মুজিবনগর সরকারের উপরাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম
মুজিবনগর সরকারের উপরাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম

আকবর আলি খানের লেখা

মুজিবনগর সরকারে কীভাবে ষড়যন্ত্র করেছিলেন খন্দকার মোশতাক

আজ ১৭ এপ্রিল মুজিবনগর সরকার দিবস। ১৯৭১ সালের এই দিনে মুজিবনগর সরকার গঠিত হওয়ার পর থেকেই সরকারের মধ্যে নানা রকম অন্তর্দ্বন্দ্ব ছিল। মুখোমুখি হয়ে গিয়েছিল মুক্তিবাহিনী ও মুজিব বাহিনী। আর এর মধ্যেই মুজিবনগর সরকারের পররাষ্ট্রমন্ত্রী খন্দকার মোশতাক আহমদ মেতে ওঠেন ভিন্ন এক ষড়যন্ত্রে। আকবর আলি খান ছিলেন মুজিবনগর সরকারের একজন কর্মকর্তা। প্রথমা প্রকাশন থেকে বেরোনো তাঁর আত্মজীবনী ‘পুরানো সেই দিনের কথা’য় তিনি সবিস্তারে লিখেছেন এ সরকারের অন্তর্দ্বন্দ্ব ও খোন্দকার মোশতাকের ষড়যন্ত্র বিষয়ে। সেই বই থেকে নির্বাচিত অংশ।

আনুষ্ঠানিকভাবে ১৭ এপ্রিল ১৯৭১ সালে মুজিবনগর সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়। তবে মে মাসের প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত মুজিবনগর সরকার একটি কেন্দ্রীভূত সরকার হিসেবে গড়ে ওঠেনি।  

মুজিবনগর সরকার যতই বড় হতে থাকে, ততই তার মধ্যে অন্তর্দ্বন্দ্বের আত্মপ্রকাশ ঘটে। তাজউদ্দীন আহমদের নেতৃত্বে গঠিত সরকার দুটি হুমকির সম্মুখীন হয়। প্রথমত, আওয়ামী লীগের তরুণ ছাত্রনেতারা যুদ্ধের জন্য কোনো সরকারের প্রয়োজন নেই বলে মনে করেন। তাঁদের মতে, যুদ্ধের জন্য বিপ্লবী কমান্ড প্রতিষ্ঠা করাই যথেষ্ট। এই কমান্ড বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে কাজ করবে। এই মতের প্রবক্তা ছিলেন শেখ ফজলুল হক মনি, সিরাজুল আলম খান, তোফায়েল আহমেদ এবং অন্যান্য ছাত্রনেতা। তাঁরা ভয় প্রকাশ করেন যে তাঁদের হাতে নেতৃত্ব না থাকলে আওয়ামী লীগের নেতৃত্ব উৎখাত হতে পারে। ভারত সরকার আওয়ামী লীগের নেতৃত্ব বজায় রাখার প্রয়োজনীয়তা মেনে নেয়। তাই বাংলাদেশ সরকারের নেতৃত্বাধীন মুক্তিবাহিনীর বাইরে ‘বাংলাদেশ লিবারেশন ফোর্সেস’ ( BLF) নামে একটি স্বতন্ত্র বাহিনী গড়ে তোলা হয়। এই বাহিনীর সংগঠকেরা তাঁদের বাহিনীকে ‘মুজিব বাহিনী’ বলতেন। ‘মুজিব বাহিনী’ নাম নিয়ে তাঁরা নিজেদের মুক্তিবাহিনীর বাইরের শক্তি বলে পরিচয় দিতেন। আওয়ামী লীগের প্রতি অতি বিশ্বস্ত ১০ হাজার ছাত্রকে এই বাহিনীতে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। এঁদের প্রশিক্ষণ হয় ভারতের দেরাদুনের অদূরে চাকরাতা প্রশিক্ষণঘাঁটিতে। মেজর জেনারেল এস এস ওবানকে এ প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করার দায়িত্ব দেওয়া   হয়। তিনি মুজিব বাহিনীকে আধুনিক অস্ত্রশস্ত্র ব্যবহারে প্রশিক্ষণ দেন এবং পাকিস্তান বাহিনীকে আক্রমণ করার জন্য এঁদের আধুনিক অস্ত্রশস্ত্রও দেওয়া হয়। তাজউদ্দীন আহমদ এবং জেনারেল ওসমানী এঁদের মুক্তিবাহিনীর কমান্ডে আনার পক্ষপাতী ছিলেন। ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী এই প্রস্তাব অনুমোদন করলেও ‘মুজিব বাহিনী’র সংগঠকদের বিরোধিতার কারণে এ প্রস্তাব কার্যকর করা সম্ভব হয়নি। মুজিব বাহিনী ও মুক্তিবাহিনী যুদ্ধক্ষেত্রে পরস্পরকে সব সময় সহযোগিতা করেনি। অনেক ক্ষেত্রে তারা নিজেদের মধ্যে লড়াই করেছে।

