ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শতবর্ষ উপলক্ষে এ আয়োজনের দুটি লেখায় থাকছে এই বিদ্যায়তনের সোনালি সময়ের ছবি
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শতবর্ষে ফিরে পড়া যাক এই বিশ্ববিদ্যালয়ের এক খ্যাতিমান শিক্ষক অ্যামি জেরাল্ডিন (এ জি) স্টকের স্মৃতিকথা। স্টক তিনটি রাষ্ট্র—১৯৪৭ সালে অখণ্ড ভারতের শেষার্ধে, ১৯৪৭-এর আগস্টে সদ্য প্রতিষ্ঠিত পাকিস্তান থেকে ১৯৫১ সাল পর্যন্ত এবং স্বাধীন বাংলাদেশে বছর কয়েক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগে অতিথি অধ্যাপক হিসেবে শিক্ষকতার বিরল অভিজ্ঞতার অধিকারী। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্মৃতি ১৯৪৭-১৯৫১ বইটি তাঁর প্রথম পর্বে চার-পাঁচ বছর শিক্ষকতাকালের অসাধারণ স্মৃতিচারণা, যেখানে পাঠদান কেন্দ্রের পাশাপাশি পূর্ব বাংলার সাহিত্য-সমাজ-সংস্কৃতি-রাজনীতি নিয়ে সূক্ষ্ম ও স্বচ্ছ ভাবনাচিন্তার অকপট প্রকাশ ঘটেছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিদায় নেওয়ার দুই দশক পর ১৯৭০ সালে বড়দিনের ছুটির প্রাক্–মুহূর্তে ইংল্যান্ডের এক শান্ত পল্লি-পরিবেশে বইটি লেখার সূত্রপাত। ভূমিকায় ১৯৭৩- আ গ্রিন বুক হাউস প্রকাশিত মেমোয়ার্স অব ঢাকা ইউনিভার্সিটি (মূল ইংরেজির বাংলা ভাষান্তর মোবাশ্বেরা খানম। এ লেখার সব উদ্ধৃতি সে অনুবাদগ্রন্থ থেকে গৃহীত) অংশে এ জি স্টক জানাচ্ছেন:
‘এই স্মৃতিকথায় লিখতে শুরু করেছিলাম কীভাবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আমাকে তার ক্রোধ, ক্ষোভ, চমৎকার সাহচর্য ও অবর্ণনীয় আকর্ষণ দিয়ে অমন অপ্রত্যাশিতভাবে স্বাগত জানিয়েছিল।’
এরপর এ জি স্টক নিজেই আমাদের স্বাগত করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে কেন্দ্র করে তাঁর স্মৃতিমঞ্জরিতে।
১৯৪৭ সালের গোড়ার দিকে ৪৫ বছর বয়সী ব্রিটিশ এই শিক্ষক পত্রিকায় উগান্ডার ম্যাকারেরে কলেজে আর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজির অধ্যাপক পদের বিজ্ঞাপন দেখে আবেদন করলেন। শিক্ষাদানের জন্য দূরদেশে যাওয়া তাঁর স্বপ্ন ছিল, সাহিত্য ছিল তাঁর ভালোবাসা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন উপাচার্য মাহমুদ হোসেন অক্সফোর্ডের ছাত্রী এ জি স্টককে তাঁর ভারতবর্ষ সম্পর্কীয় আগ্রহের কারণে হয়তো জানতেন। কারণ, সে সময় তিনি অক্সফোর্ডে পিএইচডি অভিসন্দর্ভ প্রস্তুত করছিলেন। তবে ব্যক্তিগত পরিচয়ের চেয়ে স্টককের যোগ্যতা ও আগ্রহই তাঁর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়মুখী গন্তব্য স্থির করল যেন। সাতচল্লিশের জুলাইয়ে লিভারপুল থেকে ফ্রাঙ্কোনিয়া জাহাজে করে রওনা হলেন দূরযাত্রায়। পোর্ট সৈয়দ, লোহিত সাগর, এডেন বন্দর হয়ে বোম্বে বন্দরে নোঙর করল। সেখান থেকে ট্রেনে চেপে কলকাতা, কলকাতা থেকে জলপথে নারায়ণগঞ্জ বন্দরে থামল স্টিমার। সেখান থেকে ঢাকাগামী ট্রেন।
দীর্ঘ যাত্রায় এলোমেলো, বিধ্বস্ত স্টকের মাথায় তখন অনেক চিন্তা। কোথায় থাকবেন, কীভাবে মানিয়ে নেবেন অচেনা শহরে!
