দস্তইয়েফস্কির দারিদ্র্যপীড়িত দিনগুলো কেমন ছিল

রুশ ঔপন্যাসিক ফিওদর দস্তইয়েফস্কিকে বলা হয় লেখকদের লেখক। জীবদ্দশায় অপরিমেয় দারিদ্র্যের মুখোমুখি হয়েছিলেন তিনি। কেমন ছিল তাঁর দারিদ্র্যপীড়িত দিনগুলো? তাঁর স্ত্রী আন্না গ্রিগোরিয়েভনা স্নিৎকিনার লেখায় ধরা আছে সেই বিবরণ। ভূমিকাসহ অনুবাদ করেছেন মশিউল আলম।

ফিওদর দস্তইয়েফস্কি
 ছবি: সংগৃহীত

ফিওদর দস্তইয়েফস্কির প্রধান শত্রুর সংখ্যা ছিল দুই—মৃগী রোগ আর দারিদ্র্য। জুয়ার নেশাও তাঁর একটা বড় শত্রু ছিল, তবে তিনি শেষ পর্যন্ত সেই শত্রুকে মারতে সক্ষম হয়েছিলেন।

তাঁর ৬০ বছরের জীবনের ৫০-৫২ বছরই কেটেছে প্রকট দারিদ্র্যের সঙ্গে লড়াই করে আর সেই লড়াইয়ে নিজের প্রাণশক্তি ক্ষয় করতে করতে।

১৮৬৬ সালের অক্টোবরে যখন তাঁর বয়স ৪৫ বছর, তখন ‘জুয়াড়ি’ উপন্যাস লিখতে গিয়ে আন্না গ্রিগোরিয়েভনা স্নিৎকিনা নামের ২০ বছর বয়সী এক তরুণী স্টেনোগ্রাফারের সঙ্গে তাঁর পরিচয়। ‘জুয়াড়ি’লেখা শেষ হয় ২৬ দিনে, তরুণী স্টেনোগ্রাফার চুক্তিমাফিক ৫০ রুবল পারিশ্রমিক পেয়ে যান। স্বাভাবিকভাবেই পরস্পরকে দাসবিদানিয়া (গুড বাই) বলার মুহূর্ত চলে আসে। কিন্তু দস্তইয়েফস্কির মনে হয়, এই বিদায় সহ্য করা তাঁর পক্ষে সম্ভব হবে না।

তারপর কী হলো, সে কাহিনি আমি এখানে বলতে যাব না। শুধু বলি, ‘জুয়াড়ি’লেখার মাস তিনেকের মধ্যেই দস্তইয়েফস্কি ও আন্নার বিয়ে হয়। ১৮৮১ সালে দস্তইয়েফস্কি ৬০ বছর বয়সে মারা যান, আন্না বিধবা হন মাত্র ৩৪ বছর বয়সে।

তারপর আন্না দস্তইয়েফস্কায়া আরও ৩৮ বছর বেঁচে ছিলেন; তিনি একটা স্মৃতিকথা লিখে গেছেন। সেই স্মৃতিকথার একটা অংশের অনুবাদ ছাপা হবে ‘মীজানুর রহমানের ত্রৈমাসিক পত্রিকা’র দস্তইয়েফস্কি সংখ্যায় (আগামী নভেম্বরে)।

সেখান থেকে ছোট্ট একটা অংশ এখানে শেয়ার করছি। এখানে আন্না তাঁদের বিয়ের আগের একটি সন্ধ্যার অভিজ্ঞতা বর্ণনা করেছেন।

(আন্না দস্তইয়েফস্কায়া দস্তইয়েফস্কির পারিবারিক নাম ব্যবহার না করে লিখেছেন ‘ফিওদর মিখাইলোফস্কি’)
বন্ধুরা, একটু চেষ্টা করে দেখুন, পড়া যায় কি না ( অনুবাদটা পড়ার যোগ্য হয়েছে কি না)।

