কোলাজ: আপন জোয়ার্দার
কোলাজ: আপন জোয়ার্দার

অবদমনই কি জাগিয়ে তুলছে প্রদর্শনকামিতা

হালের মেটা–দুনিয়াকে আমরা কী বলতে পারি—জনপরিসর, না ব্যক্তিগত পরিসর? জনপরিসর ও ব্যক্তিগত পরিসর একাকার হয়ে গেছে এখানে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে কেন আমরা হয়ে উঠেছি প্রদর্শনকামী?

সম্প্রতি ফেসবুক লাইভে এসে কীটনাশক খেয়ে আত্মহত্যা করার চেষ্টা করেন ভারতীয় এক কৌতুকাভিনেতা। জনপ্রিয় কৌতুকশিল্পী ও উপস্থাপক কপিল শর্মার সঙ্গে কাজ করেছেন তীর্থানন্দ রাও নামের এই অভিনেতা। তাঁর লাইভ দেখে বন্ধুরা পুলিশে খবর দেন এবং পুলিশ তাঁকে উদ্ধার করে। অভিনেতা দাবি করেন, তিনি দেনায় জর্জরিত, তাঁর হাতে কাজ নেই, প্রেমিকাও তাঁকে নিয়মিত ব্ল্যাকমেল করতেন।

এ ধরনের ঘটনা ইদানীং হরহামেশা ঘটছে। ফেসবুক লাইভে এসে মৃত্যুর প্রদর্শনী বা মেটা–দুনিয়ায় বলেকয়ে আত্মহননের ঘটনা উদ্বেগজনক হারে বাড়ছে। নিজেকে প্রকাশের এই চরম অভিব্যক্তি খুঁজে নেওয়ার পেছনের কারণগুলো কী হতে পারে?

সমাজবিজ্ঞানে দুটি শব্দবন্ধ ব্যবহৃত হয়—‘পাবলিক স্ফেয়ার’ ও ‘প্রাইভেট স্ফেয়ার’, যার বাংলা করলে দাঁড়ায় জনপরিসর ও ব্যক্তিগত পরিসর। জনপরিসর বলতে বোঝানো হয় সেই রাজনৈতিক পরিসরকে, যেখানে অচেনা ব্যক্তিদের মধ্যে চিন্তার মুক্ত ও অবাধ আদান–প্রদান ঘটবে। আর ব্যক্তিগত পরিসর হলো ব্যক্তির একান্ত তৎপরতার জায়গা। পাবলিক স্ফেয়ার বা জনপরিসরের নিজস্ব রাজনীতি রয়েছে। তবে সেই আলাপের বিস্তার অন্য সময় ঘটানো যাবে। এখন বরং ভাবা যাক হালের মেটা–দুনিয়াকে আমরা কী বলতে পারি—জনপরিসর, না ব্যক্তিগত পরিসর?

ভারতীয় কৌতুক অভিনেতা কপিল শর্মার সঙ্গে তীর্থানন্দ রাও (বাঁয়ে)

মেটা–দুনিয়া তো আবার ‘একের ভেতরে দুই’–এর মতো। ফলে এই পরিসরে আমরা যেমন চিন্তার লেনদেন করতে পারি, আবার একই সঙ্গে নিজের, এমনকি অন্যের গোপন ও ব্যক্তিগত জীবনও প্রকাশ করে দিতে পারি। ‘রামায়ণ’–এ মায়া হরিণের ছলে রাম-লক্ষণ ভুলে শিকারে বেরিয়ে যাওয়ার পর সীতা যেমন লক্ষ্মণরেখা অতিক্রম করেন, এবং সেই ফাঁকে আসে রাবণ, তেমনি এই মেটা–দুনিয়ার দুর্নিবার আকর্ষণেও আমরা অতিক্রম করে ফেলি আমাদের নিজস্ব লক্ষ্মণরেখা। তাতেই কি ঘটে রাবণের অনুপ্রবেশ?

