অলংকরণ: এস এম রাকিবুর রহমান
অলংকরণ: এস এম রাকিবুর রহমান

গল্প

আইসক্রিম

নির্দয় শীতকাল অবশেষে বিদায় নিচ্ছে; বাতাসে বসন্তের গন্ধ। কান পাতলে শোনা যাচ্ছে পথের পাশে জমে ওঠা তুষারের পাহাড়গুলোর গভীর থেকে বরফগলা পানি বেরিয়ে আসার মিহি খরখর শব্দ; গাছে গাছে কাঠবিড়ালিদের ছোটাছুটি শুরু হয়েছে। এখানে এপ্রিল নিষ্ঠুর মাস নয়।

বরফগলা পানি-কাদায় প্যাচপেচে পথ ধরে হেঁটে চলেছি মেট্রো স্টেশনের দিকে। হঠাৎ দেখি, ঘাড়ে–গর্দানে দশাসই এক যুবক এক পাতলা দিঘল তরুণীর কোমর বেড় দিয়ে ধরে হেঁটে আসছে। কাছাকাছি হতেই মেয়েটি আমার দিকে তাকিয়ে উল্লসিত কণ্ঠে চেঁচিয়ে উঠল, ‘হাব্বিব! কোথায় যাচ্ছিস একা একা?’

এটা ইসাবেলা; মেক্সিকো সিটির মেয়ে। আমরা একই বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ি। খুব ভালো মেয়ে। আমি একবার ওকে বলেছিলাম, ‘বনিতা, তুই আমাকে ভালোবাসবি?’

ইসাবেলা হাসতে হাসতে বলেছিল, ‘ভালো তো বাসিই।’

ওর হাসিটা ছিল মে মাসের দুপুরের মতো ঝলমলে। আমি ওকে বলেছিলাম, ‘এ রকম ভালোবাসা না। প্রেমিকের মতো, বাসবি?’

ইসাবেলা আবার খিলখিল করে হেসে উঠেছিল, হাসতে হাসতে মরে যেতে যেতে বলেছিল, ‘ওকে, ইউ আর মাই লাভার।’

কিন্তু ওর লাভার মিগেল। মিগেলটা সারাক্ষণ গিটার বাজিয়ে গান গায় আর শুধু হাসে। একবার এক নাচের আসরে ইসাবেলাকে আমার দিকে ঠেলে দিয়ে মিগেল বলেছিল, ‘নে, আমার প্রেমিকাকে দিয়ে দিলাম তোকে।’ ইসাবেলা তো হাসতে হাসতে খুন। বাঁ হাতে আমার ডান হাতটা টেনে নিয়ে আমার সব আঙুলের ফাঁকে ওর সব কটা আঙুল ঢুকিয়ে দিয়ে আঁকশির মতো করে চেপে ধরে আমাদের জোড়া হাত একসঙ্গে কাঁধ বরাবর তুলে ডান হাতে আমার কোমর জড়িয়ে ধরে গানের তালে তালে নাচাচ্ছিল আমাকে, আর আমি সুরের তালে তালে ওর পায়ের সঙ্গে পা মেলাতে পারছিলাম না বলে কেবলই ‘এভাবে না! এভাবে না!’ বলতে বলতে হেসে মরে যাচ্ছিল।

আমি ইসাবেলার প্রশ্নের উত্তর দেব কী, অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলাম ওর কোমর জড়িয়ে ধরে থাকা যুবকের দিকে। তারপর প্রায় ধমকের সুরে বলে উঠলাম, ‘এই গাবো! তুই মিগেলের প্রেমিকাকেও পটিয়ে ফেলেছিস?’

গাব্রিয়েল হেসে বলে, ‘কে কাকে পটায় আমিগো! মিগেল তো এক রুশ সুন্দরীর প্রেমে পড়ে গেছে!’

ইসাবেলা খিলখিল করে হেসে উঠল। পথের পাশের বার্চগাছগুলোর নিষ্পত্র ডালে ডালে কাঠবিড়ালিরা ছোটাছুটি শুরু করে দিল।

‘আমরা আইসক্রিমের দোকান খুঁজে বেড়াচ্ছি,’ ইসাবেলা আমাকে বলে, ‘যাবি আমাদের সঙ্গে?’

আমি হেসে বলি, ‘কার কোমর জড়িয়ে? গাবোটা তো অলরেডি তোর কোমর দখল করে নিয়েছে!’

‘তোর হিংসা হচ্ছে বুঝি? এই নে!’ বলে ইসাবেলা নিজেকে গাব্রিয়েলের হাতের বেষ্টন থেকে ছাড়িয়ে নিয়ে আমার কাছে এসে বগলের নিচে হাত ঢুকিয়ে দিয়ে বলল, ‘এখন চল।’

গাব্রিয়েলের ভ্যাবাচেকা মুখের চেহারাটা হলো দেখার মতো!

