একটি ফুলকে বাঁচানোর জন্য যে যুদ্ধ, তা ৯ মাসের মাথায় শেষ হলো ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১–এ, পাকিস্তানি বাহিনীর আত্মসমর্পণের মধ্য দিয়ে। কেমন ছিল সেই স্বপ্নের ক্ষণ? মুক্তিযোদ্ধা ও জনমানুষের লেখা থেকে সেই স্বর্ণসময় খুঁজে দেখার চেষ্টা।
১৯৭১ সালের সেপ্টেম্বর মাসে লেখক ও কূটনীতিক কামরুদ্দীন আহমদকে গ্রেপ্তার করে পাকিস্তান সেনাবাহিনী। মুক্তিযুদ্ধে শহীদ হন তাঁর ছোট ছেলে নিজামুদ্দীন আজাদ। ১৬ ডিসেম্বর বিকেলে দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৭ ডিসেম্বর মুক্ত হন তিনি। তাঁর স্মৃতিতে বিজয়ের মুহূর্ত।
ইয়াহিয়া খানের বন্দিদশা কাটিয়ে যখন ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে বেরিয়ে এলাম, তখন বাইরে এসে যে বাংলাদেশকে দেখলাম, সে বাংলা আমার কাছে নতুন বাংলাদেশ। হাজার হাজার যুবকের আনন্দ–উল্লাসমুখর বাংলা। তাদের হাতে এমন সব আগ্নেয়াস্ত্র, যা আমি ইতিপূর্বে কখনো দেখিনি। তাদের নিকট গোলাবারুদও অফুরন্ত। আমি প্রথম দিকে একটু ভীত হয়ে পড়লাম। রাস্তার ওপারে যাওয়ার সময় মনে হচ্ছিল, এই বুঝি গুলি এসে লাগল। রাস্তা অতিক্রম করে হাঁপিয়ে গেলাম। বাড়ি থেকে গাড়ি আসেনি। খুব একটা আশাও করিনি। জেলগেটে পৌঁছার আগে অবশ্য আশা করেছিলাম, আমার ছোট ছেলে আজাদ (শহীদ নিজামুদ্দীন আজাদ) যদি মুক্তিযুদ্ধ থেকে ফিরে এসে থাকে, তবে নিশ্চয়ই আমাকে স্বাগত জানাতে গাড়ি নিয়ে আসবে। কিন্তু গেটের বাইরে এসে যখন তাকে দেখলাম না, তখন কেন যেন মনে হলো, হয়তোবা আজাদ হারিয়ে গেছে চিরতরে। দাঁড়িয়ে ভাববার সময় নেই। কারণ, হাজার কয়েক কয়েদি তাঁদের জেলের পোশাক ছিঁড়ে ফেলে পাগলের মতো ছুটে যাচ্ছেন যাঁর যেদিকে খুশি। বোধ হয় অন্তরে তাঁদের তখনো ভয়, যদি আবার তাঁদের আটক করা হয়! নিরাপত্তা–বন্দীদের ঘরে ঢুকে তাঁদের জামাকাপড়, বিছানাপত্তর, জুতা–মোজা, বাড়ি থেকে আনা নানা প্রকার খাবার বস্তু—যে যা হাতের কাছে পেয়েছেন, লুট করছেন। জেলের কর্মচারীরা কোথায় লুকিয়েছেন, সেপাইরা প্রাণভয়ে কোথায় পালিয়ে গেছেন! পাগলাগারদের দরজা খুলে পাগলেরাও বেরিয়ে এসেছেন। বাইরে এসেই আবার জেলের মধ্যে ঢোকার চেষ্টা করছেন। রাজাকারেরা পালিয়ে যাওয়ার সময় তাঁদের রাইফেলগুলো রাস্তার দুই পাশে ড্রেনে ফেলে গেছেন আর চোর-ডাকাত প্রভৃতি সদ্যোমুক্ত দুর্ধর্ষ কয়েদিরা তা তুলে নিচ্ছেন।
