তোমা বিনে পরিচয়-সংকটে

বাংলার ভাবুক ও মরমি কবি লালন সাঁইয়ের মৃত্যুদিন ১৬ অক্টোবর। এই সময়ে লালন ও তাঁর দর্শন কতটা প্রাসঙ্গিক? আমাদের সামনে এখন অসহিষ্ণু এক বাস্তবতা। ক্রমাগত বাড়ছে ভেদ–বিভেদ আর উত্তেজনার আগুন। এখনো আমরা পাহাড়ি-বাঙালি, বাঙালি-বাংলাদেশি, মুসলিম-অমুসলিম ইত্যাদি পরিচয়ের পারস্পরিক দোলাচলে অস্থির। এই সময়ে দাঁড়িয়েই আবার ‘অপর’–এর ভিন্নমতকেও আর সহ্য করতে পারছি না আমরা। বাস্তবতা যখন এমন, তখন কতটা জরুরি লালন? এবারের প্রচ্ছদে এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজে দেখা।

পরিচয় নির্মাণ একটি স্বাভাবিক সামাজিক প্রক্রিয়া। যেকোনো বাস্তবতায় কার্যকরভাবে জীবন যাপন করার জন্য সংশ্লিষ্ট পরিবেশের বস্তুগত, অবস্তুগত ও জৈবিক উপাদানকে চেনা, জানা ও বোঝা প্রয়োজন। এই তাগিদ থেকে ব্যক্তি, বস্তু, প্রতিষ্ঠান ও প্রক্রিয়ার নামধাম এবং উপযোগিতা-অনুপযোগিতার ফিরিস্তি তৈরি করে সমাজ। সমাজবদ্ধ মানুষের ব্যক্তিগত ও সামষ্টিক পরিচয়ও তৈরি হয় একই প্রক্রিয়ায়। ব্যক্তি ও গোষ্ঠী বিচিত্র কর্মে, প্রতিষ্ঠানে ও কাঠামোতে সম্পৃক্ত থাকে বলে তারা শুধু একটি নয়, বহুবিধ পরিচয়ে পরিচিত হয়। একজন মানুষ একই সময়ে কারও সন্তান, কারও পিতা বা মাতা, কারও ভাই বা বোন, কারও সহকর্মী, কারও বন্ধু বা শত্রু। আবার লিঙ্গ, গাত্রবর্ণ, জাতপাত, ধর্ম, অর্থবিত্ত, পেশা, জন্মস্থান, ভাষা বা জাতীয়তা ইত্যাদির নিরিখেও পরিচয় তৈরি হয়। এগুলো আমাদের কোনো ব্যক্তি বা ব্যক্তিবর্গের ব্যাপারে ধারণা পেতে সাহায্য করে। আজকের পৃথিবীতে ‘প্লুরালিস্টিক সোসাইটি’ বা বহুত্ববাদী সমাজে (এখানে সর্বজনের সমাজ অর্থে বলা হচ্ছে) সবাই মানবিক মর্যাদায় বসবাস করবেন বলে আমরা স্বপ্ন দেখি। তবে বাস্তবতা হলো এসব পরিচয়কে ঘিরে স্থানীয়, আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে তৈরি হয় অগণিত সংঘাত-সংঘর্ষ।

পরিচয়কেন্দ্রিক সংঘাত

কিছু উদাহরণ দেওয়া যাক। বাংলাদেশে এই মূহূর্তে ১১ লাখ রোহিঙ্গা শরণার্থী পাশের দেশ মিয়ানমার থেকে পালিয়ে এসে মানবেতর জীবন যাপন করছে। ভারতের আসাম থেকে আরও ১৯ লাখ বাংলাভাষী মানুষ একই রকম পরিণতির শিকার হতে যাচ্ছে বলে মানবাধিকারকর্মীরা আশঙ্কা করছেন। পশ্চিমবঙ্গ থেকেও এ ধরনের আওয়াজ আসছে। কেন এই আওয়াজ? কারণ, তাঁদের পরিচয় ‘ভিন্ন’। যেহেতু ‘ভিন্ন’, সেহেতু ‘হীন’ এবং সে জন্যই তাঁরা পৃথিবীর নানা প্রান্তে বিচিত্রভাবে বিভিন্ন মাত্রার নিপীড়নের শিকার হচ্ছেন (বা ভয়ে আছেন)। কেউ প্রাণ দিচ্ছেন আর কেউবা ঘৃণার পাত্র হয়ে দিনাতিপাত করছেন। কেউ কেউ করছেন ‘মর্যাদা’ প্রতিষ্ঠার লড়াই। এ দেশে আমরা আজও পাহাড়ি-বাঙালি, বাঙালি-বাংলাদেশি, মুসলিম-অমুসলিম ইত্যাদি পরিচয়ের পারস্পরিক ঠেলাঠেলির কোনো সুরাহা করতে পারিনি। দেশে-বিদেশে পরিচয়কেন্দ্রিক এসব সংঘাত-সংঘর্ষ নিরসনে বাংলার ভাবুক লালন সাঁই (১৭৭২, মতান্তরে ১৭৭৪—১৮৯০) কি আমাদের কোনো পথ দেখাতে পারেন? তাঁর কালামে কি এ বিষয়ে কোনো ইঙ্গিত আছে? বলা প্রয়োজন, অনেকের কাছে তিনি লালন ফকির হলেও অর্থবিত্তের দিক থেকে কোনোমতেই ‘মিসকিন’ ছিলেন না। মৃত্যুর আগে আগে নগদ দুই হাজার টাকার উইল তৈরি করেছিলেন তিনি।

