প্রথম পর্ব

বুখারায় বারো রকমের মানুষ

পর্যটকদের আর্কষণের প্রাণকেন্দ্র কারুশিল্পের এসব দোকান
পর্যটকদের আর্কষণের প্রাণকেন্দ্র কারুশিল্পের এসব দোকান

চাষের পুকুরে খাবারের দলা ছুড়ে দিলে যেমন করে ছুটে আসে লোভী মাছের দল, বুখারা স্টেশনে পদার্পণমাত্র ঠিক সেভাবেই আমাদের দিকে ছুটে আসে ট্যাক্সিচালকের একটি ছোটখাটো দল। অবশ্য ওদের মূল নিশানা আমি নই, বরং আমার সঙ্গে থাকা জাপানি তরুণী সাউরি। ওদের এভাবে তেড়ে আসতে দেখে সাউরি বেশ খানিকটা ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যায়। দৃষ্টিতে একধরনের আর্তি নিয়ে ও আমার দিকে তাকায়, যার অর্থ হলো আমাকে উদ্ধার করো এখান থেকে। আমি বাঙাল মুলুকের লোক। এমন ট্যাক্সিচালক, মুটে, দালালদের চক্রব্যূহ ভেদ করে সামনে এগিয়ে যাওয়ার প্রশিক্ষণ আমার বিলক্ষণ আছে। আমি সেই তালিমখানা কাজে লাগিয়ে ওদের দিকে ফিরে বলি, সরুন, যেতে দিন, এখানকার টিকিটঘরে আমাদের কিছু কাজ আছে। অর্থাৎ, এখনই ট্যাক্সি নিয়ে শহরের দিকে যাচ্ছি না। ওতে কিছুটা কাজ হয়। ব্যূহটি ভেঙে যায়। যদিও দু-একজন নাছোড়বান্দার মতো আমাদের নীরবে অনুসরণ করে। আমি কিন্তু মিথ্যে বলিনি। এখান থেকে দুদিন বাদে আমি যাব তাসখন্দে আর সাউরি যাবে পুবের শহর কিভায়। তার জন্য আগেই ট্রেন টিকিট কিনে ফেলে নিশ্চিন্ত হতে চাই আমরা।

সাউরির সঙ্গে আমার পরিচয় সমরখন্দ থেকে বুখারা আসার পথেই। লাগেজ র‍্যাকে মাল রাখার পর খেয়াল করি, পাশের সিটে লেবুপাতা রঙের জ্যাকেট গায়ে দিয়ে যে মেয়েটি বসে আছে, সে হয়তো স্থানীয় নয়। সামনের ট্রে টেবিলে রাখা সিলভার রঙের নাইকন পয়েন্ট অ্যান্ড শুট ক্যামেরাই আমাকে সে কথা জানিয়ে দেয়। মেয়েটির চেহারা প্রাচ্যদেশীয় হওয়ায় আমি কিন্তু প্রথমেই কিছুটা দমে যাই। কারণ, পূর্বাভিজ্ঞতায় দেখেছি, ভাষাগত সীমাবদ্ধতার কারণে যাত্রাপথে এরা সহযাত্রীর সঙ্গে খুব একটা আলাপচারিতায় যুক্ত হয় না। এ মেয়েটিও তেমন কি না কে জানে! আমি তাই ওর প্রতি খুব একটা উৎসাহ না দেখিয়ে ট্রেনের দুলে ওঠার অপেক্ষায় থাকি। ‘তুমিও নিশ্চয়ই বুখারায় চলেছ?’ প্রশ্নটি আমি নই, বরং ছুটে আসে মেয়েটির তরফ থেকে। কয়েক মিনিট বাদে। সেই প্রশ্নেই বুঝতে পারি, দুজনের মধ্যে কথাবার্তায় ভাষা হয়তো প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়াবে না।

