জাতিসংঘের হিসাব অনুযায়ী, বিশ্বজুড়ে প্রতিবছর পারিবারিক ‘সম্মান’ রক্ষার নামে পাঁচ হাজার নারী ও কিশোরীকে হত্যা করেন তাদের পরিবারের সদস্যরা। যেমন এ বছরের জানুয়ারি মাসে জনপ্রিয় ইউটিউবার তিবা আল আলীকে পারিবারিক ‘সম্মান’ বাঁচাতে হত্যা করেন তাঁর বাবা। আবার বছর কয়েক আগে বাংলাদেশেও একই কারণে বাবার হাতে মরতে হয় পারুল আক্তার নামের এক নারীকে। কোনো নারী নিজের ইচ্ছায় বাঁচতে চাইলে এই যে তার পরিবারের ‘সম্মান’ চলে যায়, এ ধারণার পেছনে কাজ করে কোন ধরনের পুরুষতান্ত্রিক মনস্তত্ত্ব?
২৩ বছরের তিবাকে ঘুমের মধ্যে গলা টিপে হত্যা করা হয়। ২০২৩ সালের ৩১ জানুয়ারি রাতে ইরাকের দিওয়ানিয়ায় নিজ বাড়িতে বাবা তায়িপ আলী তাঁকে হত্যা করেন। এরপর পুলিশের কাছে আত্মসমর্পণ করেন। এ ঘটনায় তাঁর ছয় মাসের সাজা হয়।
তিবা আল আলীকে নিয়ে একটি দীর্ঘ প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে বিবিসি। প্রাণশক্তিতে ভরপুর এই ইউটিউবারের সাবস্ক্রাইবারের সংখ্যা ২০ হাজারের বেশি। মাত্র ১৭ বছর বয়সে তিনি ইরাক থেকে পড়াশোনার জন্য তুরস্কে যান। এরপর সেখানেই থেকে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। এর পেছনে প্রথম কারণ হলো, স্বাধীনভাবে জীবনযাপনের সুযোগ। এ ছাড়া আরও যে কারণগুলো ছিল, তা হলো—তুরস্কে নতুন পাওয়া স্বাধীনতা, সিরীয় বংশোদ্ভূত বাগ্দত্ত, মেকআপসহ নানা কিছু নিয়ে তাঁর ভিডিওগুলো এখানে জনপ্রিয়তা পাওয়া। জানা যায়, ২০২৩ সালের জানুয়ারি মাসে তুরস্ক থেকে ইরাকে নিজের বাড়িতে ফিরে পরিবারের সঙ্গে বিবাদে জড়িয়েছিলেন তিবা। বাবা তায়িপ তাঁর ইস্তাম্বুলের জীবন ও সিরীয় বাগ্দত্তের বিষয়ে আপত্তি জানিয়ে আসছিলেন। মেয়ে তিবা, না পরিবারের ‘সম্মান’—কোনটা বড়? এ প্রশ্নে অবশেষে মেয়েকে হত্যা করে সেই ‘সম্মান’ই ঠিক রাখা হলো।
তিবার মৃত্যুতে ইরাকের রাস্তায় নেমে আসেন শত শত নারী। ‘অনার কিলিং’ বা পারিবারিক সম্মান রক্ষায় মেয়েদের বলি চড়ানোর ঘটনা ইরাকে অহরহই ঘটে। দেশটির আইনও এ ধরনের অপরাধের অনেকটা পক্ষেই। ইরাকি দণ্ডবিধিতে পরিবারের সদস্যদের প্রতি সহিংসতাকে অনেকটা বৈধতা দেওয়া হয় যদি তা ‘সম্মান’-এর নামে করা হয়। যদি ‘উসকানি’ দেওয়ার ফলে সম্মান রক্ষায় হত্যা করা হয় বা অপরাধীর উদ্দেশ্য হয় নিজের সম্মান বাঁচানো, তাহলে ইরাকি দণ্ডবিধিতে শাস্তির মাত্রা কমে আসে। যেমনটা হয়েছে তিবার বাবার বেলায়। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, ইরাকি দণ্ডবিধির ৪১ নম্বর ধারায় বলা হয়েছে, ‘স্বামীর হাতে স্ত্রীর শাস্তি’ এবং ‘নির্দিষ্ট সীমারেখার মধ্যে কর্তৃত্বাধীন সন্তানকে পিতা-মাতার শৃঙ্খলায় রাখা’র আইনি অধিকার নিশ্চিত করা হয়েছে। এদিকে ৪০৯ ধারায় বলা হয়েছে, ‘কোনো পুরুষ যদি তাঁর স্ত্রীকে ব্যভিচারে লিপ্ত অবস্থায় হাতেনাতে ধরে ফেলেন বা তাঁর প্রেমিকাকে শয্যাসঙ্গীর সঙ্গে পান এবং তৎক্ষণাৎ তাঁদের বা যেকোনো একজনকে হত্যা করেন বা যেকোনো একজনকে আঘাত করেন এবং পরবর্তীকালে যেকোনো একজনের মৃত্যু হয়, তবে ওই পুরুষের তিন বছরের বেশি কারাবাসের শাস্তি হবে না।’
