আজ কবি আল মাহমুদের জন্মদিন। তাঁকে নিয়ে অনেক দ্বিধা কাজ করে আমাদের। এই দ্বিধার পেছনের কারণগুলো কী? স্বাধীন বাংলাদেশে কেন দিন দিন নিঃসঙ্গ হয়ে পড়েছিলেন ‘সোনালি কাবিন’-এর এই কবি? জন্মদিনে তাঁর কবিতা ও গদ্যের অনুষঙ্গে প্রশ্নগুলোর সুলুকসন্ধান।
বাংলাদেশের প্রধান কবি হয়েও মূলধারার কবিদের সঙ্গে আল মাহমুদের (১৯৩৬-২০১৯) তফাতটা কোথায়, তা কবিতা দিয়েই বোঝা সম্ভব। কিন্তু স্বাতন্ত্র্য, তফাত, পার্থক্য আর একঘরে হওয়া বা একঘরে করা এক বিষয় নয়। বাংলাদেশের সাহিত্য, বিশেষত কবিতা বাংলাদেশের রাজনীতির সমান্তরালে বিকশিত। ফলে বাংলাদেশের যা কিছু মূলধারার বয়ান হিসেবে প্রতিষ্ঠিত, কবি-লেখক-শিল্পীরা তা থেকে বিচ্ছিন্ন নন। অর্থাৎ মূলধারার বয়ানকে যাঁরা সাহিত্যে ধারণ করতে পারেন, তাঁরাই মূলধারার সাহিত্যিক হিসেবে প্রতিষ্ঠা পেয়ে যান—তা সে প্রধান বা অপ্রধান যা-ই হোক। কিন্তু ‘লোক লোকান্তর’, ‘কালের কলস’, ‘সোনালি কাবিন’-এর আল মাহমুদকে অপ্রধান বলার সুযোগ এখন পর্যন্ত ঘটেনি।
তারপরও সাহিত্যের বাজারে আল মাহমুদ দীর্ঘদিন ছিলেন নিঃসঙ্গ ও একাকী। এর শেষ চিহ্ন হয়ে থাকে তাঁর মৃত্যুর পর কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার প্রাঙ্গণে শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্য মরদেহ না নিয়ে আসতে পারার ‘রাজনীতি’। আল মাহমুদের সঙ্গে মূলধারার এই বৈরিতা বোঝার জন্য তাই তাঁর কবিতা ছাপিয়ে গদ্যপাঠও প্রাসঙ্গিক হয়ে ওঠে। যে কবি কবিতায় বলেন: ‘ফেব্রুয়ারির একুশ তারিখ/ দুপুর বেলার অক্ত/ বৃষ্টি নামে, বৃষ্টি কোথায়?/ বরকতের রক্ত।’, সেই কবিই গদ্যে যখন লেখেন ‘ফেব্রুয়ারি: সাংস্কৃতিক মাস্তানির মাস’, তখন তাঁর গদ্যকে আর নিরীহ বিষয় বলা যায় না। গদ্যের ভেতর দিয়ে তিনি যে বাংলাদেশকে পাঠ করতে চেয়েছেন, সেই পাঠও সরলরৈখিক থাকে না; বরং তৈরি হয় পাঠান্তর। আল মাহমুদের গদ্যরচনাগুলোকে কতখানি প্রবন্ধ বলা যায়, তা নিয়েও কথা আছে। তাঁর প্রবন্ধ হিসেবে পরিচিত বেশির ভাগ গদ্য সংবাদপত্রের কলাম, সম্পাদকীয় ও সভার বক্তৃতা হিসেবে লিখিত ও পুনর্লিখিত। আকারেও দীর্ঘ নয়। তবে সংবাদপত্রে প্রকাশিত হওয়ার ফলে যে তাৎক্ষণিকতার সৃষ্টি হয়, তারও একটা আবেদন থাকে—চলতি সময়কে দ্রুত ধারণ করা। কাজী নজরুল ইসলামের প্রবন্ধ ও গদ্য রচনার মধ্যেও এই প্রবণতা দেখা যায়।