পরিচয়–মোচন নয়, পরিচয় প্রকাশ ও লালনের দাওয়াই

জীবনসায়াহ্নে লালনের শিষ্যের সংখ্যা ছিল আনুমানিক ১০ হাজার। গুণমুগ্ধদের তালিকায় ছিলেন কলকাতার ঠাকুরবাড়ির সদস্যরা এবং গগন হরকরার মতো বিখ্যাত ব্যক্তি। তাঁদের কেউই আজ অব্দি নিশ্চিত করতে পারেননি তিনি কোন ধর্মের, কোন জাতের ও কোন গোত্রের। প্রশ্ন হলো, শিষ্যদের কাছে লালন নিজের কোন পরিচয় তুলে ধরেছেন? আমরা দেখি, ব্যক্তি লালন তাঁর জাত-জন্মের সবকিছু মুছে ফেলেছেন। এর মানে কি তিনি সবার মাঝে পরিচয়হীনতাকে প্রচার করতে চেয়েছেন?

লালন মানুষের পরিচয়হীনতাকে প্রচার করেননি, এমনকি সবাইকে তাঁর মতো সম্ভাব্য সমস্ত পরিচয়সূচক চিহ্ন মুছে ফেলার, ব্যক্তিকে সব পরিচয়ের ঊর্ধ্বে ওঠার পরামর্শও তিনি দেননি। তিনি জাত-জন্ম-ধর্মকেন্দ্রিক সব পরিচয়কে খারিজ করেননি। কারণ, সমাজবদ্ধ জীবনযাপনের জন্য পরিচয় দরকার—তা রক্তসম্পর্ক, লিঙ্গ, ধর্ম ইত্যাদি যেকোনো চিহ্ন বা কাঠামোকে আশ্রয় করেই হোক। লালন যদিও জাতীয়তা, ভাষা, রাষ্ট্র ইত্যাদির প্রসঙ্গ আনেননি, আমরা চাইলে এই সময়ে সেগুলোকে এই তালিকায় যুক্ত করতে পারি। লালন কোনো পরিচয়কে খারিজ না করে সেগুলোর যৌক্তিক পর্যালোচনার তাগিদ দিয়েছেন। নিজের গানে একাধিকবার লালন বলেছেন, সবাই তাঁকে তাঁর পরিচয় জিজ্ঞেস করে। কিন্তু লালন তাঁর বুদ্ধি প্রয়োগ করে সামাজিক পরিচয়ের স্বয়ম্ভু কোনো সারবস্তু খুঁজে পাননি। একটু উদাহরণ দেওয়া যাক। ধর্মের যেসব চিহ্ন ধারণ করে ধার্মিকগণ পুলকিত হন, সেগুলো অনেক ক্ষেত্রে অন্য অন্য ধর্ম ও সংস্কৃতিরও বৈশিষ্ট্য। জাতপাত যে নেহাত আরোপণমূলক পরিচয়, তা আমরা সবাই জানি। অন্যদিকে ধন, জীবন, যৌবন ইত্যাদির নিরিখে তৈরি হওয়া পরিচয়ও তো অনিত্য নয়। তাই আক্ষেপ করে লালন বলেন, পরিচয়ের প্রকৃত রূপ আজও তার অজানা রয়ে গেল: ‘সব লোকে কয় লালন কী জাত সংসারে/ লালন কয় জাতের কী রূপ দেখলাম না এ নজরে।’