...বাড়িতে ফেরার পথে দুই পাশের বাড়িগুলোর ওপর দেখলাম ঝান্ডা উড়ছে। ৯ মাস পূর্বে স্বাধীনতাসংগ্রামের সময়, বিশেষ করে ২৩ মার্চ যে ঝান্ডা প্রথম ওড়ানো হয়েছিল, সে ঝান্ডাই ওড়ানো হয়েছে। ভাবলাম, কোথায় পেলেন তাঁরা দুই দিনের মধ্যে এত পতাকা! এ-ও কি সম্ভব! যে পতাকাগুলো তৈরি হয়েছিল ঘরে ঘরে ওই ৯ মাস ধরেই, সেগুলো লুকিয়ে রাখা হয়েছিল দীর্ঘ ৯ মাস, ধরা পড়লে অনিবার্য মৃত্যু জেনেও। যেসব বাড়ির গেটে উর্দু নামফলক ছিল বা আরবি ‘আল্লাহ’, ‘মুহম্মদ’ বা ‘কলেমা’ লেখা ছিল, তা দেখলাম বাড়ির লোকেরা বেরিয়ে এসে সরিয়ে নিচ্ছিলেন। আর তার পরিবর্তে পুরোনো বাংলা নামফলক লাগিয়ে দিচ্ছেন। ঢাকা শহরের চেহারাই বদলে গেছে বলে মনে হলো। যে ঢাকা আমি জন্মাবধি দেখেছি, এ যেন সেই ঢাকা নয়।
পাকিস্তান হওয়ার পর থেকেই ঢাকা শহরের পরিবর্তন লক্ষ করা যাচ্ছিল, কিন্তু সে পরিবর্তন এসেছিল ধীরে ধীরে। এবারের পরিবর্তন একেবারেই আলাদা। পাকিস্তান হওয়ার পর ঢাকায় ঘোড়ার গাড়ির পরিবর্তে রিকশা হয়েছিল, কুর্তা-পায়জামার পরিবর্তে প্যান্ট-শার্টের প্রচলন হয়েছিল। আর অনেক ইটের খোলার রাস্তা পিচ দেওয়া রাস্তায় পরিবর্তিত হয়েছিল। সেই সঙ্গে কিছু ট্যাক্সি, বাস ও প্রাইভেট কারও এসেছিল। কিন্তু সে পরিবর্তন স্বাভাবিকভাবেই হয়েছিল বলে মনে হয়েছে। এবারের পরিবর্তন কিন্তু একেবারে আলাদা। আফগানিস্তান ও পাকিস্তানের সংলগ্ন ট্রাইবাল অঞ্চলে অনেকের হাতেই বন্দুক দেখলেও অস্বাভাবিক মনে হয় না। কিন্তু ঢাকার রাস্তায় হাজার হাজার ছেলের হাতে নানা ধরনের আগ্নেয়াস্ত্র অস্বাভাবিকই মনে হচ্ছিল। বুঝতে অসুবিধা হচ্ছিল না যে আদেশ দেওয়ার যেমন কেউ নেই, তেমনি আদেশ মেনে নেওয়ারও কোনো বাধ্যবাধকতা নেই। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এমন ধরনের অরাজকতা বর্তমান শতাব্দীতেও এসেছে। যেমন সাইপ্রাস থেকে ব্রিটিশ সরকার দেশটা চালানোর কোনো ব্যবস্থা না করেই যখন প্রশাসনিক কাজে নিযুক্ত তাঁদের লোকজন তুলে নিয়ে গেলেন, তখন যে নৈরাজ্যের সৃষ্টি হয়েছিল, তা আজও সাইপ্রাসবাসীরা ভোলেনি। এমন কোনো বাড়ি ছিল না যে বাড়ি লুণ্ঠিত হয়নি, এমন কোনো নারী ছিল না, যার ওপর পাশবিক অত্যাচার করা হয়নি। ব্রিটিশ যখন একইভাবে প্যালেস্টাইন ছেড়ে গিয়েছিল বা ফরাসিরা যখন আলজেরিয়া ছেড়ে এসেছিল, তখন অতখানি না হলেও সেখানকার মানুষগুলো প্রায় পশুর পর্যায়ে নেমে এসেছিল। যেমন হয়েছিল ১৯৪৬-৪৭ সালে ভারত উপমহাদেশে ব্রিটিশরাজের যাওয়ার প্রাক্কালে, বিশেষ করে উত্তর ভারতে। হাজার হাজার মেয়েদের উদ্ধার করেছিলেন মৃদুলা সারা ভাই—পশ্চিম ও পূর্ব পাঞ্জাব থেকে। স্বাধীনতার কয়েক বছর পরও ওই উদ্ধারকাজ চলছিল।
