বিশ্বখ্যাত জাপানি কথাসাহিত্যিক হারুকি মুরাকামির সদ্য প্রকাশিত এই গল্প ছাপা হয়েছে ‘নিউ ইয়র্কার’ পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণের ৮ ও ১৫ জুলাই, ২০২৪ তারিখের সংখ্যায়। গল্পটিতে এই লেখক ফুটিয়ে তুলেছেন কাহো নামের এক মেয়ের বেদনা। মূল জাপানি ভাষা থেকে ইংরেজিতে অনুবাদ করেছেন ফিলিপ গ্যাব্রিয়েল। আর ইংরেজি থেকে বাংলা ভাষান্তর করেছেন ফারুক মঈনউদ্দীন
লোকটি বলে, ‘জীবনে বহু মেয়ের সঙ্গে ডেটিং করেছি আমি, কিন্তু আমাকে বলতে হচ্ছে, আপনার মতো কুৎসিত চেহারার কাউকে দেখিনি কখনো।’
ডেজার্ট খাওয়ার পর তখন কফির জন্য অপেক্ষা করছিল ওরা।
লোকটার কথার রেশ শেষ হতে একমুহূর্ত লাগে, তিন কি চার সেকেন্ড হতে পারে। কথাটা আসে আচমকা, ওর মতলবটা তক্ষুনি বুঝতে পারে না কাহো। লোকটা যখন এই ঠোঁটকাটা কথাগুলো বলছিল, পুরোটা সময় হাসছিল ও। একটা ভদ্র বন্ধুত্বপূর্ণ হাসি। কোনো কৌতুকও ছিল না ওর কথায়। ঠাট্টাও করছিল না, পুরোপুরি সিরিয়াস।
একমাত্র প্রতিক্রিয়া দেখাতে পারত কাহো, কোলের ওপরের ন্যাপকিনটা টেবিলের ওর ছুড়ে ফেলে পাশের চেয়ারে রাখা পার্সটা তুলে নিয়ে উঠে দাঁড়াতে পারত, তারপর একটি কথাও না বলে বেরিয়ে যেতে পারত রেস্তোরাঁ থেকে। খুব সম্ভবত পরিস্থিতিটা মোকাবিলা করার এটাই হতো সবচেয়ে ভালো উপায়।
কিন্তু যেকোনো কারণেই হোক, কাহো পারে না সেটা। পরে তার মনে আসে, এটার একটা কারণ, সত্যিই স্তম্ভিত হয়ে গিয়েছিল ও; দ্বিতীয় কারণ ছিল কৌতূহল। রেগে গিয়েছিল সে, সত্যিই ভয়ানক রাগ হয়েছিল ওর। রাগ হবে না কেন? তবে তার চেয়ে বেশি যেটা ছিল, ওর জানার ইচ্ছা, কী বলতে চাইছিল লোকটা। সে কি সত্যিই কুৎসিত? লোকটার এই মন্তব্যের পেছনে আরও কিছু ছিল কি?
একটু থেমে লোকটা বলেছিল, ‘আপনি খুবই বিশ্রি, কথাটা একটু বাড়িয়ে বলেছি আমি। তবে আমার দেখা মহিলাদের মধ্যে আপনি একেবারে সাদামাটা, তাতে কোনো সন্দেহ নেই।’
ঠোঁট দুটি কুঁচকে স্থির দুচোখে নীরবে লোকটার চেহারা নিরীক্ষণ করে ও।
এ রকম একটা কথা বলার কী দরকার ছিল ওর? প্রথমবার দেখা করতে এসে (এ রকমই কিছু ছিল ওটা) যদি অন্যজনকে পছন্দ না হয়, তাহলে পরে আর কোনো যোগাযোগ না রাখলেই হয়। এটাই তো যথেষ্ট। মুখের ওপর অপমান করা কেন?
লোকটা কাহোর বছর দশেক বা তার চেয়ে বড়, সুপুরুষ, কাপড়চোপড় দাগহীন, নিখুঁত। ঠিক কাহোর ধরনের নয়, যদিও মনে হয় ভালো পরিবারের ছেলে। চেহারাটা ফটোজেনিক, এভাবে বললেই ঠিক হয়। আরও কয়েক ইঞ্চি লম্বা হলে নায়ক হতে পারত সে। যে রেস্তোরাঁটা বেছে নিয়েছিল, সেটাও আরামদায়ক এবং কেতাদুরস্ত, খাবার ভালো ও বিশুদ্ধ। যাকে বাচাল বলা যায়, তেমনও নয় লোকটা, আলাপ চালিয়ে যাওয়ার মতো মার্জিত কোনো অস্বস্তিকর নীরবতাও ছিল না কখনো। (বেমক্কা হলেও, পরে যখন ব্যাপারটার দিকে ফিরে দেখে, ওর মনে পড়ে না কী নিয়ে আলাপ করেছিল ওরা)। ডিনারের সময় লোকটার প্রতি নিজেকে আন্তরিক মনে হয়েছিল ওর, এটা ওকে স্বীকার করতেই হবে। আর তারপরই, আচমকা এই ঘটনা। কী ঘটেছিল আসলে?
‘আপনার কাছে ব্যাপারটা অদ্ভুত মনে হতে পারে,’ ওদের সামনে দুটি এসপ্রেসো কফি রেখে যাওয়ার পর শান্ত কণ্ঠে বলেছিল লোকটা। যেন পড়তে পেরেছিল কাহোর মনের কথা। একটা ছোট চিনির দলা নিজের কফির মধ্যে ফেলে চুপচাপ নাড়তে থাকে লোকটা। ‘যাকে কুৎসিত মনে হয় অথবা বলা উচিত, যার চেহারা পছন্দ করিনি, তার সঙ্গে শেষ অবধি ডিনার করলাম কেন? প্রথম গ্লাস ওয়াইন শেষ করার পর সাক্ষাৎটা সংক্ষিপ্ত করে ফেলা উচিত ছিল আমার। দেড় ঘণ্টা সময় নিয়ে তিন পদের ডিনার খেয়ে পুরো সময়টা নষ্ট, তাই না? একেবারে শেষে এসে এ রকম একটা কথা কেন বলতে হলো আমাকে?’
