‘প্রথম প্রহর’ তিনবার লেখেন হুমায়ূন!
১৯৮৩ সালের শুরুর দিক। ইব্রাহীম খাঁর গল্প ‘পাখির বিদায়’ অবলম্বনে একটি নাটকের শুটিং করতে এসেছেন প্রখ্যাত প্রযোজক ও নাট্যনির্মাতা নওয়াজীশ আলী খান। বাড়ির নাম দখিন হাওয়া; উত্তম পুরুষে লেখা গল্প, গল্পে এই বাড়ির উল্লেখ আছে। ইব্রাহীম খাঁর ছেলে হাবিবুর রহমান শুটিংয়ের অনুমতি দিয়েছেন। মূল চরিত্র পাখি হয়েছেন ফাল্গুনী হামিদ।
শুটিং শুরু হলো। দখিন হাওয়ার সামনে দক্ষিণ দিকে মনোরম বাগান, সেখানেই শুটিং। হঠাৎ নওয়াজীশ আলী খান লক্ষ করেন, ক্যামেরার মনিটরে অভিনেতা-অভিনেত্রী ছাড়াও আরেকটি মুখ দেখা যাচ্ছে—কন্যাশিশু কোলে এক যুবক।
‘কাট’ বলে চেঁচিয়ে ওঠেন নওয়াজীশ।
সহকারী পরিচালক যুবকটিকে সরে যেতে বলেন।
চা-বিরতির সময় বাড়ির কর্তা হাবিবুর রহমান জানান, যুবকটি তাঁর জ্যেষ্ঠ জামাতা। হুমায়ূন আহমেদ। সদ্য আমেরিকা থেকে ডক্টরেট নিয়ে ফিরেছেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে রসায়ন পড়ান। লেখকও তিনি।
নওয়াজীশ আলী খান কৌতূহলী দৃষ্টিতে তাকান যুবকের দিকে। আরে, এর লেখা দুটি উপন্যাস তো তিনি পড়েছেন—‘শঙ্খনীল কারাগার’ ও ‘নন্দিত নরকে’। দুটি উপন্যাস নিয়েই নাটক হয়েছে। তিনি হুমায়ূন আহমেদকে প্রস্তাব দেন টিভি নাটক লেখার। সে প্রস্তাব সরাসরি নাকচ করেন হুমায়ূন।
হুমায়ূনের ভাষ্য, তিনি গল্প-উপন্যাসের লোক, নাটক লেখা তাঁর কর্ম নয়।
নওয়াজীশ আবার অনুরোধ করেন, একই জবাব আসে।
হুমায়ূনের শ্যালিকারা অনুরোধ করেন, তা-ও হুমায়ূনের একগুঁয়ে জবাব, না।
নওয়াজীশ আলী খান অগত্যা হুমায়ূনের বাড়ির ঠিকানা এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের ফোন নম্বর নিয়ে চলে আসেন।
পরে বেশ কয়েকবার ফোন করেন নওয়াজীশ। হুমায়ূন আহমেদকে পাওয়া যায় না। তিনিও নাছোড়বান্দা। ফোন দিতেই থাকেন। অবশেষে পানও হুমায়ূনকে। এবারও যথারীতি একই উত্তর, হুমায়ূন আগ্রহ বোধ করছেন না।
নওয়াজীশ সোজা গিয়ে ওঠেন হুমায়ূনের বাড়িতে। হুমায়ূন তখন শ্যামলীতে থাকেন, নওয়াজীশের বাসাও কাছাকাছি ছিল। তবু হুমায়ূন রাজিই হচ্ছিলেন না। শেষমেশ রাজি হলেন, স্ত্রীর পীড়াপীড়িতে।
কথা আদায় করে নওয়াজীশ ফিরে যান। এরপরও তিনি হুমায়ূনকে ফোন দিয়ে তাগাদা দিতে থাকেন। তারপর একদিন দেখা গেল, সত্যি সত্যি পাণ্ডুলিপি নিয়ে বিটিভিতে হাজির হয়েছেন হুমায়ূন। নাটকের নাম ‘প্রথম প্রহর’। মেসবাড়িকেন্দ্রিক নাটক। সরল-সহজ সংলাপ, ছোট ছোট দৃশ্য। চরিত্রও কম। প্রথমবার শুনেই নওয়াজীশ মুগ্ধ হলেন। জোর প্রস্তুতি চলল দৃশ্যধারণের।
