আফসানা বেগম

এই শীত, এই কুয়াশার মানুষেরা

শীত আর কুয়াশায় মাখামাখি চারপাশ। হিমকুয়াশার তীব্রতায় রাজধানী আর এর বাইরের মানুষের ভাবনায় কী খেলা করে? তাঁদের ভাবনার ভিন্নতাগুলো কোথায়? জবুথবু এই শীতের প্রহরে কোন স্মৃতিগুলো বেশি মনে পড়ে আমাদের? কথাসাহিত্যিকের কলমে তার বর্ণনা

গুচ্ছ গুচ্ছ কুয়াশা যখন হুট করে সামনে এসে দাঁড়ায়, মনে হয় এতটাই দুর্বোধ্য যেন দুই হাতে সরিয়ে এগোলে অন্য কোথাও পৌঁছে যাব। এক জীবনে কত জীবন থাকে! একেক ঘটনা আরেক জীবনে প্রবেশ করিয়ে দিয়ে যায় একই মানুষকে। তাই নতুন জনম নিয়ে কুয়াশার ওপারে আগের জনমে যাওয়ার রাস্তা খুঁজি। ওপার থেকে কে যেন ডাকে, সুদূর থেকে শোনা যায়, কিন্তু বোঝা যায় না। শীত এত বিভ্রান্তি ছড়ায় কেন!

ঢাকা থেকে যখন ময়মনসিংহে গিয়ে নামি। একদিকে প্রাচীন নকশার সাদা-লাল ইমারত কুয়াশায় আধা বিলীন। কিন্তু ওদিকে হইহল্লা-উত্তেজনা স্পষ্ট। সামনের আয়ত মাঠে দেখি চার বাহু বরাবর দর্শকের সারি। তাদের অবস্থান এতটাই নিশ্ছিদ্র যে কাছে না গেলে দেখা যায় না ভেতরে কী চলছে; ফুটবল! কুয়াশার তীব্রতায় ওই ঘোর সন্ধ্যায় তারা পায়ের আঘাতে ছুটে যাওয়া বল দেখতে পায় কী করে? খানিক দাঁড়িয়ে দেখি, দেখা যায়, মনের চোখও লাগে এই খেলার খেলোয়াড় বা দর্শক হতে। বলের উৎক্ষেপণ বিন্দু থেকে বুঝে নেওয়া যায় গতিপথ। কারও সতর্ক চোখ তাই ফোনে নেই, আছে কুয়াশার সঙ্গে ফুটবলের লুকোচুরিতে—বল এই এদিকে, তারপর ওই ওদিকে। কিশোরদের গলার উত্তেজনার শব্দগুলো কানে আসে মধু হয়ে, মধু! অবাক লাগে, এখনো বিকেল গড়িয়ে রাত অবধি ছেলেরা খেলে খোলা মাঠে? ফোনের স্ক্রিনের তথ্যের জোয়ার তাদের আটকে রাখে না? শারীরিক কসরতকে তাদের বাহুল্য মনে হয় না? এ যেন গেল শতকের আশির দশকের দিনাজপুরের বড় মাঠ! এই দিকে এক দল খেলছে তো আরেক দিকে আরেক। মুগ্ধ হয়ে দর্শকের সারিতে কয়েক মুহূর্ত দাঁড়ালেই খেলার উত্তেজনায় শামিল না হয়ে উপায় নেই। মনে মনে বলি, চোখের সামনে আশির দশক ফিরিয়ে আনার জন্য ধন্যবাদ তোমাদের।

অবাক হতে হয়, রাজধানীর মতো হতাশা আর অস্থিরতা নেই কোথাও? নদীর ধারে মানুষের কলকাকলি, মাঠ থেকে ঘেমেনেয়ে রাস্তার বাতির নিচ দিয়ে কিশোর-তরুণের প্রস্থান—সবকিছু যেন অন্য কোনো তালে-লয়ে চলছে। তবে কি যত কাণ্ড রাজধানীতেই? রাস্তায় বেরোলে প্রথমে ভাবতে হবে, যে সময়ের মধ্যে গন্তব্যে পৌঁছাতে চাই, তার মধ্যে পৌঁছাব কি না। দাবিদাওয়া, রাস্তা বন্ধ, সড়ক দুর্ঘটনা, ছিনতাই—এত এত অনিশ্চয়তা মাথায় রাখতে হবে। কষ্টকর নানা অভিজ্ঞতার কথা ভাবতেই ওই শহরের স্নিগ্ধতা জড়িয়ে ধরে যেন বলে, সব অশান্তির বাতাস রাজধানীতে বয়। এ শহরে সময় স্থবির নয়, অথচ কেমন স্বস্তিকর তার চলন! রাজধানীতেও কোনো দিন তেমনই ছিল, মনে পড়ে, যখন এত প্রতিযোগিতা ছিল না, এখনকার মতো মানুষ যখন কেবল ছুটত না আর্থিক উন্নতির পেছনে, এ-প্লাসের পেছনে, ভবিষ্যতের নিশ্চয়তার পেছনে, প্রতিষ্ঠা আর আধিপত্যের পেছনে।

