‘আদিম’ সিনেমার দৃশ্য
‘আদিম’ সিনেমার দৃশ্য

‘আদিম’ কি সিনেমা, না বাস্তব চিত্র?

যুবরাজ শামীম পরিচালিত চলচ্চিত্র ‘আদিম’। সিনেমাটি যেন বাস্তবের চেয়ে বেশি বাস্তব।

কেউ যদি বলেন, ‘আদিম’ কোনো সিনেমা নয়, আমি তাঁর সঙ্গে একমত। তবে তার সঙ্গে যোগ করতে হবে এই কথা যে এটা একটা সিনেমা রূপের বাস্তব চিত্র, বাস্তব রূপের সিনেমা নয়। কেননা এই সিনেমা দেখলে মনে হবে, এখানে কেউ অভিনয় করেননি। যে যাঁর মতো কথা বলেছেন, গান গেয়েছেন, বসেছেন, খেয়েছেন, হেসেছেন, ঘুমিয়েছেন, সিগারেট ফুঁকেছেন, গালি দিয়েছেন, ঝগড়া করেছেন। মনে হয়েছে, পরিচালক শুধু চিত্রগ্রাহকের মাধ্যমে কখনো এই কোনা, তো কখনো ওই কোনা থেকে যখন যেভাবে পারেন, বাস্তবের কাণ্ডকারখানার চিত্র ধারণ করে গেছেন; যেন এখানে কোনো ক্যামেরা কখনোই ছিল না। কাউকে কিছু দেখানোর প্রয়োজনও ছিল না। ঘুমাতে যাওয়ার ভঙ্গি, দৌড়ের ভঙ্গি, ঝগড়ার ভঙ্গি, বসার ভঙ্গি, তাকানোর ভঙ্গি—এগুলো এতটাই স্বাভাবিক যে মনে হবে না কোনো সিনেমা দেখছি।

‘আদিম’-এর পরিচালক মনে হয় সিনেমা বানাতে চেয়েছিলেন। কিন্তু কাজ শুরু করে তিনি হয়তো স্থানীয় মানুষদের ভেতর এমন সব শিল্পী পেয়ে গেছেন যে তাঁর আর কোনো অভিনেতা দরকার হয়নি। এমন সব জায়গায় গিয়ে কাজ করেছেন, যেখানে এমনিতেই পরিবেশ তৈরি হয়েছিল। তিনি শুধু এর মধ্যে দুই–একজনকে বলেছেন এদিক–ওদিক যেতে। একটু হয়তো বলেছেন, ‘ভাই, সিগারেটে টান দেন।’ ‘পা–টা একটু কাৎ করেন ভাই।’ এর মধ্য দিয়ে হয়তো একটা শিশু এদিক থেকে ওদিক যাচ্ছে; যেন এখানে কোনো পরিচালক নেই, ক্যামেরা নেই।

যুবরাজ শামীম পরিচালিত ‘আদিম’ সিনেমার দৃশ্য

আমাদের আশপাশের রাস্তাঘাটে, স্টেশনে, ট্রেনে, বাসে, গলিতে, মোড়ে যেসব নামহীন মানুষ শহরের সঙ্গে অদৃশ্য সম্পর্ক গড়ে তুলেছে, তাঁদের মধ্যে কেউ আছে মুঠোফোনচোর, কেউ মুদি দোকানের কর্মচারী, কেউ মাদক বিক্রেতা, অলিতে–গলিতে ছোট ছোট কারখানায় কাজ করা দিন আনা দিন খাওয়া শ্রমিক, শিশু দিনমজুর, নেশাগ্রস্ত কিশোর, তথাকথিত পাগলরূপী ভিখারি, গৃহহীন ল্যাংড়া, যাঁদের কোনো নির্দিষ্ট পেশা নেই। নামহীন মানুষদের সঙ্গে রয়েছে নামহীন কুকুর, যাদের ইচ্ছা করলে লাথি দিয়ে রাগ–ক্রোধের সাময়িক অবসান ঘটানো যায়। ‘আদিম’ সিনেমায় এ ধরনের মানুষদের দেখা যায়, যাঁদের কোথাও কিছু ঠিক নেই। আজ আছে তো কাল নেই। যেন বর্তমানের সঙ্গে তাঁদের সহবাস। গলি–ঘুপচি আছে, ট্রেন আছে, যাত্রী আছে; কিন্তু গন্তব্য নেই। কোথাও কোনো আকাশ নেই।