টেবিলের ওপাশের লোকটার মুখের দিকে তাকিয়ে চুপ করে থাকে কাহো। কোলের ওপর ন্যাপকিনটা দুহাতে চেপে ধরা।
লোকটা বলে, ‘মনে হয় নিজের কৌতূহলটা চেপে রাখতে পারিনি আমি। বোধ হয় জানতে চেয়েছিলাম, আপনার মতো একজন সত্যিকার সাদাসিধে মহিলা কী ভাবছে, এ রকম সাদামাটা হওয়াটা কীভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করছে আপনার জীবনটাকে।’
কাহো ভাবে, ‘আপনার কৌতূহল মিটেছিল কি?’ তবে সেটা জিজ্ঞেস করে না মুখ ফুটে।
কফিতে চুমুক দিয়ে লোকটা বলে, ‘আমার কৌতূহল কি মিটেছিল?’ কোনো ভুল নেই, ওর মনের কথা বুঝতে পারছিল লোকটা। ঠিক যেভাবে পিঁপড়েভোজী প্রাণী উইঢিবিকে লম্বা সরু জিব দিয়ে চাটে।
মাথাটা সামান্য নেড়ে কাপটা পিরিচের ওপর নামিয়ে রাখে লোকটা। তারপর নিজের প্রশ্নের জবাব দেয়, ‘না, মেটেনি।’
হাত তুলে ওয়েটারকে ডাকে লোকটা, তারপর বিল মিটিয়ে দেয়। কাহোর দিকে ফিরে সামান্য বাউ করে সোজা বেরিয়ে যায় একবারও ফিরে না তাকিয়ে।
বাচ্চা বয়স থেকেই নিজের চেহারা নিয়ে তেমন আগ্রহ ছিল না কাহোর। আয়নায় নিজের যে চেহারা দেখত, সেটা সুন্দর কিংবা বিশেষ রকম বিশ্রি বলে মনে হয়নি কখনো। হতাশ বা খুশি কোনোটাই হতো না সে। চেহারা ওর জীবনের কোনো ক্ষতি করছে না, এমন ভাবনা থেকেই চেহারা সম্পর্কে অনাগ্রহ জন্মায় ওর। কিংবা বোধ হয় এভাবে বলা ভালো, এ বিষয়ে জানার কোনো সুযোগ ঘটেনি ওর। বাবা-মায়ের একমাত্র সন্তান ও, তাই সুশ্রী হতে পারত কি পারত না, তার সঙ্গে সম্পর্কিত ছিল না ওদের স্নেহ।
সত্যি বলতে, বাচ্চা বয়স থেকেই নিজের চেহারা নিয়ে তেমন আগ্রহ ছিল না কাহোর। আয়নায় নিজের যে চেহারা দেখত, সেটা সুন্দর কিংবা বিশেষ রকম বিশ্রি বলে মনে হয়নি কখনো। হতাশ বা খুশি কোনোটাই হতো না সে। চেহারা ওর জীবনের কোনো ক্ষতি করছে না, এমন ভাবনা থেকেই চেহারা সম্পর্কে অনাগ্রহ জন্মায় ওর। কিংবা বোধ হয় এভাবে বলা ভালো, এ বিষয়ে জানার কোনো সুযোগ ঘটেনি ওর। বাবা-মায়ের একমাত্র সন্তান ও, তাই সুশ্রী হতে পারত কি পারত না, তার সঙ্গে সম্পর্কিত ছিল না ওদের স্নেহ।
কৈশোর পার হওয়ার পরের সময়টুকুতেও নিজের চেহারার বিষয়ে উদাসীন ছিল ও। বান্ধবীদের বেশির ভাগেরই ছিল নিজেদের চেহারা নিয়ে উদ্বেগ। বইতে পাওয়া যায়, এমন সব ধরনের মেকআপ নিত ওরা, নিজের ব্যাপারে কখনো এ রকম তাগিদ অনুভব করেনি ও। ওর একমাত্র নজর ছিল নিজের শরীর ও চেহারাকে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখার বিষয়ে। আর সেটা কখনোই তেমন কোনো কঠিন কাজ ছিল না।
একটা কো-এডুকেশন সরকারি কলেজে পড়ত ও, ছেলেবন্ধুও ছিল কয়েকজন। ওর ক্লাসের ছেলেদের যদি ওদের প্রিয় সহপাঠিনীকে ভোট দিতে বলা হতো, কখনোই জিততে পারত না কাহো, সে রকম ছিল না ও। তারপরও কোনো কারণে, সব ক্লাসেই দু-একজন ছাত্র আগ্রহী ছিল ওর ব্যাপারে, ওরা প্রকাশও করেছে সেটা। ওর ঠিক কোন বিষয়টাতে আগ্রহী ছিল ওরা, জানে না কাহো।
এমনকি কলেজের গণ্ডি পেরিয়ে টোকিওর আর্ট স্কুলে যখন ভর্তি হয়, তখনো কদাচিৎ ছেলেবন্ধুর অভাব হয়েছে ওর। তাই ও আকর্ষণীয় কি না, এ ব্যাপারে কোনো মাথাব্যথা ছিল না। সেই অর্থে ভাগ্যবতী বলা যায় ওকে। ওর কাছে অদ্ভুত লাগত, যেসব বান্ধবী ওর চেয়ে দেখতে অনেক ভালো, তারাও নিজেদের চেহারা নিয়ে দুশ্চিন্তায় ভুগত, বহু পয়সা খরচ করে প্লাস্টিক সার্জারিও করিয়েছে কেউ কেউ। কখনোই বিষয়টার তল পায়নি কাহো।
তাই ছাব্বিশ বছর পার হওয়ার পর প্রথম দেখাতেই লোকটি যখন বেমক্কা বলে দিল যে সে কুশ্রী, সবকিছু তালগোল পাকিয়ে যায় কাহোর। লোকটার কথায় আঘাত না পেয়ে পুরোপুরি হতভম্ব ও বিচলিত হয়ে পড়ে সে।
লোকটার সঙ্গে কাহোর পরিচয় করিয়ে দিয়েছিল মাচিদা। কাহোর চেয়ে চার বছরের বড় মাচিদার ছেলেমেয়ে দুজন। ছোটদের বই বের করে এমন একটা ছোট প্রকাশনা সংস্থায় কাজ করত সে। সেই সুবাদে কাহোর লেখা ছোটদের বই সম্পাদনা করত ও। ছবির বইগুলো তেমন ভালো চলত না, তবে এসব কাজের ফাঁকে বিভিন্ন ম্যগাজিনের অলংকরণ করে চলার মতো যথেষ্ট আয় করত কাহো। এই সাক্ষাতের মাত্র কিছুদিন আগে প্রায় দুই বছর ধরে চলা সমবয়সী এক লোকের সঙ্গে সম্পর্কটা ছাড়ান-কাটান হয়ে গিয়েছিল ওর, অস্বাভাবিক বিষণ্ন হয়ে পড়েছিল সে। ভাঙনটা একটা তেতো স্বাদ রেখে গিয়েছিল ওর ভেতর। কিছুটা এই কারণেই কাজকর্মে ভাটা পড়েছিল ওর। ব্যাপারটা জানত বলে প্রথম সাক্ষাতের আয়োজনটা করেছিল মাচিদা। বলেছিল, ‘তোমার চলার ছন্দটা ঠিক হয়ে যেতে পারে।’
লোকটার সঙ্গে দেখা হওয়ার তিন দিন পর মাচিদা ফোন করে ওকে।
প্রথমেই জিজ্ঞেস করে, ‘বলো, কেমন ছিল তোমাদের সাক্ষাৎ?’
