হত্যাযজ্ঞ চলছিল ১৯৭১–এর মার্চ থেকেই। দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের বুিদ্ধজীবীদের হত্যা করা হচ্ছিল পরিকল্পিতভােব। এর ধারাবািহকতায় ১০ থেকে ১৬ ডিসেম্বর বিজয়ের মুহূর্ত পর্যন্ত অপহরণ করা হয় জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তানদের। সেই ভয়াল দিনগুলোর দিকে এখন একটু পেছন ফিরে তাকানো যাক। দেখা যাক কীভাবে পরিবার–পরিজনের সামনে থেকে টেনে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল বুদ্ধিজীবীদের। সবার কথা হয়তো এই স্বল্প পরিসরে বলা যাবে না। তবে এই কয়েকটি বর্ণনা থেকেই বোঝা যাবে, কী নিষ্ঠুর, নৃশংস ছিল সময়টি।
আবুল খায়ের
আবুল খায়ের ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের শিক্ষক। একাত্তরের মাঝামাঝি সময়ে তাঁকে সেনাবাহিনী ধরে নিয়ে গিয়েছিল, রেখেছিল ক্যান্টনমেন্টে। এরপর ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে তিনি ছিলেন ১৭ দিন। আরও কয়েকজন শিক্ষকও মুক্তি পেলেন তাঁর সঙ্গে। বেঁচে গিয়েছিলেন সেদিন তিনি। তবে ১৪ ডিসেম্বর সকালে কাদালেপা একটি মাইক্রোবাস আসে ফুলার রোডের ৩৬ নম্বর বাড়ির সামনে। ড. আবুল খায়ের শাল গায়ে হাঁটছিলেন সেখানে। ১৮–১৯ বছর বয়সী ৭–৮ জন তরুণ নেমে আসে সেই মাইক্রোবাস থেকে। তারা আবুল খায়েরকেই জিজ্ঞেস করে, ‘খায়ের সাহেব কোথায়?’ তিনি বললেন, ‘আমি।’ ওরা তাঁকে আর কোনো কথা বলার সুযোগ দিল না। চোখে কাপড় বেঁধে, স্টেনগান উঁচিয়ে তাঁকে নিয়ে গেল। আবুল খায়েরের গলিত লাশ পাওয়া যায় রায়েরবাজার বধ্যভূমিতে। তাঁকে শনাক্ত করা হয় গায়ের সেই শালটি দেখে।
ডা. মোহাম্মদ মোর্তজা
ডা. মোহাম্মদ মোর্তজা ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক শিক্ষক। চিকিৎসাবিজ্ঞানে মৌলিক পরিবর্তন আনবেন বলে ভাবতেন তিনি। দীর্ঘ ১৬ বছর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে কাজ করে সেভাবেই নিজেকে তৈরি করে নিচ্ছিলেন তিনি। দিনের একটা সময় চিকিৎসা নিয়ে থাকতেন, বাকি সময়টা কাটাতেন গ্রন্থাগারে। ডিসেম্বরে যখন চূড়ান্ত যুদ্ধ শুরু হলো, তখন তিনি তাঁর স্ত্রী সাঈদা মোর্তজাকে বলতেন, ‘যুদ্ধ একটা জাতীয় প্রয়োজন। যুদ্ধের মধ্য দিয়েই জাতীয় চরিত্র তৈরি হয়।’ ১৯৭১ সালের মাঝামাঝি বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন শিক্ষককে ধরে নিয়ে যাওয়া হয়। তাঁদের ছেড়ে দেওয়া না হলে বিশ্ববিদ্যালয় ত্যাগ করবেন বলে ভেবেছিলেন তিনি। কিন্তু কয়েক দিন পর শিক্ষকদের ছেড়ে দেওয়া হলে তিনি সে ভাবনা ত্যাগ করেন। কিন্তু ১৪ ডিসেম্বর এসে সবকিছু লন্ডভন্ড করে দিল। তাঁকে অপহরণ করে হত্যা করল আল বদরেরা।