তবু রাজধানী টানে। রাজধানীতে ফিরে দেখি সেই পুরোনো দিনের মতো শীত নামে। কুয়াশা।

আশির দশকে দিনভর কুয়াশায় দেশের প্রান্তিক শহরের বড় মাঠে সহপাঠীদের সঙ্গে দীর্ঘ সারিতে দাঁড়িয়ে থাকতে হতো। প্রেসিডেন্টের হেলিকপ্টার নামবে মাঝখানে। ঘণ্টার পর ঘণ্টা মৃদু শীতল বাতাসে দুই হাঁটু ঠকাঠক। তারই মধ্যে কাচের বোতলের কোক আর ঠান্ডা শিঙাড়ায় সবকিছু সার্থক। সাফারি পরা প্রেসিডেন্ট নামতেন, তালি দিতে দিতে এগোতেন, ‘নতুন বাংলাদেশ গড়ব মোরা’—গানের তাল আর বাণীতে ভালোমতো প্রশিক্ষণ দিয়ে আনা হতো আমাদের। তারপর সারা দিনের আনন্দফুর্তির পরে বাড়ি গিয়ে ঘরের লোকদের কাছে জানতে পারতাম, এই নতুন বাংলাদেশ ভালো নয়, একে বদলাতে হবে। সকালের কুয়াশা গলে আসা হালকা আলোর মতো রোদে বসে মুখ থেকে ড্রাগনের ধোঁয়া বোরোত, পরিবারের সদস্যরা বলাবলি করত, গতকাল ট্রাক তুলে দেওয়া হয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের ওপরে, মারা গেছে অনন্ত আটজন। চমকে উঠতাম, এ নতুন বাংলাদেশ তো তবে ভালো নয় সত্যি!

কোনো এক শীতের আগে আগে শহর বদলাতে হয়। রাজধানীতে বড় কলেজ, জীবনযাপনে কত সুবিধা! সকালবেলায় টাটকা খবরের কাগজ হাতে আসে। আর এখানে-ওখানে কত সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান! বড় ওস্তাদ, ভালো শিক্ষক। ইশ্‌, এত দিন যেন কোনো কুয়ার মধ্যে পড়ে থাকতে হয়েছিল! ওদিকে বড় শহর কেমন ভয়ানক একাকী করে ফেলে। রাস্তায় মানুষ ছুটছে, কেউ কাউকে চেনে না। ছোট শহরে রাস্তায় রিকশা থেকে পড়ে গেলেও কেউ বাড়িতে জানাত। বিশেষ কারণে মধ্যদুপুরে ছুটি হয়ে গেলে স্কুলের পোশাকে সিনেমা হলে চলে গেলে, সেটাও বাসার লোকে কী করে যেন খবর পেয়ে যেত। প্রাইভেট পড়ে বালুবাড়িতে, কিন্তু ঘুরতে দেখা গেছে মুনশিপাড়ায়! ব্যস, বাসায় খবর দেওয়া সারা। ভাবতে গেলে শান্তি লাগে, সেই ফেউলাগা শহর থেকে বাঁচা গেছে। এখন আর বড় শহরে কে করবে ফেউগিরি? অথচ সেই প্রথম হাহাকারের অনুভূতি ঘাই দিয়ে ওঠে, হায় হায়! এত লোক কেউ কাউকে চেনে না! মানুষ তবে কত একা! সেই প্রথম জানা, মানুষের একাকিত্ব কাটে কেবল চেনা মানুষের মাঝখানে। প্রিয় মানুষ ঘিরে থাকাকেই কেবল লোকালয়ে থাকা বলে।

