বাবা কবি আবিদ আজাদের কোলে ছোট্ট তাইমুর রশীদ
বাবা কবি আবিদ আজাদের কোলে ছোট্ট তাইমুর রশীদ

আমার ফোনের ডিসপ্লেতে ‘বাবা’ লেখা ওঠে না

আজ কবি আবিদ আজাদের মৃত্যুদিন। ২০০৫ সালের এই দিনে প্রয়াত হন তিনি। মৃত্যুর আগের সময়টায় কেমন কেটেছে তাঁর দিনকাল? লিখেছেন কবির পুত্র তাইমুর রশীদ

মার্চ আমার জন্য কষ্টের, যন্ত্রণার। মার্চ আমার জন্য সব হারানোর এক বেদনার মাস। ছোটবেলায় মাকে হারানো আমি, এই মার্চেই পুরোপুরি এতিম হয়েছি। এই ব্যস্ত শহরে সবাই আছে, শুধু বাবা নেই। সব থেকেও যেন এক অদ্ভুত শূন্যতা। আমার ফোনে কত ফোন আসে। আর আমিও বা কতজনকে ফোন করি। অপেক্ষায় থাকি, কিন্তু আর কখনো বাবার ফোন আসে না। জানি আর কখনো আসবেও না। আমার ফোনের ডিসপ্লেতে ‘বাবা’ লেখা ওঠে না।

২০০৫ সালের ২২ মার্চ সকালটার কথা ভাবলে এখনো আঁতকে উঠি। ফুফুর ফোনেই জানতে পারি, বাবা আর নেই। তখন খুব আক্ষেপ হয়েছে, কেন হাসপাতাল থেকে বেরিয়েছিলাম। বাবার শেষ মুহূর্তে তাঁর পাশে থাকা হলো না আমার। এই আক্ষেপ সারা জীবনের। সেদিন পাগলের মতো ছুটে গেছি শমরিতা হাসপাতালে। মোহাম্মদপুরের তাজমহল রোডের বাসা থেকে পান্থপথের এইটুকু পথ পাড়ি দেওয়া যেন ছিল বিভীষিকাময়। এই চেনা পথে কতবার চলেছি, চলছি—কিন্তু ২২ মার্চের সেই পথ যেন ছিল সম্পূর্ণ অচেনা। চোখের জলে সেদিন পুরোটা পথ পাড়ি দিয়েছি। প্রিয়জন হারালে পথগুলো কি এমনই হিংস্র হয়ে ওঠে?

বরাবরই নিজের স্বাস্থ্য নিয়ে একটু খামখেয়ালিপনা ছিল বাবার। কবিতা, সাহিত্য আড্ডা আর পান—এই তিনটিই যেন ছিল তাঁর জীবন। এমন আয়েশ করে পান চিবোতেন, পানের ছোট্ট বাটা নিয়ে ঘুরতে দেখেছি আমি বাবাকে। আর দেখেছি কবি আসাদ চৌধুরীকে। এই এক পানে যেন দুজনার অদ্ভুত মিল।

২০০৫ সালের জানুয়ারির কোনো একদিন বাংলা একাডেমি পদক ঘোষণা হলো। বেশ আলোচনা ছিল, বাবা বাংলা একাডেমি পদক পাচ্ছেন। কিন্তু তিনি সেই পদক পেলেন না। এ জন্য বাবাকে ফোন করে অনেকেই সান্ত্বনা জানালেন। অথচ বাবার ভেতর ন্যূনতম কষ্ট বা যন্ত্রণা দেখিনি। বাবা বললেন, ‘সব কাজের কি স্বীকৃতি মেলে, কবিদের কি স্বীকৃতি লাগে? মরে গেলেও যদি কবিতাগুলো কোনো কণ্ঠে উচ্চারিত হয়, তবেই না তৃপ্তি। সেই পুরস্কারে কী হবে, যদি আমার কবিতাই বেঁচে না থাকে?’

২০০৪ সালের মাঝামাঝি থেকেই বাবার শ্বাসকষ্টের তীব্রতা বাড়ে। নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হওয়ার পর থেকেই বাবা যেন নিস্তেজ হয়ে পড়েন। তখন থেকেই হাসপাতাল-বাসা-হাসপাতাল—এই ছোটাছুটিতেই আমিসহ পুরো পরিবার ব্যস্ত। বাবা দুই দিন বাসায় তো পাঁচ দিনই থাকেন হাসপাতালে। কখনো বক্ষব্যাধি, কখনো শমরিতা, কখনো সেন্ট্রাল, কখনো বা মনোয়ারা হাসপাতালে বাবাকে নিয়ে ছুটেছি। এই ছোটাছুটিতেও কবিতার রাফ খাতাটা নিতে বাবা কখনো ভোলেননি। সব সময় মনে করিয়ে দিতেন, ‘খাতাটা সঙ্গে রেখো।’ কখনো কাঁপা কাঁপা হাতে নিজেই লিখতেন, কখনো বা আমি কিংবা ফুফু লিখেছি, বাবা বলেছেন। কবিতার প্রতি এত পাগল মানুষ কী করে হয়? কী করে সম্ভব? ভাবলেও অবাক লাগে।

