বাবার কাছ থেকে মেয়ে শিখেছে গল্প খোঁজা। তবে এই বাবা আর তাঁর মেয়ের সম্পর্কটি কেমন ছিল, সত্যজিৎ রায়ের ফেলুদা আর তোপশের মতো? বাবা দিবসে আজ জানা যাক বাবা-মেয়ের এক অন্য রকম ভ্রমণের গল্প, যার মধ্যে আছে ফেলুদা আর তোপশেও।
কলকাতায় গিয়েছি বহুবার। জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়ি দেখা হয়েছে। ষাট বালিগঞ্জে পোস্ত–কই খাওয়া হয়েছে। আদি ঢাকেশ্বরী থেকে মন ও হাতভর্তি কেনাকাটা হয়েছে। এমনকি ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালের সামনে দাঁড়িয়ে পুরো পরিবারের যে পরিমাণ ছবি তোলা হয়েছে, তা পরবর্তী বছর ষাটেক দেয়ালে টাঙিয়ে রাখার জন্য যথেষ্ট। তবু প্রথম যেবার আমার আর বাবার ‘একা’ ভ্রমণের সুযোগ হলো, বাবা বেছে নিল সেই কলকাতাই। আজীবন শশব্যস্ত জীবন কাটিয়েছে বাবা। ছুটি বলতে বছরে একবার পুরো পরিবার আর দুটো ঢাউস ব্রিফকেসসমেত শীতকালীন ভ্রমণ। তাই এক মধ্য এপ্রিলে যখন ‘শুধু’ আমার সঙ্গে কলকাতা যাওয়ার জন্য সে একটা আস্ত ছুটি নিয়ে ফেলল, আমি বাসায় কলার উঁচিয়ে ঘুরলাম অন্তত দেড় সপ্তাহ। সেবার আমরা নিউমার্কেট গেলাম না, পার্কস্ট্রিটে লাইনে দাঁড়িয়ে মোমো খেলাম না, প্যান্টালুনের ডিসকাউন্টের বিজ্ঞাপনটাও এড়িয়ে গেলাম। তবু সেবারের কলকাতা ভ্রমণই হলো আমার ছোট্ট জীবনের শ্রেষ্ঠ ভ্রমণ। ভাবছেন কলকাতাকে শ্রেষ্ঠ শহর দাবি করছি? অথবা বাবার সঙ্গে ভ্রমণ বলে নিছক আবেগ থেকে অমনটা মনে হচ্ছে? একেবারেই না! শ্রেষ্ঠ কেন বলছি, সে উত্তর একদম শেষে দেব। আপাতত কলকাতার রাস্তায় ফেরত যাই। সেখানে এখন ভর দুপুরবেলা। আমাদের ট্যাক্সি থেমে আছে সুরেন্দ্রনাথ ব্যানার্জি রোডের এক জীর্ণ–প্রাচীন ভবনের সামনে।
ট্যাক্সির বনেটের ডান দিকে হেলান দিয়ে দাঁড়ানো যে ভদ্রলোক বত্রিশপাটি দন্ত বিকশিত করে হাসছেন, তিনিই আমার বাবা। চোখে ভারী চশমা পরেন, তবে ভালো করে তাকালে দেখা যায় তাঁর চোখ দুটো সময়ে-অসময়ে হাসছে। যে ভবনের সামনে আমরা দাঁড়িয়ে ছিলাম, তার ডান দিকটা বিধ্বস্ত আর বাঁ দিকটায় ঝুরি নামিয়ে দিয়েছে বটগাছ। মূল দরজার সামনে কোনোমতে ঝুলে থাকা একটা সাইনবোর্ড দেখা যায়, তাতে তামাটে অক্ষরে ইংরেজিতে লেখা ‘বোর্ন অ্যান্ড শেফার্ড’। আমি চমকে উঠলাম! গাড়ি থেকে নামার পাক্কা এক মিনিট পর আমি বুঝতে পেরেছি, কেন এই ভ্যাপসা গরমে আমরা পুরোনো ভাঙা এক বিল্ডিংয়ের সামনে দাঁড়িয়ে আছি। মাথার মধ্যে তখন তোপশে মন্ত্রের মতো বলছে, ১৪১ SNB! Bourne & Shepherd-BS! পাওয়া গেছে, মিলে গেছে! বোর্ন অ্যান্ড শেফার্ডে তত দিনে তালা ঝুলছে। সত্যজিৎ যেমন লিখেছেন, তেমন করে সেখান থেকে আর ভিক্টোরিয়া গডউইনদের ছবি পাওয়া যায় না। তাই আমরা কিছুক্ষণ বিল্ডিংয়ের সামনেই দাঁড়ালাম, দু-চারটে ছবি তুললাম। ছবি তুলতে তুলতে ফিসফিস করে বাবাকে জিজ্ঞেস করি, আমরা কি ফেলুদার সব কটা জায়গায় যাব? উত্তর আসে, ফেলুদার জায়গায় যাব কি না জানি না। আমরা শুধু আমাদের চেনাজানা কয়েকটা গল্প খুঁজব। পেলে পেলাম, না পেলে নেই। কিন্তু তার আগে চুলটা বাঁধো, এই গরমে স্টাইল হবে না!