আল মাহমুদের কবিতার শরীরে যেমন, তেমনি সাহিত্যচিন্তার কেন্দ্রেও থাকে বাংলাদেশ। সেই বাংলাদেশ কেমন? আল মাহমুদের বাংলাদেশের পাঠ অপরাপর গদ্য-উচ্চারণের মতোই স্পষ্ট ও সোজা, ‘১৯৪৭ সালে তৎকালীন ব্রিটিশ শাসিত ভারত বিভক্ত হয়ে গেলে বাংলার ভাটি অঞ্চলের যে অংশের নাম হয় পূর্ব পাকিস্তান, তা অনন্তকাল ধরেই নিজেদের অ-ভারতীয় ও অনার্য জাতি বলে গর্ববোধ করে এসেছে। এই গর্ববোধই প্রথমে ভাষা আন্দোলন, পরে সার্বভৌম বাংলাদেশের জন্ম দিয়েছে।’ এই পাঠ এখন পর্যন্ত বাংলাদেশের মূল বয়ানেরও পাঠ। তবে তাঁর এই পাঠে যুক্ত হয় ভারত–সাপেক্ষতার বিপরীত পাঠ। এই পাঠকে অস্বীকার করার জো নেই; যদিও কথাগুলো যখন বলেন আল মাহমুদ, তখন জাতীয়তাবাদী বয়ানের ভ্রু খানিকটা কুঞ্চিত হয়ে ওঠে। ‘বাংলাদেশের সাহিত্য’ বা ‘বাংলাদেশের কবিতা’ বলে যে বর্গ এখন অনেকটাই সুচিহ্নিত, এই চিহ্নায়নের পথও ততটা মসৃণ ছিল না। সাতচল্লিশ-পরবর্তী ঢাকাকেন্দ্রিক সাহিত্যই বাংলাদেশের সাহিত্য—এই পরিচয় সব সময় একমাত্রিক ছিল না। সাতচল্লিশ-পরবর্তী রাজনৈতিক পরিবর্তন কীভাবে সাহিত্যধারাকে স্বতন্ত্র করে তোলে, তা নিরূপণের জন্য অনেককেই স্বতন্ত্র স্বরে কথা বলতে হয়েছে দীর্ঘদিন। এই স্বরে জাতিসত্তা সন্ধান, স্বাদেশিকতা, ভাষাবোধ ও জাতীয়তার চেতনার সঙ্গে কখনো যুক্ত হয়েছে মুসলমানি উপাদান। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের পরও এই স্বরের যাত্রা অব্যাহত ছিল। এবং সেই স্বর নির্মাণের অভিযাত্রায় আল মাহমুদ অগ্রগামী। তিনি কবিতার মধ্য দিয়ে তার বাস্তব ভিত্তি যেমন নির্মাণ করেছেন; কথাসাহিত্য-প্রবন্ধেও যোগ করেছেন নতুন মাত্রা।
বাংলাদেশের কবিতার ধারা সম্পর্কে তাই আল মাহমুদ স্পষ্টতই বলেন, ‘এ ধারাটি কলকাতা বা বাংলাদেশ বহির্ভূত অন্য কোনো কেন্দ্রভূমির প্রাধান্যকে স্বীকার না করেই নিজেদের প্রকৃতি ও পরিবেশে থেকে রস আহরণ করে বৈচিত্র্যে পূর্ণ হয়ে ওঠার দুঃসাহসে বলীয়ান বলে আমাদের আশাকে জাগিয়ে তুলেছে’ (সাম্প্রতিক বাংলা কবিতা)। বাংলাদেশের কবি ও কাব্যধারার সীমাবদ্ধতার বিভিন্ন সূত্র সন্ধান করলেও তিনি বাংলা কবিতার ক্ষেত্রে বাংলাদেশের কবিতার প্রতিই আস্থাশীল থেকেছেন। তীব্র জাতীয়তাবাদের চেয়ে এখানে কবির স্বভূমিঘনিষ্ঠতা ও জনলগ্নতাই প্রকাশিত হয়।