২০০৫ সালের শুরুতে, তখন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছি। তবে বাবাকে নিয়ে ছোটাছুটিতে ক্লাসে যাওয়া প্রায় বন্ধ। বাবার সঙ্গে সঙ্গেই থাকি। তাঁর চুলে বিলি কাটা, সময়মতো ওষুধ খাওয়ানো, কখনো নেবুলাইজ করানো—এসব নিয়েই তখন আমার ব্যস্ততা। জানুয়ারি, ফেব্রুয়ারিসহ মার্চের পুরো সময়টায় এ সময় অভিভাবকের মতো বাবার খোঁজ রেখেছেন নজরুল গবেষক, কবি আবদুল মান্নান সৈয়দ। যদিও তাঁদের সম্পর্কের গভীরতা আরও বেশ পুরোনো। হেন কোনো বিষয় নেই, যা বাবা তাঁর সঙ্গে পরামর্শ করতেন না। আবদুল মান্নান সৈয়দও তাঁকে জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত অভিভাবকের মতোই আগলে রেখেছেন। ফোনে বাবার প্রায়ই খোঁজ নিতেন অগ্রজ কবি শামসুর রাহমান, কবি আল মাহমুদ ও শিক্ষাবিদ আসকার ইবনে শাইখ। কথাসাহিত্যিক সিরাজুল ইসলাম মুনীর, কবি শান্তা মারিয়া, শাকিল রিয়াজ, শাহিন রিজভী ছিলেন যেন আমাদের পরিবারেরই সদস্য। আর বাবার সবচেয়ে কাছের বন্ধু কবি মাহবুব হাসানের কথা তো না বললেই নয়। বাবার ভারতে চিকিৎসার পুরো সময়টায় সঙ্গে ছিলেন তিনি। এই অসুস্থতার মধ্যেও পত্রিকার সাহিত্য পাতাগুলোর জন্য কবিতা লেখা, ঈদসংখ্যায় লেখালেখির নিরন্তর চেষ্টা করেছেন বাবা। এর পেছনে চিকিৎসার বাড়তি ব্যয়ের সংস্থান হয়তো একটা কারণ ছিল। তবে এর চেয়ে বেশি বোধ করি, একেকটি কবিতা যেন তাঁকে অসুস্থ শরীরে কিছুটা হলেও স্বস্তি দিয়েছে। জীবনসায়াহ্নে দাঁড়িয়ে সবকিছুর মধ্যে আমার বাবা যেন টের পাচ্ছিলেন, তাঁর ফেরার সময় ঘনিয়ে আসছে। তাই তো তিনি লিখেছেন, ‘মৃত্যুকে তাড়িয়ে নিয়ে বেড়াই, আমি এক রাখাল বালক, ভেড়ার পালের মতো মৃত্যু চড়ে বেড়ায়, রৌদ্র-মাঠে-প্রান্তরে…আমাকে অনবরত টানে প্রান্তরের সম্ভাবনা’।

শেষবেলায় এসে আর্থিক হিসাব মেলাতে ব্যতিব্যস্ত বাবা কী কষ্ট নিয়েই না লিখতে পারেন, ‘এবার অসুখ সেরে গেলে, আমি পাখি বিক্রি করে খাব, সারা দিন পথে পথে পাখি বিক্রি করব/ যখন খুশি কবিতা লিখব আমি, কবিতা বিক্রি করে খাব/ তারপর এই সব বিক্রি–বাট্টা থেকে যেটুকু খোরাকি জুটবে, তাই দিয়ে হাসপাতালের বাকি শোধ করে দেব।’

সারা দিনের ব্যস্ততা শেষে রাতে যখন বাবার কবিতার নোট নিতে বসতাম, এত অসুস্থতার মধ্যেও তাঁর চোখেমুখে দেখতাম একধরনের ভালো লাগার অনুভূতি। কবিরা মনে হয় এমনই হন। বাবার হাসপাতালে লেখা কবিতাগুলো পড়লেই বোঝা যায়, জীবনের সব হিসাব মিটিয়ে, পাওয়া-না পাওয়ার বেদনা নিয়ে অনন্তের পথে যাত্রায় তিনি প্রস্তুত। তবে এই অন্তিমযাত্রাটাও যেন কাব্যিক। বাবা লেখেন, ‘আর একটুকরা কাগজ দরকার, শেষ লাইনটা লিখে ফেলতে হবে’।

