এখন মানুষের অবসর ঢুকে গেছে ফেসবুকের নীল দুনিয়ায়, টুইটারের কিচিরমিচিরে, ইনস্টাগ্রাম নামের অনলাইনপল্লিতে। কী বলছে গবেষণা? সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম কতটা কমিয়ে দিয়েছে আমাদের বই পড়ার অভ্যাস?
বছর তিনেক আগে বুকারজয়ী ব্রিটিশ ঔপন্যাসিক হাওয়ার্ড জ্যাকবসন যে ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন, তা বোধ হয় একটু একটু করে ফলতে শুরু করেছে। হাওয়ার্ড বেশ উদ্বেগ নিয়ে বলেছিলেন, কুড়ি বছরের মধ্যেই ফেসবুক, টুইটার শিশুদের মূর্খ বানাবে। তাঁর ভবিষ্যদ্বাণী সত্যিই অক্ষরে অক্ষরে মিলে যাবে কি না, তা জানার জন্য বিশ্ববাসীকে আরও অন্তত সতেরো বছর অপেক্ষা করতে হবে। তবে ফেসবুক-টুইটারসহ বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ইতিমধ্যে মানুষকে পুরোপুরি বইবিমুখ পরিণত করতে না পারলেও মানুষের বই পড়ার অভ্যাস যে অনেকটাই কমিয়ে দিয়েছে, তা বোঝার জন্য সতেরো বছর অপেক্ষা করার প্রয়োজন নেই। এখনই সে করুণ দৃশ্য দেখা যাচ্ছে বিভিন্ন দেশের গবেষণা ও জরিপের পাতায় পাতায়।
এমনই এক গবেষণা নজরে এল গুগল ঘাঁটতে গিয়ে। গবেষণাটি করেছিল মোবাইল রিপাবলিক নামের একটি আন্তর্জাতিক সংবাদ সংস্থা। ২০১৩ সালের জুনে ভারতের বিভিন্ন এলাকার ৮০০ মানুষের ওপর জরিপ চালিয়েছিল তারা। জরিপের ফল বলছে, ভারতে মানুষের মধ্যে বই পড়ার হার ক্রমাগত কমছে। এমনকি সংবাদপত্র পড়ার হারও কমছে। পাঠ্যবইয়ের বাইরে দৈনিক পড়া বলতে তারা ওই টুকটাক সংবাদপত্রই পড়েন। সেটাও পড়েন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। ওই জরিপে অংশগ্রহণকারী ৩৮ শতাংশ মানুষ বলেছেন, তাঁরা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম থেকেই খবর পড়েন, যেহেতু বেশির ভাগ সময় এই মাধ্যমে থাকেন তাঁরা।
তো সেই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলো কী? ৭০ শতাংশ বলেছেন, তাঁরা রেডিট থেকে খবর পড়েন। ৬৬ শতাংশের সরল স্বীকারোক্তি, ফেসবুক থেকে খবর পড়েন তাঁরা। ৫০ শতাংশ বলেছেন টুইটারের কথা। ৩১ শতাংশের বক্তব্য, টাম্বলার ব্যবহার করেন তাঁরা। ২৩ শতাংশ বলেছেন ইনস্টাগ্রামের কথা। ২১ শতাংশের ঝোঁক ইউটিউবের দিকে। আর ১৯ শতাংশ মানুষের মত, তাঁরা খবর পড়া কিংবা অন্য যাবতীয় পড়ার বিষয় লিংকডইন থেকেই পড়েন।
আট বছর আগের জরিপের ফল এটি। এরপর গঙ্গা-যমুনায় অনেক জল গড়িয়েছে। ভারতের মানুষের পাঠাভ্যাসের আশাব্যঞ্জক উন্নতি ঘটেছে কি এই বছর আটেকের ব্যবধানে? না। বরং অবস্থার আরও অবনতি ঘটেছে। সম্প্রতি এক সাক্ষাৎকারে ভারতের শিশু মনোবিজ্ঞানী কল্যাণী ভবদ বলেছেন, ভারতের শিশু-কিশোরদের মধ্যে বই পড়ার হার আশঙ্কাজনকভাবে কমছে। তারা বই পড়ার চেয়ে ইউটিউবে কার্টুন বা মুভি দেখতে বেশি স্বচ্ছন্দ বোধ করে। ভারতের শিশু-কিশোরদের মধ্যে বই পড়ার হার গত দশ বছরে যেভাবে কমেছে, তা রীতিমতো উদ্বেগজনক।