দেখা হলো উপাচার্য মাহমুদ হোসেনের সঙ্গে। জানালেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি বাংলো তাঁর বাসোপযোগী করা হচ্ছে। তবে সেটি যথাযথভাবে তৈরি হওয়ার আগপর্যন্ত তিনি তাঁরই অতিথি। বিশ্ববিদ্যালয়ে তখন ছুটি চলছিল আর গোটা উপমহাদেশ ‘ভারত’ ও ‘পাকিস্তান’ নামে ভাগ হওয়ার প্রহর গুনছিল। ঠিক সে সময়কার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশ্বস্ত চিত্র আঁকা হয়েছে এ জি স্টকের স্মৃতির অক্ষরে:
‘দেশের মতো বিশ্ববিদ্যালয়টিও প্রচণ্ড সংকটের ভেতর দিয়ে যাচ্ছিল। কমাস আগে এখানে ভয়ংকর এক সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা হয়ে গেছে।...এদিক-সেদিক বিশৃঙ্খলভাবে ছড়ানো লেকচার-রুমে আর অস্থায়ী কুঁড়েতে নানা অসুবিধার মধ্যে গাদাগাদি করে কাজ চলছিল।’
কিছুদিন পরই বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় নিজস্ব বাংলো পেয়ে যান তিনি। বর্ষাকালের মেঘমেদুর পরিবেশে ঢাকাজীবন শুরু হয় তাঁর। সঙ্গী বলতে বেয়ারা আবদুল; যে ঈদের দিন নিজ বাড়িতে রান্না করা রকমারি সব খাবারসহ তার কন্যাকে নিয়ে এ জি স্টকের বাংলোতে হাজির হয়ে তাঁকে বিস্মিত করে দিয়েছিল। এ সম্পর্কে স্মৃতিকথায় লিখেছেন:
‘ওরা আমাকে বাদ দিয়ে ঈদের আনন্দের কথা ভাবতেও পারেনি। সব শোভনতা রক্ষা করে ওদের পরিবারেও আমাকে ডাকতে পারছে না, সুতরাং এর চাইতে ভালো আর কোনোভাবে কাজটি করা যেত না।’
বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিসর তো শ্রেণিকক্ষসর্বস্ব নয়; এ জি স্টকের আবদুল চরিত্রকে বিশেষভাবে মনে রাখা এটাই প্রমাণ করে গভীর ভালোবাসা দিয়ে সেকালের কর্মচারীরা কী করে একজন ভিনদেশি শিক্ষকের হৃদয় জয় করে নিয়েছিল।
অচিরেই স্টকের সঙ্গে কবি জসীমউদ্দীনের পরিচয় ঘটে। তাঁর আমন্ত্রণে ১৯৪৮-এর গ্রীষ্মাবকাশে মিরপুরে এক গ্রামীণ সমাবেশে অংশ নেন। রক্ষণশীল প্রান্তিক পরিবেশে লোকনৃত্যগীতের আয়োজন উপভোগ করে এবং সাধারণ মানুষের কাছে একজন বিশিষ্ট বাঙালি কবির বিপুল গ্রহণযোগ্যতা চাক্ষুষ করে স্টকের মূল্যায়ন:
‘তিনি (জসীমউদ্দীন) সেই সব বিরল মানুষদের একজন, যাঁর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা তাঁকে তাঁর দেশীয় ঐতিহ্য থেকে বিচ্ছিন্ন করে দিতে পারেনি।’
বিশ্ববিদ্যালয় পরিবারে তাঁর প্রিয় দুই মানুষ ছিলেন খান সারওয়ার মুরশিদ ও মুনীর চৌধুরী। মুরশিদ সম্পাদিত নিউ ভ্যালুজ পত্রিকায় তিনি লিখতেন, অনুবাদ করতেন। পত্রিকাটি নিয়ে তাঁর পর্যবেক্ষণও গুরুত্ববহ:
