>নিজের সব অনুভূতি প্রকাশের জন্য বাঙালি একজনেরই দ্বারস্থ হয় বারবার। তিনি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। আসছে ২৫ বৈশাখ তাঁর জন্মদিন। তাই এবারের প্রচ্ছদজুড়ে আছেন তিনিই।
নিজেকে আমি স্বতঃস্ফূর্ত কবি মনে করি। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরও তা–ই ছিলেন। আমি সব সময় রবীন্দ্রনাথকে অনুসরণ করেছি। পরিণত বয়সে রবীন্দ্রনাথ ছবি আঁকায় মগ্ন হয়েছেন। সেটা মেনে একসময় আমিও ছবি আঁকার চেষ্টা করেছি। বোলপুরে তিনি শিক্ষায়তন শান্তিনিকেতন গড়ে তুলেছেন। আর আমার গ্রাম কাশবনে আমিও স্কুল নির্মাণ করেছি, লাইব্রেরি গড়ে তুলেছি। সব মিলিয়ে রবীন্দ্রনাথ আমার সঙ্গে সঙ্গেই থাকেন বা আমিই থাকি তাঁর সঙ্গে।
রবীন্দ্রনাথকে আমি খুব ছোটবেলা থেকে পেয়েছিলাম। এটা আমার একটা সৌভাগ্য। কয়েক বছর আগে একবার রবীন্দ্রনাথের সার্ধশততম জন্মবার্ষিকীর অনুষ্ঠানে দিল্লিতে গিয়ে বলেছিলাম, তোমরা আজ ১৫০ বছর পর রবীন্দ্রনাথের জন্মদিন উদ্যাপন করছ। দিল্লিতে এর আগে তাঁর জন্মদিন উদ্যাপিত হয়েছিল কি না, জানি না। কিন্তু আজ থেকে প্রায় ৯০ বছর আগে, ১৯৩০ সালে শান্তিনিকেতনের বাইরে নেত্রকোনায় রবীন্দ্রনাথের জন্মদিন উদ্যাপিত হয়েছিল। শৈলজারঞ্জন মজুমদার এর আয়োজক ছিলেন। তিনি পরবর্তী সময়ে রবীন্দ্রনাথের স্নেহধন্য হয়েছিলেন এবং তাঁর ১০৮টি গানের স্বরলিপি তৈরি করেছিলেন। তিনি শান্তিনিকেতনের সংগীত ভবনের অধ্যক্ষ ছিলেন। তাঁর বাড়ি ছিল নেত্রকোনায়। ছুটিছাটায় তিনি যখন আসতেন, তখন নেত্রকোনায় ছেলেমেয়েদের রবীন্দ্রনাথের গান শেখাতেন। ১৯২০ সাল থেকে তিনি রবীন্দ্রনাথের গান শেখাতেন। ১৯৩০ সালে তিনি যখন রবীন্দ্রনাথের জন্মদিন পালন করেন, তার উত্তরে একটি পত্রে রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন, ‘তোমাদের নেত্রকোনায় আমার জন্মদিনের উৎসব যেমন পরিপূর্ণ মাত্রায় সম্পূর্ণ হয়েছে, তেমনটি আর কোথাও হয়নি। পুরীতে আমাকে প্রত্যক্ষ নিয়ে একবার সম্মান জানানো হয়েছিল। কিন্তু কবিকে অপ্রত্যক্ষ রেখে তাঁর সৃষ্টির মধ্যে যে প্রাণ প্রতিষ্ঠা, তা-ই কবির জন্য অধিক সম্মানজনক।’
আমার ছেলেবেলা থেকেই আমাদের এলাকায় রবীন্দ্রনাথের জন্মদিন উদ্যাপনের রেওয়াজ ছিল। ১৯৬১ সালে বারহাট্টা ক্লাবে আমাদের স্কুলশিক্ষক যতীন সরকার রবীন্দ্রনাথের জন্মবার্ষিকী উদ্যাপনের উদ্যোগ নিয়েছিলেন। আমরা তখন স্কুলের ছাত্র। নাইন বা টেনে পড়ি। আমি রবীন্দ্রনাথের ‘নির্ঝরের স্বপ্নভঙ্গ’ কবিতাটি পড়ে একটি পুরস্কার পেয়েছিলাম।