ড. ফয়জুল মহী
ড. ফয়জুল মহী ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের গবেষক। মুক্তিযোদ্ধাদের সাহায্য করতেন তিনি। মুক্তিযোদ্ধারাই তাঁকে এবং তাঁর সহকর্মীদের বুদ্ধিজীবী হত্যার নীলনকশার কথা বলে সতর্ক করে দিয়েছিলেন। ডিসেম্বরের সেই ভয়ানক দিনগুলোয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছুসংখ্যক শিক্ষক ক্যাম্পাস ত্যাগ করবেন বলে সিদ্ধান্ত নেন। ১০ ডিসেম্বরে কথা হয়, ১১ ডিসেম্বর সকালে ১৫–১৬ জন শিক্ষক পরিবার ঢাকা ছেড়ে বিক্রমপুরের দিকে চলে যাবেন। ড. মহীও যাবেন বলে ঠিক হয়। কিন্তু নির্দিষ্ট দিনে তিনি আর পালিয়ে যেতে রাজি হলেন না। রাজি হননি আনোয়ার পাশা আর রাশীদুল হকও। ১৪ ডিসেম্বর যে মাইক্রোবাসে আবুল খায়েরকে তোলা হয়, সেই মাইক্রোবাসেই তোলা হয় ফয়জুল মহীকে। তিনতলার বাড়ি থেকে লুঙ্গি পরিহিত ড. মহীকে চোখ বেঁধে নিয়ে যাওয়া হয়।
শেখ আবদুস সালাম
শেখ আবদুস সালাম নড়াইলের কালিয়া মহাবিদ্যালয়ের অধ্যক্ষ ছিলেন। স্কুলজীবন থেকেই তিনি রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। ছিলেন সুবক্তা। জনসভায় তিনি ছিলেন শানিত ভাষার বক্তা। নিজের টেপরেকর্ডারে তিনি বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ ধারণ করেছিলেন। কালিয়ার বিভিন্ন স্থানের মানুষদের তিনি সে ভাষণ শোনাতেন। ১৯৭১ সালের মে মাসের প্রথম দিকে আটক হন। যশোর সেনা নিবাসে নিয়ে যাওয়া হয় তাঁকে। সেখানে তাঁর ওপর অকথ্য নির্যাতন চালানো হয়। ১৩ মে তাঁকে গুলি করে হত্যা করে মাটিচাপা দিয়ে রাখা হয়। তাঁর কবর তাঁর নিজের হাতেই খনন করতে বাধ্য করে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী।
ড. আমিনউদ্দিন
ড. আমিনউদ্দিন ছিলেন সায়েন্স ল্যাবরেটরির ঊর্ধ্বতন গবেষণা কর্মকর্তা। সাহিত্যানুরাগী ছিলেন তিনি। ১৯৭০ সালে প্রত্যয় নামে একটি সাহিত্য পত্রিকাও প্রকাশ করেন। ১৯৭১ সালের অসহযোগ আন্দোলনে এবং নয় মাস মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে তাঁর ছিল উজ্জ্বল ভূমিকা। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে তিনি ল্যাবরেটরির সহকর্মীদের কাছ থেকে নিয়মিত চাঁদা তুলে মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে পাঠাতেন। ১৪ ডিসেম্বর তাঁর স্ত্রী সুরাইয়া আমিন সপরিবারে সায়েন্স ল্যাবরেটরির কলোনি ছেড়ে অন্য কোথাও চলে যাওয়ার জন্য চাপ দিচ্ছিলেন, কিন্তু ড. আমিনউদ্দিনের তাতে দোদুল্যমানতা ছিল। ১৪ ডিসেম্বর সকাল সাড়ে আটটার দিকে কলোনিতে একটা জিপ ঢোকে। তা থেকে