নিজ মহিমায় টনি মরিসন

টনি মরিসন। তাঁর লেখা সব দৃশ্য প্রথাগত সুন্দরের সঙ্গে খাপ খায় না। কিন্তু তাঁর উপন্যাস পুরস্কার পেয়েছে। এর মধ্যে ১৯৯৩ সালের নোবেলও রয়েছে। ছবি: এএফপি
টনি মরিসন। তাঁর লেখা সব দৃশ্য প্রথাগত সুন্দরের সঙ্গে খাপ খায় না। কিন্তু তাঁর উপন্যাস পুরস্কার পেয়েছে। এর মধ্যে ১৯৯৩ সালের নোবেলও রয়েছে। ছবি: এএফপি
>টনি মরিসন (জন্ম ১৮ ফেব্রুয়ারি ১৯৩১) ছিলেন মার্কিন ঔপন্যাসিক, প্রাবন্ধিক, সম্পাদক ও শিক্ষক। প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর ইমেরিটাস। প্রথম উপন্যাস ‘দ্য ব্লুয়েস্ট আই’ ছাপা হয় ১৯৭০ সালে। ১৯৭৭ সালে ছাপা ‘সং অব সলোমন’ ন্যাশনাল বুক ক্রিটিকস সার্কল অ্যাওয়ার্ড লাভ করে। পুলিৎজার পুরস্কার পান ১৯৮৮ সালে। ১৯৯৩ সালে নোবেল পুরস্কার অর্জন করেন। গত হন ৫ আগস্ট ২০১৯ সালে।

টনি মরিসনের ভাবনার চোখ ছিল স্বচ্ছ। অস্বস্তিকর কিছু সেই চোখকে ফাঁকি দিতে পারত না। দাসত্বের ছবি তিনি দেখেছেন নিজ জীবনের মধ্য দিয়ে। তিনি তখন ‘বিলাভেড’ লিখছেন। সময়টা ১৯৮৭ সাল। উপন্যাসে দেখা যায়, একজন মানুষকে গাছে ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে। তার মাথা–পা কেটে নেওয়া হয়েছে। গায়ের জামা ছাড়া তাকে চেনার আর কোনো চিহ্ন নেই। নায়িকা সেথে দাসত্বের হাত থেকে বাঁচাতে সন্তানের গলা নিজ হাতে কাটে। তার পর দীর্ঘক্ষণ মৃত সন্তানের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে শান্তভাবে।

টনি মরিসনের লেখা সব দৃশ্য প্রথাগত সুন্দরের সঙ্গে খাপ খায় না। কিন্তু তাঁর উপন্যাস পুরস্কার পেয়েছে। এর মধ্যে ১৯৯৩ সালের নোবেলও রয়েছে। সমালোচকেরা তখন তাঁর উপন্যাসগুলোকে গীতিময়, কাব্যিক বলা শুরু করলেন। মরিসন খুশি হলেন না। সাহিত্যের ভাষাকে তো সব আবরণ থেকে, কৃত্রিম লেখকপনা থেকে মুক্ত হতে হবে! তাঁর একেকটা লেখার ১৩টি পর্যন্ত পাঠ পাওয়া যায়। র‌্যান্ডম হাউসে তিনি ১৮ বছর সম্পাদকের কাজ করেছেন। জানতেন কী করে একজন পাঠককে সম্পূর্ণ অচেনা কোনো জগতে ছুড়ে ফেলতে হয়। টনি মরিসনের ভাষার ছন্দ আর শক্তি শুধু শব্দ দিয়ে তৈরি নয়। তিনি বলেন শব্দের মাঝের নিস্তব্ধতা, কথার মাঝের নাবলা কথা দিয়ে।

কালো মানুষের ভাষা হারিয়ে গেছে প্রচলিত পাঠ থেকে। টনি মরিসন সেই ভাষা আবার ফিরে পাওয়ার দাবি করেন। চালান হওয়ার অপেক্ষায় ওয়াগনে গাদাগাদি করে ঢোকানো ক্রীতদাসের দল। তারা গলা নামিয়ে গান করছে। দুই পাশে অন্ধকার। সেই অন্ধকারে গাছের ডালে বসে তাদের দিকে তাকিয়ে আছে মৃতদের অতৃপ্ত আত্মা। সেই মৃতজনেরা কারা? এরা সেই মৃতদের আত্মা, যাদের নাম লুকিয়ে আছে শিশুদের সুর করে গাওয়া ছড়ায়। অথবা ধরা যাক তাঁর নিজেরই জীবনের গল্প। কেমন করে তিনি একজন নারী হয়ে উঠছেন একটি ইস্পাত কারখানার পাশে। ছোট্ট একটা ঘর। সে ঘরে কাঁচা রঙের তীব্র গন্ধ প্রতি মুহূর্তে বের হয়ে যেতে ধমকি দিচ্ছে। তাঁর মতো মেয়ের জীবন নিয়ে কোনো বই লেখা হয়েছে কি? তেমন কোনো বই তাঁর হাতে পড়েনি। সিদ্ধান্ত নিলেন, সেই গল্প তিনিই লিখবেন। কেউ না ছাপলেও অসুবিধা নেই। সেই উপন্যাস লিখলেন। নাম দিলেন ‘দ্য ব্লুয়েস্ট আই’। হারানো কণ্ঠস্বরের সঙ্গে তিনি ফিরিয়ে নিয়ে এলেন কালো মানুষের অভিজ্ঞতা। সেখানে পাওয়া যায় হারানো সুগন্ধি তেলের গন্ধ, রান্নায় শর্ষের ঝাঁজ। এ উপন্যাসের প্রধান চরিত্র প্রথমে নীল চোখের সুন্দরী হতে চায়। পরে গর্ব করে নিজের কালো চোখ, পুরু ঠোঁট আর ছড়ানো নাক নিয়ে। নিজেদের অসুন্দর ভাবতে কে শেখাল কালোদের? কে বলল তাদের, যে তারা সুন্দর নয়? বালিকা বয়সে তিনি ধনী এক নারীর গৃহস্থালি কাজ করে তাদের পুরোনো জামা পরে ঘুরে বেড়াতেন। তখনো জানতেন যে তিনি সুন্দর। আর লেখার সময় অতুলনীয়।

সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার সঙ্গে টনি মরিসন। ছবি: রয়টার্স

ক্রোধ সৃজন করতে দেয় না। কথোপকথনে সেই ক্রোধ তিনি অচঞ্চলভাবে লুকিয়ে রাখতেন। নিজের শব্দগুলোকে বাঁচিয়ে রাখতেন অনধিকার অনুপ্রবেশের হাত থেকে। কিন্তু বর্ণবাদের উন্মত্ততার বিরুদ্ধে, ক্ষমতার বিকৃতির বিরুদ্ধে, তথাকথিত ‘শুদ্ধতা’র বিরুদ্ধে তিনি বিস্ফোরকের মতো ফেটে পড়তে জানতেন। মানুষ গোত্র-বর্ণে, সন্দেহে, ঘৃণায় এক নীল আকাশের চাঁদোয়াকে কত ভাগে না ভাগ করল! এসব না থাকলে ভাষাকে আরও ভালোভাবে কাজে লাগানো যেত।

নমনীয়তা আর প্রাণ বাঁচিয়ে রেখে কে উদ্ধার করবে ভাষাকে? কী করে সে পৌঁছাবে অনির্বচনীয়র কাছে? এ কাজ নারীরা পারেন। তাঁর উপন্যাসে পরিবার ও সম্প্রদায়কে ভালোবাসা আর কর্তৃত্ব দিয়ে এক করে রাখেন যাঁরা, তাঁরা অনিবার্যভাবেই মা, দাদি, চাচি, বোন। টনি মরিসন নিজেও সেই কাজ করেছেন। দুই সন্তানকে বড় করা, হাজারো ঘরোয়া কাজ নিজ হাতে সামলাতে সামলাতেই তিনি লিখে গেছেন। দেশজুড়ে কালো মেয়েরা তাঁর মতোই বিশৃঙ্খলা থেকে বের করে এনেছে শৃঙ্খলা। তেমন করেই এলোমেলো অক্ষর আর ভাবনাকে গুছিয়ে তিনি লিখে গেছেন উপন্যাস। নারীরাই গল্প বলে। শিশু ভোলানো, উপকথা আর রঙিন সব গল্প। এ গল্পগুলোই মৃত প্রজন্মের সঙ্গে জীবিতদের সম্পর্ক টিকিয়ে রাখে। স্মৃতিরা নারীর পোষ মানে।

বয়স্ক নারীদের জন্য টনি মরিসনের বিশেষ দরদ ছিল। তারা সবাই খুব প্রাজ্ঞ নয়, কিন্তু খুব দাপুটে। তাঁর পর-দাদির সামনে পরিবারের সব পুরুষ বিনা বাক্যে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকত। তেমনি চরিত্র ‘বিলাভেড’–এর বেবি সাগস। অথবা তাঁর নোবেল বক্তৃতায় আবাহন করা সেই বৃদ্ধা। এই বৃদ্ধা তাঁকে মনে করিয়ে দিয়েছিল ভাষার ভবিষ্যতের কথা। যে ভাষা তরুণদের হাতের তালুতে জীবন আর মৃত্যুর মাঝে ডানা ঝাপটায়।

অনুরোধ করলে টনি মরিসন বক্তৃতা, উপদেশ দিতেন। প্রিন্সটনে এ কাজ করতে হতো। তবে তাঁর আসল আনন্দ ছিল উপন্যাস লেখায়। একা থাকলে ঘণ্টার পর ঘণ্টা লিখে যেতেন একটানা। লেখার চরিত্ররা তাঁর কথা মেনে চলত। দিনের পর দিন, রাতের আঁধার না কাটতেই তিনি উঠেছেন। এক মগ কফি বানিয়ে বসতেন। আঁধার কেটে আলো পুরো ফুটে উঠলে আর অন্ধকারের দিকে ফিরে তাকাতেন না টনি মরিসন।

ইকোনমিস্ট অবলম্বনে জাভেদ হুসেন