আমি তখন বাবার বাধ্য বালিকা, সত্যি সত্যি মাথার ওপর চূড়া করে চুল বাঁধলাম। আর চুল বাঁধা দেখে বাবা ফিরল তার নিজস্ব অতীতে, সেই অতীতে দাদি চুল বাঁধছেন ফিতা দিয়ে শক্ত করে। ফিতার রং গাঢ় সবুজ। বাবার সঙ্গে ঘুরে বেড়ানোর এই এক আনন্দ। সে আপনাকে নিতান্তই সাধারণ জায়গায় নিয়ে যাবে, প্রায় শুকিয়ে যাওয়া নদীর তীরে দাঁড় করাবে। প্রথমে কিছুক্ষণ আপনি ভাববেন, কেন এলাম? কী দেখব? তারপর সে আপনাকে গল্প শোনাবে। সেই সব গল্পের খানিকটা সে নিজে পড়েছে, খানিকটা তার অভিজ্ঞতায় পাওয়া।
ইদানীং মনে হয়, মানুষ মৃত্যুর চেয়ে শক্তিশালী। নাহলে একটা মানুষ না থাকার মাঝেও এমন করে থেকে যায় নাকি? বাবারা তো কত কিছুই শেখায়। কখনো পাটিগণিত, কখনো ইংরেজি ট্রান্সলেশন। আমি নাহয় বাবার কাছ থেকে ‘ঘুরতে ঘুরতে গল্প খোঁজা’র অভ্যাসটাই শিখে রাখলাম।
আমাদের ট্যাক্সি তখন ছুটছে চৌরঙ্গী রোড ধরে পার্কস্ট্রিটের দিকে। প্রশ্নের পর প্রশ্ন করে যাচ্ছি, এখন আমরা কোথায় যাচ্ছি? রজনী সেন রোড? নাকি রিপন লেন? নাকি জোব চার্নকের সমাধি? আমরা কি ‘গোরস্থানে সাবধানে’র পুরো রুটটা অনুসরণ করব? বাবা ততক্ষণে পুরো দমে রহস্যের মুডে। হিন্ট দিচ্ছে, তবে উত্তর দিচ্ছে না। একবার বলছে, তার প্রিয় চরিত্রের বাড়িতে যাচ্ছি। আবার বলছে, লীলা মজুমদার সেখানে শৈশব কাটিয়েছেন। গন্তব্যে পৌঁছে দেখা গেল, জায়গাটা আসলে অ্যাথেনিয়াম ইনস্টিটিউট! আমি তীব্র প্রতিবাদ করলাম, বাড়ি কোথায়? এ তো জটায়ুর স্কুল! এবার আমাকে টেনে দাঁড় করানো হলো এক পুরোনো সাইনবোর্ডের সামনে। সেখানে স্কুলের ঠিকানা লেখা—১০০ গড়পার রোড! ১০০ গড়পার রোড মানে তো জটায়ুর বাড়ি! কিন্তু…সাইনবোর্ডে আরও লেখা—এই বাড়িটি ১৯১৪ খ্রিষ্টাব্দে উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী দ্বারা নির্মিত। হচ্ছেটা কী? বাবাকে বললে হয়তো সে স্বীকার করত না, কিন্তু হাবভাবে সে তখন পুরো ফেলুদা আর আমি তার অনুগত তোপশে। সাইনবোর্ড পড়ে, স্কুলের দারোয়ান ভবপ্রসাদের সাহায্য-টাহায্য নিয়ে আমরা একটা ছবি দাঁড় করালাম।
১০০ গড়পার রোডের বাড়িটা একসময় ছিল রায় পরিবারের বাসস্থান। এ বাড়ির নিচতলায়ই উপেন্দ্রকিশোর স্থাপন করেছিলেন ‘ইউ রায় অ্যান্ড সন্স’। জমজমাট বাড়ি ছিল, ছাপাখানা থেকে নিয়মিত বেরোত ‘সন্দেশ’। পরবর্তী সময় প্রেসের দায়িত্ব পেলেন সুকুমার রায়। তিনিও এক হাতে লিখলেন, আঁকলেন, ‘সন্দেশ’ সম্পাদনা করলেন। লীলা মজুমদারেরও লেখায় হাতেখড়ি হলো এ বাড়িতেই। ১৯২১ সালে এই ১০০ গড়পার