মুজিবনগর সরকারের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ নেওয়ার পর সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাব দিচ্ছেন তাজউদ্দীন আহমদ, মুজিবনগর, ১৭ এপ্রিল ১৯৭১।
তাজউদ্দীন আহমদ এবং ভারত সরকার প্রথম থেকেই খন্দকার মোশতাককে সন্দেহ করত। তাজউদ্দীন আহমদ খন্দকার মোশতাকের একান্ত সচিব হিসেবে কামাল সিদ্দিকীকে নিয়োগ করেন। নিয়োগের আগে তিনি খন্দকার মোশতাকের সন্দেহজনক আচরণ সম্পর্কে কামাল সিদ্দিকীকে জানান এবং খন্দকার মোশতাকের সব কর্মকাণ্ড সম্পর্কে তাঁকে সরাসরি অবহিত রাখার জন্য কামাল সিদ্দিকীকে নির্দেশ দেন। কামাল সিদ্দিকী খোন্দকার মোশতাকের টেলিফোনের নিচে কয়েকটি অচেনা কাগজে টেলিফোন নম্বর দেখতে পান। টেলিফোন নম্বরগুলোকে কপি করে তিনি তাজউদ্দীন আহমদকে দেন। তাজউদ্দীন আহমদ পরে কামাল সিদ্দিকীকে জানান যে টেলিফোন নম্বরগুলো কলকাতার আমেরিকান কনস্যুলেট জেনারেলের অফিসের।

দ্বিতীয় দ্বন্দ্ব দেখা দেয় মুজিবনগর সরকার এবং আওয়ামী লীগের নির্বাচিত সাংসদদের মাধ্যমে। প্রতিবিপ্লবীদের নেতৃত্বে ছিলেন খন্দকার মোশতাক আহমদ। তাঁকে সহায়তা করছিলেন মিজানুর রহমান চৌধুরী এবং জহিরুল কাইয়ুম। মুজিবনগর সরকারের পক্ষে যে আওয়ামী লীগের নির্বাচিত সব সংসদ সদস্য রয়েছেন, সেটা প্রমাণ করার প্রয়োজন ছিল। তাই ভারত সরকারের সহায়তায় শিলিগুড়ির জঙ্গল অঞ্চলে ৫ জুলাই তারিখে আওয়ামী লীগ দলীয় সাংসদদের এক সভা অনুষ্ঠিত হয়। ভারত সরকারের সমর্থন নিয়ে তাজউদ্দীন আহমদের নেতৃত্বে গঠিত সরকারকে আওয়ামী লীগ সাংসদেরা সর্বসম্মতিক্রমে অনুমোদন দেয়।

শিলিগুড়ি সম্মেলনের পর মুজিবনগর সরকারের প্রতি প্রকাশ্য চ্যালেঞ্জ দূর হয় কিন্তু ভেতরে-ভেতরে ষড়যন্ত্র চলতে থাকে। এ ষড়যন্ত্রের নেতা ছিলেন খন্দকার মোশতাক আহমদ। তাঁকে সহায়তা করেন কুমিল্লার আওয়ামী লীগ নেতা জহিরুল কাইয়ুম এবং পররাষ্ট্রসচিব মাহবুবুল আলম চাষী (যাঁকে মার্কিন সরকারের কাছে পাকিস্তানের দেশরক্ষার গোপনীয় বিষয়াদি পাচার করার অভিযোগে চাকরি ছাড়তে বাধ্য করা হয়)। তাজউদ্দীন আহমদ এবং ভারত সরকার প্রথম থেকেই খন্দকার মোশতাককে সন্দেহ করত। তাজউদ্দীন আহমদ খন্দকার মোশতাকের একান্ত সচিব হিসেবে কামাল সিদ্দিকীকে নিয়োগ করেন। নিয়োগের আগে তিনি খন্দকার মোশতাকের সন্দেহজনক আচরণ সম্পর্কে কামাল সিদ্দিকীকে জানান এবং খন্দকার মোশতাকের সব কর্মকাণ্ড সম্পর্কে তাঁকে সরাসরি অবহিত রাখার জন্য কামাল সিদ্দিকীকে নির্দেশ দেন। কামাল সিদ্দিকী খোন্দকার মোশতাকের টেলিফোনের নিচে কয়েকটি অচেনা কাগজে টেলিফোন নম্বর দেখতে পান।