বাঙালি জাতীয়তাবাদের প্রতিপক্ষের কাছে—তা সে ষাটের দশকের পাকিস্তান পর্বে হোক অথবা পঁচাত্তর-পরবর্তী বাংলাদেশ পর্বে—যে রবীন্দ্রনাথ অন্যতম প্রতিপক্ষ বলে বিবেচিত হয়েছিলেন, আল মাহমুদের কাছে সেই রবীন্দ্রনাথ ‘জীবনধারণের এক অর্থবহ বিশ্রাম বা আশ্রয়’ (সমকালে রবীন্দ্রকাব্যের উপযোগিতা)। রবীন্দ্রনাথকে স্বীকার করে নিয়েই তাঁর কবিসত্তায় যে স্বাতন্ত্র্যের অভিযাত্রা অব্যাহত থাকে, তা প্রকাশ্য গদ্যেও (প্রবন্ধ) অস্পষ্ট থাকে না। তিনি জানান, রবীন্দ্রকাব্যেই তাঁর কবিহৃদয় ‘বশীভূত’ থাকে। যদিও ‘বিশ্বাস’ তাঁকে ‘আধুনিকদের’ থেকে অনেকখানি তফাত করে রাখে, অথচ রবীন্দ্রকবিতায় তিনি খোঁজেন ‘বিশ্বাসে বিনম্র হৃদয়’।
আল মাহমুদের কাছে সংস্কৃতি গান-নাচ-নাট্যমাত্র নয়। অনেকের আলোচনায় অনুল্লেখিত থাকলেও তিনি ধর্মবোধকে সংস্কৃতির গুরুত্বপূর্ণ উপাদান বলে মনে করেন। তিনি সংস্কৃতির অপরাপর উপাদান, যেমন পোশাক, খাদ্যাভ্যাস, সামাজিক সম্পর্ক ইত্যাদির মতো ধর্মকে একক উপাদান হিসেবে বিবেচনা করেননি, বরং সব কটি উপাদানকে ধর্মীয় মূল্যবোধসাপেক্ষ করে দেখেছেন। এ বিষয়ে সবাই একমত না-ও হতে পারে; কিন্তু তিনি নিজস্ব বিশ্বাস ও কায়দায় তার দৃষ্টান্ত দেখিয়েছেন। কোনো কোনো ক্ষেত্রে তাঁর ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ প্রবলভাবে দৃষ্টিগ্রাহ্য হলেও সেই দৃষ্টিকোণও বাংলাদেশরই একটি দৃষ্টিকোণ। নিজের ভাষা, জাতিসত্তা, সাহিত্য, জাতীয়তা ইত্যাদি নিজমূলক বিষয়ের মতো ধর্মকেও তিনি নিজের বলেই মনে করেন।
বাংলাদেশের কবি হিসেবে আল মাহমুদ কাদের পূর্বসূরি হিসেবে মেনেছেন এবং কাদের মানেননি, সেই পাঠও জরুরি। ‘জসীমউদ্দীনের অহংকার’ প্রবন্ধের শুরুতেই তিনি জানান, ‘কবি জসীমউদ্দীনের তিরিশ দশক ও ত্রিশোত্তর বাংলা কবিতার আঙ্গিকগত বৈচিত্র্যকে চমকপ্রদ বলে মাঝেমধ্যে স্বীকার করলেও তাদের নির্বাচিত বিষয়বস্তুকে কিছুতেই আধুনিক বলে মানতেন না। এই অস্বীকৃতিই তাকে নিঃসঙ্গ করে দিয়েছিল।’ এইটুকু পড়ে চট করেই মনে হয়—আল মাহমুদও কি এমনতর নৈঃসঙ্গ্যে আক্রান্ত হননি?