আসছে নতুন ধরনের পুনরাবিষ্কৃত সাম্যবাদ!

সবাই শান্ত থাকুন এবং আতঙ্কিত হোন!

[স্লাভয় জিজেক এ সময়ের সবচেয়ে আলোচিত দার্শনিক। স্লোভেনিয়ায় জন্ম নেওয়া অসংখ্য গ্রন্থপ্রণেতা এ দার্শনিক যুক্ত রয়েছেন বিশ্বের বেশ কিছু বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে। এখানে অনূদিত লেখাটি এপ্রিল মাসে প্রকাশিতব্য তার ‘প্যানডেমিক’ বই থেকে নেওয়া]

সংবাদমাধ্যমগুলো আমাদের অনবরত বলেই চলেছে ,‘আতঙ্কগ্রস্ত হবেন না’, অথচ আসল খবর পাওয়ার পর আতঙ্কিত হওয়া ছাড়া কোনো উপায় থাকছে না। অবস্থা দেখে আমার কমিউনিস্ট দেশে বেড়ে ওঠার স্মৃতি মনে পড়ে যাচ্ছে। তখন সরকারি কর্মকর্তারা জনগণকে বিভিন্ন প্রসঙ্গে প্রায়ই বোঝাতেন: আতঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই। আসলে তারা নিজেরাই যে যথেষ্ট আতঙ্কিত, এ ধরনের আশ্বাসকে আমরা তার লক্ষণ হিসেবেই বিবেচনা করতাম।

আতঙ্কের কিছু নিজস্ব নিয়ম আছে। এই যে যুক্তরাজ্যে করোনাভাইরাস আতঙ্কের কারণে দোকান থেকে টয়লেট পেপার উধাও হয়ে গেল, তাতে আমার কৈশোরের সমাজতান্ত্রিক যুগোস্লাভিয়ার একটা অদ্ভুত ঘটনার কথা মনে পড়ে গেল।একবার হঠাৎ এ রকম একটা গুজব রটল যে দেশে যথেষ্ট পরিমাণে টয়লেট পেপার মজুত নেই। সরকার সঙ্গে সঙ্গেই আশ্বাস দিল যে তাদের কাছে স্বাভাবিক চাহিদা মেটানোর মতো যথেষ্ট টয়লেট পেপার অবশ্যই মজুত আছে। আশ্চর্যের ব্যাপার হলো সেই একবারই তাদের দাবি যেমন সত্য ছিল, আর মানুষও মোটের ওপর সেটা বিশ্বাসও করেছিল। তারপরও সাধারণ ক্রেতারা ঠিকই এ রকম একটা হিসাব কষেছিল যে ‘টয়লেট পেপারের কোনো সংকট নেই জানি এবং এটা মিথ্যা রটনা। কিন্তু তারপরও যদি কিছু লোক গুজবটিকে সত্যি ধরে নিয়ে আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে দরকারের বেশি টয়লেট পেপার কিনে মজুত করতে থাকে, তাহলে তো সত্যি সত্যিই সংকট তৈরি হয়ে যাবে! তার চেয়ে বরং আমি নিজেই কিছু টয়লেট পেপার মজুত করে ফেলি না কেন!’ আমরা নিজেরা হয়তো কেউ এমনটা বিশ্বাস করতাম না যে কেউ এমন কিছু করতে পারে, আমরা হয়তো নিছক ধরে নিয়েছিলাম যে এ রকম কিছু অন্য ধরনের মানুষ তো আছেই, যারা এটা বিশ্বাস করে যে কিছু লোক ঠিকই গুজবে কান দেবে। কিন্তু কার্যত এ দুটির মধ্যে কোনো পার্থক্য ঘটেনি, কারণ ফলাফল হয়েছিল একই—বাজার থেকে টয়লেট পেপার উধাও। এখন ক্যালিফোর্নিয়া বা যুক্তরাজ্যে কি এমন কিছুই ঘটছে?

