কবির জার্নাল

পুরানো সেই দিনের কথা

রফিক আজাদ, মোহাম্মদ রফিক, হুমায়ুন কবির
রফিক আজাদ, মোহাম্মদ রফিক, হুমায়ুন কবির

‘কোথাও আমার হারিয়ে যাওয়ার নেই মানা’ গেয়ে উঠতে পারলে বেশ হতো, কিন্তু হারিয়ে যাওয়ার কোনো উপায় নেই এই শহরে, চলাই যে কঠিন হয়ে পড়েছে, পড়ছে খুব। শুধু আগেকার দিনের কথা মনে করেই খানিকটা শান্তি, সান্ত্বনা পাই, যখন যানবাহন, লোকজনের ভিড় ছিল কম। ঢাকা কলেজের দিনগুলোতে ছিলাম বাবা-মা, ভাইবোনের সঙ্গে শাহজাহানপুর রেলওয়ে কোয়ার্টার্সে, কবি হুমায়ুন কবির ছিল মালিবাগে বোনের বাড়িতে, কবি মোহাম্মদ রফিক ছিল (আমার চাইতে বয়সে কয়েক বছর বড় হলেও তুমি-তুমি সম্পর্ক হতে সময় লাগেনি) টিকাটুলির দিকটায়, বাবা-মা–ভাইবোনের সঙ্গে। আমাদের দেখা, পরিচয় পাবলিক লাইব্রেরিতে, শরীফ মিয়ার চায়ের দোকানে। আমাদের ঘনিষ্ঠতা হতে সময় লাগেনি। আমরা দিনের পর দিন শান্তিনগরের চায়ের দোকানে আড্ডা দিয়েছি চা-শিঙাড়া খেতে খেতে। হুমায়ুন তখন কবিতাই লিখত শুধু, রফিকও, রাজনীতিতে না গিয়ে। বলা উচিত, রাজনীতি থেকে বেরিয়ে এসে। ছাত্রজীবনে গভীরভাবে রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত হয়ে পড়েছিল ওরা দুজনেই। হুমায়ুন ওর মালিবাগের বোনের বাসা থেকে আসত আমাদের শাহজাহানপুরের রেলওয়ে ফ্ল্যাটে, আমরা হেঁটে হেঁটে কমলাপুরের যতটা গভীরে যাওয়া সম্ভব চলে যেতাম—এমন হয়েছে বহুদিন। তবে সবার আগে পরিচয় হয়েছিল কবি রফিক আজাদের সঙ্গে, স্বাক্ষর ছোট কাগজের সুবাদে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ঢাকা হলে গিয়ে তাঁর কক্ষ খুঁজে পেয়ে। সেদিন আমার সঙ্গে ছিল ঢাকা কলেজের সহপাঠী আবদুল হামিদ মালিক টিপু, কবি জিনাত আরা মালিক (পরে কবি মোহাম্মদ রফিকের সঙ্গে বিয়ে হলে নামে যুক্ত হয় ‘মালিক’-এর পরিবর্তে ‘রফিক’)-এর ছোট ভাই। সে কক্ষে অনেক দিন তাঁর সঙ্গী ছিলেন গল্পকার শহীদুর রহমান। এরপর একে-একে স্বাক্ষর গোষ্ঠীর প্রায় সবারই সঙ্গে পরিচয়, কারও-কারও সঙ্গে ঘনিষ্ঠতাও হয়। যতদূর মনে পড়ে, স্বাক্ষর এবং সে সময়ের আরও ছোট কাগজের কবিদের মধ্যে ছিলেন আখতারুজ্জামান ইলিয়াস, রফিক আজাদ, মোহাম্মদ রফিক, সিকদার আমিনুল হক, আবদুল মান্নান সৈয়দ, ইমরুল চৌধুরী, আফজাল চৌধুরী, প্রশান্ত ঘোষাল, জিনাত আরা রফিক, হুমায়ুন কবির প্রমুখ। ছোট কাগজ বলতে যা বোঝায়, তা-ই ছিল স্বাক্ষর। এদিক থেকে স্বাক্ষরকেই বাংলাদেশের প্রথম ছোট পত্রিকা বলা যেতে পারে বোধ হয়। তবে এটির মোট দুটি কি তিনটি সংখ্যা বেরিয়েছিল, যতদূর মনে পড়ে। স্বাক্ষর-এর পরে-পরে কালবেলা শিরোনামের ছোট কাগজটি বেরোয় জ্যোতিপ্রকাশ দত্ত ও হায়াৎ মামুদের সম্পাদনায়। স্বাক্ষর-এ আমার কবিতা প্রকাশিত হয়েছিল কি না (হওয়াই সম্ভব) মনে না পড়লেও কালবেলায় আমার কবিতা ছিল। ঢাকা শহরের কথা বলতে গিয়ে পুরোনো দিনের প্রসঙ্গ খানিকটা এল। তবে এখানে কণ্ঠস্বর-এর কথাও সঙ্গে-সঙ্গে মনে এসে পড়ে, এবং সঙ্গে সায়ীদ (আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ) ভাইয়ের নাম। তাঁর বিশাল কীর্তি ‘বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র’র নাম। বাংলাদেশের সাহিত্যজগতে কণ্ঠস্বর-এর ভূমিকা সম্পর্কে আবদুল্লাহ আবু সায়ীদের লেখা থেকে এখানে খানিকটা উদ্ধৃত করি তাঁর ভালোবাসার সাম্পান বইটি থেকে: ‘দেখতে দেখতে কণ্ঠস্বর-এর কয়েকটি সংখ্যা বেরিয়ে গেল ললনা প্রেস থেকে। কেবল বেরোল না; প্রকাশনা-সৌকর্য, লেখার মান সবদিক থেকেই যেন নিজেকেই ছাড়িয়ে যেতে লাগল। একসময় এমন অবস্থা হলো, এই পত্রিকায় লেখা ছাপা হওয়াকে তরুণ-লেখকেরা লেখক হিসেবে তাদের স্বীকৃতি বলে মনে করতে লাগল। সেদিন পত্রিকার এই মান আমরা কীভাবে অর্জন করেছিলাম, আজ তা ভেবে অবাক লাগে। আমার বয়স তখন ছাব্বিশ, বাকিরা তেইশের নিচে, কী করে এই দিয়ে আমরা দুই বাংলার সেরা পত্রিকাগুলোর সমকক্ষ পত্রিকা বের করলাম?’

