করোনা-ক্রান্তিতে ডিপ্রেশন ও নেচার ওয়াক

আইল অব হোপ

নিরিবিলি বাইক-পাথ ধরে আইল অব হোপের দিকে মাউন্টেনবাইক হাঁকাচ্ছিলাম। আইল অব হোপ হচ্ছে সমুদ্র-সংলগ্ন নোনা-জলবাহী নদী ও সরোবরের মতো প্রশস্ত জলাভূমিবেষ্টিত ছোট্ট একটি দ্বীপ। তবে একাধিক ব্রিজের কল্যাণে এ আপস্কেল জনপদটি মেনল্যান্ড তথা সাভানা শহরের সঙ্গে সড়কপথে সংযুক্ত। বেশ কিছুদিন পর মাউন্টেনবাইক নামক অনেকগুলো গিয়ারওয়ালা দ্বিচক্রযানটি চালাচ্ছি, হাঁটু কিংবা কোমরে কোনো সমস্যা হচ্ছে না দেখে নিজেরই অবাক লাগে। অত্র এলাকায় অফিশিয়ালি লকডাউন সমাপ্ত হতে আরও সপ্তাহখানেক দেরি আছে। কিন্তু জর্জিয়া রাজ্যের গভর্নর প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পকে খোশামোদ করার জন্য গতকাল হেয়ারকাটিং সেলুন, ট্যাটু পারলার ইত্যাদি খুলে দিয়েছেন। সমুদ্রসৈকতে স্নান, নেচার-ওয়াকের হাইকিং ট্রেইলে হাঁটাহাঁটি, গলফ কোর্সে খেলাধুলা এবং নোনাজলে বোট ভাসানোর ব্যাপারে উৎসাহিত করছেন। এদিকে তামাম রাজ্যজুড়ে কিন্তু করোনাভাইরাসের সংক্রমণ বেড়েছে, মৃত্যুর হারেও কোনো কমতি পড়েনি।

আরবি ক্যালিওগ্রাফিতে আঁকা আলিফ হরফটির মতো সরল-সিধা সড়কে মাউন্টেনবাইকটি স্মুথ গতিতে ঝরাপাতা মাড়িয়ে ছরছরিয়ে আগ বাড়ে। দুপাশের বুনো ঝোপঝাড়ে ঝিঁঝি পোকারাও করোনা-ক্রান্তির ব্যাপক নীরবতায় দিনদুপুরে রীতিমতো মতোয়ারা হয়ে গুঞ্জন করছে। এদের সশব্দ উৎপাত আমলে না এনে আমি লকডাউনজনিত আমার হালহকিকত নিয়ে ভাবি। অবস্থাদৃষ্টে মনে হয়, আরও দু-এক সপ্তাহের মধ্যে সঙ্গনিরোধপ্রথার ইতি ঘটবে, অনেকের মন ফের রুজু হবে সংসারের নানা কাজে। তবে যারা বয়োবৃদ্ধ এবং ভুগছেন আন্ডারলাইয়িং হেলথ কন্ডিশনস তথা নানা রোগশোকে, তাদের দিনযাপনে লকডাউনের অবরোধ বহাল থাকবে আরও অনেক দিন। আমি এ আন্ডারলাইয়িং কন্ডিশনসের ক্যাটাগরিতে পড়ি এবং আমার ফ্যামিলি ফিজিশিয়ান টেক্সট পাঠিয়ে হুঁশিয়ার করে দিয়েছেন।