এই প্রতিক্রিয়ার আরেকটা রূপ হলো পরিস্থিতি যখন প্রকৃতপক্ষেই আতঙ্কজনক, তখন আতঙ্কের অনুপস্থিতি। গত কয়েক বছরে সার্স ও ইবোলা মহামারির পর আমাদের বারবার বলা হয়েছে যে ধেয়ে আসছে এর চেয়েও ভয়ংকর নতুন মহামারি। সেটা যে আসছেই তা ছিল প্রশ্নাতীত, শুধু প্রশ্ন ছিল, কবে আসবে? আমরা এই অশনিসংকেত সম্পূর্ণভাবে বিশ্বাস করা সত্ত্বেও কেন যেন গুরুত্ব দিইনি, কোনো প্রস্তুতি নিতেও নিরুৎসুক ছিলাম—আমরা একে ঠিকমতো মোকাবিলা করেছি কেবল ‘কনটাজিওন’ জাতীয় চলচ্চিত্রে।

এই দুই বিপরীতধর্মী প্রতিক্রিয়া থেকে আমরা বুঝতে পারি যে প্রকৃত বিপদের সঙ্গে মোকাবিলা করার বেলায় আতঙ্কগ্রস্ত হওয়ার কোনো মানে নেই। আমরা যখন বিপদে আতঙ্কগ্রস্ত হই, পরিস্থিতিকে তখন যথাযথ গুরুত্ব না দিয়ে বরং একে খেলোই করে ফেলি। ভেবে দেখুন যে একটা প্রাণঘাতী মহামারির মধ্যে টয়লেট পেপার নিয়ে মাথা ঘামানো কতটা হাস্যকর!

তাহলে এই করোনাভাইরাস মহামারির যথাযথ প্রতিক্রিয়া আসলে কী হতে পারে? আমাদের কী শিক্ষা নেওয়া উচিত? কীভাবে এই সংকটকে মোকাবিলা করা উচিত?

আমি যখন বলেছিলাম যে এই মহামারি সাম্যবাদকে একটা নতুন জীবন দিতে পারে, আমার কথাটাকে প্রত্যাশিতভাবেই কটাক্ষ করা হয়েছে। অথচ আমরা দেখছি সংকট নিরসনে চীনের কঠোর রাষ্ট্রীয় উদ্যোগ অন্তত ইতালিতে এখন যা চলছে তার চেয়ে অনেক বেশি কার্যকর হয়েছে। তবে অন্যদিকে ক্ষমতায় আসীন কমিউনিস্টদের সনাতন কর্তৃত্ববাদিতার সীমাবদ্ধতাও দৃশ্যমান। এর একটা উদাহরণ হলো যে ক্ষমতাধরদের (সেই সঙ্গে জনসাধারণকে) দুঃসংবাদ দেওয়ার বিষয়ে শঙ্কা এতটাই প্রবল ছিল যে শুরুর দিকে এই ভাইরাস নিয়ে রিপোর্ট করার কারণে সাংবাদিকদের গ্রেপ্তার হতে হয়েছিল। এখন সংক্রমণ যখন কমে আসছে, আবারও এ রকম ঘটনা ঘটছে বলে শোনা যাচ্ছে।

‘করোনাভাইরাসসৃষ্ট অচলাবস্থা থেকে চীনকে আবার কর্মমুখর করে তুলতে গিয়ে একটি পুরোনো অভিলাষ মাথা ছাড়া দিয়ে উঠছে: উপাত্ত এদিক-ওদিক করে উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা যা দেখতে চান, তা-ই দেখিয়ে দেওয়া। চীনের পূর্ব উপকূলীয় শিল্পপ্রধান ঝেইজিয়াং প্রদেশে বিদ্যুতের ব্যবহার এর উদাহরণ। অন্তত তিনটি শহরে স্থানীয় শিল্পকারখানাগুলোকে বিদ্যুৎ ব্যবহারের লক্ষ্যমাত্রা বেঁধে দেওয়া হয়েছে। অভিজ্ঞরা বলছেন, এর উদ্দেশ্য হলো বিদ্যুৎ ব্যবহারের উপাত্ত দিয়ে প্রমাণ করা যে উৎপাদন আবার শুরু হয়ে গেছে। এর কারণে কিছু কারখানা খালি প্ল্যান্টে অকারণ যন্ত্রপাতি চালাতে বাধ্য হয়েছে।’

