ধারাবাহিক উপন্যাস, স্লোনেস: মিলান কুন্ডেরা, অনুবাদ: আনিসুল হক

ধীরে চলা

(তৃতীয় কিস্তি)

‘ডেঞ্জারাস লিয়াজোঁ’ বইটি চিঠির আকারে লেখা, কিন্তু এর গঠনশৈলী কেবল একটা কারিগরি প্রক্রিয়া মাত্র নয় যে তা আরেকটা আঙ্গিক দিয়ে প্রতিস্থাপন করা যাবে। এই ফরমটা নিজে খুবই স্বচ্ছ। এটা আমাদের বলে যে চরিত্রগুলোর ওপর দিয়ে যা ঘটে গেছে, তা ঘটে গেছে তারা এ সম্পর্কে মুখ খুলেছিল বলে; তারা জানিয়েছিল, রটিয়েছিল, বলেছিল, স্বীকার করেছিল। এই ধরনের একটা পৃথিবীতে, যেখানে সবকিছু বলে ফেলা হয়, সেখানে একটামাত্র অস্ত্র আছে, সদাপ্রস্তুত, সবচেয়ে প্রাণঘাতী, তাহলো প্রকাশ করে দেওয়া। উপন্যাসের নায়ক ভালমতঁ এক নারীকে পটিয়েছিল। সে একটা শেষ চিঠি লেখে নারীটিকে। সেই চিঠি মেয়েটির জীবন ধ্বংস করে দেয়। লোকটা আবার চিঠিটা লিখেছিল তার মেয়েবন্ধুর কথামতো। এই মেয়েবন্ধুর নাম মার্কিস দে মেরতি। তার কথামতো ভালমতঁ চিঠির প্রতিটা শব্দ শ্রুতিলিখন করে। পরে এই মেয়েবন্ধুটি ভালমতেঁর একটা চিঠি তার প্রতিদ্বন্দ্বীর কাছে প্রকাশ করে দেয়। এই লোক তখন ভালমর্তকে মল্লযুদ্ধে আহ্বান করে। তাতে ভালমতঁ মারা যায়। এই মৃত্যুর পর ভালমতঁ আর মেরতির গোপন অন্তরঙ্গ চিঠিপত্রও প্রকাশিত হয়ে পড়ে। মার্কিস তখন মেরতির দিনরাতকে ছারখার, ধ্বস্ত, বিষাক্ত করে দেয়।

এই উপন্যাসে কোনো একটা জুটির কোনো গোপনীয়তাই গোপন থাকে না। একটা শঙ্খের মধ্যে যেমন সমুদ্রের শব্দ শোনা যায়, এই উপন্যাসে তেমনি করে প্রতিটা মানুষ একটা করে শঙ্খের মধ্যে বাস করে, যেখানে প্রতিটা ফিসফিস করে বলা কথাও প্রতিধ্বনিত হতে থাকে। বহুগুণিত শেষহীন সেই প্রতিধ্বনি। আমি যখন ছোট ছিলাম, তখন লোকে আমাকে বলতে, শঙ্খ কানে দাও, সমুদ্রের শোঁ শোঁ আওয়াজ তুমি শুনতে পাবে। তেমনিভাবে এই চিঠির আকারে লেখা উপন্যাসে প্রতিটা শব্দ চিরকালের জন্য বারবার করে শোনা যায়। এই কি তাহলে ১৮০০ শতকের রূপ? এই কি তাহলে সেই বিখ্যাত সুখের স্বর্গ? নাকি মানুষ চিরটাকাল বসবাস করে এসেছে প্রতিধ্বনিময় শঙ্খের ভেতরে, কিন্তু বুঝতে পারেনি ব্যাপারটা। যা–ই হোক না কেন, প্রতিধ্বনিময় শঙ্খ এপিকিউরাসের জগৎ নয়—এপিকিউরাস তাঁর শিষ্যদের আদেশ করেছিলেন, ‘তোমরা অবশ্যই গোপনভাবে বসবাস করবে।’

[মিলান কুন্ডেরার ‘স্লোনেস’ উপন্যাস আমরা অনুবাদ করছি। তিনটা চ্যাপ্টার বা অনুচ্ছেদ আমরা সম্পন্ন করেছি। আপনাদের মনে করিয়ে দিতে চাই যে আমরা কেবল পড়ব না, এই উপন্যাসের গঠনশৈলীর দিকে লক্ষ রাখব। এই বইটা শুরু হয়েছিল একজন লোকের প্যারিস থেকে গ্রামের দিকে কোনো প্রাসাদ-হোটেল থাকার উদ্দেশে সস্ত্রীক মোটরযাত্রা দিয়ে। লোকটার নাম আমরা জানি না, তার বউয়ের নাম ভেরা।