কালো মুখোশধারী চারজন নেমে আসে। তাদের হাতে ছিল নামের তালিকা। ড. আমিনউদ্দিনের বাড়ির কড়া নাড়ে তারা। ড. আমিন দরজা খোলেন। পরিচয় জেনেই ওরা ঝাঁপিয়ে পড়ে ড. আমিনের ওপর। রাইফেলের নলের মুখে ড. আমিনের নিজের গামছা দিয়ে চোখ বেঁধে ওরা তাঁকে নিয়ে যায়। অন্য অনেককে যেমন বলেছিল নরঘাতকেরা, তেমনি সুরাইয়া আমিনকেও ঘাতকদের একজন বলে যায়, ভয় নেই, বোন, এক ঘণ্টা পরেই আপনার স্বামীকে ফিরিয়ে দিয়ে যাব।’
সুরাইয়া আমিন তাঁর স্বামীকে বা স্বামীর লাশ আর ফিরে পাননি।
এস এম এ রাশীদুল হাসান
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক এস এম এ রাশীদুল হাসান ভালোবাসতেন গান, বিশেষ করে রবীন্দ্রসংগীত। মেয়ে নীলিকে গান শেখানোর জন্য মাস্টার রেখে দিয়েছিলেন। বলতেন, ‘আগে মেয়ে গান শিখুক, তারপর আমি ওর কাছ থেকে শিখব।’ বিশ্বভারতীর আজীবন সদস্য ছিলেন তিনি। প্রতিবছর সপরিবারে শান্তিনিকেতন যেতেন পৌষমেলা দেখতে।
১৯৭১ সালের ২০ সেপ্টেম্বর রাশীদুল হাসানকে একবার সাদা পোশাকের সেনাবাহিনীর লোকেরা ধরে নিয়ে যায়। তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ, তিনি মুক্তিযুদ্ধের কথা বলে ছাত্রদের উজ্জীবিত করেন। কিছু শুভাকাঙ্ক্ষীর সহযোগিতায় ১২ দিন পর তিনি মুক্তি পান। ১৪ ডিসেম্বর সকালে আল বদর বাহিনীর সদস্যরা তাঁকে ধরে নিয়ে যায়। বাড়ির সবাই হতবিহ্বল হয়ে পড়েন। বাড়ির লোকেরা যখন বারান্দায় দাঁড়িয়ে কাঁদছিলেন, তখন ঘাতকেরা রাইফেল থেকে ফাঁকা গুলি করে, ভয়ে সবাই ঘরের ভেতরে ঢুকে যান।
রাশীদুল হাসানের লাশ উদ্ধার করা হয় মিরপুরের বধ্যভূমি থেকে।
গিয়াসউদ্দীন আহমদ
১৪ ডিসেম্বরেই ধরে নিয়ে যাওয়া হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক গিয়াসউদ্দীন আহমদকে। পায়জামা–পাঞ্জাবিই ছিল তাঁর পোশাক। ১৯৬৪ সালে যুক্তরাজ্যের হিথরো বিমানবন্দরে নেমেছিলেন সাদা পায়জামা, কালো শেরওয়ানি আর জিন্নাহ টুপি পরে। তিনি মনেপ্রাণে ছিলেন বাঙালি।
১৪ ডিসেম্বর বিশ্ববিদ্যালয়রের হল আর হাউস টিউটরদের বাড়িতে পানি ছিল না। পানির পাম্পড্রাইভার কোথায় পালিয়েছেন, কে জানে। গিয়াসউদ্দীন আহমদ গেলেন পানির পাম্প চালাতে। সেখানেই এল কাদালেপা মাইক্রোবাস। কালো মুখোশ পরা রাইফেল হাতে এল ঘাতকেরা। রাইফেলের বাঁট দিয়ে আঘাত করতে থাকল গিয়াসউদ্দীন আহমদের বাড়ির দরজায়। ভয়ে দরজা খুলে দিল কেউ। ওরা জিজ্ঞেস করল পরিষ্কার বাংলায়, ‘গিয়াস স্যার কোথায়?’ ‘কেউ একজন উত্তর দিল, ‘পানির পাম্প চালাতে গেছেন।’ ওরা বিশ্বাস করল না। বাড়িটা খুঁজল তন্নতন্ন করে। খুঁজল আশপাশের ফ্ল্যাটেও। পানির পাম্পের কাছেই ওরা পেল তাঁকে। দারোয়ানের কাঁধের গামছা দিয়ে চোখ বাঁধা হলো গিয়াসউদ্দীন আহমদের। সেই মাইক্রোবাসে তোলা হয়েছিল ড. আবুল খায়ের, ড. মোর্তজা, শ্রী সন্তোষ ভট্টাচার্য, আনোয়ার পাশা, সিরাজুল হক খান, ফয়জুল মহী, রাশীদুল হাসান। শিয়ালবাড়ি বধ্যভূমিতে খুঁজে পাওয়া গেল তাঁর ক্ষতবিক্ষত লাশ।