পথ চলতে গিয়ে পরিচয় হওয়া কারও সঙ্গে সহজ হওয়ার ক্ষেত্রে অনেকেই প্রাথমিকভাবে খানিক কুণ্ঠিত হন। একেবারে শুরুর দিকে সাউরির মধ্যে তেমন একটি বোধের উপস্থিতি আমি ধরতে পারলেও সেই মেঘের আবছায়া কেটে যায় যেন সহসাই। পাকদণ্ডী বেয়ে হিল স্টেশনের দিকে ছুটে চলে হঠাৎ একসময় যেভাবে চোখের সামনে অকস্মাৎ ভেসে ওঠে সতেজ শহর, ঠিক তেমনি আমরাও কথার অলিগলির মাঝে হাঁটতে গিয়ে আবিষ্কার করি দুজনের মাঝের এক আচম্বিক যোগসূত্র। প্রায় দুদশক আগে সাউরি এসেছিল আমেরিকায়। হোটেল ব্যবস্থাপনা পড়তে। মজার ব্যাপার হলো, যে কলেজে ও ভর্তি হয়েছিল, সেই কলেজ হলো আমার বর্তমান নিবাস থেকে মাইল পাঁচেক দূরে। আমার সঙ্গে পরিচয় হওয়ার পর সাউরি তাই খুলে বসে স্মৃতির জানালা। সেই জানালা গলে কুয়াশার মতোই হুড়মুড়িয়ে এসে ঢোকে ফেলে আসা সময়ের ছেলেবন্ধুর অকালবিস্মৃত মুখ। কলেজের পাশের ‘হোয়াইট লাইম পাব’-এ সোনালি মদিরায় ডুবে যেতে যেতে যার সঙ্গে সাউরির প্রথম পরিচয়। নিঃশব্দে আরও এসে কড়া নাড়ে সান ডিয়েগো শহরের নানান স্মৃতি, যে স্মৃতিগুলোর কিছু কিছু আজ ম্যাটওয়াশ পেপারে প্রিন্ট হয়ে লুকিয়ে আছে ওর টোকিওর অ্যাপার্টমেন্টে।
‘তুমি সান ডিয়েগো ছেড়ে গেলে কেন? থেকে গেলেই তো পারতে।’ স্মৃতির শহর নিয়ে ওর উচ্ছ্বাস বাস্তবিকভাবেই আমার মধ্যে এ প্রশ্ন নিয়ে আসে।
জানালার দিকে পিঠ ঠেকিয়ে আমার দিকে কিছুটা ফিরে ও বলে, ‘থাকার চেষ্টা যে করিনি তা নয়, কিন্তু সেটা নাইন-ইলেভেনের ঠিক পরের সময়। হোটেল ব্যবসার বড় দুর্যোগ মুহূর্ত। আমি তাই চাকরি পেলাম না। ফিরে এলাম জাপানে। তবে এখনো মাঝেমধ্যে ইচ্ছে হয় ফিরে যাই।’ তারপর কয়েক মুহূর্ত নিশ্চুপ থেকে বলে, ‘পুরোনো সেই ছেলেবন্ধুদের কাউকে আবার খুঁজে পেলে বেশ হতো। ওদের কাউকে না হয় বিয়ে করে গ্রিনকার্ড বাগাতাম।’ বলে হেসে ওঠে। ওর এই বক্তব্য আমাকে জানিয়ে দেয়, জীবনপথে অনেকটা পথ হেঁটে এলেও আজও হয়তো মেয়েটি নিঃসঙ্গ।

সাউরি উজবেকিস্তানে এসেছে সপ্তাহখানেকের জন্য। আগের চাকরিটা ছেড়ে নতুন চাকরিতে ঢোকার মাঝে যে সময়টা, তার সদ্ব্যবহারের জন্যই এ ভ্রমণ। এর আগেও নাকি এমনভাবেই হুট করে বিমানের টিকিট কেটে চলে গেছে পৃথিবীর নানা প্রান্তে। যদিও বাংলাদেশে কখনো আসেনি। কলকাতায় এসেছে। তাই বাঙালিদের সম্পর্কে ওর কিঞ্চিৎ ধারণা আছে। বাঙালি, কলকাতা আর বেনারস নিয়ে কিছু কথার মধ্যে সাউরি হঠাৎ বলে, ‘একটা ব্যাপারে কিন্তু তোমাদের ওদিকের লোকের সঙ্গে এখানকার মানুষের মিল আছে। তোমরা অন্য মানুষ সম্পর্কে অনেক কিউরিয়াস। আমি যখন রাস্তা দিয়ে হেঁটে যেতাম, তখন লোকে ড্যাবড্যাব করে চেয়ে দেখত। অনেকে এমনকি কাছে এসে নাম, কোথা থেকে এসেছি, বয়স কত, এমন প্রশ্নও দুম করে জিজ্ঞেস করে বসত। এখানকার লোকেও অনেকটা তেমন।’