‘আদিম’–এর পরিচালক মনে হয় সিনেমা বানাতে চেয়েছিলেন। কিন্তু কাজ শুরু করে তিনি হয়তো স্থানীয় মানুষদের ভেতর এমন সব শিল্পী পেয়ে গেছেন যে তাঁর আর কোনো অভিনেতা দরকার হয়নি। এমন সব জায়গায় গিয়ে কাজ করেছেন, যেখানে এমনিতেই পরিবেশ তৈরি হয়েছিল।

এই বাস্তব চিত্র তো আমরা সব সময়ই দেখি। তাহলে এই ‘আদিম’ নামের সিনেমার বিশেষত্ব কী? বিশেষত্ব হচ্ছে, যা আমরা তাকিয়ে দেখি, কিন্তু আসলে দেখে উঠতে পারি না, তার স্বরূপ দেখতে পাওয়া যায় এই সিনেমায়। ধরুন, আমরা জানি, দারিদ্র্য ও বঞ্চনার ইতিহাসে সব শ্রেণির মানুষ, প্রকৃতি, জীব মিলিত হয়ে যে বাস্তুতন্ত্র গঠন করেছে, তার মধ্যে তৈরি হয়েছে একটি শৃঙ্খলা; যেখানে আধিপত্য, লড়াই, সংগ্রাম, শক্তিচর্চা বিদ্যমান। এই শৃঙ্খলা প্রতিদিন বিঘ্নিত হলেও প্রাকৃতিক নিয়মে বিভিন্ন ধরনের প্রতিক্রিয়া প্রতিদিন তার অস্তিত্বকে আবার আরেকটি স্থিতাবস্থায় নিয়ে আসে। এই অবস্থা গত দিনের স্থিতাবস্থা থেকে ভিন্ন হতে পারে, কিন্তু বাস্তুতন্ত্রের মানচিত্রে প্রতিটি প্রাণ তার নিজস্ব বৈশিষ্ট্য নিয়ে ক্রিয়া–প্রতিক্রিয়ায় সক্রিয়ভাবে উপস্থিত থাকে। কিন্তু কীভাবে তা হয়, সেটি দেখা যায় না। এই সিনেমায় গরিবের এক আংশিক বাস্তুতন্ত্রের সন্ধান মেলে। এখানে মনে হয় যেন রাষ্ট্র, রাষ্ট্রযন্ত্র বলে কিছু নেই। আবার আছেও। পরিচালক খোলা আকাশের নিচে ঘুমন্ত মানুষকে দেখাননি। বৃষ্টি আনেননি, শীত দেখাননি, কষ্ট পেতে দেখাননি। সবই ঢেকে দিয়েছেন ঘুমানোর সময় এককাপড় দিয়ে। কিন্তু দেখিয়েছেন স্টেশনের বেঞ্চে, রেললাইনের পাশের পরিত্যক্ত খোলা জায়গায় ঘুমাতে, ঘুমানোর জায়গা নিয়ে গণ্ডগোল পাকাতে, ঘুমের মধ্যে এমনকি স্বপ্ন দেখতে। এ যেন শুধু ঘুম। গরিবের ঘুম। গরিবের একমাত্র আয়েশের কাজ। আর রাষ্ট্র উপস্থিত ট্রেনের আসা–যাওয়ায়, দুর্মূল্যের বাজারে, বস্তির মানুষের গানের কথায়, নেশায় বুঁদ হয়ে ইহজগতের বঞ্চনা ও যন্ত্রণা ভুলে যাওয়ায়।

‘আদিম’ সিনেমায় রাস্তাঘাটে, স্টেশনে, ট্রেনে, বাসে, গলিতে, মোড়ে যেসব নামহীন মানুষ শহরের সঙ্গে অদৃশ্য সম্পর্ক গড়ে তুলেছে, তাঁদের মধ্যে কেউ আছে মুঠোফোনচোর, কেউ মুদি দোকানের কর্মচারী

এই সিনেমার আরেকটি বৈশিষ্ট্য হলো, পরিচালক একটি গতিশীল প্রক্রিয়ায় চিন্তাভাবনা করে চরিত্রগুলোর রূপ দিয়েছেন। মনে হয়েছে, যেন পূর্বনির্ধারিত কোনো নিয়ম বা স্ক্রিপ্ট মেনে তিনি কাজ করেননি। যদিও কাহিনির পরিবর্তন হয়নি তাতে। হয়তো যখন যেখানে যাঁকে দিয়ে যা বলাতে পেরেছেন, তা–ই বলিয়েছেন। কিছু কিছু ঝগড়া কিছুটা আরোপিত মনে হলেও বেশির ভাগ চিত্রে স্বাভাবিকতা ছিল।