আইল অব হোপ

সংকট আরও ঘনীভূত হয়েছে অনিদ্রার প্রকোপ বৃদ্ধি পেলে। অনেকক্ষণ ধ্রুপদী সংগীতের রেকর্ড বাজিয়ে বা চিত্রকলার বইগুলোতে রঙিন তসবির ঘেঁটে রাত দেড়টা-দুইটার পর ঘুমাতে যাই, তারপর কেবলই মনে হয়, বালিশ যেন সিরিশ কাগজ দিয়ে মোড়া। ভোরেও করোটিতে পুঞ্জিভূত হতে থাকে, লাগাতার হ্যাংওভার। সিনিওর সেন্টারে ব্রিজ খেলার সূত্রে পরিচিত অবসরপ্রাপ্ত সাইকিয়াট্রিস্টকে কল করি। মুফতে উপদেশ দেওয়ার মওকা পেয়ে তিনি আমাকে লাইনে থাকতে বলেন, তারপর খুঁজে পেতে মুখমণ্ডলে বাঁধানো দাঁত লাগিয়ে জোরেশোরে বলেন, 'আই অ্যাম ড্যাম শিওর ইউ আর এক্সপেরিয়েন্সিং ডিপ্রেশন।' আমি সহমত পোষণ করে ঝাঁটাপেটা খাওয়া মেকুরের মতো মিনমিনিয়ে জানতে চাই, কোনো দাওয়াই বা এলাজ তাঁর মনে আছে কি? জবাব দিতে সাইকিয়াট্রিস্ট প্রচুর সময় নেন। ভদ্রলোক সম্ভবত ভুগছেন মৃদু ডায়মেনশিয়ায়। হরতনের খেলায় ইনি কখনো–সখনো চিরতন বা রুহিতন দিয়ে ট্রাম করার চেষ্টা করেন। ভুল ধরিয়ে দিলে ঝাড়বাতির দিকে চেয়ে থাকেন, কখনো-বা ঝকঝকে দাঁতে খামোকা জেল্লা ছড়িয়ে হাসেন। লাইন কেটে গেল কি? ওপাশ থেকে কোনো জবাব আসে না, উদ্বিগ্ন হয়ে জানতে চাই, 'ডক্টর, আর ইউ স্টিল দেয়ার?' 'অহ ইয়েস...ইয়াপ' বলে ভারি আশ্বস্ত করার ভঙ্গিতে এবার তিনি বেশ গুছিয়ে জবাব দেন, উপদেশের গুরুত্ব আমলে এনে আমি উডপেনসিলে নোট নিই। আমার মতো বয়োবৃদ্ধরা 'অ্যাট রিস্ক অব ডিপ্রেশন'–এ এজ গ্রুপের মধ্যে 'ইমোশনাল ডিসট্রেস' বা মানসিক সংকট গেল দু মাসে বেড়েছে ১০০০ শতাংশ। অনেকেই আত্মহত্যা করছেন। আলোচনার পরিশেষে তিনি জানতে চান, 'আত্মহত্যার সাম্প্রতিক পরিসংখ্যান সম্পর্কে তুমি জানতে চাও কি? এ বিষয়ে লেখা কিছু স্টাডি রিপোর্ট তোমাকে পাঠাতে পারি?' আমি তাঁকে সবিনয়ে ধন্যবাদ জানিয়ে টেলিফোন থেকে নিস্তার পাই।