খন্দকার মোশতাক

টেলিফোন নম্বরগুলোকে কপি করে তিনি তাজউদ্দীন আহমদকে দেন। তাজউদ্দীন আহমদ পরে কামাল সিদ্দিকীকে জানান যে টেলিফোন নম্বরগুলো কলকাতার আমেরিকান কনস্যুলেট জেনারেলের অফিসের। ভারতীয়দের তদন্তে আরও জানা যায় খন্দকার মোশতাকের পক্ষে জহিরুল কাইয়ুম মার্কিন দূতাবাসে দেখা করতে যান।

আগস্ট ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ সরকারের মন্ত্রিসভায় সেপ্টেম্বর মাসে নিউইয়র্কে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের যে সভা অনুষ্ঠিত হবে, সে সভার জন্য বাংলাদেশের প্রতিনিধিদলের সদস্যদের মনোনয়ন দেওয়া হয়। সভায় সিদ্ধান্ত হয় যে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী খন্দকার মোশতাক আহমদ বাংলাদেশের প্রতিনিধিদলের নেতৃত্ব দেবেন। তাঁর সঙ্গে তাঁর একান্ত সচিব কামাল সিদ্দিকী যাবেন কাগজপত্র নিয়ে।

পররাষ্ট্রমন্ত্রী এবং তাঁর একান্ত সচিবের বিশ্বসভায় অংশগ্রহণের উপযুক্ত কাপড়চোপড়ের জন্য দেড় হাজার টাকা করে বরাদ্দ দেওয়া হয়। কামাল সিদ্দিকী এ টাকা তুলে তাঁর মন্ত্রীর জন্য পোশাক তৈরি করার ব্যবস্থা করেন এবং নিজে একটি স্যুট ও একজোড়া জুতা কেনেন। তারপর হঠাৎ খন্দকার মোশতাকের নিউইয়র্ক সফর বাতিল করা হয়। জানা যায়, ভারত সরকার টের পেয়েছিল খোন্দকার মোশতাক মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মাধ্যমে পাকিস্তানের সঙ্গে সমঝোতার চেষ্টা করছেন। তাঁর শর্ত ছিল পাকিস্তান যদি শেখ মুজিবকে ছেড়ে দেয়, তাহলে শেখ মুজিব এসে যুদ্ধ বন্ধ করে দেবেন এবং এক পাকিস্তানের কাঠামোতে সাংবিধানিক সমস্যার সমাধান করবেন। ভারত সরকার তাই খন্দকার মোশতাককে দেশের বাইরে যাওয়ার জন্য পাসপোর্ট দিতে অস্বীকার করেন। কামাল সিদ্দিকীরও দেশের বাইরে যাওয়া হয়নি। শীতের সময়ে মাঝেমধ্যে বাইরে গেলে আমি কামাল সিদ্দিকীর কাছ থেকে নিউইয়র্কে যাওয়ার জন্য তৈরি করা তাঁর কোটটি ধার করতাম।

