শামসুর রাহমান (২৩ অক্টোবর ১৯২৯—১৭ আগস্ট ২০০৬)।
শামসুর রাহমান (২৩ অক্টোবর ১৯২৯—১৭ আগস্ট ২০০৬)।

শামসুর রাহমান কেন পড়ব, কেন প্রাসঙ্গিক শামসুর রাহমান

আজ ২৩ অক্টোবর কবি শামসুর রাহমানের জন্মদিন। তিনি কেন প্রাসঙ্গিক, কেন তাঁর কবিতার কাছে বারবার ফিরে যেতে হয় আমাদের, কবির জন্মদিনে তার সুলুকসন্ধান।

শামসুর রাহমান কেন পড়ব? এ রকম একটি প্রশ্ন বছরে দুবার ওঠে: একবার শামসুর রাহমানের জন্মদিনে, আরেকবার তাঁর মৃত্যুদিনে। প্রশ্নটি খানিকটা হাস্যকর ও বেদনাবাহী। যদিও আমরা কখনো জিজ্ঞাসা করি না কাহ্নপা কেন পড়ব? চর্যাপদ পড়াটা করা কেন জরুরি? অবশ্য প্রশ্ন করা হয়: বঙ্কিমচন্দ্র পড়ার ফজিলত কী?

রবিবাবুর দরকার আছে কি? হাল আমলের কবি-সাহিত্যিকদের কাউকে কাউকে বেহাল দশায় ফেলে দেওয়ার গুপ্ত বাসনা থেকে এ–জাতীয় প্রশ্ন বেশি বেশি করা হয়ে থাকে। আবার সেসব জবাবও খুঁজতে হয়। বিশেষ করে প্রশ্ন করে ঝামেলায় ফেলার চেষ্টা করা হয় তাঁদের, যাঁরা সমকালের বিষয়বস্তুকে কবিতায় পরিণত করেছেন। প্রশ্নের বিপদে ফেলা হয় নজরুলকেও।

এসব প্রশ্নের পেছনে থাকে একধরনের উচ্চমন্য সংশয়, দ্বিধা ও কিঞ্চিৎ অবমাননা; যেন ব্যাপারটা এ রকম: এঁরা আর কী লিখেছে? কালের ধাক্কায় এঁরা কি টিকবে? যা লেখা হচ্ছে তা তো লেখা হচ্ছে কেবলই ‘এখন’: প্রতিটিই মহৎ, প্রতিটি চিরকালের। আদতে কারও লেখালেখি নিয়ে যখন প্রশ্ন তোলা হয়, তখন তার মজবুত প্রাসঙ্গিকতা আরও জোরালো হয়ে ওঠে। আজকের এ লেখা সে ধরনেরই কিছু পর্যবেক্ষণ থেকে তৈরি হচ্ছে। কারণ, আজ শামসুর রাহমানের জন্মদিন!

শ্যামলীর বাসায় টেবিলে লিখছেন কবি শামসুর রাহমান। ২০০০ সালের ১ জানুয়ারি

আর তাই আমাদের কিছু প্রশ্নের সহজ মীমাংসা বের করা দরকার হয়ে পড়েছে যেন। আজ অনেকের মনে হয়তো এমন প্রশ্নও দেখা দেবে: কে বড় কবি? শামসুর রাহমান, নাকি আল মাহমুদ? কে শ্রেষ্ঠ? কে টিকবে?

গণকের মতো করে কেউ কেউ বাণীও দেবেন। হাস্যকর এ প্রশ্নগুলোই বাংলাদেশে তুলনামূলক সাহিত্য সমালোচনার মৌলিক প্রসঙ্গ বলে বিবেচনা করা হয়। শ্রেষ্ঠত্ব নির্ণয়ের পরস্পরবিরোধী অবস্থান সৃষ্টির মাধ্যমে সাহিত্য বা কবিতাকে প্রকৃতপক্ষে নিয়ে যাওয়া হয় অ-সাহিত্য ও অ-কবিতার দিকে। অথচ কবিরা টিকে থাকা বা না-থাকা নিয়ে হয়তো ভাবেননি কোনো দিন।