কিন্তু আমরা সেই নায়ককে ভুলে গেছি। আমরা এরই মধ্যে দর্শন নিয়ে আলোচনা করেছি। সাহিত্য নিয়ে আলোচনা করেছি। আঠারো শতকের উপন্যাস নিয়ে আলোচনা করেছি। গোপনীয়তা না থাকার যন্ত্রণা নিয়ে আলোচনা হয়েছে। সুখবাদ বা ভোগবাদ, প্রমোদপরায়ণতা নিয়ে আলোচনা হয়ে গেছে। এবার আমরা ৪ নম্বর অনুচ্ছেদে ঢুকব। এবার আমরা আমাদের প্রথম নায়ক এবং তার স্ত্রীকে পাব। তাঁরা হোটেলে ঢুকছেন।)


হোটেলের রিসেপশন ডেস্কের লোকটা বেশ ভালো। সাধারণ হোটেলের রিসেপশনে যে ধরনের লোক থাকে, তাদের চেয়ে অনেক ভালো। রিসেপশনিস্ট আমাদের মনে করিয়ে দেন যে দুই বছর আগেও আমরা এই হোটেলে এসেছিলাম। দুই বছরে বহু কিছু বদলে গেছে। তাঁরা একটা কনফারেন্স রুম বানিয়েছেন, নানা ধরনের সভা করার জন্য, একটা চমৎকার সুইমিংপুল বানানো হয়েছে। আমাদের কৌতূহল হয়, পুলটা দেখা দরকার, আমরা উজ্জ্বল একটা লবি পার হই, লবিটার জানালাগুলো পার্কের দিকে খোলা। লবির শেষ প্রান্তে একটা চওড়া সিঁড়ি নেমে গেছে নিচে, সেখানেই টাইলে শোভিত একটা বড় সুইমিংপুল, তার ছাদটা কাচের। ভেরা মনে করিয়ে দেয়, শেষবার যখন এসেছিলাম, এখানে একটা গোলাপবাগান ছিল।

আমরা আমাদের রুমে থিতু হই। তারপর পার্কে যাই। সবুজ আঙিনা নেমে গেছে সেন নদীর দিকে। খুব সুন্দর! আমরা উচ্ছ্বসিত। আমরা অনেকটা পথ হাঁটব বলে সিদ্ধান্ত নিই। কয়েক মিনিট যেতে না যেতেই একটা হাইওয়ে এসে পড়ে, সাঁই সাঁই করে গাড়ি ছুটে যাচ্ছে, আমরা ফিরে আসি।

রাতের খাবার ছিল দারুণ। প্রত্যেকে সুসজ্জিত, যেন এই ছাদের নিচে হারিয়ে যাওয়া পুরোনো দিনের কথা শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করছে। আমাদের পাশে একটা জুটি, তাঁদের একটা দুজন সন্তানসহ বসেছেন। বাচ্চাদের একজন জোরে গান গাইছে। একজন ওয়েটার ট্রে হাতে তাদের টেবিলে নত হয়ে আছেন। মা তাকিয়ে আছেন তাঁর ছেলের দিকেই, তিনি চাইছেন ওয়েটার তাঁর ছেলের প্রশংসা করুক, ছেলেটিও সবাই তার দিকে তাকিয়ে আছে দেখে আরও উৎসাহিত হয়ে গাইছে। এবার সে উঠে দাঁড়াল চেয়ারের ওপরে, আর গানের গলা চড়িয়ে দিল। বাবাটার মুখে হাসি ছড়িয়ে পড়ল।

চমৎকার শহর বর্ডা, হাঁস, মিষ্টান্ন (এই হোটেলের গোপন রেসিপির)—ভেরা আর আমি গল্প করি, তৃপ্ত, ভাবনাহীন। রুমে ফিরে আসি। টেলিভিশন অন করি। টেলিভিশনের পর্দায় আরও শিশু। এবার কালো শিশু। তারা মারা যাচ্ছে। আমরা যখন এই হোটেলে ছিলাম, তখন সপ্তাহের প্রতিটা দিন একটা আফ্রিকান দেশের শিশু দেখানো হতো, যেটা গৃহযুদ্ধ আর দুর্ভিক্ষে পীড়িত। যে দেশের নাম সবাই এরই মধ্যে ভুলে গেছে। (এসবই ঘটেছিল দুই বা তিন বছর আগে, কেমন করে এসব নাম মনে রাখা একজনের পক্ষে সম্ভব।) শিশুগুলো হাড্ডিসার, ক্লান্ত, তাদের মুখের ওপর থেকে হাত নেড়ে মাছি তাড়ানোর শক্তিও তাদের নেই।

ভেরা আমাকে বলে, ‘ওই দেশে কি কোনো বুড়ো মানুষ মারা যায় না?’
না না। দুর্ভিক্ষের কৌতূহলোদ্দীপক ব্যাপার হলো, পৃথিবীতে ঘটে যাওয়া লক্ষ লক্ষ দুর্ভিক্ষের একটা অভিন্ন সাদৃশ্য হলো, দুর্ভিক্ষে শিশুরা মারা যায়। আমরা কখনো টেলিভিশনের পর্দায় কোনো দুর্দশাগ্রস্ত সাবালককে দেখব না, এমনকি যদি আমরা রোজ টেলিভিশনের খবর দেখি, তবুও না, তার দ্বারা প্রমাণিত হচ্ছে এই দৃষ্টান্তরহিত কথাটাই... (চলবে)