ভাবতে ভাবতে কখন যে প্যাডেলে জোরেশোরে চাপ দিচ্ছি, ঠিক বুঝতেও পারি না। দেখি, চলে এসেছি ওয়ার্মশ্লো নামে শত-একরী ফার্ম হাউসটির দোরগোড়ায়, যা আমেরিকার এ আত্রাফে তুলা চাষের জন্য প্ল্যান্টেশন হাউস নামে পরিচিত। দাঁড়িয়ে পড়ে একটু বিরতি নিই। জর্জিয়ার কলোনিয়েল আমলে বিলাত থেকে জাহাজ ভাসিয়ে আসা এক অভিবাসীর মেধা ও কৃষ্ণাঙ্গ ক্রীতদাসদের মেহনতে গড়া ভিলার গেটহাউসটি নির্জন এক জগদ্দলের মতো দাঁড়িয়ে আছে। আমি ম্যানশনের উদ্যানজুড়ে সারি দিয়ে লাগানো ঔকগাছগুলোর দিকে চুপচাপ তাকাই। শাখা–প্রশাখা থেকে ঝুলছে অজস্র স্প্যানিশ-মসের ধূসরিম ঝুরি। ঝলাঝুলি করছে ফিচেল প্রকৃতির কাঠবিড়ালি। বাতাবরণের শ্যামলিমায়ও প্রশান্তি নামে না মনে। স্পষ্টত অনুভব করি, ডিপ্রেশন ইজ রিয়েল। এ মানসিক অবস্থার মোকাবিলা আগেও করেছি বার কয়েক। যতটা মনে পড়ে, কাবুলে বোমা-বিস্ফোরণজনিত অবরোধে কয়েক দিনের জন্য ইন্টারনেটের কানেকশন বিলুপ্ত হয়ে গেলে বিষয়টা খতরনাক হয়ে উঠেছিল। মাত্র বছর কয়েক আগে ওয়েস্ট আফ্রিকায় ইবোলার দুর্বিপাকে ডিপ্রেশন পুরোনো একজিমার মতো মাথা চাড়া দিয়ে উঠেছিল। চিকিৎসক-কবিরাজে ফায়দা হয়নি কিছু। তবে এ ব্যাধির যৎসামান্য টোটকা চিকিৎসা আমার জানা আছে। তার একটি হচ্ছে, ঘরের অন্ধকার খুপরিতে দিন-কে-দিন অন্তরীণ না থেকে খোলা হাওয়ায় ঘুরপাক করা। এ ধরনের ঘোরাঘুরিতে ফিজিক্যাল অ্যাক্টিভিটির পরিমাণ বাড়লে আখেরে হালকা হয়ে ওঠে মনমেজাজ।

>আজকাল সিনিওর সিটিজেনদের মধ্যে অনেকেই নতুন করে কোন পেশার ওপর দক্ষতা অর্জনের প্রশিক্ষণ নিচ্ছেন। বলা হচ্ছে যে আনকোরা কিছু শিখতে পারলে মস্তিষ্কে তৈরি হয় নিত্যনতুন কোষ, তা সহায়ক হয় ডায়মেনশিয়া কিংবা আলঝেইমার প্রভৃতি রোগের প্রতিরোধে। যাদের দক্ষতা অর্জনে আগ্রহ নেই, তারাও কোন হবি যথা সংগীত, চিত্রকলা কিংবা বার্ড ওয়াচিং প্রভৃতির কলাকৌশল শিখতে শুরু করেছেন। ব্যাটেল পিটারসন নাকি কৈশরে একটু-আধটু ড্রাম পেটাতেন। তো নতুন কিছু শেখার জোয়ারে ভেসে হালফিল ইনি স্টিল-ড্রাম বাজাতে শুরু করেছেন। পাড়ার একটি পার্টিতে তিনি নিজে থেকে উদ্যোগ নিয়ে স্টিল-ড্রাম বাজিয়ে আমোদ দেওয়ার চেষ্টা করছিলেন।

আমি ফের বাইকের প্যাডেলে চাপ দিই। আইল অব হোপের প্রান্তিকে এসে অনুভব করি, বাইক-পাথে আমি সম্পূর্ণ একা। স্পিড আপনা–আপনি বেড়ে যায়, হৃদয়-মনে বাল্যবন্ধু সিনেমার সংগীত গুনগুনিয়ে ওঠে। সড়কের দুপাশে দীর্ঘ গাছপালার স্যাঁতসেঁতে তলা গাঢ় সবুজ আন্ডারগ্রোথে ছায়াচ্ছন্ন। তবে মাঝেমধ্যে একটি-দুটি প্রশস্ত অপেনিং দিয়ে দেখা যায় ছাঁটা ঘাসের বিশাল লনওয়ালা ভিলা টাইপের বিরাট সব কাঠের ঘরবাড়ি। এ বাড়িগুলোর কোনো কোনোটি কটন প্ল্যান্টেশনের বিত্তবান শ্বেতাঙ্গ নাগরিকদের অবসর বিনোদনের ওয়াটারফ্রন্ট প্রপার্টি। শতখানেক বছর আগেও এগুলোর দেখভাল করত কৃষ্ণাঙ্গ ক্রীতদাসেরা। হালফিল অবশ্য পরিস্থিতির বদল হয়েছে, এসব ম্যানশনের তত্ত্বাবধান করছে বহুলাংশে মেক্সিকো থেকে আগত অভিবাসী সম্প্রদায়।