ভারত-পাকিস্তান পাশাপাশি দেশ। একসময় বৃহত্তর ‘ভারতবর্ষ’ বলে পরিচিত ছিল বাংলাদেশ, ভারত ও পাকিস্তান। সংগত কারণে এসব দেশের মানুষের রুচিগত তারতম্যও খুব সামান্য। ভারতের পাঠকদের যখন এই অবস্থা, তখন স্বাভাবিকভাবেই মনে প্রশ্ন জাগে, পাকিস্তানের অবস্থাটা কেমন? আবারও শরণাপন্ন হওয়া যাক গুগলের।
গুগল ঢুঁড়ে পাকিস্তানের পাঠকদের ওপর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের প্রভাব নিয়ে একটি গবেষণা প্রবন্ধ পাওয়া গেল। গবেষণাটি করেছেন পাকিস্তানের চারজন বিশ্ববিদ্যালয়শিক্ষক। পাঞ্জাব বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই শিক্ষক মুহাম্মদ রফিক ও আন্দলিব আসিম এবং লাহোরের গভর্নমেন্ট কলেজ ইউনিভার্সিটির শিক্ষক মুহম্মদ তুফাইল খান ও ইসলামাবাদের আল্লামা ইকবাল ওপেন ইউনিভার্সিটির শিক্ষক মুহাম্মদ আরিফ ৪৩০ শিক্ষার্থীর ওপর গবেষণা জরিপ পরিচালনা করেন, যাঁদের বয়স ২১ থেকে ২৫ বছরের মধ্যে। গত বছরের জানুয়ারিতে রিসার্চ গেট জার্নালে প্রকাশিত হয় তাঁদের সেই গবেষণা। ওই প্রবন্ধে দেখা যায়, ৬৩ শতাংশ শিক্ষার্থী দিনের বেশির ভাগ সময়ই ফেসবুক-টুইটারসহ বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে কাটান। ফলে বই পড়ার জন্য তেমন সময় পান না তাঁরা। এতটা সময় তাঁরা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে কী করেন?
এ প্রশ্নের উত্তরও মিলেছে গবেষণায়। ৪২ দশমিক ৯ শতাংশ শিক্ষার্থী বলেছেন, চারপাশে ঘটে যাওয়া খবর ও তথ্য জানতে তাঁরা ফেসবুকে সময় কাটান। ৩৬ দশমিক ৭ শতাংশ বন্ধু ও শিক্ষকদের সঙ্গে একাডেমিক তথ্য বিনিময় করতে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ঘুরে বেড়ান। ৩৩ শতাংশের ভাষ্য, তাঁরা ফেসবুকে থাকেন শুধু বন্ধুদের সঙ্গে গল্পগুজব (চ্যাট) করার জন্য। ১৬ দশমিক ৬ শতাংশ সারা দিন শুধু ছবি আপলোড করেন ফেসবুক-টুইটারে। ৯ দশমিক ৯ শতাংশের বক্তব্য, শিক্ষকদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে থাকেন তাঁরা। আর ৭ দশমিক ৭ শতাংশ শিক্ষার্থীর মন্তব্য, সমমনা ব্যক্তিদের নিয়ে ফেসবুকে গ্রুপ তৈরি করেন আর নানা বিষয় নিয়ে আলোচনা করেন।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এত কাজকর্ম করার পর স্বাভাবিকভাবেই তাঁদের হাতে আর বই পড়ার মতো সময় থাকে না। থাকে না ধৈর্য কিংবা মানসিকতাও। যে অবসরে মানুষ বইয়ের পাতা খুলে বসবে, সেই অবসর এখন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের দখলে। একসময় মানুষের উদাস দুপুর কিংবা বিষণ্ন বিকেলগুলো দখল করে থাকত নানান বই—গল্প, উপন্যাস, কবিতা। এখন মানুষের অবসর ঢুকে গেছে ফেসবুকের নীল দুনিয়ায়, টুইটারের কিচিরমিচিরে, ইনস্টাগ্রাম নামের অনলাইনপল্লিতে। ফলে কমে যাচ্ছে বই পড়ার অভ্যাস।