বাংলাদেশেও একই ধরনের ঘটনা ঘটেছিল সাত বছর আগে। নিজের পছন্দের ছেলেকে বিয়ে করেছিলেন টাঙ্গাইলের কালিহাতীর পারুল আক্তার। তাঁর বাবা সেই বিয়ে মেনে নেননি। পোশাক কারখানার কর্মী পারুল ও তাঁর স্বামী নাছিরের মাঝেমধ্যেই ঝগড়া হতো। বিয়ের তিন বছর পর ঝগড়া করে স্ত্রীকে বাসায় রেখে বেরিয়ে যান নাছির। পারুল তাঁর বাবাকে ফোন করে পারিবারিক অশান্তির কথা বলেন। বাবা মেয়েকে বলেন বাড়ি ফিরতে। অতঃপর নিজের ও পরিবারের সম্মানহানি করায় মেয়েকে হত্যার পরিকল্পনা করেন বন্ধুর সঙ্গে মিলে।
নারী অধিকারকর্মী ড. লেয়লা হুসেইন বিবিসিকে বলেন, ‘এই হত্যাগুলোর শিকড় নারীবিদ্বেষ এবং নারীর দেহ ও আচরণ নিয়ন্ত্রণের আকাঙ্ক্ষায় প্রোথিত।’ তিনি আরও বলেন, ‘অনার কিলিং’ বা সম্মান রক্ষায় হত্যা—বিষয়টি এ ধারণাকেই প্রতিষ্ঠিত করে যে নিহত নারীই নিজের মৃত্যুর জন্য দায়ী। কোনো ভুল বা লজ্জাজনক কাজ করেছেন বলেই তাঁর মৃত্যু হয়েছে।
টাঙ্গাইল থেকে বাবা জয়পুরহাটে নিয়ে যান মেয়ে পারুলকে। পাঁচবিবি এলাকায় একটি নদীর পাশে নির্জন জায়গায় রাতের অন্ধকারে গামছা পেঁচিয়ে শ্বাস রোধ করে হত্যা করে নদীতে ফেলে দেন মেয়ের লাশ। এরপর জামাইকে ফাঁসাতে একের পর এক মামলা করতে থাকেন। অবশেষে পিবিআইয়ের তদন্তে বেরিয়ে আসে বর্বরোচিত এ অপরাধ।
নারী অধিকারকর্মী ড. লেয়লা হুসেইন বিবিসিকে বলেন, ‘এই হত্যাগুলোর শিকড় নারীবিদ্বেষ এবং নারীর দেহ ও আচরণ নিয়ন্ত্রণের আকাঙ্ক্ষায় প্রোথিত।’ তিনি আরও বলেন, ‘অনার কিলিং’ বা সম্মান রক্ষায় হত্যা—বিষয়টি এ ধারণাকেই প্রতিষ্ঠিত করে যে নিহত নারীই নিজের মৃত্যুর জন্য দায়ী। কোনো ভুল বা লজ্জাজনক কাজ করেছেন বলেই তাঁর মৃত্যু হয়েছে। জাতিসংঘের হিসাব অনুযায়ী, বিশ্বজুড়ে প্রতিবছর পারিবারিক ‘সম্মান’ রক্ষার নামে পাঁচ হাজার নারী ও কিশোরীকে হত্যা করেন তাদের পরিবারের সদস্যরা।
তিবা কিংবা পারুলকে নিজের ইচ্ছায় জীবনযাপনের সিদ্ধান্তের চরম মূল্য দিতে হয়েছে। কিন্তু জর্ডানের কিফায়ার সঙ্গে যা ঘটেছিল, তা ভাবতে বাধ্য করে যে মেয়ে হিসেবে জন্ম নেওয়াই হয়তো অপরাধ। ১৬ বছরের এই স্কুলছাত্রীকে তারই এক ভাই ধর্ষণ করেন এবং পরিবারের জন্য অসম্মান বয়ে আনায় আরেক ভাই তাকে হত্যা করেন। জর্ডানিয়ান সাংবাদিক রানা হুসেইনি নিজ দেশে ‘অনার কিলিং’ নিয়ে কাজ করেছেন। একই সঙ্গে আইনি সংস্কারের জন্যও লড়েছেন তিনি। ২০২১ সালে আল-জাজিরার জন্য লেখা এক প্রতিবেদনে তিনি জানিয়েছিলেন, কিফায়ার গল্প কীভাবে তাঁকে এ লড়াইয়ে উদ্বুদ্ধ করেছে এবং তিনি সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, তিনি হয়ে উঠবেন সেই নারীদের কণ্ঠস্বর, যাঁরা নিজেদের গল্প বলার অধিকার পাননি। একই সঙ্গে তিনি এ ধরনের অপরাধের উৎস অনুসন্ধানের সিদ্ধান্ত নেন।