তিনি হিন্দু, খ্রিষ্টান ও মুসলমানদের বিভিন্ন আচারের উদাহরণ দিয়ে দেখিয়েছেন যে পরিচয়-নির্মাণের ব্যাপারটি কোনো সমাজেই নির্দিষ্ট সূত্র মেনে তৈরি হয় না। তারপরও জগৎজুড়ে এই পরিচয় নিয়ে মানুষের মধ্যে আলোচনা-সমালোচনা ও দ্বন্দ্ব-সংঘাতের শেষ নেই। সামাজিক পর্যালোচনা অব্যাহত থাকলে সবাই উপলব্ধি করবেন যে পরিচয় নির্মাণের ব্যাপারটি যুক্তিনির্ভর নয়, আরবিটরারি। তখন, তিনি আশা প্রকাশ করেন, পরিচয়কে ঘিরে হামবড়া ভাব কমে যাবে।

জনপরিসরে পরিচয়ের বাহাদুরি নয়

লালন সব ধরনের পরিচয়ের স্বীকৃতি দেন। তবে পরিচয়কেন্দ্রিক রাজনীতির মূলে যে নিজের আধিপত্য ও অপরের অধস্তনতা প্রতিষ্ঠার অন্তহীন বাসনা থাকে, এই বিষয়ে যেহেতু তিনি পুরোপুরি সজাগ, তাই জনপরিসরে এর দাপট কমানোর পরামর্শ তিনি আমাদের দেন। পরিচয় নিয়ে মানুষ যখন আর দশজনের সঙ্গে জনপরিসরে (পাবলিক স্ফিয়ারে) সম্পৃক্ত হবেন, তখন যেন পরিচয়ের বাহাদুরি না থাকে। তিনি বলেন, ‘লালন কয় জাতের ফাতনা/ ডুবিয়েছি সাধ বাজারে।’

আগেই বলেছি, মানুষ পরস্পরের সঙ্গে, বস্তুর সঙ্গে এবং সামাজিক সংগঠন ও প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে নানান ধরনের সম্পর্ক তৈরি করে এবং বিভিন্ন পরিচয়ে পরিচিত হয়। একেকটি পরিচয় একেক মাত্রার ক্ষমতা ও আধিপত্যের নির্দেশক। এখন জনপরিসরে সেই আধিপত্যকে কীভাবে কমানো যাবে? এ ব্যাপারে লালন প্রতিটি পরিচয়ের ভিত্তিমূলে দৃষ্টি দেন। এসব সম্পর্কের ভিত্তিমূলে প্রতিযোগিতা থাকে? অন্যকে ছাড়িয়ে যাওয়ার বাসনা থাকে? নাকি যোগ্যতম হিসেবে টিকে থাকার খায়েশ থাকে? যদি পুঁজি, মুনাফা বা খ্যাতি অর্জনের প্রতিযোগিতা কোনো সম্পর্কের ভিত্তিমূলে থাকে, তাহলে সেই সম্পর্ক শেষ পর্যন্ত জবরদস্তি, শোষণ-পীড়ন-বঞ্চনা ও ভোগান্তি নিয়ে আসে। যেমন ১৯৪৭ সালে পাকিস্তানি (মুসলিম) জাতীয়তাবাদ ও ভারতীয় (হিন্দু) জাতীয়তাবাদ ঔপনিবেশিক শাসনের ইতি ঘটিয়েছে সত্য, তবে এই জাতীয়তাবাদই কিছুকাল পর উভয় দেশে নিষ্পেষণের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হতে শুরু করেছে। কারণ, এই পরিচয়ের ভিত্তিমূলে ছিল শাসনক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হওয়ার আকাঙ্ক্ষা। লালন জানেন, সমাজে সব সময়ই পরিচয় নির্মাণ-পুনর্নির্মাণের প্রক্রিয়া চলতে থাকে। আর তাই এই প্রক্রিয়ায় বিশেষ একটি উপাদান যোগ করার পরামর্শ তিনি দেন। সেটি হলো অপরের প্রতি দাস্যভাব। এ বিষয়ে লালনের গান থেকেই উদ্ধৃত করা যেতে পারে, ‘ভুল বুঝি পড়েছে তোর/ আমি সেই ছিদাম নফর’, কিংবা ‘দৃষ্টি দেখো তুমি আমার/ ছিদাম নফর তোমার’ ইত্যাদি। অর্থাৎ অপরের সাপেক্ষে লালন নিজে নফর বা ভৃত্যের মনোভঙ্গী নিয়ে হাজির থাকতে চান। আধিপত্যবাদী মনোভঙ্গি নিয়ে নয়, ‘গৌরের সঙ্গে যাবি দাসী হবি/ এইটা মনে কর বাসনা।’