তো ফিরে যাই পুরোনো কিছু প্রশ্নে: কেন প্রাসঙ্গিক শামসুর রাহমান? কেনই-বা তিনি বহুল পঠিত কবির তালিকায় পৌঁছে গেলেন? এসব প্রশ্নের জবাব খুঁজতে হবে বাংলাদেশের ইতিহাসের পাটাতন থেকে। নন্দনতত্ত্ব বা সৌন্দর্যচেতনার অনৈতিহাসিকতার চশমা দিয়ে শামসুর রাহমানের প্রাসঙ্গিকতাকে বোঝা যাবে না। কারণ, কবি হিসেবে শামসুর রাহমানের বিস্তৃতি এবং বাংলাদেশের ইতিহাসের চলমানতা পরস্পর সম্পর্কিত। এই যোগসূত্র পাঠ করাটা জরুরি। প্রশ্ন উঠতে পারে: বাংলাদেশের কোন ইতিহাস?

সামাজিক, সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক, নন্দনতাত্ত্বিক? আমি বলব, ইতিহাসের বহু ধারার বিষয়বস্তুর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট করেই শামসুর রাহমানের কবিতাকে পড়তে হবে। কিন্তু বাংলাদেশে শামসুর রাহমানের কবিতাকে খণ্ডিত দৃষ্টিকোণ থেকে পড়া হয়ে থাকে। শুদ্ধ নন্দনতত্ত্ববাদীরা সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক বাস্তবতাকে হাওয়ায় উড়িয়ে দিয়ে সবকিছুকে বিবেচনা করেন রূপ, রস ও সুন্দরের আলোকে।

রাজনৈতিকভাবে পাঠ করতে গিয়ে কেউ কেউ ভাষা-আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধ ও স্বৈরতন্ত্র-বিরোধিতা পর্যন্ত বিস্তৃত করেন শামসুর রাহমানকে। গণতন্ত্রের কবি, স্বাধীনতার কবি, মুক্তিযুদ্ধের কবি ইত্যাদি সরল অভিধায় চিহ্নিত করেন। কিন্তু কবিতার ঐতিহাসিক ও সমাজতাত্ত্বিক ব্যাখ্যাকে গুরুত্ব দিয়ে বুঝতে চেষ্টা করেন না। সত্যিকার অর্থে কবিতা শুধু নয়, সাহিত্যের সমাজতাত্ত্বিক ও সাংস্কৃতিক পাঠ বাংলাদেশে গড়েই ওঠেনি; ‘সাহিত্যের সমাজতত্ত্ব’ নামক শাখাটির দুর্বলতা বাংলাদেশের সাহিত্য সমালোচনায় দুর্বলতম ধারা।

অথচ শামসুর রাহমানের কবিতা পড়ার ক্ষেত্রে খুবই প্রাসঙ্গিক সমাজতাত্ত্বিক ও সাংস্কৃতিক ব্যাখ্যা। ধরা যাক, পঞ্চাশ থেকে আশির দশকে গড়ে ওঠা ঢাকা শহরের সমাজ ও সংস্কৃতিকে জানতে চান; জানবেন কী করে? আপনার জানতে ইচ্ছা হলো পুরান ঢাকা আদতে কেমন ছিল? কীভাবে বদলে যাচ্ছিল শহরবাসী মধ্যবিত্ত, নিম্নবিত্ত? কার লেখার কাছে ফিরে গেলে মনে হবে: এ–ই হলো ঢাকা, এ–ই হলো পুরান ঢাকা, ঘোড়া গাড়ির ঠকঠক, সহিসের চিৎকার, ভিস্তিওয়ালার হাঁকডাক। কার কবিতা পড়তে পড়তে চেনা যাবে এই যে গড়ে উঠছে মতিঝিল?