—কবিতায় না হলেও জীবনবিশ্বাসের চিহ্নায়নে? বাংলাদেশ কবিতাপাঠের ক্ষেত্রে তিনি জসীমউদ্দীন-সংক্রান্ত কিছু বিষয়ে সদর্পে মতামত দিয়েছেন, ‘তাকে (জসীমউদ্দীন) যেখানে-সেখানে “পল্লিকবি” বলে গাল পাড়লেও নাগরিক নৈঃসঙ্গ্য সহ্য করার মতো খাঁটি “আরবান” মানসিকতা তার মধ্যে ছিল বলেই পরবর্তী ত্রিশ, চল্লিশ এবং পঞ্চাশ দশকের “আরবান কবিকুলের” যূথবদ্ধ গ্রাম্য অবজ্ঞাকে তিনি পাত্তা দেননি।’ এই বক্তব্যে জসীমউদ্দীনের প্রতি কেবল তাঁর ‘বাংলাদেশীয়’ সমর্থনই মেলে না, বরং একই সঙ্গে বাংলাদেশের কবিতার পূর্বসূরি নির্ধারণ ও সাতচল্লিশ-পরবর্তী বাংলাদেশের কাব্যধারার দোদুল্যমানতা প্রকাশিত হয়। বাংলাদেশের কাব্যধারায় ফররুখ আহমদও আল মাহমুদের পূর্বসূরি হিসেবে গৃহীত। ফররুখকে তিনি ‘ন্যায়ের পথে নিঃসঙ্গ কবি’ বলে গ্রহণ করেছেন। এই গ্রহণের পেছনে কেবল কবিকৃতিকেই বিবেচনায় আনেন না, বরং যে কারণে বাংলাদেশের ‘প্রগতিশীল’ মহলে তিনি ছিলেন সমালোচনার লক্ষ্যবস্তু—ইসলামি মূল্যবোধ—তাকেও গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা-অনুষঙ্গ করেছেন। বলেছেন, ‘তুলনামূলক সাহিত্যালোচনায় ফররুখকে অকবি, সাম্রাজ্যবাদের বা উপনিবেশবাদের দালাল হিসেবে চিহ্নিত করা যুক্তির দ্বারা সম্ভবপর ছিল না।’ এই একই কথা ফলে যায় কয়েক দশক পরে স্বয়ং আল মাহমুদের ক্ষেত্রেও।
পঁচাত্তর-পরবর্তী বাংলাদেশ পর্বের যে জাতীয়তার ধারণা, যার নাম বাংলাদেশি জাতীয়তা, আল মাহমুদ সেই ধারণার অনুসারী। কিন্তু তিনি পঁচাত্তরের পরেই যে এর অনুসারী হয়েছেন, তা নয়। তাঁর কাব্য-অভিযাত্রায় এই পরিচয় সনামে না থাকলেও এর উপস্থিতি শুরু থেকেই ছিল। গদ্যে তা আরও প্রত্যক্ষ। এই বাংলাদেশ-ধারণার স্বরূপ প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে তিনি কখনো কখনো প্রতিবেশী ভারতীয় বাঙালিদের সঙ্গে তুলনা-প্রতিতুলনায় জড়িত হয়েছেন। তিনি দেখিয়েছেন, হিন্দি ও ইংরেজির আধিপত্যে কলকাতায় বাংলা যেখানে কোণঠাসা, সেখানে ‘আমাদের (বাংলাদেশের) ভাষা স্বাধীন। আমাদের সাহিত্য স্বাধীন।’ যদিও সংস্কৃতিচর্চার বিষয়ে তিনি জানান, ‘এদেশীয় কয়েকজন ভারতীয় আমাদের জাতীয় সংস্কৃতির বিপরীত কর্মতৎপরতায় লিপ্ত থেকে এখনো কলকাতাকেই বাঙালি সংস্কৃতির পীঠস্থান বানিয়ে রাখতে চায়।’ কথাটায় আক্রমণ আছে; কিন্তু বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের মধ্যে এই প্রবণতার পক্ষে ও বিপক্ষে—উভয় আলাপই জারি আছে। সত্তর ও আশির দশকে বাংলাদেশের পুস্তকশিল্পে ভারতীয় আধিপত্যের বিষয়েও তিনি সবাক। জ্ঞানের রাষ্ট্রসীমা না থাকলেও বাজার হিসেবে বইয়ের রাষ্ট্রগত সমীকরণ আছে। ১৯৬৫ সালের পাকিস্তান-ভারত যুদ্ধের পর পশ্চিমবঙ্গনির্ভর পূর্ব পাকিস্তানের বাংলাভাষী পাঠককে বেশ বেকায়দায় পড়তে হয় ভারতীয় বাংলা বইয়ের দুর্লভতার কারণে—এটা অনেকেরই জানা। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের পর সেই অর্গল খুলে যায়। কিন্তু এর কারণে বাংলাদেশি বই ব্যবসায়ীরা যে প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়ে, সে বিষয়েও একাধিক নিবন্ধে তিনি উল্লেখ করেছেন।
বাংলাদেশের সাহিত্য ও সংস্কৃতির পরিচিহ্নায়নে আল মাহমুদ ধর্মীয় চিন্তা, বিশ্বাস, ধর্মীয় ঐতিহ্য ও মূল্যবোধকে বাদ দেন না; বরং গ্রহণ করার মধ্য দিয়ে এর পরিধিকে বাড়িয়ে নিতে সচেষ্ট থাকেন। সংস্কৃতি বলতে কী বোঝেন, তা বলতে গিয়ে তিনি লেখেন ‘আমার সংস্কৃতি ও গণমাধ্যম’ প্রবন্ধ। এখানে ‘আমার সংস্কৃতি’ মানে বাংলাদেশের সংস্কৃতি। আল মাহমুদের কাছে সংস্কৃতি গান-নাচ-নাট্যমাত্র নয়। অনেকের আলোচনায় অনুল্লেখিত থাকলেও তিনি ধর্মবোধকে সংস্কৃতির গুরুত্বপূর্ণ উপাদান বলে মনে করেন। তিনি সংস্কৃতির অপরাপর উপাদান, যেমন পোশাক, খাদ্যাভ্যাস, সামাজিক সম্পর্ক ইত্যাদির মতো ধর্মকে একক উপাদান হিসেবে বিবেচনা করেননি, বরং সব কটি উপাদানকে ধর্মীয় মূল্যবোধসাপেক্ষ করে দেখেছেন। এ বিষয়ে সবাই একমত না-ও হতে পারে; কিন্তু তিনি নিজস্ব বিশ্বাস ও কায়দায় এর দৃষ্টান্ত দেখিয়েছেন। কোনো কোনো ক্ষেত্রে তাঁর ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ প্রবলভাবে দৃষ্টিগ্রাহ্য হলেও সেই দৃষ্টিকোণও বাংলাদেশরই একটি দৃষ্টিকোণ। নিজের ভাষা, জাতিসত্তা, সাহিত্য, জাতীয়তা ইত্যাদি নিজমূলক বিষয়ের মতো ধর্মকেও তিনি নিজের বলেই মনে করেন। এখানে কোনো লুকোছাপা নেই। যে সাম্প্রদায়িকতার তির আল মাহমুদের দিকে, তিনি নিজেই কবিতার ক্ষেত্রে সাম্প্রদায়িক বিবেচনাকে ক্ষণস্থায়ী মনে করেন। ‘সাম্প্রতিক বাংলা কবিতা’ প্রবন্ধে কবিদের মধ্যে এই প্রবণতাকে নির্দেশ করেছেন শ্লেষাত্মক অনুষঙ্গে: ‘সাম্প্রদায়িকতা ও দলীয় মতাদর্শ কাককেও কিছুকালের জন্য কোকিল বা ময়ূরে রূপান্তর করতে পারে।’ হাল আমলে ধার্মিকতা আর সাম্প্রদায়িকতা অভিন্ন হিসেবে বিবেচিত হলেও আল মাহমুদের কাছে বিচারের মাপকাঠিটি ভিন্ন। আল মাহমুদের আত্ম-আবিষ্কারের অভিযাত্রায় ধর্মের যে উপস্থিতি, সেটি নতুন বিষয় নয়। মুসলমান-অধ্যুষিত বাংলাদেশের রাজনীতি ও সাহিত্যে ধর্মীয় অনুষঙ্গ বিপুলভাবে উপস্থিত থাকে চল্লিশের দশকে। পাকিস্তানের রাষ্ট্রযন্ত্র তার শোষণের অন্যতম হাতিয়ার হিসেবে ধর্মতন্ত্রকে ব্যবহার করে। ষাটের দশকে বাঙালি জাতীয়তাবাদ বিকশিত হওয়ার মুহূর্তে প্রতিপক্ষ হিসেবে উপস্থিত থাকে সেই শোষকশক্তি। আর তার উপজাত হিসেবে বাঙালি জাতীয়তাবাদের অদৃশ্য প্রতিপক্ষে পরিণত হয় ধর্মীয় ঐতিহ্য। কিন্তু জনমানুষের নিত্যকার জীবনে ধর্মের সদর্থক উপস্থিতিও তো ছিল। বাঙালি মুসলমান বাঙালিত্বকে গ্রহণ করলেও মুসলমানিত্বকে অস্বীকার করেনি কখনো। কিন্তু মূলধারার বয়ানে মুসলমানিত্ব থেকে যায় ঊহ্য। আল মাহমুদ জনমানুষের মধ্য থেকে নিজের পরিচয় নির্ণয় করতে সেই ঊহ্য পরিচয়কে প্রকাশ্য করেছেন এবং সদর্থক অর্থে গ্রহণ করেছেন।
বিচিত্রমাত্রিক জীবন আল মাহমুদের। ‘লোক লোকান্তর’–এর কবি যেমন ‘গণকণ্ঠ’-এ কাজ করেছেন, স্বৈরশাসকের কবিতা আসর এশীয় কবিতা উৎসবে (১৯৮৭) ছিলেন অগ্রণী, একসময় ইসলামপন্থী দলের সভা-মাহফিলেও অংশগ্রহণ করেছেন; কিন্তু তারপরও তাঁর ‘কালের কলস’ বা ‘সোনালি কাবিন’ বুদ্বুদের মতো মিলিয়ে যায় না। একইভাবে দ্বিধাহীনভাবে তাঁর গদ্য-উচ্চারণও তাঁর সত্তা ও সময় পরিচিহ্নায়নের অন্যতম সারথি হয়ে থাকে। আল মাহমুদ তাঁর গদ্য ও প্রবন্ধে যা কিছুকে ‘আমার’ বা ‘আমাদের’ বলে উল্লেখ করেছেন, তা-ই বাংলাদেশের সমরূপ হিসেবে নির্দেশিত হয়েছে। এভাবেই তিনি বাংলাদেশকে সামূহিকভাবে ধারণ করতে চেয়েছেন। কিন্তু বাংলাদেশকে তিনি যেভাবে ধারণ করেন বা দেখেন, তা সম্পূর্ণত মূলধারার বয়ানের অনুগামী নয়। ফলে আল মাহমুদের দৃষ্টিতে ও সৃষ্টিতে বাংলাদেশের পাঠ কেবল পাঠের মধ্যে সীমায়িত থাকে না; জাতীয়তাবাদী হেজিমনির সাপেক্ষে পাঠান্তরভুক্ত হয়ে যায়। এই পাঠান্তরই আল মাহমুদের একলা হওয়ার অন্যতম কারণ; অন্য বিবেচনায় এটিই তাঁর অনন্যতা।