ডকে দড়ি বাঁধা দুটি ভারী বোট

এসব প্রসঙ্গ নিয়ে ভাবতে ভাবতে হঠাৎ মনে হয়, ধার করা ফেন্সি গিয়ার লাগানো মাউন্টেনবাইকখানা হয়ে উঠেছে আমার পছন্দসই বাহন। এটি যিনি আমাকে মাস সাতেক আগে ধার দিয়েছিলেন, সে প্রয়াত রুপালি চুলের বয়োবৃদ্ধ মানুষ হেরাল্ড গ্রিনবার্চ সাহেবের বসতবাড়িটিও আইল অব হোপের নোনা-জলবাহী লেগুনের কাছাকাছি। স্বেচ্ছাসেবার কাজকর্ম শিখতে আমি কেবল যেতে শুরু করেছি সিনিওর সেন্টারে। গ্রিনবার্চ সাহেব ওখানে হার্টের সমস্যায় যাঁরা ভুগছেন, তাঁদের জড়ো করে ফিজিক্যাল অ্যাক্টিভিটির তালিম দিতেন। এ অ্যাক্টিভিটিগুলোর একটি হচ্ছে, নিয়ম করে সপ্তাহে অন্তত দুদিন বাইসাইকেল চালানো। এতে যে উপকার হয়, তার প্রমাণ হিসেবে নিজের ফিটফাট দেহটি দেখিয়ে বলতেন, ৯ বছর আগে বাইপাস সার্জারি পর থেকে বাইসাইকেল চালিয়ে ও সাঁতার কেটে তিনি নীরোগ থাকতে পেরেছেন। আমার হৃৎপিণ্ডে মেরামতির প্রয়োজন আছে জানতে পেরে গ্রিনবার্চ উৎসাহ দিয়ে বলেন, 'ইয়াংম্যান, কাম অলং অ্যান্ড বাইক আরাউন্ড আ বিট উইথ মি, আই অ্যাম টেলিং ইউ...থিংকস আর গোনা গেট ইমপ্রুভ।' প্রস্তাবে আমি রাজি হই, কিন্তু সমস্যা দেখা দেয় আমার নিজস্ব কোনো মাউন্টেনবাইক না থাকায়। কেবল সান্তা-ফে শহর ছেড়ে অত্র এলাকায় এসে থিতু হওয়ার কোশেশ করছি, জুতমতো ঘর জোটানোই জটিল হয়ে উঠছে, এ শহরে বাস করব কি না, তাও নিশ্চিত নই, এ পরিস্থিতিতে মাউন্টেনবাইক কেনা...। তিনি টোকা দিয়ে সিগারেটের ছাই ফেলে বলেন, 'ড্রপ বাই মাই হাউস অ্যাট দ্য আইল অব হোপ। আমার গ্যারেজের লাগোয়া গুদামে পড়ে পড়ে জং ধরছে দু-তিনখানা বাইক, ধার নাও একখানা, পরে তোমার নিজের বাইক হলে নাহয় রিটার্ন করে দিয়ো।'