এই তো দৈনিক বাংলার মোড়, গুলিস্তান, ইংলিশ রোডের পতিতা, মাহুতটুলি, নয়াবাজার। পত্রিকায় নিশ্চয়ই এসবের তথ্য পাবেন, নানা রকম উপাদান পাবেন। পুরোনো ছবি ঘেঁটে, দাপ্তরিক নথিপত্র উদ্ধার করে নিশ্চয়ই রসদ পাওয়া যাবে। কিন্তু ঢাকা শহরের সাহিত্যিক রিপ্রেজেন্টেশন কোথায়? পঞ্চাশ বছরের ঢাকা শহরের কাব্যিক প্রতিবেদনগুলো কোথায়? নিশ্চিতভাবেই বলতে পারি, শামসুর রাহমানের কবিতা সেই খনি। সামান্য খুঁড়তেই ঢেকে রাখা ঢাকা উন্মোচিত হয়ে যায়। ধারণা করি, এমন প্রশ্ন নিশ্চয়ই কেউ করবেন না যে এই ঢাকা চিনে কী লাভ? ঢাকা তো ঢাকাই।

রাজনীতি ও সংস্কৃতির পরিভাষায় আমরা যাকে বলি বাঙালি জাতীয়তাবাদী রাজনীতি, তার কেন্দ্রীয় পরিসর তৈরি হয়েছিল ঢাকায়। ঢাকা ও ঢাকার রাজনীতি ছিল পূর্ব বাংলার বাঙালিকে জাতি হিসেবে শনাক্ত করার কেন্দ্রভূমি। এই শহরে বসেই শামসুর রাহমান লিখছেন ‘বর্ণমালা, আমার দুঃখিনী বর্ণমালা’, ‘আসাদের শার্ট’। সময় লিখিয়ে নিয়েছে কবিতা, কবিতা লিখে দিয়েছে জাতীয় মানচিত্রের নকশা।

যদি করেই থাকেন, তারও জবাব আছে; চিনতে হবে এই জন্য যে পূর্ব বাংলা নামক একটি ভূখণ্ড কী করে সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক শোষণের ভেতর দিয়ে এগিয়ে এল, বিকশিত হলো, তার হদিস মেলে শামসুর রাহমানের কবিতায়। পঞ্চাশ-ষাটের অনেক কবিই ঢাকাকে ঢাকা ভাবেননি; ছেঁড়া কাঁথায় শুয়ে লাখ টাকার স্বপ্ন দেখার মতো করে ঢাকাকে ভেবেছেন ডাবলিন, জুরিখ, প্যারিস, লন্ডন ইত্যাদি।

ইউরো-আমেরিকান কবিতা পাঠের ফলে উঠে এসেছে রূপান্তরিত ঢাকা। মাঝেমধ্যে শামসুর রাহমানও এই অনৈতিহাসিক কাজটি করেছেন। কিন্তু সেটি তাঁর প্রধান প্রবণতা হয়ে দাঁড়ায়নি। ভুলে গেলে চলবে না: ঢাকা শহরই তখন পূর্ব বাংলার রাজনৈতিক কেন্দ্র, সাংস্কৃতিক মান বা আদর্শ। ঢাকা শহরই তখন প্রতিরোধের শহর। এই ঢাকারই ছিল প্রতিরোধের দুটি পক্ষ: কলকাতা ও করাচি। ঢাকা কাউকে গ্রহণ করেনি। ঢাকা ছিল পূর্ব বাংলার আত্মপরিচিতি নির্মাণের শহর। আর তাই শামসুর রাহমান পড়তে পড়তে সেই পরিচিতি নির্মাণের পর্বটিকে চেনা যায়। অর্থাৎ পূর্ব বাংলার রাজনৈতিক চেতনাসম্পন্ন জনগোষ্ঠীকে চেনা যায়।

রাজনীতি ও সংস্কৃতির পরিভাষায় আমরা যাকে বলি বাঙালি জাতীয়তাবাদী রাজনীতি, তার কেন্দ্রীয় পরিসর তৈরি হয়েছিল ঢাকায়। ঢাকা ও ঢাকার রাজনীতি ছিল পূর্ব বাংলার বাঙালিকে জাতি হিসেবে শনাক্ত করার কেন্দ্রভূমি। এই শহরে বসেই শামসুর রাহমান লিখছেন ‘বর্ণমালা, আমার দুঃখিনী বর্ণমালা’, ‘আসাদের শার্ট’। সময় লিখিয়ে নিয়েছে কবিতা, কবিতা লিখে দিয়েছে জাতীয় মানচিত্রের নকশা।