এই প্রতারণা যখন ক্ষমতাধরদের কাছে স্পষ্ট হবে, তখন কী ঘটবে আমরা আন্দাজ করতে পারি: স্থানীয় ব্যবস্থাপকেরা অন্তর্ঘাতমূলক কাজের দায়ে অভিযুক্ত হয়ে কঠোর সাজা পাবেন, আর সেই সঙ্গে সচল হবে অবিশ্বাসের দুষ্ট চক্র। করোনাভাইরাসকে যুঝতে গিয়ে চীন যে ঠিক কী কী গোপন করেছে, তা কেবল একজন চীনা জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জকে পেলেই জানা যাবে। কিন্তু এই আমি, যদি এই কমিউনিজমের কথাই না বলে থাকি, তাহলে আমি আসলে কোন সমাজতন্ত্র কথা বলতে চেয়েছি? সেটা বুঝতে হলে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার কিছু বিজ্ঞপ্তি পড়তে হবে, যেমন:
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রধান তেদরোস আধানোম গেব্রোয়াসুস গত বৃহস্পতিবার বলেন, ‘বিশ্বজুড়ে গণস্বাস্থ্য সংস্থাগুলো এই ভাইরাসের বিস্তার মোকাবিলা করতে সক্ষম হলেও কিছু কিছু দেশের ঝুঁকির মাত্রার সঙ্গে রাজনৈতিক সদিচ্ছার সামঞ্জস্য নেই। আমরা আর কোনো মহড়া দিচ্ছি না। এখন হাল ছাড়ার সময় নয়, অজুহাত দেওয়ার সময় নয়। এখন সর্বোচ্চ শক্তি নিয়ে প্রস্তুত থাকার সময়। এ ধরনের পরিস্থিতির জন্য রাষ্ট্রগুলো কয়েক দশক ধরে পরিকল্পনার সুযোগ পেয়েছে। এখন সেই পরিকল্পনা বাস্তবায়নের সময়।’ তিনি আরও রোগ করেন, ‘এই মহামারিকে পিছু হটানো সম্ভব, কিন্তু সে জন্য প্রয়োজন সরকারযন্ত্রগুলোর যাবতীয় কলকবজার সমবেত, সমন্বিত এবং সামগ্রিক প্রয়াস।’

তাঁর বক্তব্যের সঙ্গে আরও যোগ করা যায়, এই কার্যক্রম রাষ্ট্রীয় সরকার পর্যায়ে সীমাবদ্ধ থাকলেই শুধু চলবে না, রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণের বাইরে মানুষের স্থানীয় উদ্যোগ এবং কার্যকর আন্তর্জাতিক সমন্বয় ও সহযোগিতাও এ ক্ষেত্রে অত্যাবশ্যক। যদি হাজার হাজার মানুষ শ্বাসকষ্ট নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়, তাদের জন্য বিপুল পরিমাণ চিকিৎসার সরঞ্জাম প্রয়োজন হবে। যুদ্ধের সময় রাষ্ট্র যেভাবে অসংখ্য অস্ত্র জোগাড় করে ফেলে, ঠিক সেই একইভাবে এসব সরঞ্জাম সংগ্রহ করতে হবে। এ জন্য অবশ্যই প্রয়োজন হবে আন্তরাষ্ট্রীয় সহযোগিতা। সামরিক তৎপরতার মতোই এ ক্ষেত্রেও রাষ্ট্রগুলোকে তথ্য বিনিময় করতে হবে, সব পরিকল্পনা হতে হবে সমন্বিত। এ রকম ‘কমিউনিজম/সাম্যবাদ’ই এখন সময়ের দাবি বলে আমি মনে করি। যেমন উইল হাটন বলেছেন, ‘একধরনের সংকট এবং মহামারিপ্রবণ অনিয়ন্ত্রিত মুক্তবাজার বিশ্বায়নের মৃত্যু ঘনিয়ে এসেছে ঠিকই, কিন্তু জন্ম হচ্ছে নতুন একধরনের বিশ্বায়নের, যা পারস্পরিক নির্ভরতা এবং প্রমাণভিত্তিক সামষ্টিক উদ্যোগকে গুরুত্ব দেয়।. কিন্তু এখন পর্যন্ত ‘প্রতিটি দেশ যার যার তার তার’(এভরি কান্ট্রি ফর ইটসেলফ) ধরনের চিন্তারই দাপট বেশি: ‘জাতীয় পর্যায়ে চিকিৎসা সরঞ্জাম রপ্তানির ওপর বিভিন্ন দেশ নিষেধাজ্ঞা আরোপ করছে, স্থানীয় ঘাটতি আর পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বিশৃঙ্খল সেকেলে সব ব্যবস্থার মধ্যে ডুবে থেকে, সংকটের আঞ্চলিক বোঝাপড়াতেই সীমাবদ্ধ থাকছে তারা।’