সরাসরি জবাব এড়িয়ে কাহো কেবল অস্পষ্ট জবাব দেয়, ‘হুঁ।’ তারপর পাল্টা প্রশ্ন করে, ‘ মানুষটা কী ধরনের?’
মাচিদা বলে, ‘সত্যি বলতে, ওর সম্পর্কে বেশি কিছু জানি না আমি। বন্ধুর বন্ধু বলতে পারো। মনে হয় বয়স চল্লিশের মতো, এখনো বিয়ে করেনি, কোনো এক ইনভেস্টমেন্ট কোম্পানিতে কাজ করে। ভালো ঘরের ছেলে, কাজকর্মে ভালো। যত দূর জানি, কোনো খারাপ রেকর্ড নেই। একবারই দেখা হয়েছিল ওর সঙ্গে, কয়েক মিনিট কথা হয়েছিল, মনে হয়েছে লোকটা দেখতে ভালো এবং যথেষ্ট হাসিখুশি। স্বীকার করছি একটু খাটো সে, তবে টম ক্রুজও তো তেমন লম্বা নয়। এমন নয় যে টম ক্রুজকে নিজ চোখে দেখেছি আমি।’
কাহো জিজ্ঞেস করে, ‘কিন্তু একটা হ্যান্ডসাম, আকর্ষণীয়, ভালো চাকুরে আগে থেকে জানাশোনা নেই, এমন কারও সঙ্গে ডেটিং করার ঝামেলায় যাবে কেন? ওর সঙ্গে যাওয়ার জন্য তো বহু মেয়ে ছিল।’
মাচিদা বলে, ‘আমারও তা-ই মনে হয়। এমনিতে খুব শার্প ও, নিজের কাজে ভালো, তবে শুনেছি ওর স্বভাবটা একটু আজব। দেখা হওয়ার আগেই ওর সম্পর্কে একটা খারাপ ধারণা দিতে চাইনি বলে কথাটা জানাইনি তোমাকে।’
কথাটার পুনরাবৃত্তি করে কাহো বলে, ‘একটু আজব?’ মাথা ঝাঁকায় ও। এটাকে একটু আজব বলা যায়?
মাচিদা জিজ্ঞেস করে, ‘তোমরা কেউ কারও ফোন নম্বর রাখোনি?’
জবাব দেওয়ার আগে একটু থামে কাহো। ফোন নম্বর বিনিময়? তারপর বলে, ‘না রাখিনি কেউ।’
তিন দিন পর মাচিদা আবার ফোন করে ওকে।
বলে, ‘হ্যান্ডসাম সাহারার ব্যাপারে ফোন করলাম তোমাকে। কথা বলা যাবে?’ সাহারা হচ্ছে ওর সঙ্গে প্রথম ডেটিং করা লোকটার নাম। নামের উচ্চারণটা সাহারা মরুভূমির মতো। হাতের ড্রয়িং পেনসিলটা নামিয়ে রেখে ফোনটা বাঁ হাত থেকে ডান হাতে নেয় কাহো। বলে, ‘নিশ্চয়ই, বলো।’
মাচিদা বলে, ‘কাল রাতে ফোন করেছিলে লোকটা। বলছে, তোমার সঙ্গে আরেকবার দেখা করতে চায়, তোমরা দুজন আরেকবার কথা বলতে পারো কি না। বেশ সিরিয়াস মনে হলো ওকে।’
একটা লম্বা শ্বাস ঠেকাতে পারে না কাহো, একমুহূর্ত চুপ করে থাকে। লোকটা আরেকবার দেখা করতে চায়, যাতে দুজন কথা বলতে পারে। কথাটা বিশ্বাস করতে পারে না যেন।
মাচিদার উদ্বিগ্ন গলা শোনা যায়, ‘কাহো সান, শুনছ তুমি?’
কাহো বলে, ‘হ্যাঁ, শুনছি।’
‘তোমাকে ও পছন্দ করেছে বলে মনে হয়। ওকে কী বলব?’