কবি শামসুর রাহমান

জাতীয়তাবাদ–বিষয়ক ভাষ্যকার বেনেডিক্ট অ্যান্ডারসন লিখেছিলেন, জাতি হলো রাজনৈতিকভাবে কল্পিত সম্প্রদায়; খুবই গুরুত্বপূর্ণ কথা। লেখালেখি, সাহিত্য, ভাষা ছাড়া এই কল্পিত সম্প্রদায় গড়ে ওঠা কঠিন। তিনি এ–ও দেখিয়েছিলেন উপন্যাস কী করে জাতীয় চেতনা তৈরিতে সহায়তা করেছিল।

রাজনৈতিক ইশতেহারের মাধ্যমে হয়তো কল্পিত সম্প্রদায়ের ধারণা দেওয়া সম্ভব। কিন্তু সেটিকে জনগণ স্তরে জারি রাখা এবং মধ্যবিত্তের চেতনায় তাড়িত করার ক্ষেত্রে সাহিত্যের কোনো বিকল্প ছিল না। আমরা যদি উনিশ শতকের কলকাতা এবং বিশ শতকের প্রথম পঞ্চাশ বছরের ভারতীয় উপমহাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাস ও সাহিত্যে চোখ রাখি, তাহলে স্পষ্টভাবেই দেখতে পাব সাহিত্য ও জাতীয়তাবাদ কত তীব্রভাবে কাজ করেছে। এমনকি তৈরি হয়েছিল ‘জাতীয় সাহিত্যে’র ধারণা।

উদাহরণ হিসেবে আমরা বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের ‘আনন্দমঠ’ উপন্যাসের নাম বলতেই পারি; যা ভারতীয় জাতীয়তাবাদের প্রচারে মতাদর্শিক হাতিয়ার হিসেবে কাজ করেছে। পাকিস্তান-পরবর্তী কালে পূর্ব বাংলার কবি-সাহিত্যিকদের বড় একটি অংশ দাঁড়িয়ে গেলেন বাঙালি জাতিসত্তার নতুন সংজ্ঞায়নে। একুশে ফেব্রুয়ারির হাত ধরে ধীরে ধীরে তা গড়িয়ে গেল জাতি-কল্পনায়। এই রাজনৈতিক কল্পনা ও বাসনার পরিণতি আজকের বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্র।

শামসুর রাহমানের কবিতা পূর্ব বাংলার জাতি-কল্পনা ও রাষ্ট্র-বাসনার প্রকাশ। এর প্রমাণ হিসেবে চাইলে অজস্র উদ্ধৃতি দেওয়া যাবে তাঁর কবিতা থেকে। কিন্তু তার কোনো প্রয়োজন দেখি না। কারণ, মুখে মুখে আওড়ানো হয় যাঁর কবিতা, বাঙালির জাতীয়তাবাদী আয়োজনে যিনি অনিবার্য হয়ে ওঠেন, তাঁর উদ্ধৃতি দেওয়ার প্রয়োজন পড়ে না। তবে একটি কবিতার কাছে আমি যেতে চাই, সেটি ‘তোমাকে পাওয়ার জন্যে, হে স্বাধীনতা।’এ কবিতাটিকে আমার কাছে মনে হয় শামসুর রাহমানের জাতি ও রাষ্ট্র কল্পনার চূড়ান্ত রূপ।

’৪৭–এর পর থেকে বাংলাদেশে ধর্মনিরপেক্ষ, শ্রেণি বৈষম্যহীন, অসাম্প্রদায়িক, গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের যে স্বপ্ন তৈরি হয়েছিল, তার একটি কবিতাবাহিত রূপ ‘তোমাকে পাওয়ার জন্যে, হে স্বাধীনতা।’এই স্বপ্ন কেবল ঢাকাবাসী শহুরে মধ্যবিত্তের স্বপ্ন নয়, পূর্ব বাংলার সংখ্যাগরিষ্ঠ কৃষিজীবী মানুষেরও আমূলবিদ্ধ আকাঙ্ক্ষা।