উজবেকিস্তানে ইদানীং ভিসাপদ্ধতি কিছুটা শিথিল করায় অল্পবিস্তর ট্যুরিস্ট আসছেন, কিন্তু তার আগে বহুকাল ধরে এ দেশটি এক অর্থে আবদ্ধ দেশই ছিল। বিদেশি নিয়ে স্থানীয় লোকেদের কৌতূহল থাকাটা তাই হয়তো বিচিত্র নয়। তবে সাউরির কাছে এদের কৌতূহলের ব্যাপারটি কিছুটা বাড়াবাড়ি মনে হয়েছে জনৈক এক পরোপকারী যুবকের কর্মকাণ্ডের কারণে। ঘটনার বিশদ জানতে গিয়ে শুনি, গতকাল বিকেলে হোটেলে ফেরার পর হোটেলের এক কর্মচারী যুবকের সঙ্গে ওর পরিচয় হয়। পরদিন ট্রেনে করে বুখারা যাবে শুনে যুবকটি জানায়, স্টেশনে বড্ড ভিড়। সাউরির পক্ষে সেখানে গিয়ে টিকিট কাটা একধরনের অসম্ভব। এ ক্ষেত্রে যুবকটি সাহায্যের হাত বাড়াতে চায়। টিকিটের টাকা আর পাসপোর্ট নিয়ে স্টেশনে গিয়ে সে সাউরির জন্য টিকিট কেটে এনে হোটেলে পৌঁছে দেয়। তবে টিকিটখানা হস্তান্তরের সময় মুখ ফসকে বলে ফেলে, ‘তোমার পাসপোর্টে দেখলাম তোমার জন্ম অমুক সালে সেন্দাই শহরে, তবে যে বললে তুমি টোকিওতে থাকো?’ এটুকু শোনার পর আমি সাউরিকে থামিয়ে বলি, ‘ও তোমাকে বলেছে স্টেশনে অনেক ভিড়? কই, আমি তো আজ সকালে স্টেশনে গিয়েই টিকিট কেটে নিয়ে এলাম, আমার সামনে টিকিট কাটার জন্য মাত্র তিন-চারজন ছিল। সেটিকে নিশ্চয়ই চিড়েচ্যাপ্টা হওয়ার মতো অবস্থা বলা যায় না!’
তারপর হঠাৎ আরেকটি সন্দেহ মনে উঁকি দেওয়ায় বলি, ‘আচ্ছা, ও তোমার কাছ থেকে টিকিট কেনা বাবদ কত নিয়েছে, বলো তো?’ অঙ্কটি শুনে বুঝি, সেই পরোপকারী যুবক প্রকৃত অঙ্কের পেছনে আরও কয়েকটি শূন্য যোগ করে সাউরির কাছ থেকে কিছু পয়সা মেরে দিয়েছে।
সরলমনা বিদেশিদের লুটে নেওয়ার জন্য পৃথিবীর অনেক দেশেই হয়তো এমন কিছু বিটকেল লোকটা ওত পেতে থাকে। ব্যাপারটি বোঝার পর সাউরিকে কিছুটা মর্মাহত দেখায়, তারপর উল্টো দিকে ছুটে যাওয়া ধূসর প্রান্তরের দিকে তাকিয়ে বলে, ‘থাক, বাদ দাও, আমাকে ঠকিয়ে ওই কটা টাকা নিয়ে ছেলেটি যদি আজকের মতো সুখী হয়, হোক।’

বুখারা স্টেশনে টিকিট নিয়ে একটা জটিলতা তৈরি হয়। কিভা যাওয়ার কোনো টিকিট নেই, অ্যাভেইলবল টিকিট যা আছে, সে দুদিন বাদের। সাউরির মাথায় হাত। সেই যে দুজন ট্যাক্সিড্রাইভার, যারা আমাদের নীরবে অনুসরণ করছিল, তারা এবার এগিয়ে আসে। যে অল্পবিস্তর ইংরেজি জানে, সে আকারে-ইঙ্গিতে জানায়, বিচলিত হওয়ার কিছু নেই। বুখারা থেকে চাইলে ট্যাক্সিতে করেও কিভা যাওয়া সম্ভব। সময় লাগবে ঘণ্টা পাঁচেকের মতো। এবং আকার-ইঙ্গিতে বোঝায়, তেমন হলে ওরা নিজেরাও কিভায় নিয়ে যেতে প্রস্তুত।
আমি সাউরিকে ইশারায় কাছে ডেকে বলি, আগেই এদের সঙ্গে কোনো চুক্তিতে যাওয়ার দরকার নেই। আগে হোটেলে যাই। সেখানকার লোকেরা ট্যাক্সি নিয়ে নিশ্চয়ই সুপরামর্শ বাতলে দিতে পারবে।