পাঠক সমাবেশ থেকে ২৫ খণ্ডে যে রবীন্দ্র রচনাবলি বের হয়েছে, তাতে—যেখানে ‘প্রভাতসংগীত’ আছে—বেশ কয়েক দিন আগে সেই কবিতাটি আবার খুঁজলাম। দেখি, পরবর্তী সময়ে তিনি কবিতাটিতে অনেক পরিবর্তন করেছেন।
আমার বাবা সুখেন্দু প্রকাশ গুণ রবীন্দ্রনাথের ‘দেবতার গ্রাস’ কবিতাটি ভালো আবৃত্তি করতেন। এক দুপুরে, বর্ষাকালই হবে মনে হয়, বৃষ্টি হচ্ছিল। তিনি আমাদের ‘দেবতার গ্রাস’ পড়ে শোনাচ্ছিলেন। ‘যখন সমুদ্রে জোয়ার এল, রাখালকে সমুদ্রে ফেলে দেওয়া হলো’—সেই দৃশ্যটি আমার পক্ষে সহ্য করা খুব কঠিন হয়ে পড়ল। আমি হাউমাউ করে কেঁদে ফেলেছিলাম। এখন কাঁদতে লজ্জা হয়। কিন্তু ছেলেবেলায় আমরা কাঁদতে পারি; কারণ, তখন লজ্জা থাকে না। আমাদের আবেগ আমরা নিঃসংকোচে প্রকাশ করতে পারি। বাবা অনেক বুঝিয়ে বললেন, এটি সত্য কোনো ঘটনা নয়। কিন্তু আমার কেবল মনে হচ্ছিল যে রবীন্দ্রনাথ নিষ্ঠুর। রাখালকে এভাবে নদীতে ফেলে দেওয়ার দৃশ্যটি তিনি পরিহার করতে পারতেন। আমার মনে সমুদ্রে জোয়ার আসার বিষয়টি গভীরভাবে রেখাপাত করেছিল। অনেক পরে যখন বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ নিয়ে আমি ‘স্বাধীনতা—এই শব্দটি কীভাবে আমাদের হলো’ কবিতাটি লিখি, তাতে সমুদ্রে জোয়ার আসার বর্ণনাটি আমি ‘দেবতার গ্রাস’ কবিতার মধ্যে পেয়েছিলাম। ‘দেবতার গ্রাস’ সেই কবে শুনেছিলাম ছেলেবেলায়, আমার মনের ভেতরে গেঁথে গিয়েছিল। বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের জনসভায় আসা মানুষের মধ্যে নেতা যখন এসে উপস্থিত হলেন, তখন সেটি আবার ফিরে এল আমার কবিতার ভেতর দিয়ে।
রবীন্দ্রনাথ যে কতভাবে গোচরে-অগোচরে আমাদের প্রভাবিত করেছেন, সেটি বলে শেষ করা যায় না। প্রেমাংশুর রক্ত চাই, না প্রেমিক না বিপ্লবী, কবিতা অমীমাংসিত রমণী—এই প্রথম তিনটি কাব্যগ্রন্থের মধ্যে রবীন্দ্রনাথ আমার মনে ছিলেন না। আমি যখন কবিতা রচনা করি, তখন তো আমি একা থাকি। আমার চারপাশে আমার চেয়ে শিক্ষিত বা বুদ্ধিমান কোনো মানুষ থাকে না। ফলে আমি খুব স্বাধীন থাকি। এই ঘোরের মধ্যে আমার প্রথম তিনটি কাব্যগ্রন্থের কবিতা রচিত হয়েছে। সেখানে রবীন্দ্রনাথের প্রভাব আবিষ্কার করা যাবে না। কিন্তু পরবর্তী সময়ে আমি যখন