এস এ মান্নান
খেলাধুলার প্রতি তীব্র আকর্ষণ ছিল এস এ মান্নানের। তিনি লাড়ু ভাই নামেই ব্যাপক পরিচিত ছিলেন সাংবাদিক মহলে। ঢাকার আজাদ ও পরে অবজারভার পত্রিকায় ক্রীড়া সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। পূর্ব পাকিস্তান টেলিভিশনে খেলাধুলার অনুষ্ঠান পরিচালনা করতেন। ১৪ ডিসেম্বর সন্ধ্যা সাড়ে সাতটার দিকে রাজাকার, আল বদরের দল লাড়ু ভাইয়ের পুরানাপল্টনের বাড়িতে ঢোকে। তিনি তখন বন্ধুদের সঙ্গে গল্প করছিলেন। তাঁর পরনে ছিল সাদা স্যান্ডো গেঞ্জি আর সবুজ রঙের সিল্কের লুঙ্গি। উপস্থিত সব পুরুষকেই ওরা ধরে নিয়ে যায় সেখানকার রাজাকার হেডকোয়ার্টারে। ১৬ ডিসেম্বর বিজয়ের পর রায়েরবাজার বধ্যভূমিতে তাকে শনাক্ত করা হয় ওই সবুজ লুঙ্গি দেখে।
মীর আবদুল কাইয়ুম
মীর আবদুল কাইয়ুম শিক্ষাকেই জীবনের ব্রত হিসেবে নিয়েছিলেন। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মনোবিজ্ঞানে এমএ করে কান্দিপাড়া আজগর আলী হাইস্কুলে কিছুদিন শিক্ষকতা করেন। এরপর গফরগাঁও কলেজে অধ্যাপনা করেন। ১৯৬৪ সালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞান বিভাগে এশিয়া ফাউন্ডেশন প্রকল্পের অধীনে রিসার্চ সেন্টারে যোগ দেন। এরপর ১৯৬৬ সালে তিনি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞান বিভাগে ডেমন্সট্রেটর ও পরে প্রভাষক পদে যোগ দেন। ঊনসত্তরের গণ–অভ্যুত্থানে তিনি সক্রিয়ভাবে অংশ নেন। ১৯৭১ সালের ২৫ নভেম্বর পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর সদস্যরা তাঁকে গ্রেপ্তার করে। অনেকের সঙ্গে তাঁকে জীবন্ত কবর দেওয়া হয়। রাজশাহী শহরের পদ্মা নদীর তীরে সরকারি বাংলোর বাবলাতলায় এই বধ্যভূমি রয়েছে।
নিজামুদ্দীন আহমদ
বিবিসির সাংবাদিক নিজামুদ্দীন আহমদ মুক্তিযুদ্ধের সময় বিবিসিতে খবর পাঠাতেন। ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর ভাষণের পর বাড়িতে উড়িয়ে দিয়েছিলেন কালো পতাকা। মুক্তিবাহিনীকে সহযোগিতা করতেন তিনি। যোগাযোগ ছিল প্রবাসী সরকারের সঙ্গে। ১২ ডিসেম্বর লিখছিলেন তিনি টাইপ রাইটারে। বেলা একটার দিকে ক্লান্ত নিজামুদ্দীন আহমদ স্ত্রী কোহিনুর আহমদকে বললেন, ‘খিদে পেয়েছে।’ তড়িঘড়ি খাবার ঠিক করে ডাকতে গিয়ে কোহিনুর বেগম দেখেন, ঘুমিয়ে পড়েছেন তিনি। ঘুম ভাঙলে সবাই খেতে বসলেন টেবিলে। এ সময় দরজায় শিকল ঝাঁকানোর শব্দ। কোহিনুর বেগম দরজা খুলেই দেখলেন খাকি পোশাকের দুই লোক। কালো কাপড়ে মুখ ঢাকা। একজনের চোখে সবুজ সানগ্লাস। আর্মি ও আল বদরের লোকেরা নিজামুদ্দীন আহমদের আইডেন্টিটি কার্ড দেখতে চাইল। তিনি দেখালেন। অতর্কিতে তাঁর দিকে বন্দুক তাক করে ওরা বলল, হ্যান্ডসআপ। নিজামুদ্দীন আহমদ হাত ধুয়ে আসতে চাইলেন। ওরা সে সুযোগও দিল না। ধরে নিয়ে গেল তাঁকে। সাংবাদিক মার্ক টািলসহ দেশি-বিদেশি সাংবাদিকরা অনেক খুঁজেছেন তাঁকে। িকন্তু তাঁর লাশ কোথাও খুঁেজ পাওয়া যায়নি।
সুখরঞ্জন সমাদ্দার
সুখরঞ্জন সমাদ্দার ছিলেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সংস্কৃত বিভাগের শিক্ষক। মুক্তবুদ্ধি ও অসাম্প্রদায়িক চিন্তাধারার মানুষ ছিলেন তিনি। সংগীতচর্চাও করতেন তিনি। ১৯৭১ সালের ১৩ এপ্রিল পাকিস্তানি সেনাসদস্যরা রাজশাহী শহরে ঢুকে পড়ে। সেদিন সন্ধ্যায় যুদ্ধে মারাত্মকভাবে আহত একজন বাঙালি সেনা ইপিআর ক্যাম্পাসে এসে পানি চাইছিলেন। সুখরঞ্জন সমাদ্দার নিজ হাতে তাঁকে পানি খাওয়ান। আশ্রয় দেওয়া হলে বিপদ আসতে পারে জেনেও তিনি তাঁকে আশ্রয় দেন। ভোররাত চারটার দিকে ইপিআর সদস্য চলে যান। ১৪ এপ্রিল সকাল সাড়ে নয়টার দিকে পাকিস্তানি সেনাসদস্যরা সুখরঞ্জন সমাদ্দারকে ধরে নিয়ে যায়। সেদিনই তাঁকে নির্মমভাবে হত্যা করা করে বিনোদপুরে ফেলে রেখে দেয় তারা। সুখরঞ্জন সমাদ্দারের বাড়িতে দুধ দিতে আসতেন যে গোয়ালা বা ঘোষ, তিনিই সে সময় মাটিচাপা দেন লাশটি। স্বাধীনতা লাভের পর এই ঘটনা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে জানানো হলে তাঁর দেহাবশেষ এনে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠাগারের সামনে পুনঃসমাহিত করা হয়।
হবিবুর রহমান
১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ অপারেশন সার্চলাইটের খবর রাজশাহীতে পৌঁছালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, কর্মচারীসহ অনেক সাধারণ মানুষ দলে দলে চলে যেতে থাকেন নিরাপদ আশ্রয়ে। হাতে গোনা যে কয়জন ব্যক্তি থেকে গিয়েছিলেন, তাঁদের মধ্যে ছিলেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের গণিত বিভাগের শিক্ষক হবিবুর রহমান। ২৬ মার্চ ভোররাতের দিকে পাকিস্তানি সেনারা ঢুকে পড়ে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে। শহীদ হবিবুর রহমান সপরিবারে রয়ে গিয়েছিলেন যে বাসায়, সেই ‘প-১৯/বি’ নম্বর বাসাটিতে তখনো উড়ছিল কালো পতাকা। এ নিয়ে তাঁর উত্তপ্ত বাক্যবিনিময় হয় পাকিস্তানি সেনাদের সঙ্গে। পরে সৈন্যরা নিজেরাই জোর করে পতাকা নামায়।