আন্না দস্তইয়েফস্কায়া লিখেছেন

আমরা একসঙ্গে যে সন্ধ্যাগুলো কাটাতাম, সেগুলো ছিল বরাবরই শান্ত ও প্রফুল্ল। কিন্তু এক সন্ধ্যায় অপ্রত্যাশিতভাবে ভীষণ একটা ঝড় বয়ে গিয়েছিল।

নভেম্বরের শেষের দিকে ঘটনা। ফিওদর মিখাইলোভিচ [দস্তইয়েফস্কি] বরাবরের মতো সন্ধ্যা সাতটায় আমাদের বাসায় এলেন। আজ তাঁকে দেখে বোঝা যাচ্ছিল, তাঁর ভীষণ শীত করছে। এক গ্লাস গরম চা খাওয়ার পর তিনি আমাকে জিজ্ঞেস করলেন কনিয়াক আছে কি না। আমি বললাম কনিয়াক নেই, কিন্তু ভালো শেরি আছে; সঙ্গে সঙ্গে তাঁর জন্য শেরি নিয়ে এলাম; তিনি বড় রুমকায় পরপর তিন-চারটা পেগ খেলেন, তারপর আবার এক গ্লাস গরম চা খাওয়ার পর মনে হলো তাঁর শীত কেটেছে।

আমি বুঝতে পারছিলাম না, আজ তাঁর এত শীত লাগার কারণ কী। একটু পরেই কারণটা বোঝা গেল: আমি কিছু-একটা আনার জন্য হল ঘরের মধ্যে দিয়ে যাওয়ার সময় লক্ষ করলাম, বাইরের পোশাক ঝোলানোর হ্যাঙারে ফিওদর মিখাইলোভিচের শুবার (শুবা: পশমের তৈরি ওভারকোট/ ফার কোট) বদলে ঝুলছে একটা ওয়াডেড ওভারকোট, যে ধরনের ওভারকোট হেমন্তকালে পরা হয়।
তক্ষুনি ফিরে এসে তাঁকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘আজ তুমি শুবা পরে আসনি?’
তিনি হেসে বললেন, ‘না, হেমন্তের ওভারকোট পরে এসেছি।’

‘কী বিবেচনা তোমার! কিন্তু কেন শুবা পরে এলে না?’
‘শুনেছিলাম আজ আবহাওয়া উষ্ণ হবে।’

‘এইবার বুঝলাম, কেন তোমার এত শীত করছে। আমি এক্ষুনি সিমিওনকে পাঠাচ্ছি; ও গিয়ে তোমার এই ওভারকোটটা রেখে শুবাটা নিয়ে আসবে।’

‘প্রয়োজন নেই! প্লিজ, প্রয়োজন নেই,’ তিনি আমাকে থামানোর জন্য ব্যস্ত হয়ে উঠলেন।
‘প্রয়োজন নেই মানে কী, দারাগোই মোই? ফিরে যাওয়ার পথে তো তোমার একদম ঠান্ডা লেগে যাবে: রাতে শীত আরও বাড়বে তো।’

তিনি চুপ করে রইলেন। আমি জোরাজুরি করতে লাগলাম; শেষে তিনি বললেন, ‘শুবা তো আমার নেই।’
‘নেই মানে? চুরি হয়ে গেছে নাকি?’
‘না, চুরি-টুরি হয়নি; ওটা বন্ধক রাখতে হয়েছে।’