প্রেমের কবিতা লিখতে শুরু করি—দীর্ঘ দিবস দীর্ঘ রজনী, চৈত্রের ভালোবাসা, ও বন্ধু আমার, বাংলার মাটি বাংলার জল ইত্যাদি নানা কাব্যগ্রন্থের ভেতরে—তিনি আমাকে দারুণভাবে প্রভাবিত করতে শুরু করেন। তাতে আমার এই মনে হলো যে রবীন্দ্রনাথের প্রভাব ধারণ করার জন্য বোধ হয় একটু পরিপক্বতা দরকার। ফলে যত দিন যেতে থাকল, আমি তত রবীন্দ্রনাথের কাছে যেতে থাকলাম। তাঁর কাছ থেকে গ্রহণ করতে শুরু করলাম। একটা পর্যায়ে মনে হলো, এর জন্যই আমি অপেক্ষা করছিলাম। এটার জন্যই অপেক্ষা করছিলাম তো।
১৫০ বছরের বেশি সময় ধরে রবীন্দ্রনাথ আছেন আমাদের সঙ্গে। তাঁর ছেলেবেলার প্রথম দিকের বছর বিশেক বাদ দিলে—অবশ্য ২০ বছর বয়সের মধ্যেও তো তিনি অনেক কিছু লিখেছেন—১৩০ বছরের অধিককাল ধরে তিনি আছেন। এই এতগুলো বছর ধরে বাঙালি তাঁর রচনার সঙ্গে পরিচিত হয়েছে। তাঁর মধ্য দিয়ে আমাদের রুচির বিকাশ হয়েছে। আমরা প্রত্যেকেই যেমন বলি, আমার মায়ের রান্না খুব ভালো। তাঁর মতো এত ভালো রান্না আর কেউ করতে পারে না। এটা কেন হয়? কারণ, মায়ের রান্না খেয়ে আমাদের জিভ অভ্যস্ত হয়ে ওঠে। জিভের একটা নস্টালজিক অভ্যাস তৈরি হয়। আমাদের খাদ্যের স্বাদ গ্রহণের ক্ষমতাকে একটা নির্দিষ্ট জায়গায় পৌঁছে দেয়। পরবর্তী সময়ে অন্য কারও, এমনকি ফাইভ স্টার হোটেলের রান্না খেয়েও মায়ের রান্নার মতো স্বাদ পাওয়া যায় না। মায়ের রান্নার সঙ্গে আমাদের যে সম্পর্ক, রবীন্দ্রনাথের সঙ্গেও আমাদের সম্পর্কটা অনেকটা সে রকমই। রবীন্দ্রনাথকে আমরা ছোটবেলা থেকেই পড়ি। তাঁকে পড়তে পড়তে শৈশব, কৈশোর, যৌবন, বার্ধক্য—জীবনের নানা স্তর আমরা অতিক্রম করি। যেসব অভিজ্ঞতা ও বিচিত্র অনুভূতির ভেতর দিয়ে আমরা অগ্রসর হই—রবীন্দ্রনাথ আমাদের ভাষা দিয়েছেন বলে তিনি আমাদের জীবনের সঙ্গী হয়ে ওঠেন। রবীন্দ্রনাথ এভাবে আমাদের বেঁধে রেখেছেন তাঁর সৃষ্টির ভেতর দিয়ে।
মুক্তিযুদ্ধের সময় আমাদের যে নতুন অভিজ্ঞতা, সে অভিজ্ঞতার যে নতুন ভাষ্য, আমাদের নতুন কবিরা তা রচনা করেছেন। নতুন ঔপন্যাসিকেরা রচনায় তাঁদের বিচিত্র অনুভূতিকে ভাষা দিয়েছেন। সেখানে তাঁর সঙ্গে একটা পার্থক্য হবেই। সমকালীনতা বিচারে সমকালীন লেখকেরা অধিকতর প্রাসঙ্গিক হন। কিন্তু চিরকালীনতার বিচারে আমাদের বুকের গভীরে রবীন্দ্রনাথের ছায়াই আমরা আবিষ্কার করতে পারব। আমরা সুন্দরের যে ধারণা পোষণ করি, যে সুন্দর বাক্য