১২ এপ্রিল আরও কয়েকজন শিক্ষকের একটি দল ক্যাম্পাস ত্যাগ করে যাওয়ার সময় তাঁকেও সঙ্গে যেতে অনুরোধ করলে হবিবুর রহমানের জবাব ছিল, ‘লাইক দ্য ক্যাপ্টেন অব দ্য শিপ আই শ্যাল বি দ্য লাস্ট টু লিভ।’
এপ্রিলের ১৩–১৪ তারিখে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী দ্বিতীয়বারের মতো রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে প্রবেশ করে। যতদূর জানা যায়, পাকিস্তানি সেনারা দ্বিতীয়বার ক্যাম্পাসে গেলে হবিবুর রহমান তাদের কাছে সেনাসদস্যদের অসদাচরণের কথা তুলে ধরেন। তখন তারা হবিবুর রহমানকে ধরে নিয়ে গিয়ে জুবেরী ভবনে তাদের ক্যাম্পে রাখে। পাকিস্তানি সেনাদের হীন ও জঘন্য কর্মকাণ্ডকে ভালো হিসেবে তুলে ধরে তারা একটি চিঠি লিখে দিতে বলে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের জনপ্রিয় এই শিক্ষককে। কিন্তু তাদের এই ঘৃণ্য প্রস্তাবে রাজি হননি হবিবুর রহমান। ১৯৭১-এর ১৫ এপ্রিল পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর হাতে শহীদ হন তিনি।
আ ন ম গোলাম মোস্তফা
আ ন ম গোলাম মোস্তফা ছিলেন দৈনিক পূর্বদেশ–এর সাংবাদিক। শিশুদের খুব ভালো বাসতেন তিনি। যুদ্ধের সময় সদ্য বাবা হওয়া গোলাম মোস্তফা বাচ্চাদের বানিয়ে বানিয়ে গল্প শোনাতেন। বাচ্চাদের জন্য বই লেখারও ইচ্ছে ছিল তাঁর। তিনি বিশ্বাস করতেন, পাকিস্তান সরকার সাংবাদিকদের কোনো ক্ষতি করবে না। ১৯৭১ সালের ডিসেম্বরেরই ২ বা ৩ তারিখে রায়েরবাজারে গিয়েছিলেন সম্বন্ধির বউভাতের অনুষ্ঠানে। সকালে সবাই স্বাধীন বাংলা বেতারকেন্দ্রের অনুষ্ঠান শুনছিলেন। রাজাকারেরা ঘিরে ফেলেছিল সে বাড়ি। টেনেহিঁচড়ে নিয়ে গিয়েছিল বাড়ির ছেলেদের। পরে গোলাম মোস্তফার সাংবাদিক পরিচয় পেয়ে তারা ক্ষমা চেয়ে ছেড়ে দিয়েছিল সবাইকে।
১১ ডিসেম্বর সেদিন সারা দিন কাঁদছিল ছেলে অভী। গোলাম মোস্তফার কোলেই ছিল সে। অভীকে বুকে নিয়ে ঘুমিয়েও পড়েছিলেন তিনি। আজানের সময় ১২ ডিসেম্বর ১২–১৩ জন লোক বাড়ির সামনে এসে দাঁড়াল বন্দুক হাতে। মোস্তফা তখন কান্নারত ছেলেকে নিয়ে লনে হাঁটছিলেন। ওরা জিজ্ঞেস করল, ‘এটা কি গোলাম মোস্তফার বাড়ি? মোস্তফা কোথায়?’ তিনি এগিয়ে এসে নিজের পরিচয় দিলেন। তারা বলল, ‘ভয়ের কিছু নেই। আপনি বাচ্চাকে রেখে আসুন। পূর্বদেশ অফিসে যেতে হবে।’ গোলাম মোস্তফার ছোট ভাই পূর্বদেশ–এ গিয়ে তাঁকে খুঁজে পাননি। আর কোনো দিনই তাঁকে খুঁজে পাওয়া যায়নি।
সূত্র: রশীদ হায়দার সম্পাদিত ও বাংলা একাডেমি থেকে প্রকািশত গ্রন্থ স্মৃতি ৭১, বাংলাপিডিয়া ও প্রথম আলো।