একটি কূট তর্ক ইদানীং শোনা যায়, পূর্ব বাংলায় ধর্মনিরপেক্ষতা ও অসাম্প্রদায়িকতার ধারণা আদৌ ছিল কি না! সেক্যুলারিজম ও নাস্তিকতাকে গুলে বিষগুলি বানিয়ে অনেকে ফেনায়িত করেন তর্কটিকে। যদি এই সন্দেহ থেকেই থাকে, তাহলে তর্ককারীদের যেতে বলব বাংলা অঞ্চলের লোকায়ত কবি, শিল্পী, পালাকারদের রচনার কাছে। ইউরোপীয় সেক্যুলারিজম বা নাস্তিকতার বাইরেও ধর্মনিরপেক্ষ চেতনা বাংলায় সতত প্রবহমান। পূর্ব বাংলার লোকায়ত কবি-সাহিত্যিকেরাও ভিন্ন একটি ভূখণ্ডের কথা ভেবেছিলেন: যা সনাতন ভারতবর্ষ নয়, নব্য পাকিস্তান নয়; কিন্তু নতুন এক দেশ, যে দেশের নাম তখনো অজানা।

এ কারণেই তিনি অন্তরঙ্গ বন্ধু হয়ে উঠেছিলেন বাংলাদেশের বিপুলসংখ্যক মানুষের। পাঠকের অন্তরে শামসুর রাহমান জুগিয়েছিলেন আত্মপ্রকাশের আনন্দ। এই সূত্রে আমাদের মনে রাখতে হবে আবৃত্তির প্রসঙ্গও। কেননা, আশির দশকে কবিতার লিখন ও পঠন হাত ধরাধরি করে চলেছে।

শামসুর রাহমান বলছেন, স্বাধীনতার জন্য সকলের আকাঙ্ক্ষা: হরিদাসী, সকিনা বিবি, মতলব মিয়া, শূন্য থালা হাতে বসে থাকা কিশোরী, রুস্তম শেখ, মোল্লা বাড়ির বিধবা। এ তালিকা দীর্ঘ। আদতে তা শুধু স্বাধীনতা নয়, একটি নতুন রাষ্ট্রমাত্র নয়, ‘একটি নতুন পৃথিবীর জন্ম হতে চলেছে।’ নতুন পৃথিবী কেন? যে রাষ্ট্র জন্মাবে পৃথিবীর মানচিত্রে অন্য অনেক রাষ্ট্রের মতো, তা একটি রাষ্ট্রমাত্র; কিন্তু পূর্ব বাংলার বাঙালির কাছে তা যেন এক নতুন পৃথিবী। পূর্ব বাংলার এত এত লড়াই—নীল বিদ্রোহ, কৃষক বিদ্রোহ, ধর্মান্দোলন, উপনিবেশ-বিরোধী অবস্থান এগুলো কি শূন্যে মিলিয়ে যাবে? ঐতিহাসিক প্রয়োজন কি ফুরিয়ে গিয়েছিল এসব আন্দোলনের? নাহ। হয়তো তাই শামসুর রাহমানকে বলতে শুনি:

তোমাকে পাওয়ার জন্যে, হে স্বাধীনতা,

তোমাকে পাওয়ার জন্যে আর কতবার ভাসতে হবে রক্তগঙ্গায়?

আর কতবার দেখতে হবে খাণ্ডবদাহন?’