কুষ্টিয়ার ছেঁউড়িয়ায় লালন শাহের আখড়ায় তাঁর স্মরণোৎসবে বাউল গানের আসর। ছবি: কবির হোসেন

পরিচয়কেন্দ্রিক বাহাদুরিকে দমিয়ে রাখবে দাস্যভাব

সামাজিক পরিচয়গুলোর সঙ্গে দাস্যভাব যোগ করলে সেই পরিচয়ের জবরদস্তিগুণ হ্রাস পায়, অন্যের ওপর আধিপত্য বিস্তারের বাসনাও যায় কমে। তখন সমাজবদ্ধ মানুষ পরস্পরের সঙ্গে এবং তাদের পরিবেশ ও প্রতিবেশের সঙ্গে সেবায়েত হিসেবে হাজির থাকে। ফলে সামাজিক সম্পর্কগুলো হয়ে ওঠে মানবিক। লালনের মত হলো, মানুষ যেকোনো পরিচয় ধারণ করতে পারে। সেই পরিচয়ের মধ্যে কোনটি শ্রেয়তর আর কোনটি হীনতর, সে বিবেচনা নিতান্তই অর্থহীন। কেননা, বিশেষ সামাজিক বিন্যাসে মানুষের কোন পরিচয়টি কখন আধিপত্য বিস্তার করবে, সেটি স্থির নয়। বাসচালক, চিকিৎসক ও পুলিশের মধ্যে কোন পরিচয়টি বেশি আধিপত্য তৈরি করবে, তা নির্ভর করে পরিস্থিতির ওপর। ঠিক তেমনি বিশেষ গাত্রবর্ণ যেমন শ্রেষ্ঠত্বের নিদর্শন হতে পারে, তেমনি শারীরিক গঠন—যেমন উচ্চতা বা স্থুলতাও হতে পারে অপরকে দমিয়ে রাখার অজুহাত। আর এই পরিচয়কেন্দ্রিক আধিপত্য বিস্তার কোনো সূত্র বা ফর্মুলার অধীন নয়। সে জন্য কারও পরিচয় গোপন করাকে সমাধান হিসেবে হাজির করেননি লালন। বরং নিজ নিজ পরিচয়ে অন্যের সঙ্গে কীভাবে সম্পর্কিত হতে হবে, সে ব্যাপারে জোর দিয়েছেন তিনি। লালন বলেন, ‘তাইতে বলি ওরে কানা/ সর্বজীব হয় গুরুজনা।’ আমাদের সতর্ক থাকা প্রয়োজন যে দাস্যভাবে হাজির থাকা এবং অন্যের দাস হওয়া সম্পূর্ণ ভিন্ন বিষয়।

সমাজে দাস্যভাব প্রবল হলে সমাজ কাঠামোর সম্ভাব্য কোন ধরনের রূপান্তর ঘটতে পারে? ব্যাপারটা স্পষ্ট করার জন্য একটি উদাহরণ দিচ্ছি। বর্তমানে উন্নয়নশীল দুনিয়ার আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর প্রত্যেক সদস্য যদি তাঁদের পেশাগত দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে দাস্যভাব বজায় রাখেন, তাহলে সেই জবরদস্তিমূলক প্রতিষ্ঠানটির কোন ধরনের রূপান্তর ঘটবে? আমাদের প্রস্তাব হলো, তখন প্রতিষ্ঠানটিতে যেমন তাৎপর্যপূর্ণ পরিবর্তন আসবে, তেমনি ইতিবাচক পরিবর্তন আসবে অন্যান্য রাষ্ট্রীয় ও অধিরাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান ও কাঠামোতে।

লালনের দাওয়াইয়ের অভিনবত্ব কী?