আমরা তিনজন আইসক্রিমের দোকানের খোঁজে হাঁটতে শুরু করলাম। কিছুদূর হাঁটার পর দেখি, একটা পার্কের এককোণে এক ভ্রাম্যমাণ আইসক্রিম লরির সামনে লম্বা একটা লাইনে দাঁড়িয়ে আছে নানা বয়সের লোকজন। লাইনের লেজটা খুঁজে নিয়ে আমরাও দাঁড়িয়ে গেলাম। কিন্তু একটু পরই গাবো বিরক্ত কণ্ঠে বলে উঠল, ‘তোদের এই সমাজতান্ত্রিক লাইন আমার একদমই সহ্য হয় না! আইসক্রিম খেতে হবে না, চল এখান থেকে!’

ওর হাসিটা ছিল মে মাসের দুপুরের মতো ঝলমলে। আমি ওকে বলেছিলাম, ‘এ রকম ভালোবাসা না। প্রেমিকের মতো, বাসবি?’

কিন্তু ইসাবেলা ছাড়বে না; আইসক্রিম তাকে খেতেই হবে। সে স্তালিনীয় ভঙ্গিতে গাব্রিয়েলকে বলল, ‘চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকবি! আইসক্রিম কিনব, তারপর যাব।’

সুবোধ বালকের মতো জুত হয়ে দাঁড়াল গাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেস।

কিন্তু মিনিট তিনেক না পেরোতেই আইসক্রিমের লরি থেকে এক দশাসই যুবতী চিৎকার করে বলে উঠল, ‘আইসক্রিম ফুরিয়ে গেছে। আপনারা চলে যান।’

গাব্রিয়েল উল্লাসে নেচে উঠে হাততালি বাজাতে শুরু করল। ইসাবেলা ওকে মারার জন্য থাপ্পড় বাগিয়ে ধাওয়া করল, গাব্রিয়েল একদিকে দৌড় লাগাল। আইসক্রিম কেনার জন্য লাইনে দাঁড়ানো লোকজন ছত্রভঙ্গ হয়ে বিভিন্ন দিকে চলে গেল। বিকট শব্দ তুলে সাদা ধোঁয়ার কুণ্ডলী উড়িয়ে চলে গেল আইসক্রিমের শূন্য লরিটাও।

ছোট্ট পার্কজুড়ে সুনসান নীরবতা নেমে এল।

আমি ইসাবেলাকে বললাম, ‘গাবোটা গেল কই?’

‘নিশ্চয়ই চুরুট কিনতে,’ বলল ইসাবেলা। তারপর পার্কের দিকে ইঙ্গিত করে বলল, ‘চল, ওখানে একটু বসি।’

আমরা পার্কের ভেতরে ঢুকে দেখতে পেলাম, লিও তলস্তয়ের বিশাল এক প্রস্তরমূর্তি বসে আছে আকাশ ঢেকে। তাকে ঘিরে দাঁড়িয়ে রয়েছে কয়েকটা পাইন, পপলার ও ম্যাপলগাছ। তলস্তয়ের পায়ের পাশে দাঁড়ানো ম্যাপলগাছটার নিচে একটা কাঠের বেঞ্চে বসে আছে এক যুবক; তার দুই হাঁটুতে দুই কনুই ঠেস দেওয়া, মাথাটা নিচের দিকে ঝুলে রয়েছে। পরনে কালো ওভারকোট, পাশে একটা পোর্টফোলিও। আমরা তার পাশের বেঞ্চে গিয়ে বসলাম।

 ‘শুনতে পাচ্ছিস?’ একটু পর ইসাবেলা ফিসফিস করে বলল আমাকে।

 ‘কী?’ 

 ‘গোঙানির শব্দ! শুনতে পাচ্ছিস না?’

আমি কান খাড়া করে শুনতে পেলাম, পাশের বেঞ্চে বসা যুবকের দিক থেকে একটু পরপর চাপা গোঙানির শব্দ ভেসে আসছে।

 ‘লোকটা অসুস্থ নাকি রে? চল তো, দেখি।’ বলতে বলতে উঠে দাঁড়াল ইসাবেলা।

আমরা যুবকটির কাছে গিয়ে দাঁড়ালে সে মাথা তুলে আমাদের দিকে তাকাল।

 ‘আরে ফ্রানৎস! কী হয়েছে তোমার?’ ইসাবেলা বলল।

 ‘মাথাব্যথা! ক্লাস্টার হেডেক!’ যন্ত্রণাক্লিষ্ট স্বরে বলল ফ্রানৎস কাফকা, তারপর দুহাতে খামচে ধরল নিজের মাথার চুল।

 ‘সে কী!’ ইসাবেলার কণ্ঠে গভীর দরদপূর্ণ উৎকণ্ঠা বেজে উঠল, ‘তাহলে এখানে বসে আছ কেন? চলো, তোমাকে পলিক্লিনিকে নিয়ে যাই।’

 ‘লাভ নেই, মস্কোর কোনো হসপিটাল-ক্লিনিকে এখন ট্রিপট্যান্স নেই।’ মৃদু হাঁপাতে হাঁপাতে বলল ফ্রানৎস।

 ‘শুধু ত্রিপতান্স নয়, সোভিয়েত ইউনিয়নের কোনো হাসপাতালেই এখন কোনো ওষুধ নেই,’ সিগারেটের ধোঁয়া উড়িয়ে হেঁটে আসতে আসতে বলল গাব্রিয়েল, ‘তোমাদের সমাজতন্ত্রের মরণঘণ্টা বেজে উঠেছে।’

ইসাবেলা ওর দিকে তাকিয়ে চিৎকার করে উঠল, ‘খবরদার! তুমি বিড়ি নিয়ে আমাদের কাছে আসবে না!’