দক্ষিণ এশিয়ার দুই দেশের অবস্থা যখন এমন, তখন উন্নত বিশ্ব বলে যারা পরিচিত, সেই ইউরোপ-আমেরিকার অবস্থা কেমন? তাদের তো আমরা ‘রিডিং সোসাইটি’ বলে জানি। সেসব দেশের পাবলিক বাসে, মেট্রোরেলে এখনো বই হাতে মানুষ দেখা যায় বলে শুনি। বর্তমান অবস্থা কি সত্যিই এমন আছে? নেদারল্যান্ডসের ওপেন ইউনিভার্সিটির ইমেরিটাস অধ্যাপক পল ক্রিশ্চনার ২০১০ সালে গবেষণা করে দেখিয়েছেন, নেদারল্যান্ডসের ফেসবুক ব্যবহারকারীরা সপ্তাহে এক থেকে পাঁচ ঘণ্টা বই পড়ার পেছনে ব্যয় করেন, অপর দিকে যাঁরা ফেসবুক ব্যবহার করেন না, তাঁরা সপ্তাহে বই পড়েন এগারো থেকে পনেরো ঘণ্টা। তার মানে, যাঁরা ফেসবুক ব্যবহার করেন, তাঁদের কাছ থেকে বই পড়ার সময় কেড়ে নিচ্ছে ফেসবুক। তাঁরা আর আগের মতো দীর্ঘ সময় বই পড়েন না।
হায় ফেসবুক! পাঠাভ্যাসের ওপর ফেসবুকের (সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের) প্রভাব নিয়ে ২০১৭ সালে খোদ যুক্তরাজ্যে একটি জরিপ চালিয়েছিল ওয়ার্ল্ড কালচার স্কোর ইনডেস্ক নামের একটি আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান। সেই জরিপে দেখা যায়, যুক্তরাজ্যের মানুষ সপ্তাহে মাত্র পাঁচ ঘণ্টা আঠারো মিনিট সময় ব্যয় করেন বই পড়ার পেছনে। অর্থাৎ দিনে এক ঘণ্টাও নয়। বই পড়ার পেছনে সময় ব্যয় ক্রমশ কমছে। আর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বেশি সময় দেওয়ার কারণেই যে তাঁদের বই পড়ার পেছনে সময় দেওয়ার হার কমে যাচ্ছে, তা আর না বললেও চলে।
ইউরোপ থেকে এবার যুক্তরাষ্ট্রের দিকে তাকালে দেখা যাবে, সেখানেও অনেকটা ছুমন্তরে বই পড়ার সময় কেড়ে নিয়েছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম। আমেরিকান সাইকোলজিক্যাল অ্যাসোসিয়েশন ২০১৮ সালে যুক্তরাষ্ট্রের বিশ্ববিদ্যালয়পড়ুয়া শিক্ষার্থীদের ওপর জরিপ পরিচালনা করেছিল। সেই জরিপে অংশ নেওয়া ৮০ শতাংশ তরুণ-তরুণী বলেছেন, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহার করার কারণে বই পড়ার সময় পান না। তাই দিনে তাঁরা এক ঘণ্টাও বই পড়েন না। অন্যদিকে মাত্র ২০ শতাংশের কথা, প্রতিদিন তাঁরা কিছু না কিছু পড়েন। সেটা সংবাদপত্র, ম্যাগাজিন, বই—যা কিছু হোক না কেন।