উইকেন্ডের অবসরে দু-একবার তাঁর সঙ্গে মাউন্টেনবাইকও হাঁকিয়েছি। নানা কারণে অন্তরঙ্গতা তেমন হয়নি। সিনিওর সেন্টারে স্বেচ্ছাসেবা করতে গিয়ে তাঁর ব্যাপারে গালগল্প শুনেছি বেশ কিছু। গাল্ফ স্ট্রিম নামে নগরীর একটি শৌখিন উড়োজাজাজ নির্মাণের কারখানায় খাটছে গ্রিনবার্চ সাহেবের বিপুল অঙ্কের বিত্ত। তাঁর তিন প্রজন্মের পুরোনো বসতবাড়ির স্টাডিতে নাকি আছে—ক্রীতদাস ব্যবসা–সংক্রান্ত নথিপত্র, যা হাল জামানার গবেষকেরা তাঁর দ্বারস্থ হয়ে অ্যাকসেস লাভে ব্যর্থ হয়েছেন। গেল বছরের শেষ দিকে তিনি স্থানীয় দুটি কৃষ্ণাঙ্গ আফ্রিকান-আমেরিকান তরুণ-তরুণীকে ঘানার স্লেভ ক্যাসোল সরেজমিন দেখতে যাওয়ার স্টাডি-ট্যুরে বৃত্তি দিয়ে স্পনসর করেন। এতে গ্রিনবার্চ–সম্পর্কিত গুজবের বেলতা-চাকে যেন ঢিল পড়ে। আড়ালে-আবডালে বাতচিত হতে শোনা যায়, পূর্বপুরুষদের ক্রিতদাস ব্যবসার গিল্ট ফিলিং থেকে তিনি বৃত্তির কড়িতে গোনাগারি করলেন।

এসে পড়ি আইল অব হোপের নোনাজল–সংলগ্ন খাসমহলে। মেরিনার কাঠে তৈরি জেটির বিরাট প্ল্যাটফর্মটি সম্পূর্ণ নির্জন। কিন্তু বোট বাঁধা নেই তেমন। আন্দাজ করি, বেশ বেলা হয়েছে, যারা নাও ভাসাতে সক্ষম, তারা বাই দিস টাইম ভেসে গেছে দরিয়ার দিকে। এখানে গ্রিনবার্চ সাহেবের সেইলবোটটি নোঙর করে থাকার কথা, তা দেখতে না পেয়ে একটু অবাক হই। তাঁর সংসারে সন্তানাদি বা ওয়ারিশান কে আছেন, আমি ঠিক জানি না। বাড়িতে তিনি একাকীই বসবাস করতেন। হয়তো মৃত্যুর সংবাদ পেয়ে কোনো নিকট আত্মীয় সৎকার করতে এসেছিলেন, তিনি কি সেইলবোটটি ভাসিয়ে নিয়ে গেছেন অন্যদিকে? যাক, প্যাডেল মেরে আরেকটু আগাই। এদিকে ছোট ছোট কাঠের ডক বা প্রাইভেট জেটি। একটি ডকে দড়ি বাঁধা হয়ে ভাসছে দুটি ভারী বোট। আমি সাইকেল থেকে নেমে পড়ে আস্তে-ধীরে মাউন্টেনবাইকটি ঠেলে ঠেলে হাঁটি। তাবৎ পরিসরের তুমুল নীরবতায় চিড় কেটে বিপুল আওয়াজে যেন বিস্ফোরিত হয় একটি বাদ্যযন্ত্র। আমি নিরিখ করে চারদিকে তাকাই। একটি প্রাইভেট ডেকের ব্রিজে দাঁড়িয়ে স্থূলকায় একজন কৃষ্ণাঙ্গ মানুষ, তিনি সোনালি রঙের টুবা নামে বিশাল একটি বাদ্যযন্ত্র জাপটে ধরে বাজানোর কসরত করতে করতে ফিরে তাকান। আমি প্রমাদ গুনি, মানুষটি আমার চেনা। এনার নাম আনসার ব্যাটেল পিটারসন। ইনিও সিনিওর সেন্টারের আরেক সাঙ্গাত। বছর কয়েক আগে ব্যাটেল পিটারসন কাঠমিস্ত্রী হিসাবে ডক নির্মাণ করতেন। এখনও সুযোগ পেলে জেটি মেরামতের ছোটা-কাজে হাত লাগান। মাইল্ড স্ট্রোকের পর অবসর নিয়ে ইনি ভলান্টিয়ার হিসাবে সিনিওর সেন্টারে মেনটেইন্যান্স জাতীয় কাজের তদারকি করেন।