নির্মাণ করি, যে চিত্রকল্প নিই, সেখানে রবীন্দ্রনাথেরই ছায়া দেখতে পাই। সব সুন্দরের মধ্যেই তাঁর একটা ছায়া আছে। প্রথম দর্শনের পর ফরাসি লেখক রমাঁ রলাঁ রবীন্দ্রনাথের চেহারার যে বর্ণনা দিয়েছিলেন, সেটি উপস্থাপন করে আমি এ লেখার ইতি টানব। রমাঁ রলাঁ লিখেছেন, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এসেছেন দেখা করতে। সঙ্গে তাঁর ছেলে রথীন্দ্রনাথ। রবীন্দ্রনাথের পরনে ভারতীয় পোশাক। কালো মখমলের উঁচু টুপি আর ছাই রঙের লম্বা জোব্বা। অতিমাত্রায় সুন্দর। লম্বা মুখখানা সুন্দর সুষম। খাঁটি আর্যজনোচিত। সেই টকটকে রঙের সোনালি রৌদ্রমাখা চেহারায় জীবনের দান যে উজ্জ্বল বাদামি দুই চোখ, তাতে সুন্দর চোখের পাতার ছায়া পড়েছে। খাড়া নাক। সাদা গোঁফের নিচে হাসিমুখ। রেশমের মতো দাড়ি তিন ভাগে, ছুঁচালো দুই সাদা ভাগের মধ্যের ভাগটা তখনো কালো। প্রচুর ও প্রশান্ত আনন্দ গোটা মুখ থেকে বিচ্ছুরিত হচ্ছে। চেহারা অনেকটা সেই প্রাচ্য ঋষির মতো।
জ্যঁ ক্রিস্তফ-এর লেখক রমাঁ রলাঁর অনবদ্য বর্ণনায় যে রবীন্দ্রনাথকে আমরা দেখতে পাই, তাঁর আলোকচিত্র, আত্মপ্রতিকৃতি বা ভাস্কর্যে এত অনুপুঙ্খ বর্ণনা পাওয়া যায় না।
কয়েক বছর আগে আমি একটি অপরাধ করেছি। একটি নাটকে আমি রবীন্দ্রনাথের চরিত্রে অভিনয় করেছি। সে জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করি। কারণ, অভিনয় করলেও আমি তো আর রবীন্দ্রনাথ নই। তিনি অনেক বিশাল ব্যাপার।
শুরুতেই লিখেছি, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর আমার অনুসরণীয় ব্যক্তিত্ব। আমি সর্বদা তাঁকে মেনে এসেছি। আমার মতে, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সৃষ্টিকর্ম যেভাবে আদৃত হয়েছে, তাঁর কর্মজীবন সেই পরিমাণে অনুসৃত হয়নি। একটি কাজ রবীন্দ্রনাথের করার কথা ছিল, কিন্তু করে উঠতে পারেননি বা ওই চিন্তা তাঁর মাথায় আসেনি, এ রকম একটি কাজ আমি করেছি, বিশ্বকবিতার বাসগৃহ (হোম অব ওয়ার্ল্ড পোয়েট্রি) ‘কবিতাকুঞ্জ’ প্রতিষ্ঠা করার মধ্য দিয়ে। সেখানে বিশ্বের সব দেশের সর্বকালের সেরা কাব্যগুলো একত্র করার কাজ চলছে। আপাতত ১০০টি দেশের শতাধিক ভাষার কাব্য সংগ্রহ করা হয়েছে।
রবীন্দ্রনাথ—রবিঠাকুর জাতীয় জীবন এবং ব্যক্তিগত জীবনে বারবারই আমাদের প্রেরণা দিয়েছেন, দেন। কারণ, তিনি বটবৃক্ষ। আর বটবৃক্ষের তলে সবাই–ই তো ছায়া পায়।