প্রায় একই ধরনের ফলাফল উঠে এসেছে ইউএস ব্যুরো অব লেবার স্ট্যাটিসটিকস পরিচালিত জরিপেও। প্রতিষ্ঠানটি ২৬ হাজার মানুষের ওপর জরিপ চালায়, যাঁদের বয়স ৩৫ থেকে ৪০ বছর। জরিপে দেখা যায়, ২০০৪ সালে মানুষ যতটুকু সময় বই পড়ত, বর্তমানে তা ৩০ শতাংশ কমে গেছে। আর এই হ্রাসের পেছনে রয়েছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের ঝকমারি দুনিয়া।
যুক্তরাষ্ট্রে উদ্ভাবিত এই সব সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম দখল করেছে সারা বিশ্ব। বাদ নেই বাংলাদেশও। বাংলাদেশের পাঠকদের কী অবস্থা, এখন নজর দেওয়া যাক সেদিকে। বাংলাদেশে ২০১৮ সালে শিক্ষার্থীদের ওপর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের প্রভাব নিয়ে গবেষণা করেছিলেন খুলনার নর্দান ইউনিভার্সিটি অব বিজনেস অ্যান্ড টেকনোলজির ইংরেজির প্রভাষক মো. ওবায়দুল্লাহ ও খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজির সহযোগী অধ্যাপক মোল্লা আজিজুর রহমান। তাঁদের গবেষণা প্রবন্ধটি প্রকাশিত হয় রিসার্চ গেট জার্নালে। ওই প্রবন্ধ থেকে জানা যায়, তাঁরা ৯৬ জন শিক্ষার্থীর ওপর জরিপ চালিয়েছিলেন। এর মধ্যে ৬২ দশমিক ৫ শতাংশ বলেছেন, অবসরে তাঁরা ফেসবুকে চ্যাট করেন। আর ৩৭ দশমিক ৫ শতাংশের ভাষ্য, অবসরে তাঁরা উপন্যাস পড়েন। ৭৭ দশমিক ১ শতাংশ বই পড়ার চেয়ে ফেসবুকে সময় কাটাতে কিংবা ইউটিউবে মুভি দেখতে বেশি পছন্দ করেন। তবে মাত্র ৬ দশমিক ২ শতাংশ বলেছেন, তাঁরা ফেসবুকে থাকার চেয়ে বই পড়তে পছন্দ করেন। ৩৩ দশমিক ৩ শতাংশ দিনে একটিও বই পড়েন না। আর ৩২ দশমিক ৩ শতাংশের কথা, দিনে ১ ঘণ্টা বই পড়েন।
এই সব গবেষণা ও জরিপ থেকে সহজেই অনুমান করা যায়, সারা পৃথিবীতেই বই পড়ার হার কমছে। ঝুম বৃষ্টির দিনে শর্ষের তেলে মাখা মুড়ি খেতে খেতে কেউ আর গল্পের বইয়ে নাক ডুবিয়ে দেন না। হৃদয়ছোঁয়া কোনো উপন্যাস পড়তে পড়তে এখন রাত কাবার করে ভোর দেখেন খুব কম মানুষই। ক্লাসের বইয়ের আড়ালে কোনো গোয়েন্দা সিরিজ পড়তে পড়তে মা-বাবার চোখকে ফাঁকি দেন না কেউ। এর চেয়ে বরং বৃষ্টির দিনে ভিডিও কলে বন্ধুদের সঙ্গে লাইভ চ্যাটে বেশি আনন্দ। পাঠ্যবইয়ের আড়ালে গোয়েন্দা বই পড়ার চেয়ে ওয়েব সিরিজে গোয়েন্দা কাহিনি দেখার মধ্যেই এখন ঢের আনন্দ।
ফলে মানুষের বাড়িতে আর ‘পড়ার ঘর’ বলে কিছু থাকছে না। ড্রয়িংরুম থেকে হারিয়ে যাচ্ছে বইয়ের তাক। অথচ দার্শনিক সিসেরো খ্রিষ্টপূর্ব ১০৬ বছর আগে বলে গেছেন, ‘বই ছাড়া একটি ঘর আত্মা ছাড়া একটি দেহের মতো।’
সামনের দিনগুলোতে আমরা কি আত্মা ছাড়াই বেঁচে থাকব!
সূত্র: ইনডিপেনডেন্ট, রিসার্চ গেট জার্নাল, টাইমস অব ইন্ডিয়া, ফ্রি প্রেস জার্নাল, আমেরিকান সাইকোলজিক্যাল অ্যাসোসিয়েশন ও ইনস্টিঙ্কফিট