সমস্ত সামাজিক পরিচয়ের সঙ্গে দাস্যভাবকে যুক্ত করার প্রকল্প কি লালনের অভিনবত্ব? ব্যাপারটার একটু ব্যাখ্যা দরকার। আমাদের সমাজে কোনো একজন মৃত্যুপথযাত্রী অন্যদের কাছে কী বলে বিদায় নেন বা নিতে চান? তিনি সবার কাছ থেকে ক্ষমা চেয়ে নেন। একজন চাকুরে অন্যত্র বদলি হওয়ার পর অন্য সহকর্মীদের কাছ থেকে বিদায় নেওয়ার বেলায়ও ক্ষমা চান। আবার, সাধ্যাতীত আপ্যায়ন করার পরও গৃহকর্তা তাঁর সম্ভাব্য দোষত্রুটির জন্য অভ্যাগতগদের কাছে ক্ষমা চান। আবার অতিথিকে বিদায় জানানোর বেলায়ও একজন গৃহী অতিথির কাছ থেকে ক্ষমা প্রার্থনা করেন। ব্যাপারগুলো যে সবাই যুক্তি-বুদ্ধি দিয়ে বুঝে করেন, তা হয়তো নয়। আমাদের সামাজিকীকরণ প্রক্রিয়া সবাইকে এগুলো নিজেদের অজান্তেই শিখিয়ে দিয়েছে। প্রতিটি ক্ষেত্রে এমন ক্ষমার মাহাত্ম্য কী? ক্ষমা প্রার্থনার মূলে আছে বিশেষ ‘অবলিগেশন’ বা দায়িত্ববোধ। অন্যের সঙ্গে সেবার সম্পর্কে সম্পর্কিত হওয়ার বাসনা। যেহেতু সেই সেবা তাঁদের বিবেচনায় যথাযথ হয়নি, তাই তাঁরা ক্ষমা প্রার্থনা করেন।

এই কয়েকটি উদাহরণ থেকে এতক্ষণে এটি স্পষ্ট যে দাস্যভাবে অপরের সঙ্গে সম্পৃক্ত হওয়ার মনোভঙ্গিই হলো আমাদের আবহমান সংস্কৃতির বেসলাইন বা ভিত্তিমূল। বঙ্গভূমি অথবা বৃহৎ বঙ্গে বসবাসকারী হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টান বা মুসলমান সবাই এই চেতনাটুকু লালন ও ধারণ করে। আমরা আজ যদি বাঙালি সংস্কৃতির সদ্‌গুণের হদিস করি, তবে সমাজে সবার দাস হিসেবে সেবামূলক কর্তব্য পালনে ব্রতী হওয়ার ব্যাপারটা সর্বাগ্রে গণ্য হতে পারে। আর লালন সেই সদ্‌গুণটিকেই একটি ‘প্লুরালিস্টিক সোসাইটি’ বা সর্বজনের সমাজে সব পরিচয়ের সঙ্গে জুড়ে দেওয়ার তাগিদ দেন।

প্রশ্ন আসতে পারে, বিশ্বব্যাপী সর্বজনের সমাজ নির্মাণের হরেক রকম তত্ত্ব দার্শনিক ও পণ্ডিতেরা ইতিমধ্যে দিয়েছেন। এ ব্যাপারে আবার কেন আমরা লালনের আশ্রয় নিচ্ছি? জবাবে বলা যায়, গত শতক থেকে পণ্ডিতেরা এই প্রসঙ্গে যত তত্ত্ব হাজির করেছেন, তার সবই তৈরি হয়েছে ইউরোপ-আমেরিকার সংস্কৃতির ঔচিত্যবোধের ধারণা থেকে। সেসব সমাজে ঐতিহাসিকভাবে সর্বজনের সমাজ তৈরি করার তাগিদ শুরু হয়েছে পুঁজিবাদের প্রয়োজনে। ফলে সর্বজনের সমাজ নির্মাণ আজও তাঁদের কাছে স্বপ্নই রয়ে গেছে। অন্যদিকে লালন এমন সমাজের নির্যাস থেকে তাঁর দাওয়াই হাজির করেছেন, যেখানে হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিষ্টান–মুসলমানরা শত শত বছর ধরে পাশাপাশি বসবাস করেছে। বঙ্গের এই সমাজ আবহমান কাল থেকেই ‘প্লুরাল’ বা বহুজনের সমাজ। আর ইউরোপ–আমেরিকা ‘প্লুরাল’ বা বহুজনের হয়েছে মাত্র কয়েক শ বছর যাবৎ।

হালের পণ্ডিতেরা বলেন, পরিচয়কেন্দ্রিক সংঘাত-সংঘর্ষের মূল কারণ হলো ‘অপরের’ প্রতি আক্রমণকারী ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর মনোভঙ্গি। লালনও এ বিষয়ে পুরোপুরি একমত। তবে এই দুই ঘরানার মধ্যে তফাতও আছে। অধুনা তত্ত্ব রাষ্ট্রযন্ত্র দিয়ে এই পরিচয়ের সংঘাত প্রতিরোধ করতে চায়। অন্যদিকে লালন প্রতিটি পরিচয়ওয়ালার অন্তর্গত রূপান্তরের মধ্য দিয়ে আক্রমণকারীকে সেবায়েতে রূপান্তর করার প্রকল্প হাজির করেন। তাঁর প্রকল্পে সবাই নিজ নিজ পরিচয়ে দাস্যভাবে হাজির থাকবেন, সেবায়েত হবেন।