ইতিহাসের কোনো ঘটনাই ফুরিয়ে যায় না; উদ্দীপনা ও শক্তি হিসেবে টিকে যায় মর্মের গহনে। সেই গহন উত্তাপ কখন কীভাবে বিস্ফোরিত হবে বলা মুশকিল। এই কবিতাটিতে শামসুর রাহমান চূড়ান্ত এক ভবিষ্যতবাদী উচ্চারণ করতে সক্ষম হয়েছেন :

পৃথিবীর এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে জ্বলন্ত

ঘোষণার ধ্বনি-প্রতিধ্বনি তুলে,

নতুন নিশান উড়িয়ে, দামামা বাজিয়ে দিগ্বিদিক

এই বাংলায়

তোমাকে আসতেই হবে, হে, স্বাধীনতা।

পুত্রবধূ টিয়া রহমানের সঙ্গে কবি শামসুর রাহমান

উল্লেখ্য যে কবিতাটি লিখিত হয়েছে ১৯৭১-এ যুদ্ধ শুরুর পরপর। সর্বব্যাপ্ত অনিশ্চয়তার মাঝখানে থেকেও শামসুর রাহমান নিশ্চিত করেছেন স্বাধীনতাকে। এটি তখনই সম্ভবপর হয়, যখন একজন কবি নিজের জাতির ‘জাতীয়’ নকশাকে চিনতে পারেন। এখানেই শামসুর রাহমান দ্রষ্টা। তাহলে বোঝা যাচ্ছে শামসুর রাহমান পূর্ব বাংলার রাজনৈতিক প্রকল্পনায় সাড়া দিয়েছেন।

জীবনানন্দ দাশ একটি কথা বলেছিলেন, ‘কবিতার অস্থির ভেতরে থাকবে ইতিহাসচেতনা ও মর্মে থাকবে পরিচ্ছন্ন কালজ্ঞান।’ শামসুর রাহমানের কবিতা পড়তে গেলে এ কথাটি মনে আসে।

ইতিহাস ও কালজ্ঞানের সমন্বয় তাঁর কবিতায় ব্যাপকতর। তবে এ ক্ষেত্রে সতর্কভাবে মন্তব্য করতে চাই যে জাতীয়তাবাদ মূলত মধ্যবিত্তের ভাবাদর্শ; এর সঙ্গে যখন ইতিহাসচেতনা ও কালজ্ঞান যুক্ত হয়, তখন সাধারণত মধ্যবিত্তের শ্রেণিস্বার্থ প্রাধান্য পায়। শ্রেণি রাজনীতির প্রশ্নে শামসুর রাহমানের ভাষ্য অনুপস্থিত কিংবা জোরালো নয়। এটি তাঁর কবিতার সীমাবদ্ধতা নয়, বরং ধ্রুপদি জাতীয়তাবাদী প্রজন্মের ভাবনার ছকই এ রকম। পঞ্চাশের দশকের কবি হাসান হাফিজুর রহমান, সৈয়দ শামসুল হক, আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ প্রমুখের প্রায় প্রত্যেকে এই ছকের অধীন। আল মাহমুদ এ ক্ষেত্রে ব্যতিক্রমী প্রবণতা দেখিয়েছেন; জাতীয়তাবাদ, শ্রেণিপ্রশ্ন, ধর্মনিরপেক্ষতা, সমাজতন্ত্র ও ইতিহাসচেতনাকে একটি সুতায় মালা গেঁথে গেঁথে বুঝতে চেয়েছেন। কালজ্ঞানের স্বাক্ষর প্রবল বলেই আজও ‘সোনালি কাবিন’–এর সনেটগুলো প্রাসঙ্গিক হয়ে ওঠে। কিন্তু বিশাল একটি জাতির প্রতিদিনকার ভাবস্বর, লড়াই–সংগ্রাম, হার–জিতের বৃত্তান্ত হয়ে ওঠেনি আল মাহমুদের কবিতা। নন্দনতাত্ত্বিক কলাকৌশল ও বক্তব্যে চমকপ্রদ তাঁর কণ্ঠ।