সাধারণ বুদ্ধিতে ‘না’ করে দেওয়াই উচিত। মুখের ওপর এমন জঘন্য কথা বলতে পারে যে লোক, তার সঙ্গে আবার দেখা করার কী দরকার? তবু সেই মুহূর্তে কোনো সিদ্ধান্তে আসতে পারে না ও। ওর মাথার মধ্যে কিছু সন্দেহ একসঙ্গে ঢুকে পড়ে জট পাকিয়ে যায়।
মাচিদাকে বলে, ‘একটু ভেবে নিই? তোমাকে ফোন করব আমি।’
সেই শনিবারে শেষ পর্যন্ত সাহারার সঙ্গে দেখা করে কাহো। দিনের বেলায় অল্প সময়ের জন্য এমন একটা জায়গা ঠিক করে ওরা, যেখানে নিরিবিলি কথা বলা যাবে, আশপাশে অন্য লোকজন থাকলেও থাকতে পারে, তবে কোনো খাওয়াদাওয়া বা পান নয়। এসব শর্ত মাচিদা জানিয়ে দিয়েছিল সাহারাকে। আর কাহোকে বলেছিল, ‘দ্বিতীয় সাক্ষাতের জন্য অদ্ভুত শর্ত। তুমি খুব বেশি সাবধানী হয়ে পড়েছ দেখছি।’
কাহো বলে, ‘আমারও তা-ই মনে হয়।’
‘হাতব্যাগে স্ক্রু ড্রাইভার বা অন্য কিছু লুকিয়ে নিচ্ছ না তুমি, ঠিক?’ বলে খুশিমনে হেসেছিল মাচিদা।
কাহো মনে মনে ভাবে, সে রকম হলে খারাপ হতো না।
আগেরবার যখন তাদের দেখা হয়, সাহারাকে দেখে মনে হচ্ছিল কাজ শেষে ঘরে ফিরছে, পরনে ছিল চমৎকার গাঢ় স্যুট আর টাই। তবে এবার ছুটির দিনের ক্যাজুয়াল পোশাক, একটা পুরু চামড়ার জ্যাকেট, সরু জিনসের ট্রাউজার আর দৈনন্দিন পরা হয় এমন বুট জুতা। সানগ্লাসটা বুকপকেটে রাখা। বেশ কেতাদুরস্ত চেহারা।
নির্দিষ্ট সময়ের কিছু পর এসে পৌঁছায় কাহো, ততক্ষণে হোটেল লবিতে এসে গেছে সাহারা, কাউকে ফোনে টেক্সট মেসেজ পাঠাচ্ছিল। কাহোকে দেখার পর একটা মৃদু হাসি দেখা যায় ওর ঠোঁটে, সেলফোনের চামড়ার কাভারটা বন্ধ করে ও। ওর পাশের চেয়ারে একটা মোটরসাইকেলের হেলমেট।
সাহারা বলে, ‘একটা ১৮০০ সিসি বিএমডব্লিউ চালাই আমি। এই ব্র্যান্ডের সব কটির মধ্যে এটার সিলিন্ডার সবচেয়ে বড়, ইঞ্জিনের শব্দও দুর্দান্ত।’
কিছু বলে না কাহো। নিজের মনে বিড়বিড় করে বলে, ‘তুমি কিসে চড়ো, তাতে আমার কি আসে যায়—বিএমডব্লিউ মোটরসাইকেল, তিন চাকার রিকশা, গরুর গাড়ি—যেটাই হোক।’
সাহারা বলে, ‘বাজি ধরে বলতে পারি, মোটরসাইকেল নিয়ে আপনার কোনো আগ্রহ নেই। তবে ভাবলাম, আপনাকে জানানো উচিত, কেবল আপনার অবগতির জন্য।’
কাহো ভাবে, ‘এই লোক জানে, কীভাবে মনের কথা বোঝা যায়।’
ওয়েট্রেস এলে নিজের জন্য একটা কফির ফরমাশ দেয় কাহো। সাহারা বলে ক্যামোমাইল চায়ের কথা।
সাহারা জিজ্ঞেস করে, ‘আচ্ছা, কখনো অস্ট্রেলিয়া গিয়েছেন আপনি?’
মাথা নাড়ায় কাহো। কখনো যায়নি।
এবার দুহাত বাতাসে পাখার মতো ঘুরিয়ে সাহারা জিজ্ঞেস করে, ‘মাকড়সা পছন্দ করেন? আট পা-ওয়ালাগুলো?’
জবাব দেয় না কাহো। মাকড়সাকে সবচেয়ে বেশি ঘেন্না করে ও, তবে জানতে দিতে চায় না সেটা।
সাহারা বলে, ‘অস্ট্রেলিয়া গিয়ে একটা মাকড়সা দেখেছিলাম বেসবল গ্লাভসের সাইজের। দেখেই ঘেন্নায় শিউরে উঠেছিলাম আমি। গায়ে কাঁপুনি এসে গিয়েছিল। কিন্তু স্থানীয় ব্যক্তিরা এগুলোকে ঘরে আমন্ত্রণ জানায়। কেন, জানেন?’
চুপ করে থাকে কাহো।
‘কারণ, এগুলো নিশাচর, তেলাপোকা খেয়ে ফেলে। উপকারী পতঙ্গ বলতে পারেন। তবু ভাবুন, তেলাপোকা খাওয়ার জন্য মাকড়সা রাখা। আমি অবাক হয়ে ভাবি, এই ফুড চেইনটা কত দক্ষ আর নিখুঁত।’
কফি আর ভেষজ চা আসে, কিছুক্ষণ কোনো কথা না বলে সামনে কাপ নিয়ে চুপচাপ বসে থাকে দুজন।
কয়েক মিনিট পর সাহারা বলে, ‘মনে হয় ব্যাপারটা একটু অদ্ভুত মনে হচ্ছে আপনার। মানে, এই যে আপনার সঙ্গে আবার দেখা করতে চাইলাম।’ ওর গলার স্বর কিছুটা আনুষ্ঠানিক।
এবারও কাহো কোনো জবাব দেয় না। আসলে সাহস পাচ্ছিল না।
সাহারা বলে, ‘বলতেই হবে যে সত্যিই অবাক হয়েছি আমার সঙ্গে আবার দেখা করতে রাজি হয়েছেন বলে। আমি কৃতজ্ঞ, তবে অবাক হয়েছিলাম আপনাকে সেই কড়া কথাটা বলার পরও আপনি রাজি হয়েছেন দেখে। না, আমি যা বলেছিলাম, সেটা কড়া কথার চেয়ে বেশি কিছু। ব্যাপারটা ক্ষমার অযোগ্য অপমান, যেকোনো মহিলার মর্যাদাকে পায়ে মাড়িয়ে দেওয়া। এ রকম কথা যেসব মহিলাকে বলেছি, তাদের বেশির ভাগই দ্বিতীয়বার দেখা করতে রাজি হয়নি। এটাই তো স্বাভাবিক।’
‘তাদের বেশির ভাগই’, মনে মনে কথাটার পুনরাবৃত্তি করে কাহো। একটা ধাক্কা খায় ও।
এই প্রথম কথা বলে ও, ‘তাদের বেশির ভাগই? আপনি বলতে চাইছেন, যেসব মহিলার সঙ্গে দেখা হয়েছে, তাদের সবাইকে একই কথা বলেছেন? আপনি বলছেন...।’
সঙ্গে সঙ্গে স্বীকার করে সাহারা, ‘ঠিক তা-ই। যাদের সঙ্গে দেখা হয়েছে, সব মহিলাকে ঠিক সেটাই বলেছি, যা বলেছিলাম আপনাকে, “আপনার মতো কুৎসিত চেহারার কাউকে দেখিনি কখনো।” ডিনার উপভোগ করছি, যখন ডেজার্ট দেওয়া হয়েছে টেবিলে, ঠিক এমন সময়। এ-জাতীয় বিষয়ে সময়টাই সব।’
শুকনো গলায় কাহো জিজ্ঞেস করে, ‘কিন্তু কেন? এমন একটা কাজ কেন করতে হবে আপনাকে? বুঝতে পারছি না আমি। কোনো কারণ ছাড়াই মানুষকে আহত করেন আপনি? কেবল ওদের অপমান করার জন্য নিজের সময় ও টাকা খরচ করেন?’