নারীর প্রতি সহিংসতার নমুনা লিপিবদ্ধ হয়েছে ইতিহাসের বিভিন্ন সময়। সব প্রাচীন সভ্যতাতেই নারীর ব্যভিচারের বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট দণ্ডবিধি রয়েছে। অথচ পুরুষের বহুগামিতা কিংবা উপপত্নী রাখার বিষয়টি অনেক সময় আভিজাত্য বা প্রাচুর্যের প্রতীক হিসেবে পরিগণিত হয়েছে। রানা হুসেইনি তাঁর প্রতিবেদনে প্রয়াত ড. ভিভিয়ান ফক্সকে উদ্ধৃত করেন, যিনি পরিবার ও নারীর ইতিহাস-গবেষক। ড. ফক্স বলছেন, ‘জুডেও-খ্রিষ্টান ধর্মমতে, গ্রিক দর্শনে ও সাধারণ পশ্চিমা আইনি দণ্ডবিধিতে পুরুষতন্ত্রকে প্রাকৃতিক মনে করা হয়, অর্থাৎ পুরুষের শ্রেষ্ঠত্বের ধারণা থেকে জন্ম নেয় পুরুষের আধিপত্য।’ জার্নাল অব ইন্টারন্যাশনাল উইমেনস স্টাডিজে তিনি লেখেন, ‘পুরুষের আধিপত্যের স্বাভাবিক অভিব্যক্তি হিসেবে নারীর প্রতি সহিংসতাকে দেখার বিষয়টি এসব মতবাদের ভিত্তিতেই সংস্কৃতির অংশ হিসেবে স্থায়িত্ব পেয়েছে।’
ঈশ্বরের আদেশে, পুরোহিতের সমর্থনে, আইনি বাধ্যবাধকতায় নারী সব সময় মেনে নিয়েছে এবং যখন দরকার পড়েছে, মানসিকভাবে সম্মত হওয়ার বিষয়টিকে ধারণ করেছে। আর এমন পরিবেশে নারীর প্রতি সহিংসতা ফুলেফেঁপে উঠেছে এবং এখনো উঠছে।
ম্যাথিউ এ গোল্ডস্টিন একজন ইতিহাসবিদ, যিনি রোমান সাম্রাজ্যে ‘সম্মান রক্ষায় হত্যা’র বিষয়টি নিয়ে গবেষণা করেছেন। এ ধরনের হত্যার গোড়ার কারণ এবং ‘সম্মান’-এর ধারণা ব্যাখ্যা করেছেন তিনি। তাঁর মতে, এ সম্মান হলো স্ত্রীর গর্ভে নিজ উত্তরাধিকারের জন্ম নিশ্চিত করতে পুরুষের আকাঙ্ক্ষা। নারীর কাঁধে এই ‘সম্মান’-এর ভার চাপিয়ে দিয়ে পুরুষ তাঁকে সহজে নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন এবং নিজের বংশধর সম্পর্কে নিশ্চিত হতে পারেন। মোদ্দাকথা হলো, নারীর অবদমন ও যৌনতা নিয়ন্ত্রণই হলো পুরুষের বংশগতি রক্ষার সহজতম উপায়। আর এ কারণেই বিভিন্ন সভ্যতা ও সংস্কৃতিতে ‘ভালো মেয়ে’র সংজ্ঞা নির্ধারিত হয় সতীত্ব ও আনুগত্যের ভিত্তিতে। নারী প্রথমে বাবা কিংবা ভাইয়ের অনুবর্তী, তারপর স্বামীর এবং শেষ বয়সে পুত্রের। আর নারীদেহ পুরুষের সম্মান বা বংশগতি রক্ষায় বরাদ্দপ্রাপ্ত। সে আর কন্যা নয়, ভগিনী নয়, স্ত্রী নয়, মা-ও নয়, নারী কেবল ‘সম্মান’। আর এ শব্দের দোহাই দিয়ে জঘন্যতম অপরাধও অনায়াসে করা যায়। শুধু তা–ই নয়, সেই অপরাধ করে পার পাওয়াও যায়। আর হাজার বছর ধরে নারীও এ সহিংসতার চক্রে বাঁধা; বেশির ভাগ ক্ষেত্রে তাঁরা মেনে নেন নিজের নিয়তিকে।