, নাকি অন্য কোনো ইঙ্গিত এতে লুকিয়ে আছে! যা–ই হোক, তাঁরা ছিলেন এমন দুজন মানুষ, জীবদ্দশাতেই যাঁরা পেয়েছিলেন নিজেদের স্বর্গ-নরকের দেখা। এমনকি কখনো কখনো তাঁরা নিজেরাই হয়ে উঠেছিলেন সেই স্বর্গ–নরকের অধিপতিও, যা সম্ভবত পৃথিবীর তৃতীয় কোনো মানুষের ভাগ্যে জোটেনি। আর কেউ পারেননি তাঁদের মতো এতটা ‘মানুষ’ হয়ে উঠতে। কিংবা আরেকটু কম ‘মানুষ’ হতে!