রোডের বাড়িতেই সত্যজিৎ রায়ের জন্ম। বছর পাঁচেক পর অর্থনৈতিক কারণে এ বাড়ি বিক্রি করে দিতে হলো, ছাপাখানা ও ‘সন্দেশ’-এর পাটও চুকে গেল। ১৯৩১ সালে এই ঠিকানায় জায়গা পেল ‘অ্যাথেনিয়াম ইনস্টিটিউট’। আর এ সবকিছুর প্রায় চার দশক পর, ১৯৭১ সালে সত্যজিৎ রায় ‘সোনার কেল্লা’য় প্রথম আনলেন জটায়ুকে। সেই জটায়ুর বাড়ির ঠিকানা হয়ে গেল ১০০ গড়পার রোড আর স্কুলের নাম হলো অ্যাথেনিয়াম ইনস্টিটিউট! ব্যস! নিজের শৈশবের সব ঠিকানা জটায়ুর মধ্যেই ধরে রাখলেন সত্যজিৎ রায়। আমি অবাক হয়ে বাবাকে প্রশ্ন করি, তুমি জানতা জটায়ুর বাড়ি আর সত্যজিতের বাড়ি একই জায়গায়? সে হাসে, রহস্য করে, তবে উত্তর দেয় না।
পাল্টা প্রশ্ন তোলে, তুমি জানতা জটায়ুর খানিকটা অন্তত সত্যজিতের মিরর ইমেজ? আমাদের এসব আজগুবি প্রশ্নোত্তর চলল আরও চার দিন। রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে আমরা আবিষ্কার করলাম চায়না টাউনের ঠিক মাঝখানে একটা ‘চায়না কালীমন্দির’ আছে। কালী প্রতিমার সঙ্গে চীনাদের কী সম্পর্ক? উত্তর খুঁজতে খুঁজতে বাবা তার নিজের কৈশোরে চলে যায়। সেই কৈশোরে তার বাড়ির পাশে সন্ধ্যাবেলা কীর্তন হয়।
স্বভাবতই আমাদের মনে প্রশ্ন আসে, এই মন্দিরে কি তবে চীনা ভাষায় কীর্তন হয়? কাকে প্রশ্ন করা যায়, ভেবে না পেয়ে সেবারের মতো আমরা ফেরত চলে আসি। স্কটিশ চার্চ কলেজের বারান্দায় দাঁড়িয়ে বাবা প্রশ্ন ছুড়ে দিল, বলো, কে পড়তেন এই কলেজে? আমি হাসতে হাসতে উত্তর দিই, ঐতিহাসিক লোক? নাকি অনিমেষ বললেও চলবে?
দ্বিতীয় দিন আমরা জোড়াসাঁকো গেলাম। ভাবলাম, রবীন্দ্রনাথের বাড়ি যাওয়া হবে। বাবা সেদিকে ভিড়লই না। ‘নতুন গল্প খুঁজব’ ঘোষণা দিয়ে ঠাকুরবাড়ির গেট থেকে হাঁটতে শুরু করল উত্তরমুখী হয়ে। হাঁটতে হাঁটতে আমরা জমজমাট মসলার বাজার পেরোলাম। হলুদ-মরিচ-জিরা-জাফরানের সেই গলির পর আবির্ভূত হলো তসবিহ-আতর-ধূপকাঠির গলি। গলির মাথায় লাল ইটের নাখোদা মসজিদ। কিন্তু নাখোদা মসজিদই যদি দেখব, তবে ঠাকুরবাড়ির গেটে ট্যাক্সি ছেড়ে দিলাম কেন? উত্তর এল, হেঁটে হেঁটেই তো গল্প খুঁজতে হয়, আম্মা। যেই রাস্তা দিয়ে এখন তুমি হেঁটে এলে, বঙ্গভঙ্গের সময় ঠিক সেই রাস্তায় হেঁটেছেন রবীন্দ্রনাথ। গল্পে গল্পে জানা গেল, ঠাকুরবাড়ির লোকেরা পায়ে হেঁটে কোথাও যেতেন না। কিন্তু কলকাতায় হিন্দু-মুসলমান দাঙ্গা তখন তুঙ্গে। দাঙ্গার প্রতিবাদস্বরূপ বাড়ি থেকে হেঁটে গিয়ে নাখোদা মসজিদের বড় হুজুরের হাতে রাখি পরিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ। সেবারের সব ছুটিটায় আমরা এভাবেই গল্প আর ইতিহাস, ইতিহাস আর গল্পের পেছনে ছুটলাম।