এখনো মনে আছে, ২০০৫ সালের জানুয়ারির কোনো একদিন বাংলা একাডেমি পদক ঘোষণা হলো। বেশ আলোচনা ছিল, বাবা বাংলা একাডেমি পদক পাচ্ছেন। কিন্তু তিনি সেই পদক পেলেন না। এ জন্য বাবাকে ফোন করে অনেকেই সান্ত্বনা জানালেন। অথচ বাবার ভেতর ন্যূনতম কষ্ট বা যন্ত্রণা দেখিনি। বাবা বললেন, ‘সব কাজের কি স্বীকৃতি মেলে, কবিদের কি স্বীকৃতি লাগে? মরে গেলেও যদি কবিতাগুলো কোনো কণ্ঠে উচ্চারিত হয়, তবেই না তৃপ্তি। সেই পুরস্কারে কী হবে, যদি আমার কবিতাই বেঁচে না থাকে?’ এ জন্যই মনে হয় তিনি লিখতে পারেন, ‘ঠিকানা আমার উধাও দিগন্তর, রৌদ্র যেখানে ভাসায় সমুদ্দুর, একটানে লেখো, লিখে নাও বারবার, আবিদ আজাদ প্রযত্নে রোদ্দুর।’

আবিদ আজাদ (১৬ নভেম্বর ১৯৫২—২২ মার্চ ২০০৫)

অসুস্থতা ও আর্থিক টানাপোড়েনে নিজ হাতে গড়া শিল্পতরু প্রকাশনীর কার্যক্রম ২০০৫ নাগাদ বাবা রীতিমতো সংকুচিত করে এনেছেন। প্রতিষ্ঠানটি তখন চলছিল অনেকটা খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে। বাবা প্রায়ই বলতেন, ‘শিল্পতরু ব্যবসাসফল কি না, জানি না। তবে একসময় সাহিত্যানুরাগীদের প্রাণের জায়গা ছিল এই শিল্পতরু।’ স্মৃতির অ্যালবামে বাবা প্রায়ই হাতড়াতেন কাঁঠালবাগান ঢালের শিল্পতরুর কার্যালয়ে কবি-সাহিত্যিকদের প্রাণোচ্ছল সেই আড্ডা। বাবার মৃত্যুর এত বছর পরও পরিচিত-অপরিচিত অনেকের কাছেই শুনি সোনালি সেসব দিনের কথা।

আইসিইউতে মৃত্যুর মুখ থেকেই বেশ কয়েকবার ফিরে এসেছিলেন বাবা। তবে ২২ মার্চ আর তাঁর ফেরা হলো না। আইসিইউ মেশিনেই তাঁর জীবনাবসান হয়। বাবার শেষ নিশ্বাসের সঙ্গে সঙ্গে পুরো পৃথিবীটাই যেন বদলে গেল আমাদের।

২০০৫ সালের ২২ মার্চ পুরো দিনটাই কেটেছে একটা ঘোরের মধ্যে। শমরিতা হাসপাতাল থেকে অ্যাম্বুলেন্সের সাইরেন আর বাবার নিথর দেহটা নিয়ে তাজমহল রোডের বাসা, বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণ, তাঁর কর্মস্থল বাংলাদেশ বেতার হয়ে শেষ ঠিকানা মিরপুর শহীদ বুদ্ধিজীবী কবরস্থান। পুরো সময়টায় বাবাকে ছুঁয়ে বসে থাকার চেষ্টা করেছি। তাঁর ঘ্রাণ নেওয়ার চেষ্টা করেছি সেই ছোট্টবেলার মতো। দিন শেষে বাবাকে যখন একা, পুরোপুরি একা মিরপুরে রেখে এলাম, তখন সন্ধ্যা। সব আছে, সবাই আছে, শুধু বাবা নেই।

বাবার চশমাটা সেই সকাল থেকেই ছিল আমার বুকপকেটে। এই চশমা ছাড়া বাবার চলতই না। অথচ এখন আর এই চশমার দরকার নেই বাবার। তিনি এখন নিশ্চয়ই সব স্পষ্ট দেখেন, চশমা ছাড়াই। চশমার সেই পুরোনো বাক্স, আর বাবার শেষ হাতছোঁয়া কলম—সব যত্নে আগলে রেখেছি। বাবার চশমা, ফতুয়া আর তাঁর কবিতা—এসবই আমার, শুধুই আমার। জীবনযুদ্ধে যখনই হেরে যাই, হোঁচট খাই, এগুলো ছুঁয়েই বাবাকে অনুভব করি আমি। শক্তি পাই। বাবার চশমায় হাত বোলাতে বোলাতে আমার চোখেও জল আসে, অস্পষ্ট হয়ে আসে চারপাশ। বিড়বিড় করেই বলতে থাকি, ‘অস্পষ্ট হচ্ছে সামনের রাস্তা, মশার পিঠে চড়ে কুয়াশা নামছে…স্পষ্ট হচ্ছে শুধু ফিরে যাওয়ার রাস্তা, চশমার কাচ মুছতে আর ভাল্লাগে না আমার।’
কবিতার খাতা বুকে নিয়ে অনেক অনেক ভালো থেকো, বাবা।