একাকী শহরটাতে বহু মাস পরে একদিন আন্দোলনের খবর ভাসে। যাদের নামে হুলিয়া ছিল, তারাও নাকি রাস্তায় নেমে এসেছে। এবার সামরিক সরকার আর টিকবে না। উত্তাল শহর, মিছিল, মৃত্যু। বাড়ির সামনে মিছিলে যোগ দিতে সময় লাগে না, পায়ে পায়ে স্লোগানে স্লোগানে নীলক্ষেত, টিএসসি। অবাক কাণ্ড, আর একা লাগে না। মনে হয়, এই মিছিলের সবাই সবাইকে চেনে। মানুষ চেনা লাগে, চেনা চেনা লাগে দোকানপাট, ঘরবাড়ি। এ জন্যই কি শুনেছিলাম—‘পথে এবার নামো সাথী, পথেই হবে এ পথ চেনা’! অপরিচিত শহরটা হঠাৎ নিজের লাগে, মানুষগুলোকে আপন লাগে, যেন প্রত্যেকের কষ্ট-মৃত্যু গুরুত্ব রাখে প্রত্যেকের কাছে। তখন আর কিছুতেই একাকী লাগে না। তারপর একদিন স্বৈরাচারের পতন হয়, সপ্তাহব্যাপী পথেঘাটে কত কত নাটক-গান। সেবারের হালকা শীতে খোলা রাস্তায় বসে সেসব দেখা। বিকেলের রোদ গায়ে লাগতেই আরাম। সন্ধায় কুয়াশায় ঘুরেফিরে একই মুখ প্রতিদিন, যেন কত আপন! মুখগুলো বলে, আমরা মিলিতভাবে যা চেয়েছিলাম, তা–ই পেয়েছি। একটা জাগরণ অচেনা মানুষদের কাছাকাছি আনতে পারে—জনস্রোতে নানা মতে মনোরথের ঠিকানা।

আবারও কখনো চেনা শহরে স্বৈরাচারী হয়ে ওঠে কেউ। কিন্তু মানুষ আর সহজে এক হয় না। কে জানে কখন এত এত প্রতিযোগিতায় টিকতে গিয়ে কত মানুষ সুবিধাবাদী হয়ে যায়। কোনোভাবে ক্ষমতার সঙ্গে থাকতে পারলেই সব পাওয়া যায়। বড় শহর, ছোট শহর—সবখানে তার ঢেউ লাগে। আর তাই এত মৃত্যুর পরও যখন আবারও বহু মানুষ এক হতে পারে, তখন কে জানে কত মানুষ দলছুট হয়ে থেকে যায়। অনুশোচনা নেই। তাই ময়মনসিংহে যখন উপস্থিত হই, তখন সাংস্কৃতিসেবীদের মধ্যে এত এত ভাগ, মুখ দেখাদেখি বন্ধ। কুয়াশার নিচে যেমন ব্রহ্মপুত্র ঢাকা পড়ে থাকে, সেখানে তেমনি কিছু খোলাসা হয় না। তবে এত হতাশ হলে কি চলে? সময় লাগবে, কোনো দিন মানুষে মানুষে সদ্ভাব হবে নিশ্চয়, মানুষ আর একা থাকবে না।

ফিরে এলে বড় শহরে বিভ্রান্তি বাড়ে, শীতও বাড়ে। ওদিকে খুলনার পথে পেঁজা তুলার মতো কুয়াশা। কখনো দেখলে মনে হয়, কয়েক প্রস্থ মেঘ চলে যাচ্ছে। হেডলাইটের আলো পারে না বিভ্রান্তি দূর করতে। আগের মতোই বহু চেষ্টায় সংস্কৃতির সঙ্গে জড়িয়ে থাকা মানুষগুলোকে একসঙ্গে করতে পারলেও তাঁদের মনে তখনো আসেনি স্বস্তি। সামনাসামনি বসে সৌজন্য দেখিয়ে খানিক নরম সুরে কথা বলেন তাঁরা। তারপর পুরোনো দিনের কথা উঠে যায়। অভিযোগ অন্তহীন। তখনো এমন সময় আসেনি যে যথেষ্ট বলা হয়েছে, রাগ ঝাড়া হয়েছে যথেষ্ট। মানুষগুলোকে দেখতে ভালো লাগে তাও। কেউ প্রকাশক, কেউ সংগঠক, কেউ কবি বা গায়ক। দীর্ঘদিনের সাধনার ছাপ তাঁদের চোখেমুখে। নিজেদের ভেতরে যোগাযোগ বহু বছরের, হাজারো স্মৃতি উথলে ওঠে। তবু একজন আরেকজনের প্রতি ক্ষমাহীন। একসঙ্গে বসে আছেন বলতে কেবল একে অন্যকে সহ্য করে যাচ্ছেন। ওইটুকুই সে পর্যন্ত অগ্রগতি।