আমার আর সাউরির হোটেল কিন্তু ঠিক একই পাড়ায় না। তবে খুব সম্ভবত শহরের পুরোনো অংশের আশপাশেই। ভাড়া বাচাতে আমরা একটি ট্যাক্সিতেই যাব বলে ঠিক করি। আর এতক্ষণ অনুসরণ করার পুরস্কার হিসেবে সেই দুজন ট্যাক্সিওয়ালার একজনকে বেছে নিই চালক হিসেবে। সকালের সেই ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে ট্যাক্সিওয়ালার সঙ্গে ভাড়া দামাদামির ব্যাপারটা সাউরি পুরোপুরি আমার ওপর ছেড়ে দেয়। ট্যাক্সিতে যেতে যেতে আমরা ঠিক করি, কাল সকালে দুজনে কোনো এক জায়গায় দেখা করে একসঙ্গে সারা শহরে ঘুরব।

আমি যে হোটেলে উঠেছি, সেটিকে খুঁজে পাওয়ার সবচেয়ে সহজ উপায় হলো শহরের সর্বোচ্চ মিনারটিকে নিশানা করে হাঁটা। কারণ, সেই মিনারের উল্টো দিকের সরু গলিতেই হোটেলের অবস্থান। আর সব হোটেলের মতো এর বাইরে না আছে নিয়ন বাতির সাইন, না আছে হইহুল্লোড়। যেন এক নিঝুম বসতবাড়ি। ভেতরে ঢুকে দেখি, সামনে মোজাইকে বাঁধানো উঠোন। উঠোনের দুদিকে দ্বিতল ভবন। কাঠবাদামরঙের কাঠের রেলিং দিয়ে দোতলার বারান্দাটির বন্ধন এঁকে দেওয়া।
কয়েক মিনিট অপেক্ষার পর কাউকে না দেখে আমি উঠোনের পাশের দাওয়ায় ফেলে রাখা টিনের বালতিতে মৃদু টোকা দিয়ে ঘণ্টার শব্দ উৎপন্ন করি। সে শব্দে ভেতরে থেকে ব্যাস্তসমস্ত হয়ে বের হয়ে আসে এক তরুণী। বারবার দুঃখ প্রকাশ করে জানায়, হোটেলের মূল মালিক অন্য শহরে গেছে। ওকে বলে গেছে, ঘর খুলে আমার আপ্যায়ন-দেখভাল যেন সে করে। দোতলায় একটি ঘরে আমার থাকবার ব্যবস্থা হয়েছে জানিয়ে মেয়েটি আমার সুটকেস বয়ে নেওয়ার জন্য তৈরি হয়। আমি ‘আহা করছেন কী, করছেন কী’ বলে তার হাত থেকে আমার ব্যাগটিকে ছিনিয়ে আনি। হতে পারে, সে হোটেল মালিকের সেবিকা, কিন্তু তাই বলে এমন একটি সুশ্রী তরুণীকে দিয়ে নিজের মাল টানাব, তেমন নরাধম হয়তো এখনো হয়ে উঠিনি।