করোনাভাইরাস মহামারি কেবল বাজারভিত্তিক বিশ্বায়নের সীমাবদ্ধতাই প্রকাশ করছে না, আরও দেখিয়ে দিচ্ছে রাষ্ট্রের পূর্ণ সার্বভৌম ক্ষমতার ক্ষতিকর দিক। এই সার্বভৌমত্ব জাতীয়তাবাদী লোকরঞ্জনের একটি দাবি। কিন্তু স্পষ্টতই ‘সবার আগে আমেরিকা (বা যেকোনো দেশ)’ জাতীয় স্লোগানের দিন এখন শেষ, কেননা আমেরিকাকে বাঁচাতে পারে শুধু বৈশ্বিক সহযোগিতা। আমি কোনো কল্পরাজ্যের আলাপ করছি না, মানুষে মানুষে মহান সংহতির আদর্শের কথা বলছি না, বরং বিদ্যমান সংকট আমাদের চোখে আঙুল তুলে দেখিয়ে দিয়েছে যে আমাদের সবার টিকে থাকার জন্য প্রয়োজন বিশ্বজনীন সংহতি এবং সহযোগিতা। পরার্থপরতাই আমাদের নিজ নিজ স্বার্থরক্ষার একমাত্র যুক্তিসম্মত উপায়। আর এ কথা শুধু করোনাভাইরাসের ক্ষেত্রেই সীমাবদ্ধ নয়: কয়েক মাস আগেও চীন বিরাট একটা সোয়াইন ফ্লু সংক্রমণে ভুগেছে এবং অদূর ভবিষ্যতে পঙ্গপাল দ্বারা আক্রান্ত হতে পারে বলে খবর আছে। লক্ষণীয়, পৃথিবীজুড়ে করোনাভাইরাসের চেয়ে অনেক বেশি মানুষের প্রাণনাশ করছে জলবায়ু সংকট, অথচ সেটা নিয়ে আমাদের মধ্যে কোনো আতঙ্ক নেই—এ কথা আমাদের মনে করিয়ে দিয়েছেন ওয়েন জোনস।

কঠোর প্রাণবাদী দৃষ্টিভঙ্গি থেকে করোনাভাইরাসকে একটা হিতকর সংক্রমণ হিসেবে বিবেচনা করা যায়। এর মাধ্যমে মানবসমাজ থেকে বৃদ্ধ আর দুর্বলদেরকে আধমরা আগাছার মতো উপড়ে ফেলা যাবে, যাতে নতুন সতেজ চারারা বেড়ে উঠতে পারে। সামগ্রিকভাবে তাতে বিশ্বে স্বাস্থ্যের উন্নতিই ঘটবে। আমি যে বৃহত্তর সাম্যবাদী নীতির কথা বলছি, একমাত্র তার মাধ্যমেই এই ধরনের প্রাগৈতিহাসিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে আমাদের উত্তরণ ঘটতে পারে। ইতিমধ্যেই পরিস্থিতির চাপে সংহতির আদর্শ জলাঞ্জলি দেওয়ার আলামত স্পষ্ট। যুক্তরাজ্যে মহামারি যদি আরও ভয়ানক আকার ধারণ করে, হাসপাতালগুলো ‘তিন জ্ঞানী ব্যক্তি’ বিধির দ্বারস্থ হবে: ‘অভিজ্ঞ চিকিৎসকেরা সতর্ক করছেন যে ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিটগুলো রোগীর চাপ সামলাতে হিমশিম খেতে শুরু করলে রোগীরা জীবনদায়ক চিকিৎসা থেকে বঞ্চিত হতে পারেন। তথাকথিত ‘তিন জ্ঞানী ব্যক্তি’ বিধি অনুযায়ী এ রকম ক্রান্তিকালে প্রতিটি হাসপাতালের তিনজন জ্যেষ্ঠতম পরামর্শক কোন কোন রোগী শয্যা বা শ্বাসপ্রশ্বাস সহায়ক ভেন্টিলেটর পাবে, তা ঠিক করে দেবেন।’ এই তিন পণ্ডিত কোন নীতির ভিত্তিতে তা ঠিক করবেন? বৃহত্তর স্বার্থে বৃদ্ধ এবং নাজুকদের উৎসর্গ? এ রকম পরিস্থিতি কি সীমাহীন দুর্নীতির পথ খুলে দেয় না? এই সব পন্থা কি এটাই প্রমাণ করে না, যে আমরা শেষ পর্যন্ত সবলের টিকে থাকার নির্মম নীতিই আঁকড়ে ধরতে প্রস্তুত? অতএব আবারও দেখছি যে আমাদের সামনে বিকল্প দুটি: বর্বরতা অথবা একধরনের পুনরাবিষ্কৃত সাম্যবাদ।

অনুবাদ: সাজিয়া শারমীন