মাথাটা সামান্য ঝোঁকায় সাহারা, তারপর বলে, ‘কেন, সেটাই আসল প্রশ্ন। ব্যাপারটা ব্যাখ্যা করা খুব জটিল। তার চেয়ে আমরা বরং এ রকম একটা মন্তব্যের ফলাফল নিয়ে কথা বলি না কেন? আমাকে যেটা সবচেয়ে বেশি অবাক করে, যে মহিলাকে কথাটা বলি, তার প্রতিক্রিয়া। আপনি ভাবতে পারেন, ঠিক মুখের ওপর এ রকম জঘন্য কথা বললে বেশির ভাগই আচমকা ক্ষেপে উঠবে, কিংবা হেসে উড়িয়ে দেবে। এ রকমও রয়েছে কিন্তু। তবে সত্যিই খুব বেশি নয়। বেশির ভাগ মহিলাই...খুবই আহত হয়। খুব গভীরভাবে, দীর্ঘ সময়ের জন্য। কোনো কোনো ক্ষেত্রে বোকার মতো অদ্ভুত কিছু বলে ফেলে। সহজে বোঝা যায় না, এমন কিছু।’
কিছুক্ষণের জন্য চেপে বসে নীরবতা। তারপর কাহোই সেটা ভাঙে। ‘আপনি বলছেন সেসব প্রতিক্রিয়া উপভোগ করেন আপনি?’
‘না, উপভোগ করি না। তবে আমার কাছে অদ্ভুত মনে হয়। সত্যিই সুন্দরী, কিংবা কমপক্ষে গড়পড়তার চেয়ে অনেক ওপরে, এমন কোনো মহিলাকে যদি তাদের মুখের ওপর বলা হয় যে সে কুশ্রী, কেমন অবাক করার মতো উত্তেজিত হয়ে ওঠে কিংবা কীভাবে যে আহত হয়।’
কাহোর সামনে ধোঁয়া ওঠা কফি ধীরে ধীরে ঠান্ডা হয়ে আসছিল, কাপটা স্পর্শও করেনি সে। এবারে কঠিন গলায় বলে, ‘আমার মনে হয়, আপনি অসুস্থ।’
মাথা ঝোঁকায় সাহারা। ‘আমারও তা-ই মনে হয়। সম্ভবত ঠিক বলেছেন আপনি। আমি অসুস্থ হতে পারি। আমার নিজের পক্ষে কোনো অজুহাত বা অন্য কিছু নয়, তবে একজন অসুস্থ মানুষের চোখে যে পৃথিবী দেখা যায়, সেটা আরও অসুস্থ। ঠিক না? শোনেন, আজকাল মানুষ চেহারা দেখানো তত্ত্বকে ভয়ানক অপছন্দ করে। সৌন্দর্য প্রতিযোগিতার প্রকাশ্য নিন্দা করে বেশির ভাগ মানুষ। জনসমক্ষে ‘কুশ্রী মহিলা’ কথাটা বলে দেখুন, মার খাবেন আপনি। কিন্তু টেলিভিশন আর ম্যাগাজিনগুলো দেখুন। কসমেটিকস, প্লাস্টিক সার্জারি আর স্পা ট্রিটমেন্টের বিজ্ঞাপনে ভর্তি। ব্যাপারটা আপনি কীভাবে দেখেন, তাতে কিছু আসে যায় না, কিন্তু এসব হচ্ছে হাস্যকর অর্থহীন দ্বিমুখী নীতি। একটা সত্যিকার তামাশা।’
কাহো বলে, ‘কিন্তু সেটা তো অন্য কাউকে আঘাত দেওয়ার বৈধতা দেয় না, দেয় কি?’
সাহারা বলে, ‘ঠিক বলেছেন আপনি। আমি অসুস্থ। এই সত্য অস্বীকার মতো নয়। তবে সেটা নির্ভর করে কীভাবে ব্যাপারটা দেখছেন আপনি। অসুস্থ হওয়াটাও উপভোগ্য হতে পারে। অসুস্থ মানুষের নিজস্ব বিশেষ একটা জায়গা আছে, যা কেবল অসুস্থ লোকেরাই উপভোগ করে। মানসিকভাবে অস্থির মানুষের জন্য একটা ডিজনিল্যান্ডের মতো। এবং সৌভাগ্যবশত, সেই জায়গা উপভোগ করার মতো সময় আর টাকা আছে আমার।’
একটি কথাও না বলে উঠে দাঁড়ায় কাহো। এটার শেষ টানা উচিত। এই লোকের সঙ্গে আর কথা বলা যায় না।
ও দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতেই সাহারা বলে, ‘এক সেকেন্ড। আমাকে আরেকটু সময় দিতে পারেন? খুব বেশি সময় নেব না। পাঁচ মিনিটই যথেষ্ট। আমি চাই, আপনি একটু থেকে আমার কথাটা শুনে যান।’
কয়েক সেকেন্ড ইতস্তত করে কাহো, তারপর বসে পড়ে আবার। বসতে চায়নি সে, তবে লোকটার কণ্ঠস্বরে এমন কিছু ছিল যে ঠেকাতে পারে না।
সাহারা বলে, ‘আমি যেটা বলতে চেয়েছিলাম, সেটা হচ্ছে আপনার যে প্রতিক্রিয়া ছিল, সেটা আর সবার চেয়ে আলাদা। আমার জঘন্য কথাগুলো যখন আপনাকে আক্রমণ করে, আতঙ্কিত হননি আপনি, রেগে গিয়ে কোনো রকম প্রতিক্রিয়া দেখাননি, হেসে উড়িয়ে দেননি, তেমন আহত হয়েছেন বলেও মনে হয়নি। এসব বস্তাপচা আবেগে ভেসে না গিয়ে কেবল তাকিয়ে ছিলেন আমার দিকে। যেন মাইক্রোস্কোপের নিচে কোনো ব্যাকটেরিয়া পরীক্ষা করে দেখছেন। আপনিই একমাত্র এবং প্রথম যে এভাবে প্রতিক্রিয়া দেখালেন। মুগ্ধ হয়েছিলাম আমি। আর ভাবছিলাম, এই মহিলা আহত বোধ করছে না কেন? এমন কিছু কি আছে, যা গভীরভাবে আঘাত করবে ওকে, থাকলে কি সেটা?’