কিন্তু বাংলাদেশে যখন কোনো সরকারের অস্তিত্ব ছিল না, তখনো মুক্তিবাহিনীর লোক ওই পরিস্থিতির সুযোগ গ্রহণ করেছে বলে আমি শুনতে পাইনি। মুক্তিবাহিনীর হাতে রাজাকারেরা খুন হয়েছেন; কিন্তু তাঁদের স্ত্রী-কন্যাকে কেউ ধর্ষণ করেছেন—এমন উদাহরণ নেই।
ভাবলাম, কোথায় পেলেন তাঁরা দুই দিনের মধ্যে এত পতাকা! এ-ও কি সম্ভব! যে পতাকাগুলো তৈরি হয়েছিল ঘরে ঘরে ওই ৯ মাস ধরেই, সেগুলো লুকিয়ে রাখা হয়েছিল দীর্ঘ ৯ মাস, ধরা পড়লে অনিবার্য মৃত্যু জেনেও।
...বাংলাদেশের সাধারণ মানুষ যে কত আদর্শবান হতে পারে এবং সমাজ ও মানুষের জন্য কতটা ত্যাগ স্বীকার করতে পারে, সে সম্বন্ধে আরও জ্ঞাত হলাম, যখন আমার স্ত্রী ছেলেমেয়ে নিয়ে গ্রাম থেকে ফিরে এলেন বাড়িতে আমার মুক্তির সপ্তাহখানেক পর। তাঁর মুখে শুনলাম, বাঙালি জাতির মহানুভবতার কথা। গরিব গৃহস্থরা পর্যন্ত নিজেদের ঘর ছেড়ে দিয়েছেন তাঁদের জন্য। শহরের তোপের মুখ থেকে যাঁরা সর্বস্ব হারিয়ে কেবল জীবন নিয়ে পালিয়ে এসেছেন, তাঁদের জন্য গ্রামের সাধারণ মানুষ দিয়েছেন আহার ও বাসস্থান। তাঁদের নিরাপত্তার জন্য নিজেদের জীবন বিপন্ন করতেও পরান্মুখ হননি। সমস্ত খাবার আশ্রিতদের খেতে দিয়ে নিজেরা অভুক্ত থেকেছেন। যাঁর নৌকার দরকার, তাঁকে নৌকা জোগাড় করে দিয়েছেন। আবার নৌকার মাঝিরাও ভাড়ার টাকাও নিতে চাননি তাঁদের কাছ থেকে।
...আর একটি পরিবর্তন আমার দৃষ্টিগোচর হলো, যেটি হচ্ছে, যুব সম্প্রদায়ের মধ্যে চেহারার পরিবর্তন। ছেলেরা গোঁফ-দাড়ি-চুল অযত্নে বড় হতে দিচ্ছে। মনে হয় এই যেন জঙ্গল থেকে গেরিলা যুদ্ধ করে তারা বেরিয়ে এল। সাধারণত গেরিলারা যেখানে জঙ্গলে থাকে, সেখানে সভ্যতার প্রবেশ নিষিদ্ধ।
...রিকশায় বাড়ি ফেরার সময় রাস্তায় দুই পাশের ড্রেনে বেশ কয়েকটি মৃতদেহ পড়ে থাকতে দেখলাম। কেউ তুলে নেয়নি। তার অর্থ বেশ কয়েক দিন ধরে পৌরসভার কাজকর্ম বন্ধ আছে। রাস্তার চারদিকে তাকাচ্ছিলাম যদি কোনো পরিচিত মুখের সন্ধান পাওয়া যায়, কিন্তু পরিচিত কাউকেই দেখলাম না। চারদিকে তরুণদের কণ্ঠে ভেসে আসছে ‘জয় বাংলা’ ধ্বনি। বয়স্কদের রাস্তায় বড় একটা দেখলাম না। কারণ বোধ হয় যেভাবে ঘরে ফেরা মুক্তিযোদ্ধাদের গোলাগুলির আওয়াজ চলছিল, তাতে স্বাভাবিকভাবেই তাঁরা ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে পড়েছিলেন এবং ঘরের ভেতর থাকাই নিরাপদ মনে করছিলেন।