‘একটি ইংরেজি জার্নাল, প্রায় পাক্ষিক, যার উদ্দেশ্য ছিল পূর্ব পাকিস্তানে যে নতুন চিন্তাভাবনার বিকাশ ঘটছে, সেগুলোকে তুলে ধরা। আমার কাছে এখনো যেসব পুরোনো সংখ্যা আছে, তা থেকে আমার মনে হয় প্রথম থেকে পত্রিকাটির একটি উল্লেখযোগ্য ও সাহসী অভিযান ছিল।’
ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্কের গভীরতা আঁচ করা যায় মুনীর চৌধুরীকে নিয়ে শিক্ষক স্টকের এমন সস্নেহ মন্তব্যে:
‘মুনীর হাসিখুশি একটি ঝোড়ো বাতাসের মতো মাঝেমধ্যে এসে উপস্থিত হতো, সমাজতান্ত্রিক সাহিত্যতত্ত্ব নিয়ে আলোচনা করত আর সেই সব পুলিশের সঙ্গে অপ্রত্যাশিত দেখা-সাক্ষাতের অদ্ভুত সব গল্প বলত, যারা ইতিমধ্যেই একজন সম্ভাব্য মারাত্মক বামপন্থী হিসেবে ওর ওপরে চোখ রাখছে।’
দেশবিভাগের পর শিক্ষাব্যবস্থার বিরাট পরিবর্তনের হাওয়া এসে লাগল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গায়েও। ১৯৪৮ সালে ভাষা আন্দোলনের প্রথম পর্বের উত্তাল দিনগুলোর সাক্ষী এ জি স্টক। সে বছরের ২৮ ফেব্রুয়ারি তাঁর ধারণা ও দূরদৃষ্টি এভাবেই টুকে রেখেছিলেন দিনলিপিতে:
‘ইতিমধ্যে এটা পরিষ্কার হয়েছে যে ক্ষোভ দানা বাঁধছে। সরকারি অফিসে উর্দুভাষী পাঞ্জাবিদের বিরুদ্ধে ক্ষোভ ধূমায়িত হচ্ছে। বোঝাই যাচ্ছে যে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দিলে তাতে স্বায়ত্তশাসনের সীমা যেমন অনেক বিস্তৃত হয়, তেমনি অনেক স্বাভাবিকও হয়।’
বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনি বিরক্তির সঙ্গে প্রত্যক্ষ করেছেন মুখস্থবিদ্যার স্ফীতি ও নম্বরলোভী প্রবণতা:
‘সবচাইতে খারাপ ব্যাপারের একটি হচ্ছে বিশেষ করে ইংরেজি শিক্ষায়, নির্বিচার মুখস্থবিদ্যার সঙ্গে মুক্তচিন্তার মতো কোনো বিষয়ের ভীতি যুক্ত হওয়া। সাফল্যের জন্য যখন নম্বরই প্রধান চাহিদা হয়ে দাঁড়ায়, তখন প্রার্থীরা নম্বরকেই শিক্ষার লক্ষ্য বলে ধরে নেয়।’
বিশ্ববিদ্যালয়ের সে সময়কার মেয়েদের সামষ্টিক বিষয়ে সাহসী ভূমিকা আর নিজেদের প্রকাশে রক্ষণশীল কুণ্ঠা স্টকের দৃষ্টি এড়ায়নি:
‘একই মেয়েরা, যখন কোনো নীতির জন্য লড়ছে, ধর্মঘটের সময় পিকেটিং করবে, পুলিশকে অগ্রাহ্য করবে, এমনকি আহতদের হাসপাতালে দেখতে গিয়ে প্রচলিত নিয়ম ভাঙবে। আবার এই মেয়েরাই পর্দায় অভ্যস্ত ছিল, সিনেমায় একজন বয়স্কা অভিভাবক ছাড়া যেত না, সাধারণত একই শ্রেণিকক্ষে বসে থাকা ছাত্রদের সঙ্গে কথা বলত না।’
জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতার মতো গুণী শিক্ষককে ইংরেজি বিভাগে নিয়োগ দিতে এ জি স্টককে রীতিমতো যুদ্ধ করতে হয়েছে। কারণ, তখনকার পাকিস্তান রাষ্ট্রের সাম্প্রদায়িক মনোবৃত্তি।