কুয়াশা বাড়ে। একের পর এক নাকি শৈত্যপ্রবাহ আসবে। সেই কোন ছেলেবেলায় দেখেছি পত্রিকার হেডলাইন—‘কাল থেকে ছয় দিন সারা দেশে শৈত্যপ্রবাহ’। শৈত্যপ্রবাহের চেয়েও মন শীতল হয় বরিশালের মানুষগুলোকে দেখে। মাফলার আর চাদরে প্যাঁচানো মুখ। তাঁরা একে অন্যের দীর্ঘ সাংস্কৃতিক চর্চার সঙ্গী। কত বই তাঁদের, বহু বছরের পুরোনো পত্রিকা। কেউ পত্রিকা প্রকাশ করেন, কেউ এলাকার ইতিহাসে সিদ্ধহস্ত। বরিশালের আঞ্চলিক ভাষায় হাজারখানেক ছড়া লিখেছেন কেউ। সামান্য সাধতেই আবৃত্তি। তারপর একের পর এক আবৃত্তি। নিজেদের সাফল্যের তৃপ্তি তাঁদের ঘিরে রাখে। রাজধানীর হট্টগোল যেন বহু দূর তাঁদের চিন্তাচেতনা থেকে। নিজেদের গণ্ডির মধ্যে কী সুখী একেকটা মানুষ! অপূর্ণতা নেই, চর্চার গল্প আর হাসিঠাট্টা। বিস্মিত হতে হয় দেখলে যে রাজধানীর সুযোগ-সুবিধা না পাওয়ার কোনো আক্ষেপ নেই কারও। নিজেদের পরিপূর্ণ জগতে মগ্ন প্রত্যেকে। আধিপত্যের সংকট নিয়ে যাতনা নেই, লেখক-কবিদের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম-সংশ্লিষ্ট লড়াই নিয়ে ভাবনা নেই, বরং একে অন্যকে প্রশংসা করে সন্ধ্যাটা পার করতে পারেন। তাঁদের সরলতা দেখে রাজধানীর কত আয়োজন মেকি লাগে, মনে হয় কী নিয়ে পড়ে থাকি! মাঠে শিশু-কিশোরের ঢল বারবার দৃষ্টি কাড়ে, তবু লেখকদের দিকে চোখ যায়। তাঁদের আন্তরিকতায় মুগ্ধ হই। আরও মুগ্ধ হই যে তথ্যের বিপুল স্রোতের মধ্যে তাঁরা নেই। প্রতিদিন সকালে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের মব তাঁদের বিতৃষ্ণা ধরায় না। বিষণ্নতার মধ্যে দিনভর তাঁরা ডুবে থাকার সুযোগ পান না। বিস্মিত হয়ে ভাবি, কেবল তথ্যের অবাধ প্রবাহ চোখের সামনে না পড়া আর পড়লেও তাকে নিজেদের জগতের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত করতে না পারা মানুষকে এতটা প্রশান্তি দিতে পারে!

এরপর রাজশাহীতেও কবি-শিক্ষক-ছড়াকার শীতের মধ্যে লেখক আড্ডার বৃত্তাকার প্যান্ডেলের নিচে বসেন। রাত গভীরে গড়ায় এলাকার সাংস্কৃতিক চর্চা নিয়ে তাঁদের নানা অভিজ্ঞতার কথা শুনে। সেখানেও তাই কেউ জানতে চান না, ঢাকায় নাকি ওমুক সমস্যা হয়েছে? আছে প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান—ঘুরে ঘুরে লেখক-কবিদের পাণ্ডুলিপি সংগ্রহ করছে; সংগঠক আছেন—কত রকমের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের পরিকল্পনা তাঁর মাথায়—আজ এ দলকে ওমুক প্রশিক্ষণ দিতে হবে, কাল তমুক জায়গায় নিয়ে যেতে হবে। আছে কবিতা পরিষদ, কত কত কবি সেখানে চর্চা করে যাচ্ছেন বছরের পর বছর। কে ছোট, কে বড়—এ নিয়ে মাথাব্যথা নেই।

বিপুল যোগাযোগের মধ্যেও যোগাযোগহীনতা কারও জন্য কত সৌভাগ্যের হতে পারে, তা–ই দেখি। আর রাজধানীর জন্য হতে পারে ঠিক ততটাই দুর্ভাগ্যের। রাজধানীতে বিরাট সভা আয়োজিত হলে মনে হয় সারা দেশে সাড়া পড়ে গেল। ওদিকে বাস্তবের বিচ্ছিন্নতার বোধে শীতকাল আরও শীতল লাগে। রাজধানীতে বসে যে গণ্ডি নিয়ে গর্বে ফেটে পড়ে মানুষেরা, তার সঙ্গে দেশের ছোট-বড় শহরের তেমন কোনো যোগাযোগ তৈরি হয় না। সংস্কৃতিচর্চায় এই সহজ সত্য মানা কঠিন। এত এত যোগাযোগব্যবস্থা, তবু দূর এখনো অনেক দূর, বহুদূর। সর্বজনীন বলে কিছু তৈরি হয়নি—এই ভাবনা ভোগায়।

শুধু এক কুয়াশা আর শীতই যেন পুরো দেশকে এক সুতায় গেঁথেছে।