অঞ্জন দত্ত কিংবা মালার পাল্লায় পড়ে একবার মৌলালির মোড়ে গিয়ে নামলাম। তারপর জানলাম, জায়গার নাম আসলে মৌলা আলি। এদিকে শংকরের শাজাহান হোটেল খুঁজে না পেয়ে গ্র্যান্ড হোটেলের বেকারি দেখে ফেরত চলে এলাম। একদম শেষ দিনটায় যখন প্রিন্সেপ ঘাটে সূর্য ডুবতে দেখছি, তখনই মনে হলো, এই ভ্রমণটাই আমার ছোট্ট জীবনের শ্রেষ্ঠ ভ্রমণ। নাহলে কে আর আমার সঙ্গে রাস্তায় রাস্তায় অঞ্জনের গান বা তোপশের বাড়ি খুঁজে বেড়াবে? কেই–বা আমাকে দুই মাইল হাঁটিয়ে ব্যাখ্যা দেবে এই রাস্তায়ই দীপাবলি কলেজে যেত? বেশ আহ্লাদ করেই বাবাকে সে কথা জানিয়েছিলাম। সে বিন্দুমাত্র পাত্তা না দিয়ে বলল, পৃথিবীতে তুমি আরও কত জায়গা দেখবা, আম্মা! তারপর নাহয় শ্রেষ্ঠ খুঁজো!
আমি এখন সত্যিই নানা জায়গা দেখছি, এদেশ থেকে ওদেশে একাই ঘুরে বেড়াচ্ছি। তাস্কানির সবুজে হাঁটছি। বার্সেলোনার সৈকতে রোদ পোহাচ্ছি। ট্রাফালগার স্কয়ারে ঠায় দাঁড়িয়ে আছি। কিন্তু মনে মনে তো আমি আসলে খুঁজছি গল্প। আমাদের সেই চারদিনের কলকাতা ভ্রমণে যেমন শিখেছিলাম, বাবা যেমন খুঁজত। সে গল্প খুঁজত গানে, গল্পে, এমনকি গিরিজা দেবীর ঠুমরিতেও। তারপর সেই গল্পদের উৎপত্তিস্থলে গিয়ে দাঁড়াত আরও গল্পের খোঁজে। তাতে নাকি গল্পকে ‘চেনা’ হয়। গিরিজা দেবীর গান শুনতে শুনতে সে বেনারস যেতে চাইত। আমরা বিরক্ত হয়ে জানতে চাইতাম, সেখানে কি তুমি গিরিজা দেবীকে পাবা নাকি? সে উদাস কণ্ঠে উত্তর দিত, তবে যে পরিবেশটায় গিরিজা দেবী হয়ে ওঠা যায়, তার খানিকটা তো দেখতে পাব! সেবারের কলকাতা ভ্রমণ বাবার সঙ্গে আমার প্রথম ও শেষ ‘একা’ ভ্রমণ। প্রথম প্রথম দুঃখ হতো। যেকোনো সুন্দর জায়গায় দাঁড়িয়ে মনে হতো শোকের চেয়ে ‘তীব্র’ কোনো অনুভূতি হয় না। তারপর একসময় শোকের সঙ্গেও বোধ হয় বন্ধুত্ব হয়ে গেল। ভ্যাটিকানের দরজায় দাঁড়িয়ে আমি সেই দেবশিশুটাকে খুঁজে নিতে শিখলাম, যার গল্প বছর দশেক আগে বাবার কাছে শুনেছিলাম। মার্সেয়ীর সমুদ্রে যখন সূর্য ডুবে গেল, আমি যেন স্পষ্ট শুনতে পেলাম, মন্টে ক্রিস্টোর গল্পটা কিন্তু পড়ে আসতে পারতে! ইদানীং তাই মনে হয়, মানুষ মৃত্যুর চেয়ে শক্তিশালী। নাহলে একটা মানুষ না থাকার মাঝেও এমন করে থেকে যায় নাকি? বাবারা তো কত কিছুই শেখায়। কখনো পাটিগণিত, কখনো ইংরেজি ট্রান্সলেশন।
আমি নাহয় বাবার কাছ থেকে ‘ঘুরতে ঘুরতে গল্প খোঁজা’র অভ্যাসটাই শিখে রাখলাম।