শ্বেতশুভ্র ভিলার শানদার সিঁড়ি

আজকাল সিনিওর সিটিজেনদের মধ্যে অনেকেই নতুন করে কোন পেশার ওপর দক্ষতা অর্জনের প্রশিক্ষণ নিচ্ছেন। বলা হচ্ছে যে আনকোরা কিছু শিখতে পারলে মস্তিষ্কে তৈরি হয় নিত্যনতুন কোষ, তা সহায়ক হয় ডায়মেনশিয়া কিংবা আলঝেইমার প্রভৃতি রোগের প্রতিরোধে। যাদের দক্ষতা অর্জনে আগ্রহ নেই, তারাও কোন হবি যথা সংগীত, চিত্রকলা কিংবা বার্ড ওয়াচিং প্রভৃতির কলাকৌশল শিখতে শুরু করেছেন। ব্যাটেল পিটারসন নাকি কৈশরে একটু-আধটু ড্রাম পেটাতেন। তো নতুন কিছু শেখার জোয়ারে ভেসে হালফিল ইনি স্টিল-ড্রাম বাজাতে শুরু করেছেন। পাড়ার একটি পার্টিতে তিনি নিজে থেকে উদ্যোগ নিয়ে স্টিল-ড্রাম বাজিয়ে আমোদ দেওয়ার চেষ্টা করছিলেন। যতটা শুনেছি, তাঁর অধীর বাদনে কোনো কোনো শ্রোতার বধির হওয়ার উপক্রম হয়েছিল। এতে নিরুৎসাহিত হয়ে ব্যাটেল পিটারসন ই-বে থেকে শস্তায় খরিদ করেছেন ঝলমলে একটি টুবা। তিনি ফের তাতে শিঙা ফোঁকার মতো জবরদস্ত আওয়াজ তোলেন, রাজ্যের সব সিগাল পাখি জল ছেড়ে পড়িমরি করে উড়ে যায় দিগন্তের দিকে। মিউজিকের ইমপ্যাক্টে আমিও শিউরে ওঠে অন্যদিকে তাকিয়ে দ্রুত বাইকটি ঠেলি। এ ভদ্রসন্তান ইউটিউবের কায়দা-কানুন করায়ত্ত করতে পারলে, তামাম অন্তর্জালজুড়ে ব্রাউজ করনেওয়ালাদের মধ্যে খবর হয়ে যাবে।