নিজ গ্রাম নরসিংদীর পাড়াতলীতে শস্যখেতের মধ্যে শামসুর রাহমান, ১৯৯৯

অন্যদিকে শামসুর রাহমান লিখেছেন প্রতিদিনের কবিতা। ক্ল্যাসিক উপমা, চিত্রকল্প কিংবা রূপকের ঝালর মোড়ানো নয় তাঁর কবিতা। হাঁটতে চলতে, ঘুরতে ফিরতে, শয্যায় যেতে যেতে, সঙ্গমে কাতর হতে হতে তাঁর কবিতা জন্মায়। রবার্ট লওয়েলের কবিতা সম্পর্কে যেমন বলা হয়, ‘পোয়েট্রি অব কনফেশন’ বা ‘স্বীকারোক্তির কবিতা’ শামসুর রাহমানের কবিতা অনেকটা তা-ই। তাঁর স্বীকারোক্তি রাজনীতি, ধর্ম, প্রেম, যৌনতা, শহর, চাকরি, পরিবার সবকিছু নিয়ে।

আর এ কারণেই তিনি অন্তরঙ্গ বন্ধু হয়ে উঠেছিলেন বাংলাদেশের বিপুলসংখ্যক মানুষের। পাঠকের অন্তরে শামসুর রাহমান জুগিয়েছিলেন আত্মপ্রকাশের আনন্দ। এই সূত্রে আমাদের মনে রাখতে হবে আবৃত্তির প্রসঙ্গও। কেননা, আশির দশকে কবিতার লিখন ও পঠন হাত ধরাধরি করে চলেছে। মুদ্রণ সংস্কৃতি এবং প্রযুক্তিনির্ভর আবৃত্তির সংস্কৃতি পরস্পরকে সহায়তা করেছে। সামরিক শাসনের বিরোধিতায় কবিতা ও ক্যাসেট হয়ে উঠেছিল প্রতিরোধের মাধ্যম। সে সময় অনেকেই লোকপ্রিয় হয়েছেন। শামসুর রাহমানের লোকপ্রিয়তা ছিল আকাশচুম্বী। এর কারণ নিশ্চয়ই তাঁর কবিতার দৈনন্দিনমুখিনতার ভেতরই নিহিত।

একবার হিসেব মিলিয়ে নিই: ১৯৪৭ থেকে ১৯৯০ পর্যন্ত পূর্ব বাংলার জনগণ সত্যিকার সেন্সরমুক্তভাবে নিজেকে কতটুকু প্রকাশ করতে পেরেছে? পাকিস্তানবাদ, পাকিস্তানি সামরিক শাসন, মুক্তিযুদ্ধ-পরবর্তী রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা এবং দীর্ঘ কালের সামরিক শাসনে সহজ কথাটি কি সহজে বলা যেত? শামসুর রাহমান বেছে নিয়েছিলেন সহজের পথ; এটিই তাঁর শক্তি ও সীমাবদ্ধতা। কারণ, পরবর্তী সময় তিনি আটকে গিয়েছিলেন দৈনন্দিনতার ছকে, সেখানে হয়তো কবিতাও হয়ে উঠেছিল ‘রুটিন ওয়ার্ক’। সে ধরনের কবিতার নন্দনতাত্ত্বিক মূল্য নিয়ে প্রশ্ন থাকলেও সমাজতাত্ত্বিক ও সাংস্কৃতিক মূল্য নিয়ে কোনো সংশয় নেই। দুর্ভাগ্যের বিষয় হলো আমাদের দেশে কবিতা বোঝার মাপকাঠি মূলত বুদ্ধদেব বসু, আবদুল মান্নান সৈয়দ ও হুমায়ুন আজাদ ঘরানার আধুনিকতাবাদ। উপমা, চিত্রকল্পের ফর্দ আর ‘বক্রোক্তি ভঙ্গি ভণিতি’-জাতীয় ভাষাবোধের কারণে কবিতার ‘অ্যাসথেটিক বিউটি’ আলোচ্য হয়ে উঠলেও ‘সোশিও-কালচারাল বিউটি’ একেবারেই গৌণ; আর তাই শামসুর রাহমানের কবিতা প্রসঙ্গে দোনোমনা ভঙ্গি দেখা যায় তরুণমহলে। একজন শিল্পীর সত্যিকার পাঠ একরৈখিক হতে পারে না; আজকের দুনিয়ায় যেকোনো পাঠ যেহেতু বহুরৈখিক, শামসুর রাহমানকেও পাঠ করা দরকার বহুরৈখিক আলোর পাদপীঠে।