আকবর আলি খান

মোশতাকের সমর্থকেরা যে পাকিস্তানের সঙ্গে সমঝোতা চেষ্টা করছে, তা মোশতাকের অন্য সহকর্মীদের আচরণ থেকেও বোঝা যাচ্ছিল। তাহেরউদ্দীন ঠাকুর ছিলেন সরাইল থেকে নির্বাচিত জাতীয় সংসদ সদস্য। তিনি খন্দকার মোশতাকের অনেক কাছের লোক ছিলেন। আমি কলকাতায় যোগ দেওয়ার পর একদিন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে যাই। সেখানে তাহেরউদ্দীন ঠাকুরের সঙ্গে আমার দেখা হয়। মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে আলোচনা করতে করতে একপর্যায়ে তাহেরউদ্দীন ঠাকুর আমাকে বলেন, ‘এসডিও সাহেব, আপনারা কেন এই রাজনৈতিক বিষয়ে জড়ালেন সেটা বুঝতে পারছি না। আমরা রাজনীতিবিদেরা অনেক বিষয়ে ঝগড়া করি আবার সেসব বিষয় নিয়ে আপসও করি। আমাদের জন্য কিছুই বাধ্যতামূলক নয়। কিন্তু আপনাদের আইনের ভিত্তিতে প্রশাসন চালাতে হয়। একবার যদি আইন ভাঙেন, তাহলে আপনাদের অবশ্যই শাস্তি হবে। সুতরাং যদি দেখা যায় কিছুদিন পর আপস করে আমরা ঘরের ছেলেরা ঘরে ফিরে গেছি, তখন কিন্তু আপনারা ফিরে যেতে পারবেন না। আপনাদের বিচার হবে।’

তাঁর এই বক্তব্য আমি সঙ্গে সঙ্গে কামাল সিদ্দিকীকে জানাই। আমরা দুজনে খসরুজ্জামান চৌধুরী, সাদাত হোসেনসহ অন্যান্য কনিষ্ঠ সহকর্মীর সঙ্গে আলোচনা করি এবং এই সিদ্ধান্তে পৌঁছাই শুধু দেশের স্বার্থেই নয়, আমাদের ব্যক্তিগত স্বার্থেও বাংলাদেশের স্বাধীনতা অপরিহার্য। সুতরাং যারা স্বাধীনতার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছে, তাদের সঙ্গে কোনো অবস্থাতেই আপস করা যাবে না।

তবে মুক্তিবাহিনী এবং মুজিব বাহিনীর মধ্যে সব ক্ষেত্রে সংঘর্ষ এড়ানো যায়নি। মুজিব বাহিনীর সদস্যরা মুক্তিবাহিনীর সদস্যদের আদৌ কোনো পাত্তা দিতেন না। ফলে দেশের বিভিন্ন স্থানে মুজিব বাহিনী ও মুক্তিবাহিনীর মধ্যে সংঘর্ষ দেখা দেয়। ‘মুজিব বাহিনী’র সদস্যরা প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ এবং সর্বাধিনায়ক জেনারেল ওসমানী—কারও আদেশই মানতেন না। তাঁরা শুধু শেখ মনি ও কয়েকজন ছাত্রনেতার আদেশ মানতেন। এই দ্বন্দ্ব মুক্তিযুদ্ধ চলার সময় নিরসন করা যায়নি। ভারত সরকার এ ব্যাপারে সহায়তার আশ্বাস দিয়েছিল কিন্তু শেষ পর্যন্ত তারা কোনো কার্যকর ব্যবস্থা নিতে পারেনি।

অন্তর্দ্বন্দ্ব মুক্তিবাহিনীর ভেতরেও ছিল। জিয়াউর রহমানের নেতৃত্বে জেড ফোর্স, সফিউল্লাহর নেতৃত্বে এস ফোর্স এবং খালেদ মোশাররফের নেতৃত্বে কে ফোর্সের মধ্যে অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব ছিল। এই দ্বন্দ্ব মুক্তিযুদ্ধের সময়ে নিরসন করা সম্ভব হয়নি। পরবর্তীকালে স্বাধীন বাংলাদেশে হানাহানির মাধ্যমে এই অন্তর্দ্বন্দ্বের নিরসন হয়।

পুরানো সেই দিনের কথা আকবর আলি খান

পুরানো সেই দিনের কথা (প্রথম খণ্ড)
আকবর আলি খান
প্রকাশক: প্রথমা প্রকাশন, ঢাকা, প্রকাশকাল: ফেব্রুয়ারি ২০২২, প্রচ্ছদ: মাসুক হেলাল, ৩৬৪ পৃষ্ঠা, দাম: ৬৮০ টাকা।
বইটি সংগ্রহ করতে অর্ডার করুন prothoma.com