তবে ‘আদিম’–এর বিশেষত্ব কিন্তু শুধু কাহিনিতে নয় বা শুধু চরিত্র নির্মাণেও নয়। এর বিশেষত্ব সামগ্রিকতায়। মূল চরিত্র আসলে তিনজন—নেশাগ্রস্ত কালা, তার বউ সোহাগী আর তার প্রতি আকৃষ্ট ল্যাংড়া। এসব চরিত্রই মূলত ঘটনাকে এগিয়ে নিয়ে গেছে। কিন্তু পার্শ্বচরিত্রগুলোও ছিল একই রকম শক্তিশালী। মনে দাগ কাটার মতো চরিত্র ও তার প্রতিক্রিয়া এসব পার্শ্বচরিত্রেও পাওয়া যাবে। পার্শ্বচরিত্রগুলো আসলে মূল প্রেক্ষাপট তৈরি করে দিয়েছে। এসব চরিত্র না থাকলে মূল চরিত্রগুলো কেন্দ্র করে ঘটা ঘটনা দিয়ে এই গভীর বাস্তুতন্ত্রে শ্রেণির ভেতরে শ্রেণির বিন্যাস যেমন বোঝা যেত না, তেমনি বোঝা যেত না মানুষের চিরন্তন ছুটে চলার গল্প।

‘আদিম’ সিনেমার দৃশ্য

‘আদিম’ ছবিতে কোনো মধ্যবিত্তকে দেখা যায়নি। দেখা যায়নি কোনো মাফিয়া চক্র বা উচ্চবিত্তকে। অথবা বলা ভালো, রাতের অন্ধকারে তাদের মুখমণ্ডল ঢাকা থাকে, যেমন থাকে বাস্তব জগতে। শহরের সঙ্গে চরিত্রগুলোর সম্পর্কটাই তাদের উপস্থিতিকে জানান দিয়েছে। যদিও গল্পটা খুবই সাধারণ। কিন্তু পুরো বাস্তুতন্ত্রের মানচিত্রে সম্পর্কগুলো যেভাবে বিস্তার লাভ করে, তাতে ভিন্ন শ্রেণির উপস্থিতি ছাড়াই বোঝা গেছে গরিবের গরিবত্ব কোনো গায়েবি ব্যাপার নয়। মাজারে গানের আসর, নেশায় বুঁদ হয়ে থাকা—এসব কোনো কিছুই আকাশ থেকে পড়া কোনো গরিবি সংস্কৃতি নয়। গরিবের মধ্যকার শ্রেণিবিদ্বেষ, ঈর্ষা, স্বার্থপরতা, কামড়াকামড়ি মনে করিয়ে দিয়েছে পুরো সমাজের মধ্যকার কামড়াকামড়িকে। বিশেষ করে কুকুরের গায়ে লাথিটা, বঞ্চনার ক্ষোভটা আর তা থেকে খুনখারাবি—এগুলো দিয়ে পরিচালক যে অনুক্রম দেখিয়েছেন, তার শুরু কোথায় আর শেষ কোথায়—এই প্রশ্ন এখানে মুখ্য হয়ে উঠেছে।

‘আদিম’ সিনেমার দৃশ্য

যুবরাজ শামীমের কাহিনি, চিত্রনাট্য, সম্পাদনা ও পরিচালনায়, আমির হামজার সিনেমাটোগ্রাফিতে এবং সুজন মাহমুদের শব্দ সম্পাদনায় নির্মিত হয়েছে ‘আদিম’। এ রকম সিনেমা আর দ্বিতীয়টি বানানো সম্ভব নয় বলেই মনে হয়েছে আমার। অর্থাৎ, শুধু কাহিনি, ফ্রেমিং আর বক্তব্য থাকলেও ঠিক এ রকম সিনেমা আরেকটি বানানো সম্ভব নয় যাঁদের কারণে, তাঁরা হচ্ছেন এর অভিনয়শিল্পী। হয়তো এমন শিল্পীও পাওয়া যাবে ঢের। কিন্তু এমন পরিচালক, চিত্রনাট্য, ও শিল্পীর সম্মিলন দুর্লভ।

খুব হতাশ হয়েছিলাম, যখন দেখলাম এমন একটি সিনেমার একটা প্রদর্শনী শুধু দুপুরবেলা এমন সময়ে রয়েছে, যখন কর্মজীবী বা শিক্ষার্থীরা কেউই দেখতে যেতে পারবেন না। তবে আশার ব্যাপার এই যে মস্কো আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে গেছে সিনেমাটি। আশা করি, সিনেমাটি বাংলাদেশে আরও অনেক মানুষের কাছে পৌঁছাবে ভবিষ্যতে।