এই রাবণেরও বহু চেহারা, বহু ছল। ব্যক্তির ভেতরের দ্বৈততাকে ভুলিয়ে–ভালিয়ে সে সামনে নিয়ে আসে। অস্তিত্ববাদের জনক ফরাসি চিন্তাবিদ জঁ পল সার্ত্রে বলেন, ‘মানুষ পেয়েছে মুক্তির সাজা।’ মুক্তিকে কেন সাজা বলছেন তিনি? তাঁর মতে, যুক্তিশীল মানুষ জানে, নিজ অস্তিত্বের দায়িত্ব তারই। সে যখন তার নিয়তির দ্রষ্টা হয়ে ওঠে, তখন তার চেয়ে একা আর কেউ নেই। আধুনিক মানুষ এই সময়ই অস্তিত্ব সংকটের মুখোমুখি হয়। পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্রের নানা দাবি মেটানোর ক্রমানুক্রমিক তাগিদের পাশাপাশি জাগতিক জীবনের আকস্মিকতার মাঝখানে জন্ম নেয় অর্থহীনতা। এই অর্থহীনতা থেকে হামাগুড়ি দিয়ে বেরিয়ে আসে অবসাদ। রাবণের মতো ক্ষণে ক্ষণে রূপ বদলানো এই অবসাদ ঠেলেও মানুষ কি নিজেকে প্রকাশ করতে চায়?

রামায়নের কাহিনি নিয়ে নির্মিত ‘আদিপুরুষ’ সিনেমায় রাবণের চরিত্রে সাইফ আলী খান। সিনেমাটি আগামীকাল ১৬ জুন মুক্তি পাচ্ছে

কিন্তু সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমকেন্দ্রিক মেটা–পৃথিবীতে প্রকাশও পেয়েছে ভিন্নমাত্রা। এখানে জনপরিসর ও ব্যক্তিগত পরিসরের সীমা ঘুচে যাওয়ায় ক্রমান্বয়ে প্রদর্শনকামী হয়ে উঠছে মানুষ। ‘এক্সিবিশনিজম’ বা প্রদর্শনকামিতাকে মানুষের একধরনের বিকৃত আচরণরূপে শনাক্ত করেছেন মনস্তত্ত্ববিদেরা। তাঁরা বলছেন, এ ক্ষেত্রে মানুষ যৌন উত্তেজনা বা আনন্দের জন্য নিজের গোপন অঙ্গ কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর সামনে প্রদর্শন করে। একাধিক নিরীক্ষায় দেখা গেছে, মানুষকে ভড়কে দেওয়া বা আরও মোটাদাগে বললে, মানুষের মনোযোগ কেড়ে নেওয়াই এখানে মুখ্য উদ্দেশ্য। বর্তমান মেটা–দুনিয়ায় নিজের গোপন জীবনের প্রকাশ ঘটানোর মধ্যে দিয়ে আমরাও কি সেই মনোযোগ কেড়ে নেওয়ারই প্রয়াস ঘটাই না?

মেটা–দুনিয়া তো আবার ‘একের ভেতরে দুই’–এর মতো। ফলে এই পরিসরে আমরা যেমন চিন্তার লেনদেন করতে পারি, আবার একই সঙ্গে নিজের, এমনকি অন্যের গোপন ও ব্যক্তিগত জীবনও প্রকাশ করে দিতে পারি।

যে প্রসঙ্গ দিয়ে লেখাটি শুরু করেছিলাম, এবার আসি সেখানে—মেটা–দুনিয়ায় মৃত্যুর বয়ানের প্রসঙ্গে। অস্তিত্ববাদীদের কাছে মৃত্যুর গুরুত্ব অপরিসীম। মৃত্যু অস্তিত্বের অন্ত নয়, বরং আত্মসচেতনতার পাঠ। আত্মহননই একমাত্র স্বাধীন সিদ্ধান্ত, যা মানুষ নিতে পারে। কেননা, অস্তিত্বশীল হওয়ার সিদ্ধান্ত সে নিতে পারে না। কিন্তু মরণ একই সঙ্গে একান্ত আর অন্তিম অভিব্যক্তি।

কিন্তু ক্রমাগত মনোযোগ কাড়ার প্রতিযোগিতায় এই একান্ত বিষয়টিকেও কি আমরা শেষ হাতিয়ার করে তুলছি? নাকি মানবজীবনের স্তরে স্তরে যে অবদমন, তার বিকৃত বহিঃপ্রকাশ এই প্রদর্শনকামিতা?