স্ত্রী আন্না গ্রিগোরিয়েভনা স্নিৎকিনার সঙ্গে দস্তইয়েফস্কি

আমি অবাক হয়ে গেলাম। কেন তাকে এই কাজ করতে হলো, তা জানার জন্য তাঁকে চেপে ধরলাম। শেষে তিনি নিতান্ত অনিচ্ছায় বললেন, আজ সকালে এমিলিয়া ফিওদরোভনা (তাঁর বড় ভাই মিখাইলের বিধবা স্ত্রী) তাঁর কাছে এসেছিলেন, তাঁকে বিপদ থেকে উদ্ধার করতে হবে: পঞ্চাশ রুবলের একটা ঋণ আজকেই শোধ করতে হবে। তারপর তাঁর সৎছেলেও (দস্তইয়েফস্কির প্রথম স্ত্রী মারিয়া ইসায়েভা ও তাঁর প্রথম স্বামী আলেকসান্দর ইসায়েভের ছেলে পাভেল ইসায়েভ) টাকা চাইল; আর টাকা চেয়ে চিঠি পাঠিয়েছে ছোট ভাই নিকোলাই মিখাইলোভিচ।

কিন্তু ফিওদর মিখাইলোভিচের কাছে কোনো টাকা ছিল না। তখন সবাই মিলে সিদ্ধান্ত নিল, টাকা জোগাড়ের জন্য নিকটস্থ বন্ধকীর দোকানে তাঁর শুবাটা বন্ধক রাখা হোক; তাঁরা তাঁকে নিশ্চয়তা দিল যে আজ থেকে বরফগলা শুরু হবে, সামনের কয়েকটা দিন আবহাওয়া উষ্ণ থাকবে, সুতরাং তিনি “রুস্কি ভেস্তনিক” পত্রিকা থেকে টাকা পাওয়ার আগপর্যন্ত হেমন্তের ওভারকোটটা পরেই চলাফেরা করতে পারবেন।

তাঁর আপনজনদের এই নিষ্ঠুর আচরণে আমার ভীষণ ক্ষোভ হলো। আমি তাঁকে বললাম, তাঁর আপনজনদের সহযোগিতা করার ইচ্ছাটা আমি বুঝি; কিন্তু সেটা করতে গিয়ে এমন কাজ করা উচিত নয়, যার ফলে তাঁর স্বাস্থ্যের ক্ষতি হতে পারে, এমনকি হয়তো মৃত্যুও ঘটতে পারে।

কথাগুলো আমি শান্তভাবেই শুরু করেছিলাম, কিন্তু বলতে বলতে খেপে উঠতে লাগলাম। আমার ক্ষোভ ও দুঃখ ক্রমেই বেড়ে উঠতে লাগল। একপর্যায়ে নিজের ওপর সব নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেললাম, উন্মাদের মতো যা ইচ্ছা তা-ই বলতে লাগলাম; বললাম যে এখন আমার প্রতি তাঁর দায়িত্ব আছে, কারণ আমি তাঁর বাগ্‌দত্তা; বললাম তাঁর মৃত্যু হলে আমি তা সহ্য করতে পারব না; কাঁদলাম, চিৎকার করলাম, ছটফট করতে লাগলাম হিস্টিরিয়াগ্রস্তের মতো।

ফিওদর মিখাইলোভিচ ভীষণ ঘাবড়ে গেলেন, আমাকে জড়িয়ে ধরলেন, আমার হাতে চুমু খেলেন, আমাকে শান্ত হওয়ার অনুরোধ করতে লাগলেন।

আমার মা আমার কান্নার শব্দ শুনতে পেলেন, তড়িঘড়ি করে এক গ্লাস চিনি শরবত বানিয়ে নিয়ে এলেন।

শরবত খাওয়ার পর একটু শান্ত হলাম; তখন লজ্জাবোধ হতে লাগল, আমি ফিওদর মিখাইলোভিচের কাছে ক্ষমা চাইলাম। তিনি আমাকে প্রবোধ দেওয়ার মতো করে বললেন, গত শীতকালে তাঁকে তাঁর ওই পশমি ওভারকোটটা বন্ধক রাখতে হয়েছিল পাঁচ থেকে ছয়বার; হেমন্তে পরার ওভারকোটেই তাঁকে শীতকালটা কাটাতে হয়েছিল।