এমন সময় ছোট্ট এক সমস্যা বাধাল গল্পের মহিম নামের একটি চরিত্র। এই চরিত্র ধুতি পরে।
মাত্র কিছুদিন আগেই আবদুল্লাহ আল মামুন (প্রয়াত) রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের একটি নাটক করেছেন, যেখানে সংগত কারণেই পুরুষ শিল্পীরা ধুতি পরেছে এবং তা নিয়ে বেশ একচোট হম্বিতম্বি করে গেছেন তৎকালীন তথ্যমন্ত্রী শাহ আজিজুর রহমান।
মহিমের চরিত্র দেখে নওয়াজীশ আলী খানের অবস্থা ঘরপোড়া গরুর মতন। সিঁদুরে মেঘ দেখেছেন তিনি। এ নাটক বানাবেন কীভাবে? যোগাযোগ করলেন নাটক বিভাগের প্রধান আতিকুল হক চৌধুরীর সঙ্গে। আতিকুলও মহিম চরিত্র রাখতে রাজি হলেন না।
সে সময় বিটিভির একটি গানের অনুষ্ঠানে এসেছিলেন পশ্চিমবঙ্গের গীতিকার গৌরীপ্রসন্ন মজুমদার। তাঁর পরনে তিন পকেটওয়ালা শার্টের সঙ্গে প্যান্ট। সিদ্ধান্ত হলো মহিমকে এমন একটি শার্টের সঙ্গেই পাজামা পরানো হবে।
কয়েক দিন পর হুমায়ূন আসেন। সব শুনে পাণ্ডুলিপি ফেরত নিয়ে যান তিনি। পরদিন একই নামে আরেকটি নাটকের পাণ্ডুলিপি নিয়ে আসেন। এবারও নওয়াজীশ আলী খান মুগ্ধ। বনফায়ার ঘিরে নাটকটি। চরিত্ররা বনে এক রাতে ‘বনফায়ার’ উৎসবে মাতোয়ারা। হঠাৎ পাশের জলাশয়ে এক তরুণীর লাশ ভাসতে দেখা যায়। শুরু হয় জল্পনাকল্পনা। এ লাশ কার? এটি খুন, নাকি আত্মহত্যা? ...সেই ভাসতে থাকা তরুণীর লাশ নিয়ে নাটক এগিয়ে যায়।
এই নাটকটিও করা হয়নি। কারণ, এর চিত্রায়ণের জন্য যা যা প্রয়োজনীয়, বিটিভির তা ছিল না। ফলে আবার ‘প্রথম প্রহর’ বাদ।
এবারও উদ্ধারকর্তা হিসেবে আবির্ভূত হুমায়ূন। প্রবল ধৈর্য দেখিয়ে আবার একই নামে একটি নাটক লিখে আনেন। এবারের বিষয় সততা। তখন বিটিভি থেকে ত্রৈমাসিক টিভি গাইড বের হতো, সেটাতে ‘প্রথম প্রহর’-এর ঘোষণা চলে গিয়েছিল, ফলে বারবার একই নামের কাছে আশ্রয় নেওয়া। এবার আর কোনো বাধার সম্মুখীন হতে হয়নি। ১৯৮৩ সালের আগস্টে প্রচারিত হয় ‘প্রথম প্রহর’ (আদতে একে ‘তৃতীয় প্রহর’ বলাই উত্তম)। অভিনয় করেছিলেন মাসুদ আলী খান, আবুল হায়াত, লাকী ইনাম প্রমুখ।
‘প্রথম প্রহর’ দেখে বহু দর্শক ফোন করে প্রতিক্রিয়া জানান। বিটিভির স্বনামধন্য প্রযোজক বেলাল বেগ জানিয়েছিলেন, বাংলাদেশের টিভি নাটকে একটি নতুন অধ্যায়ের সূচনা হলো। সত্যিকারের টিভি নাটক এমনই হওয়া উচিত।
সে-ই শুরু!
গ্রন্থনা: রাসেল রায়হান
সূত্র: অন্যদিন বিশেষ সংখ্যা, নওয়াজীশ আলী খানের লেখা থেকে