হোটেলের ঘরটি একটু পুরোনো ঢঙে সাজানো। দৃশ্যাবলি আঁকা চাদর ঢেকে আছে একদিকের দেয়াল। সিলিঙে কাঠের মোটা থাম। দরজা খানিক খোলা থাকায় বুঝতে পারি, বাইরে টিপ টিপ করে বৃষ্টি হচ্ছে। সেই বৃষ্টির ছোঁয়া পেতে ব্যাগপত্র রেখেই বাইরের লম্বা বারান্দায় এসে দাঁড়াই। নিচের সেই উঠোনটি জলের স্পর্শ পেয়ে একেবারে ঝকঝক করছে। উঠোনের দুধারে রাখা খাবার টেবিল দুটো ভিজে যাচ্ছে পাশের লাইমগাছের পাতা থেকে ঝড়ে পড়া জলে। মাঝে দু-একবার মেঘও ডেকে উঠল। আমার ঘর বাদে বাকি সব ঘরের দরজা বন্ধ। যেন আমিই এ হোটেলের একমাত্র বোর্ডার। সেই মেয়েটিও যেন কোথায় হারিয়ে গেছে।
হোটেলে ঢোকার মুখে দু-তিনটে ছেলেকে বল নিয়ে খেলতে দেখেছিলাম। বৃষ্টি দেখে ওরাও বুঝি পালিয়ে গেছে। এমন নিস্তব্ধতার মধ্যেই দুজন লোককে দেখি হোটেলে ঢুকে দোতলার সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠে আসতে। দুজনের গায়েই বর্ষাতি। এ দুজনও বোধ করি আমাকে বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে চমকে গেছে। তাই কাছাকাছি এগিয়ে এলে ‘আজই এলেন বুঝি?’ বলে দুজনের মধ্যে যিনি একটু বয়স্ক, তিনি পরিচিত হতে চান।
বৃষ্টির তোড় বাড়ায় একটু সরে আমার ঘরের দরজার কাছ ঘেঁষে দাঁড়াই। বয়স্ক লোকটি একটু ঢ্যাঙা, শীর্ণকায়। পাশের জন বেশ স্বাস্থ্যবান, গালে চাপ দাঁড়ি, বয়স চল্লিশের কোঠায়। শারীরিক ভঙ্গিমায় একে মনে হয় ঢ্যাঙা লোকটির চ্যালা। যদিও এরা দুজন দুজনকে পরিচয় দেয় বন্ধু হিসেবে। এর মধ্যেই জেনেছি যে দুজনই জার্মান। মধ্যবয়স্ক দুই জার্মান বন্ধু একই হোটেলের একই কামরায় এসে উঠবেন, সেটি বিশ্বাস করতে কিছুটা কষ্ট হয়। যাকগে, তাঁদের জীবন নিয়ে আমার বিন্দুমাত্র কৌতূহল নেই। আমি বরং রাতের খাবারের জন্য ভালো রেস্তোরাঁর হদিস ওদের কাছ থেকে জেনে নিই। ওরা এখানে এসেছে দিন তিনেক আগে। তাই এ তল্লাটের সব রেস্তোরাঁতেই নাকি ওদের ঢুঁ মারা হয়ে গেছে ইতিমধ্যে।

ঘণ্টা কয়েক বাদে বৃষ্টি একটু ধরে আসে। না বুঝে সেই ফাঁকে বাইরে বেরিয়ে আমি পড়ে যাই ভেজা কনকনে ঠান্ডা হাওয়ার কবলে। বেশি না, মাত্র দুদিন আগেই কিন্তু সমরখন্দ শহরে দাবদাহের কারণে খাটো প্যান্ট পরে ঘুরতে হয়েছে। তখন ভেবেছি, প্রখর গ্রীষ্মের এই বুঝি প্রারম্ভ। তারপর আজকেই এই হাওয়া বাদল আমাকে একেবারে বোকা বানিয়ে ছাড়ল।

জাপানী তরুণী সাউরি বুখারার হস্তশিল্পের দোকানে

বুখারার এই পুরোনো শহরটি যেন দুর্গের মতো। বৃহদায়তন দুর্গের ভেতরে অনেক সময় যেমন গড়ে ওঠে ক্ষুদ্র নগর, এখানেও ব্যাপারটা অনেকটা তেমনই। ভেতরের স্থানটিতে নানা স্থাপনা। এখন রাত হওয়ায় বাতি নেভাবার পাঁয়তারা চলছে। কয়েকটি দোকানের বাইরের বারান্দায় ঝুলিয়ে রাখা কাপড় আর্দ্র বাতাসে এলোমেলোভাবে দুলছে। আমি জ্যাকেটের জিপার গলা অবধি উঠিয়ে এ দুর্গনগরের অপর প্রান্তে থাকা রেস্তোরাঁগুলোর দিকে জোর কদমে হাঁটতে থাকি।

‘ওল্ড বুখারা’ রেস্তোরাঁটিকে খুঁজে পেতে খুব একটা বেগ পেতে হয় না। দরজার সামনে আলোকমণ্ডিত স্থানটিতে রেখে দেওয়া দুটি কাঠের ছাগল যেন বুভুক্ষুজনকে ঝলসানো মাংসের খাবার লোভ দেখিয়ে টেনে আনে। দরজা খুলে ভেতরে যেতেই শুনতে পাই বাঁ ধারে একজন বেহালা বাজাচ্ছে। সামনে রাখা স্পিকার সে শব্দকে এমপ্লিফায়ারে চালান করে দিয়ে রেস্তোরাঁর চারদিকে ছড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টায় মত্ত। আমাকে দেখে ম্যানেজার এগিয়ে এসে ডান ধারের ছোট টেবিলে বসায়। ভেতরটায় সেই কনকনে হাওয়ার উপদ্রব নেই। আমি জ্যাকেটটি খুলে সামনের চেয়ারের হাতলে রাখি। আর তখনই খেয়াল করি, পাশের টেবিলে যে ফরাসি মেয়েটি বই খুলে বসে আছে, সে আমার অপরিচিত নয়।