বাড়ি পৌঁছে দেখলাম, আমার বাড়ির ছাদেও বাংলাদেশের পতাকা উড়ছে। কে তুলেছিল, তা আজও জানতে পারিনি। আমার বাড়িতে কেউ ছিল না। ডিসেম্বরের ৪ তারিখে ডেপুটি জেলার সাহেব আমাকে জানিয়েছিলেন যে আমার স্ত্রী তাঁকে টেলিফোন করে জানিয়েছেন, সে সবাইকে নিয়ে শহর ছেড়ে চলে গেছে এবং খবরটি আমাকে জানাতে বলেছে। কোথায় গেছে, তা বলে যায়নি। পাকিস্তানি বাহিনী ৪ তারিখে ঘণ্টা দুয়েকের জন্য কারফিউ তুলে নিয়েছিল। সেই সুযোগে তারা বেরিয়ে পড়েছিল। জেল থেকে বেরিয়েই বুঝেছিলাম, আমার ছোট ছেলে আজাদ আর ফিরে আসেনি। পরে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ইউনিয়নের ছেলেদের মুখে শুনেছিলাম, আজাদ ও তার বন্ধুরা কুমিল্লার চৌদ্দগ্রাম থানার বেতিয়ারা গ্রামে পাকিস্তানি বাহিনীর সঙ্গে সম্মুখযুদ্ধে নিহত হয়েছে। অবশ্য সে খবর পেয়েছিলাম ১৯ তারিখে। ১৭ তারিখে আমি যখন ঘরে ফিরলাম, তখন দেখলাম, বাড়িঘর–জিনিসপত্র—সব তছনছ ও লন্ডভন্ড। অনেক কিছুই লুটপাট হয়ে গেছে। আমার একটি ছোটখাটো লাইব্রেরি ছিল, যার মধ্যে ছিল বহুদিনের জমানো বইপুস্তক। তার একটিও অবশিষ্ট নেই। রাজনীতির প্রতি বরাবরই আমার আকর্ষণ ছিল। তাই ১৯৩৭ থেকে ১৯৭০ সাল পর্যন্ত অনেক কাগজপত্র জমা করেছিলাম। কিছু লিফলেট, প্যাম্ফলেট, বিভিন্ন পার্টির কর্মসূচি—সবই হারিয়ে গেছে চিরদিনের জন্য। বিশ্বের অনেক নামজাদা লোকের সঙ্গে যে ছবিগুলো ছিল, সেগুলোও নেই। বিছানাপত্র, জামাকাপড় পেছনের বাগানে নিয়ে পেট্রল দিয়ে পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু আশ্চর্য যে গাড়িটি গ্যারেজের মধ্যেই তালাবদ্ধ অবস্থায় রয়েছে, কেউ খোলার চেষ্টাও করেনি। গাড়িটি নতুন, ১৯৭০ সালের মডেল ১৯৭১ সালে আমদানি করা হয়েছিল। বোঝা গেল, যারা লুটপাট করেছে, তাদের গাড়ির প্রতি কোনো আগ্রহ ছিল না। তবে যা নষ্ট হয়েছে, তা আর বাকি জীবনে কোনো দিনই ফেরত পাব না।
কামরুদ্দীন আহমদ ছিলেন সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের অন্যতম সদস্য। ১৯৫৪ সালের যুক্তফ্রন্টের নির্বাচনী কার্যক্রমেও এই লেখকের ভূমিকা ছিল। তাঁর গুরুত্বপূর্ণ বইয়ের মধ্যে রয়েছে বাংলার এক মধ্যবিত্তের আত্মকাহিনি ও বাংলার মধ্যবিত্তের আত্মবিকাশ। বাঙালি জাতীয়তাবাদে বিশ্বাস করার কারণে ১৯৭১ সালের সেপ্টেম্বরে তাঁকে আটক করে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী। চার মাস তিনি কারাগারে কাটান। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর মুক্ত হন ১৭ ডিসেম্বর। মুক্তি পেয়ে যা দেখেছেন, সেই স্মৃতি তিনি লিখেছেন স্বাধীন বাংলার অভ্যুদয় এবং অতঃপর [ধ্রুপদ সাহিত্যাঙ্গন, ঢাকা, ২০১৮] গ্রন্থের ‘স্বাধীন বাংলার অভ্যুদয়’ অংশে। সেই বই থেকে নির্বাচিত অংশ।