এসে পড়ি ওয়াটারফ্রন্টের কিনারা ঘেঁষে চলে যাওয়া বৃক্ষশোভিত সরণিতে। এদিককার পেল্লায় মাপের ভিলাগুলোর কোনো কোনোটায় বাস করছেন বিত্তবান সিনিওর সিটিজেনরা। সচরাচর তাঁরা গাল্ফকার্ট হাঁকিয়ে আস্তে-ধীরে হাওয়া বিধৌত সরণিতে ঘুরপাক করেন। আজ কোথাও আমি কোনো গাড়ি-ঘোড়ার লিমলেশও দেখতে পাই না। এসে পড়ি গ্রিনবার্চ সাহেবের ভিলাটির কোনায় ছায়া ছড়ানো বয়োবৃদ্ধ ঔকগাছটির তলায়। বাতাসে ঝুলে থাকা ধূসর বর্ণের স্প্যানিশ মসগুলো কিংবদন্তির দৈত্যের চুল-দাড়ির মতো দুলছে। আমি মাউন্টেনবাইক স্ট্যান্ডে দিয়ে একটু দাঁড়াই। এ ধরনের ঔকগাছ প্রাক-ঔপনিবেশিক জামানার, কোনো কোনোটার বয়স দুই-আড়াই শত বছরেরও ওপর। গ্রিনবার্চ সাহেব বৃক্ষগুলোর বয়স বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে নিরূপণ করে লেভেল লাগানোর কথা বলতেন। কাজটি তাঁর অসমাপ্ত হয়ে গেছে। মাত্র ১০ দিন আগে তিনি প্রয়াত হয়েছে। না, করোনা সংক্রমণে তাঁর মৃত্যু হয়নি। তবে লকডাউনের সামান্য দিন আগে—তাঁর বসতবাড়িতে সার্ভিস দিতে আসা মেইডকে কাজে আসতে মানা করে দিয়েছিলেন। শরীরে একটি অস্ত্রোপচারের প্রয়োজন ছিল। কিন্তু শহরের হাসপাতালগুলো করোনা সংক্রমণে রুগণ মানুষের জন্য প্রস্তুতির প্রয়োজনে বাতিল করে দিয়েছিল সব ধরনের ইলেকটিভ সার্জারি। এমনকি শরীরী দুর্বিপাকে ইমার্জেন্সিতে যাওয়াও নিরুৎসাহিত করছিল। গ্রিনবার্চ সাহেবের অসুস্থতার সংবাদ প্রতিবেশীরা জানতে পারেনি। সম্ভবত রাতের বেলা অকস্মাৎ হার্ট অ্যাটাকে তাঁর মৃত্যু হয়। তাঁর সঙ্গে আমার অন্তরঙ্গতা ছিল না, তবে একটি আনফিনিশড বিজনেস থেকে গেছে। মাইন্টেনবাইকটি তো তাঁকে ফিরিয়ে দেওয়ার কথা। তাঁর কোনো ওয়ারিশানকে আমি চিনি না, এ পরিস্থিতিতে কী করা যায়...?

নোনাজল ছোঁয়া লিলুয়া বাতাস এসে শরীর জুড়িয়ে দেয়। কে যেন খোনা গালায় কথা বলে ওঠে। বারবার জপা বাক্যটির শব্দগুলো পরিষ্কার হয়ে ওঠে। আমি ঘাড় বাঁকিয়ে গাছের ডালপালায় নিরিখ করি, এবার স্পষ্ট শুনতে পাই, 'ক্লারা—গেট মি আ ড্রিংক...উইল ইউ?' কণ্ঠটি সম্ভবত টিয়া বা তোতা-জাতীয় কোনো পাখির। আমি খেচরটির সন্ধানে ফের তাকাই বৃক্ষের সবুজ ক্যানোপিতে, না তেমন কিছু দেখতে পাই না, তবে ফের শুনতে পাই, 'ইয়াহ, গিভ মি সাম জিন অ্যান্ড টনিক...অ্যান্ড আ লিটিল লাইম...দ্যাট উড ডু।' খেচরকণ্ঠে গ্রিনবার্চ সাহেবের কথা বলার ভঙ্গি সুন্দরভাবে ফুটে ওঠে। জানতে কৌতূহল হয়, ক্লারা নামের নারীটি কে, তার সঙ্গে কী সম্পর্ক ছিল গ্রিনবার্চের? পাখা ঝটপটানোর শব্দ শুনতে পাই, কিন্তু পত্রালির ঘন আড়াল আমার দৃষ্টিকে অবরুদ্ধ করে রাখে। আমি অবগত যে, হবি হিসাবে গ্রিনবার্চ সাহেব ম্যাকাও, আমাজন উপকূলের বর্ণাঢ্য টিয়া প্রভৃতি পুষতেন। পাখিগুলো নাকি তাঁর বসতবাড়ির অঙিনার খোলামেলা চরে বেড়াত। আমি গাছতলা ছেড়ে চলে আসি রোদে ঝলসে ওঠা শ্বেতশুভ্র ভিলাটির সামনে।