‘মনে হচ্ছে, আমাদের উভয়েরই চূড়ান্ত গন্তব্য ছিল বুখারা। তাই নয় কি?’ মেয়েটির টেবিলের কাছে গিয়ে এ কথা যখন বলছি, তখন কারিগরি গোলযোগের কারণে সেই এমপ্লিফায়ারে বিকট একটি শব্দ হয়। সে কারণে ও কানে হাত চাপা দেয়। শব্দের তীব্রতা কমে এলে চোখে খানিক বিস্ময় জড়ো করে বলে, ‘হ্যাঁ, তাই তো! আমি অবশ্য তাসখন্দ থেকে সরাসরি এখানে এসেছি। তুমি নিশ্চয়ই সমরখন্দ হয়ে এখানে এসেছ?’

‘তুমি কী করে বুঝলে?’ অবাক কণ্ঠে আমার জিজ্ঞাসা।

‘সেটা বোঝা কি খুব কঠিন? ছোট শহর। দুকদম হাঁটলেই সব ট্যুরিস্টের সঙ্গে দিনে অন্তত একবার করে তোমার দেখা হবে। আমি গত তিন দিনে তোমাকে একবারও এখানে দেখিনি, তাই অনুমান করলাম।’

এর মাঝেই দেখি, বেয়ারা ওর টেবিলে এনে রেখে গেল এক বাটি সাদা ভাত। ভাতের দ্বীপের মাঝে ছোট গাজর, আর নিচের দিকে একফালি লাল ক্যাপসিকাম। ঠিক যেন মানুষের মুখ। পাশে এক বাটি সবুজ সালাদ। এই কি তবে ওর রাতের খাবার? প্লেনে মেয়েটির সিট ছিল আমার পাশের আইলে। আর জানালার দিকে সিটে অপর এক যুবক। তার সঙ্গে মেয়েটিকে ফরাসি ভাষায় কথা বলতে দেখে আন্দাজ করি, মেয়েটি ফরাসি। খাবার দেওয়ার পালা এলে মেয়েটি চেয়ে নেয় নিরামিষ খাবার। আর এখানেও সেই একই নিরামিষ খাবারের সমাহার দেখে কৌতূহল না চাপতে পেরে বলি, ‘তুমি কি ভেজিটেরিয়ান?’ এ কথার জবাব শুরুতেই না দিয়ে ও বলে, ‘তুমি দাঁড়িয়ে কেন? চেয়ারটা টেনে বসো না।’

মেয়েটির সঙ্গে কথা বলে ওর এই ভেজিটেরিয়ান হওয়ার পেছনে এক চমকপ্রদ গল্প শুনতে পাই। ওর মা প্যারিসের এক প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষিকা। মায়ের সঙ্গে সেই বালিকা বয়স থেকে এ পর্যন্ত ছয়বার ভারতে গেছে। সারা ভারতে যত আকর্ষণীয়, দর্শনীয় স্থান আছে, সবই মা-মেয়ের চষে ফেলা। এই ভারতভ্রমণের একপর্যায়েই নিরামিষভোজী হওয়ার ব্যাপারে ও ঝুঁকে পড়ে। সেই থেকে এই প্রবৃত্তিটা শক্তভাবে ধরে রেখেছে। এই যে এবার ইরানে দুই সপ্তাহের ভ্রমণ শেষে উজবেকিস্তানে ঘুরতে এসেছে, এর পরের গন্তব্য কিন্তু আবারও সেই ভারত। সেখানে হিমাচল প্রদেশের ধর্মশালা শহরে কোনো এক সাধুর আশ্রমে গিয়ে ধ্যান শিখবে। সেখানে ঠিক কদিন থাকবে, এখনো জানে না। হতে পারে কয়েক সপ্তাহ, আবার হতে পারে কয়েক মাস। তারপর হয়তো আবার প্যারিসে ফিরে যাবে। ওর এই নিরুদ্বেগ, নিশ্চিন্ত জীবন দেখে কিছুটা ঈর্ষান্বিত না হয়ে পারি না।
(চলবে)