কাহো বলে, ‘তার মানে, এসব আপনি করছেন, এ-জাতীয় লম্বা সাক্ষাতের আয়োজন করছেন বারবার, সবই কেবল মহিলাদের প্রতিক্রিয়া দেখার জন্য? কেবল এটুকুই?’
মাথা ঝোঁকায় লোকটা। ‘না না, অত বেশি নয়। কেবল যখন নিজ থেকেই সুযোগটা এসে যায়। আমি কখনোই ডেটিং অ্যাপ বা অন্য কিছু ব্যবহার করি না। ওসব খুব সোজা-সরল আর বোরিং। যাদের চিনি, তাদের কাছে নিজের পরিচিতি দিই, আর সেসব মহিলার সঙ্গেই দেখা করি, যাদের ব্যাকগ্রাউন্ড জানা আছে আমার। আদ্যিকালের ঘটকালির মতো আয়োজন করা দেখা হওয়াটাই সবচেয়ে ভালো। মানে, প্রাচীন মতবাদের ধারা। আমার কাছে এটাকেই উত্তেজনাপূর্ণ মনে হয়।’
কাহো বলে, ‘আর তখন আপনি মহিলাটিকে অপমান করেন?’
সাহারা জবাব দেয় না। কেবল একটা হাসি দেয় ও, তবে দ্রুত মিলিয়ে যায় সেটা। বুকের সামনে হাত দুটি তুলে ধরে ও, কিছুক্ষণ তাকিয়ে পরীক্ষা করে, যেন দেখছে হাতের রেখায় কোনো পরিবর্তন এল কি না।
তারপর হাতের ওপর থেকে চোখ তুলে বলে, ‘ভাবছিলাম, আমার সঙ্গে মোটরসাইকেলে একটা রাইডে যাবেন কি না। আপনার জন্য একটা বাড়তি হেলমেটও নিয়ে এসেছি। আজকের আবহাওয়াটাও ভালো, এলোমেলো ঘুরে বেড়াতে পারি দুজন। বাইকের মিটারে দেখছি, পাঁচ হাজার কিলোমিটার পার করে ফেলেছি। বিএমডব্লিউর ইঞ্জিন যে কারণে বুক ফুলিয়ে চলতে পারে, সেটা হচ্ছে তার নিখুঁত কাজ।’
একটা অদম্য ক্রোধ টগবগিয়ে ওঠে কাহোর ভেতর। বহুদিন এমন রাগ হয়নি ওর। কিংবা এবারই প্রথম এমন হলো ওর। ‘এলোমেলো ঘুরে বেড়াতে পারি দুজন? এসব কি ভাবছে এই লোক?’
নিজের মনোভাব চেপে রেখে কাহো বলে, ‘না, ধন্যবাদ।’ যত দূর সম্ভব, নিজের গলার স্বর শান্ত রাখে ও। ‘আপনি জানেন এই মুহূর্তে আমার এক নম্বর কাজ কী?’
মাথা নাড়ায় সাহারা, ‘কী হতে পারে সেটা?’
‘আপনার আর আমার মধ্যে কিছুটা দূরত্ব রাখা, অল্প দূরত্ব হলও চলবে। তারপর আমার ওপর যে নোংরা এসে পড়েছে, সেটাকে ঘষে ঘষে তুলে ফেলা।’
সাহারা বলে, ‘আচ্ছা। বটে। বেশ। আমার মনে হয়, দুর্ভাগ্যজনকভাবে এবার আপনার সঙ্গে ঘুরে বেড়ানোটা বাদ দিতে হবে। কিন্তু আপনি কি ভাবছেন? আমার থেকে সামান্য দূরত্ব পেলে তাতে কি কাজ হবে?’
‘তার মানে কী?’
কোথাও একটা বাচ্চা কেঁদে ওঠে। লোকটা একবার সেদিকে তাকিয়ে দেখে, পরমুহূর্তে সরাসরি কাহোর দিকে তাকায়।
তারপর বলে, ‘আমার মনে হয় আপনি বুঝতে পারবেন, শিগগিরই। যদি একবার কারও ব্যাপারে আগ্রহী হই আমি, তাদের অত সহজে চলে যেতে দিই না। আপনার কাছে ব্যাপারটা অবাক করা মনে হতে পারে, কিন্তু দূরত্বের হিসেবে আপনি আর আমি খুব বিচ্ছিন্ন নই। দেখুন, মানুষ শিকলের ছাঁচটা থেকে পালাতে পারে না। তারা ওটা দেখতে চায় বা না চায়, তাতে কিছু আসে যায় না, এমনকি এ ব্যাপারে তাদের কিছু করার না থাকলেও। কোনো কিছু গিলে ফেলা আর নিজেই অন্যের গেলার শিকার হওয়া একই মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠ। সামনে আর পেছনে, জমা আর খরচ। দুনিয়াটাই এ রকম। আমার মনে হয়, সম্ভবত আবার কোথাও দেখা হবে আমাদের।’
মাচিদা বলে, ‘সত্যি বলতে, ওর সম্পর্কে বেশি কিছু জানি না আমি। বন্ধুর বন্ধু বলতে পারো। মনে হয় বয়স চল্লিশের মতো, এখনো বিয়ে করেনি, কোনো এক ইনভেস্টমেন্ট কোম্পানিতে কাজ করে। ভালো ঘরের ছেলে, কাজকর্মে ভালো। যত দূর জানি, কোনো খারাপ রেকর্ড নেই। একবারই দেখা হয়েছিল ওর সঙ্গে, কয়েক মিনিট কথা হয়েছিল, মনে হয়েছে লোকটা দেখতে ভালো এবং যথেষ্ট হাসিখুশি। স্বীকার করছি একটু খাটো সে, তবে টম ক্রুজও তো তেমন লম্বা নয়। এমন নয় যে টম ক্রুজকে নিজ চোখে দেখেছি আমি।’