আঙিনায় মেনিকিওর করা সবুজ লন থেকে উঠে গেছে শানদার সিঁড়ি, কোথাও মানুষজন কেউ নেই, তুমুল এ নির্জনতায় দাঁড়িয়ে ভাবি, মাউন্টেনবাইকটি কি গেটে ফেলে রেখে ফিরে যাব? ঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারি না। মনে হয়, এ মুহূর্তে সিদ্ধান্তটি না নিলেও চলে। তো বাইকের প্যাডেলে চাপ দিতে যাই, চোখ আপনা–আপনি ফিরে যায় সফেদ ভিলাটির আঙিনায়। শৈশবে আমাদের গ্রামের বাড়িতে ভিখ মাগতে আসা এক বৃদ্ধের গলায় শোনা লোকগীতির একটি চরণ অনেক বছর পর ফিরে আসে মনে, 'সাহেবের বাংলায় আছে ধুমধাম, সাহেব নাই-রে..।' প্যাডেল মারতে মারতে সংগীতটির পরবর্তী চরণ নিয়ে ভাবি, কিন্তু কিছুতেই তা মনে পড়ে না। প্যাডেলে দ্রুত চাপ পড়ে, আর মনে হয়, প্রস্থান আসবে এভাবে, পেছনে পড়ে থাকবে বসতবাড়ি, জমিজিরত ও পোষা পাখি।

নেচার ওয়াক

দুপুর হয়নি, ভেষজ চায়ের মতো কবোষ্ণ রোদ ছলকাচ্ছে চতুরদিকে, এখনই ঘরে ফিরতে ইচ্ছা হয় না। অনেকক্ষণ মাউন্টেনবাইক হাঁকানো হলো। নেমে পড়ে, ঝোপঝাড়ের ভেতর দিয়ে ঘঁষটে বাহনটিকে নিয়ে আসি শহরতলির নেচার ওয়াকের ট্রেইলহেডে। পার্কিংলটে গোটা চারেক গাড়ি দেখতে পেয়ে বুঝতে পারি বনানীতে পদপরিক্রমার পথরেখা নির্জন নাও হতে পারে। আমি বাইক লক করে ঘুরে দাঁড়াই, চোখে পড়ে হরেক রকমের চিত্র তথা অক্টোপাস, মেডিটেশনের ম্যান্ডেলা,শঙ্খ, শান্তিচিহ্ন, কেনোবিসের প্রসূনশুদ্ধ পত্রালি প্রভৃতি আঁকা বিট-আপ টয়োটা কারটি। আন্দাজ করি, গাড়িটির মালিকিন ভায়োলেতা অলরেডি ঢুকে পড়েছে বনানীতে। হিপি চরিত্রের এ তরুণী শখের গ্লাস ব্লোয়ার, অর্থাৎ তীব্র তাপে কাচ গলিয়ে তাতে বর্ণের বিচ্ছুরণ মিশিয়ে নির্মাণ করে ছোটখাটো ভাস্কর্য ও নানা প্রতীক। এ ছাড়া পার্শব্যবসা হিসেবে সে নগরীর পার্কে পর্যটকদের কাছে চাপলিশে বিক্রি করে কেনোবিসের স্টিক ও কাচের কল্কে। হামেশা হাসিখুশি ভায়োলেতার শরীর-মনে আছে সহজাত চার্ম, উর্দ্দিষ্ট পুরুষদের সঙ্গে সে কখনো–সখনো ফ্লার্টি হতে পছন্দ করে। স্টিক বিক্রির জন্য ভায়োলেতা যাদের অ্যাপ্রোচ করে, তারা সহজে ফসকাতে পারে না। সুতরাং তার সান্নিধ্যের সম্ভাবনায় সতর্ক হওয়ার প্রয়োজন আছে।