১৯৫০ সালের সাম্প্রদায়িক উন্মত্ততার প্রত্যক্ষদর্শী এ জি স্টক ও তাঁর সহকর্মীদের উদ্যোগে বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা ও ইংরেজি বিভাগ সীমান্তের দুই পারের বাংলাভাষী মানুষের মধ্যে মৈত্রীবন্ধন প্রতিষ্ঠার মানসে আয়োজন করেন ‘দুই বাংলার সাহিত্যের পরিপ্রেক্ষিত’ শীর্ষক সিম্পোজিয়াম। ইংরেজি বিভাগের উদ্যোগে কবি উইলিয়াম ওয়ার্ডসওয়ার্থের জন্মশতবর্ষ উদ্যাপনের বিবরণও দিয়েছেন তিনি।
বিশ্ববিদ্যালয়ের এক সমাবর্তনে আচার্যের বক্তৃতায় পূর্ব পাকিস্তানের তদানীন্তন গভর্নর ফিরোজ খান নূন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকস্বল্পতা কাটাতে ‘ভারত থেকে কোনো শিক্ষক আনা হবে না’ এমন কুটিল ইঙ্গিত করলে এ জি স্টক সমবেত শিক্ষার্থীদের মুখে অসন্তোষের আভা দেখতে পেয়েছেন, যার অর্থ সরকারের সাম্প্রদায়িক নীতির কারণেই তাদের বহু প্রিয় ও শ্রদ্ধেয় শিক্ষককে দেশত্যাগ করতে হয়েছে।
স্মৃতিকথা শেষ করার ঠিক আগে এ জি স্টকের বয়ানে পাওয়া যায় এক কৌতূহলোদ্দীপক ঘটনা। জর্জ বার্নার্ড শর মৃত্যুর পর ঢাকায় নেমে আসা শোকাবহ পরিবেশ তাঁকে অভিভূত করেছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আয়োজিত হয় স্মরণসভা। ইংরেজি বিভাগের ছাত্রছাত্রীরা তাদের প্রিয় শিক্ষক এ জি স্টককে অনুরোধ করল বিভাগের পক্ষ থেকে টেলিগ্রামে একটি শোকবার্তা প্রয়াত বিশ্বখ্যাত নাট্যজন বার্নার্ড শর পরিবারকে পৌঁছাতে। তবে তাৎক্ষণিকভাবে যথাযথ কোনো প্রাপকের সন্ধান না পেয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের শোকবার্তাটি ডাকে পাঠানো হলো সেই সময়ের ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ক্লিমেন্ট অ্যাটলিকে; এবং তাঁর দপ্তর থেকে ডাকযোগে প্রাপ্তিস্বীকারও এল। অতঃপর এ জি স্টকের মুগ্ধতামিশ্রিত মূল্যায়ন:
‘বাঙালিদের কাছে সাহিত্য জাতীয়তাবাদের প্রাণস্বরূপ, আর তাই তারা ভাবতেই পারে না যে কোনো জাতি তার বিখ্যাত কোনো লেখকের মৃত্যু একজন রাষ্ট্রনায়ক বা রাজার মৃত্যুর চাইতে কম দুঃখের সঙ্গে গ্রহণ করবে।’
হয়তো এ দেশের মানুষের এমন সব বিশেষ বৈশিষ্ট্যের সম্মোহনেই ১৯৫১-তে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছেড়ে গিয়ে আবার বছর কুড়ি পর সে বিদ্যায়তনে ফিরে আসেন তিনি। কারণ, তাঁর প্রাণে প্রোথিত ছিল এই কথাগুলো:
‘বিচিত্র এক নিসর্গ থেকে ক্রমে ছবিটা একটি দেশে রূপ নিচ্ছিল এক বিদেশির হৃদয় হরণ করার লক্ষ্যে। যত হতাশাই বিশ্ববিদ্যালয়ে হানা দিক না কেন, এটা জানতেই আনন্দ ছিল যে সেখানে ছাত্ররা আছে আলো জ্বালাতে আর সহকর্মীরা আছেন যাঁদের সঙ্গে কাজ করে আনন্দ আছে।’