কাহো ভাবে, ‘লোকটার সঙ্গে দেখা করাই উচিত হয়নি আমার।’ লম্বা পায়ে দরজার দিকে এগিয়ে যেতে যেতে নিশ্চিত বুঝতে পারে ও। মাচিদা সেদিন যখন ফোন করে, পরিষ্কার করে বলা উচিত ছিল, “না, ধন্যবাদ। লোকটার সঙ্গে আর কখনোই দেখা করতে চাই না আমি।”
‘কৌতূহল। কৌতূহলই আমাকে টেনে এনেছে এখানে। আমি বোধ হয় দেখতে চেয়েছিলাম, কী এমন উদ্দেশ্য লোকটার, আসলে কি চাইছিল সে। মনে হয় এটাই জানতে চেয়েছিলাম আমি। কিন্তু ভুল ছিল কাজটা। কৌতূহলটাকে টোপের মতো ব্যবহার করে কৌশলে আমাকে লোভ দেখাতে চেয়েছিল সে, মাকড়সা যে রকম করে। একটা শীতল স্রোত বয়ে যায় ওর মেরুদণ্ড বেয়ে। সে ভাবে, আরামের কোনো জায়গায় যেতে চাই আমি। দক্ষিণে সাদা বালুর কোনো দ্বীপ। সব চিন্তা থেকে মনের দরজা বন্ধ করে দিয়ে চোখ বন্ধ করে শুয়ে থাকব সেখানে, সূর্যের আলো বয়ে যাক আমার ওপর দিয়ে।’
কয়েক সপ্তাহ কেটে যায়। মন থেকে যত দ্রুত সম্ভব সাহারা নামের লোকটা সম্পর্কে সব চিন্তা দূর করতে চায় কাহো। ওর জীবনের সঙ্গে কোনো সম্পর্কহীন অর্থহীন এই পর্ব ঠেলে সরিয়ে দিতে চায়, এমন কিছু আর কখনো কোথাও দেখতে চায় না ও। তারপরও রাতে টেবিলে বসে কাজ করার সময় না চাইলেও লোকটার চেহারা আচমকা জেগে ওঠে মনের মধ্যে। ম্লান হেসে কোনো কারণ ছাড়া নিজের সুন্দর আঙুলগুলোর দিকে তাকিয়ে থাকে লোকটা।
আগে কখনো যা করেনি, তার চেয়ে আরও বেশি সময় আয়নার সামনে কাটাতে শুরু করে কাহো। বাথরুমের আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে মুখের প্রতিটি খুঁটিনাটি দেখে সে, যেন আবার নিশ্চিত হতে চাইছে, সে আসলে কে। আর তখন মনে হয়, কোনোটার জন্যই আগ্রহ নেই ওর। এটা নিশ্চিত তারই মুখ, কিন্তু তারপরও এমন কিছু পায় না, যা দিয়ে বোঝা যায় এটা তারই মুখ। এমনকি ওর যে বান্ধবীরা প্লাস্টিক সার্জারি করিয়েছে, তাদের ঈর্ষা করতে শুরু করে সে। ওরা জানে, কিংবা অন্ততপক্ষে ওরা বিশ্বাস করে যে ওরা জানে, সার্জারিতে পাল্টে ফেলা ওদের মুখের কোন অংশটা আরও সুন্দর করে তুলবে ওদের কিংবা নিজেদের চেহারা নিয়ে সন্তুষ্ট করবে।
‘জীবনটা হয়তো একটা নিপুণ প্রতিশোধ নিচ্ছে আমার ওপর’, এই ভাবনা মন থেকে তাড়াতে পারে না ও। ‘আসল সময় যখন আসবে, আমার যা ঋণ, হয়তো সেটাই নেবে জীবন। জমা আর খরচ।’ বুঝতে পারে কাহো, সাহারা নামের সেই লোকের সঙ্গে যদি কখনো দেখা না হতো, কখনোই এ রকম করে ভাবত না সে। ওর মনে হয়, ‘লোকটা হয়তো ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করছে দীর্ঘ সময় ধরে, আমি যাতে ওর সামনে গিয়ে দাঁড়াই। যেমন বিশাল একটা মাকড়সা অন্ধকারে অপেক্ষা করে শিকারের জন্য।’
গভীর রাতে যখন সবাই ঘুমে, মাঝেমধ্যে বড় কোনো মোটরসাইকেল ওর অ্যাপার্টমেন্টের সামনের রাস্তা দিয়ে দ্রুত চলে যায়। যখনই ড্রাম পেটানোর মতো ইঞ্জিনের সেই নিচু ধক ধক শুনতে পায় সে, ওর শরীরেও খুব হালকা কাঁপুনি ধরে। উল্টোপাল্টা হয়ে যায় ওর নিশ্বাস, ঠান্ডা ঘাম বেরিয়ে আসে বগলের নিচে।
লোকটা বলেছিল, ‘আপনার জন্য একটা বাড়তি হেলমেটও নিয়ে এসেছি।’
নিজেকে সেই বিএমডব্লিউ মোটরসাইকেলের পেছনে দেখতে পায় ও। কল্পনা করে শক্তিশালী সেই ইঞ্জিন কোথায় নিয়ে যাবে ওকে। কী রকম জায়গায় আমাকে নিয়ে যাবে ওটা?