শুরু করেছিলাম ঢাকা শহরে যে চলাফেরা কঠিন হয়ে পড়েছে সে বিষয় নিয়ে। দিনে-দিনে কঠিনতর হয়ে উঠেছে চলাচল। কবে, কীভাবে এই অবস্থা বদলাবে?

দুই.

কিছু কিছু নাটক দেখানো হয় বলে শুনি, কিছু কিছু ছবি দেখানো হয় বলে শুনতে পাই। আগের চেয়ে বেড়েছে, না, কমেছে? মানসম্পন্ন নয় তেমন শুনতে পাই। আগে নিয়মিতই চলচ্চিত্র প্রদর্শনী হতো। সমিতি ছিল, আয়োজন করত। এখনো কি তেমনটা হয়? কত কত চলচ্চিত্র সমিতি ছিল। একজন মুহম্মদ খসরু ছিলেন। বাংলাদেশের চলচ্চিত্র-আন্দোলনে তাঁর তুলনা খুঁজে পাওয়া ভার। আরও মানুষজন ছিলেন। কত কত চলচ্চিত্র উৎসব ছিল। সেসব নিয়ে প্রথম আলোতেই কত কত লিখেছিও। না, এখন আর তেমনটা হয় না। হলে খবর পেতাম। খুব কঠিন, কষ্টকর শহরে চলাচল। তবু কি দেখার উপায় খুঁজে নিতাম না?

তিন.

বিনোদন, চলচ্চিত্রের কথা হচ্ছিল। তবে বিশ্বের বর্তমান ও অতীতের নানা বিষয়ের খোঁজখবর পাওয়া ঘরে বসেও হয়, বিনোদন ঘরে বসেই হয়, শুধু যদি থাকে একটি ল্যাপটপ বা ডেস্কটপ এবং ইন্টারনেট সংযোগ। মানবজাতির কীর্তি হলোকস্ট নিয়ে অসংখ্য ছোট-বড় প্রামাণ্য ছবি দেখা হয়েছে ও হবে, দেখা মনে হয় শেষই হবে না, যতদিন বেঁচেবর্তে থাকি। আচ্ছন্ন করে রাখে। সঙ্গে-সঙ্গে আমাদের একাত্তরে পাকিস্তানিরা যে গণহত্যা চালিয়েছিল, কীভাবে ৩০ লাখ মানুষকে নির্মমভাবে হত্যা করেছিল, তা নিয়ে ভাবতে গেলেও অবসাদগ্রস্ত হতে হয়।

হলোকস্ট নিয়ে ছবিই প্রায় আচ্ছন্ন হয়ে দেখা হয়েছে, হচ্ছে প্রায় প্রতিদিন, আর মোহমুক্তির বাকি থাকছে না কিছু। বাহ্, বেশ কয়েনেজ: একদিকে বিনোদন, আচ্ছন্ন করে রাখা, অন্যদিকে মোহমুক্তি।