লোকটা বলেছিল, ‘দূরত্বের হিসাবে আপনি আর আমি খুব বিচ্ছিন্ন নই।’
সেই অদ্ভুত প্রথম দেখার ছয় মাস পর ছোটদের জন্য নতুন একটা বই লেখে কাহো। এক রাতে স্বপ্ন দেখে, একটা গভীর সাগরের তলায় পড়ে আছে সে। ঘুম ভাঙার পর ওর মনে হয়, যেন হঠাৎ করে সমুদ্রের তলা থেকে কেউ ওকে ছুড়ে দিয়েছে ওপরের দিকে। সোজা নিজের টেবিলে চলে যায় ও, তারপর লিখে ফেলে গল্পটা। শেষ করতে খুব বেশি সময় লাগে না।
নিজের মুখের খোঁজ করছে, এমন এক মেয়ের গল্প ওটা। কোনো এক সময় নিজের মুখটা হারিয়ে ফেলেছিল সে, ও যখন ঘুমে ছিল, তখন কেউ চুরি করে নিয়ে গিয়েছিল। তাই সেটা ফিরে পাওয়ার জন্য চেষ্টা করতে হয় তাকে।
তবে মনে নেই চেহারাটা কেমন ছিল ওর। এটাও মনে নেই, সুন্দর কি বিশ্রি ছিল, গোলগাল নাকি লম্বাপনা। মা-বাবা, ভাই-বোন—সবাইকে জিজ্ঞেস করে ও, তবে কোনো কারণে কেউ মনে করতে পারে না কেমন চেহারা ছিল ওর। নাকি বলতে চাইছিল না ওরা।
তাই চেহারার খোঁজ করতে একাই বেরিয়ে পড়বে বলে ঠিক করে মেয়েটি। আপাতত ওর মুখে এঁটে যায়, এমন একটা চেহারা খুঁজে নেয় সে, যেখানে নিজের মুখ থাকার কথা, সেখানে লাগিয়ে নেয় ওটা। কোনো মুখ ছাড়া চলার পথে লোকজনের সঙ্গে দেখা হলে ওদের কাছে অদ্ভুত ঠেকবে ব্যাপারটা।
সারা পৃথিবী ঘুরে বেড়ায় মেয়েটি। উঁচু পাহাড়ে চড়ে, পার হয় গভীর নদী, বিস্তীর্ণ মরুভূমি পেরিয়ে যায়, পথ কেটে চলে বিপৎসংকুল অরণ্যের ভেতর দিয়ে। নিজের চেহারা দেখলেই চিনতে পারবে, এ ব্যাপারে নিশ্চিত ছিল ও। ‘যেহেতু আমার অস্তিত্বের খুব গুরুত্বপূর্ণ অংশ ওটা’, আপন মনে বলে ও। অভিযাত্রায় বহু মানুষের সঙ্গে দেখা হয় ওর, সব ধরনের বিদঘুটে অভিজ্ঞতা ঘটে। একপাল হাতির পায়ের নিচে পড়তে পড়তে বেঁচে যায়, একবার আক্রমণ করে বসেছিল বিশাল কালো এক মাকড়সা, প্রায় খেয়ে ফেলেছিল বুনো ঘোড়ার লাথি।
সব জায়গায় ঘুরে ঘুরে অগুনতি মুখ পরীক্ষা করতে পেরিয়ে যায় দীর্ঘ সময়, নিজের মুখটা খুঁজে পায় না ও। যতগুলো দেখেছে, সবই অন্যের মুখ। বুঝতে পারে না কী করবে ও। টের পায় না যে আর বালিকাটি নেই ও, পূর্ণবয়স্ক মহিলা হয়ে গেছে। নিজের মুখটা কি আর খুঁজে পাবে না সে? হতাশায় ভেঙে পড়ে ও।
উত্তরের এক অন্তরীপের মাথায় বসে চরম হতাশায় যখন কাঁদছিল সে, ফারের কোট পরা দীর্ঘদেহী এক যুবক এসে বসে ওর পাশে। যুবকটির লম্বা চুলে ঢেউ খেলে যাচ্ছিল সমুদ্রের বাতাস। ওর মুখের দিকে তাকায় লোকটা, তারপর চওড়া হাসি হেসে বলে, ‘আপনার মতো সুন্দর চেহারার কোনো মহিলা আগে কখনো দেখিনি আমি।’
তত দিনে যে মুখটা লাগিয়ে নিয়েছিল, সেটা আসল মুখ হয়ে গেছে ওর। সব ধরনের অভিজ্ঞতা, সব রকম আবেগ ও চিন্তা একত্র হয়ে মুখটা তৈরি করেছে ওর। এটা ওর চেহারা, ওর একার মুখ। একসময় যুবকটির সঙ্গে বিয়ে হয় ওর, তারপর উত্তর দ্বীপে সুখী জীবন কাটাতে থাকে দুজনে।
কোনো বিশেষ কারণে বইটা ছেলেমেয়েদের মনে কিছু একটা ঝলক ছড়ায় বলে মনে হয়, বিশেষ করে টিনএজার মেয়েদের ক্ষেত্রে, কাহো নিজেও জানে না কেন। এই বয়সী পাঠক-পাঠিকারা নিজের চেহারার খোঁজে বিস্তীর্ণ বিশ্বে বালিকাটির অভিযান এবং সংগ্রামের ঘটনাগুলো অনুসরণ করে প্রবল উত্তেজনায়। শেষ পর্যন্ত যখন মেয়েটি ওর চেহারা খুঁজে পায় এবং আবিষ্কার করতে পারে মনের শান্তি, পাঠককুল একটা স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে। কাহোর একরঙের রেখাচিত্রে আঁকা প্রতীকী ইলাস্ট্রেশনসহ বইটা সহজ।
গল্পটি লেখা ও তার ইলাস্ট্রেশনের কাজ একধরনের মানসিক সুস্থতা এনে দেয় কাহোর ভেতর। ও বুঝতে পারে, ‘এই পৃথিবীতে আমি যে রকম, সেভাবেই বেঁচে থাকতে পারি। ভয় পাওয়ার কিছু নেই।’ সমুদ্রের নিচে পড়ে থাকার সেই স্বপ্ন এটাই শিখিয়েছে ওকে। মাঝরাতে যে উদ্বেগ ভর করত ওর ওপর, সেটা কমে আসে। যদিও সেটা যে একেবারেই চলে গেছে, সে কথা বলতে পারে না ও।
মুখে মুখে সুখ্যাতি ছড়িয়ে পড়ার কারণে ভালোই কাটছিল বইটা, কাগজে আসছিল ভালো আলোচনা। দারুণ রোমাঞ্চিত মাচিদা।
ও বলে, ‘আমার মনে হয়, ছোটদের এই বই বহুদিন ধরে বেস্ট সেলার থাকবে। সে রকমই মনে হচ্ছে আমার। তোমার অন্য সব কটির চেয়ে সম্পূর্ণ আলাদা এই বইটা, এটাই অবাক করেছে আমাকে। কিন্তু ভাবছি, আইডিয়াটা কোথায় পেলে তুমি?’
একমুহূর্ত ভেবে নিয়ে কাহো জবাব দেয়। বলে, ‘একটা ভীষণ অন্ধকার গভীর জায়গায়।’
অনুবাদ: ফারুক মঈনউদ্দীন