গাব্রিয়েল বাধ্য ছেলের মতো থেমে দাঁড়াল। এক হাত কোমরে রেখে কাফকার দিকে তাকিয়ে সিগারেট ফুঁকতে ফুঁকতে বলল, ‘ফ্রানৎস, মাথাব্যথা নিয়ে তুমি বাইরে বেরিয়েছ কেন?’

 ‘চুপ করো!’ গাব্রিয়েলের উদ্দেশে ধমক দিয়ে উঠল ইসাবেলা, ‘লোকটা মাথার যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছে, আর তুমি ওকে বকিয়ে নিতে চাচ্ছ?’

গাব্রিয়েল নিশ্চয়ই চুরুট খুঁজে পায়নি, নইলে তার ঠোঁটে কেন রুশদের মার্কামারা সিগারেট ‘বেলামোর কানাল’! সেই উৎকট দুর্গন্ধ ছড়ানো সিগারেটে কষে একটা টান মেরে সে বলল, ‘আরে না, আমাকে বকিয়ে নিতে হবে না, ফ্রানৎস নিজেই আপনমনে এত বকবক করে যে ক্লাস্টার হেডেক বাঁধিয়ে ফেলেছে!’

 ‘বাজে কথা বোলো না,’ ইসাবেলা ফ্রানৎসের দিকে তাকিয়ে গাব্রিয়েলের উদ্দেশে বলল, ‘ফ্রানৎস কাফকা মিনিমালিস্ত, ওর প্রতিটা বাক্য একদম মেপে মেপে লেখা।’

 ‘ইসাবেলা একদম ঠিক বলেছে,’ আমি গাব্রিয়েলের মুখের দিকে তাকিয়ে বললাম। তারপর তাকালাম ফ্রানৎসের দিকে, সে কোনো প্রতিক্রিয়া করে কি না, তা দেখার প্রত্যাশায়। কিন্তু বেচারি এখনো দুই হাতে নিজের মাথার চুল খামচে ধরে আছে, ওর গলার গভীর থেকে চাপা কাতরানির শব্দ বেরিয়ে আসছে।

ইসাবেলা আর সইতে পারল না, ফ্রানৎসের সামনে গিয়ে তার দুই হাঁটুর কাছে উবু হয়ে বসে করুণ কোমল স্বরে বলল, ‘ফ্রানৎস, কেন এখানে বসে বসে কষ্ট করছ? পলিক্লিনিকে যাবে, চলো!’ 

ফ্রানৎস অতি কষ্টে মাথা তুলে ক্ষীণ কণ্ঠে বলল, ‘নাতাশা এসে আমাকে খুঁজে না পেলে রাগ করবে।’

‘নাতাশা কে? কোন নাতাশা?’ প্রায় সমস্বরে বলে উঠল ইসাবেলা ও গাব্রিয়েল। নিজের অজান্তে আমার মুখ থেকেও বেরিয়ে এল ‘কোন নাতাশা?’

এ সময় আমাদের পেছন থেকে ভেসে এল একটা পুরুষকণ্ঠ, ‘এখানে মাথাব্যথায় কষ্ট পাচ্ছে কে?’ 

আমি পেছন দিকে ঘাড় ফেরানোর আগেই বেজে উঠল ইসাবেলার কণ্ঠ, ‘দক্তর চেখভ! এসো এসো! এখন তো তোমাকেই দরকার।’

ঘাড় ঘুরিয়ে দেখতে পেলাম, একটা চামড়ার ব্যাগ হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে আন্তন চেখভ, তার চোখ থেকে চশমাটা যেন এক্ষুনি খসে পড়বে। তাকে দেখে ফ্রানৎস কাতর স্বরে বলল, ‘আপনার ব্যাগে কি ট্রিপট্যান্স ইনজেকশন আছে?’ 

 ‘না, মরফিন আছে।’ সংক্ষেপে বলল আন্তন। তারপর নিজের ব্যাগটা খুলে ইয়াব্বড় একটা সিরিঞ্জ আর একটা কাচের শিশি বের করল।

তারপর ম্যাপলগাছের ছায়াচ্ছন্ন তলায় কাঠের বেঞ্চে এক করুণ রসাত্মক দৃশ্যের অবতারণা হলো: ডক্টর চেখভের নির্দেশে ফ্রানৎস কাফকা বেঞ্চে উপুড় হয়ে শুয়ে পড়ল, ইসাবেলা ও গাব্রিয়েল তার ট্রাউজার টেনে নামিয়ে ফরসা নিতম্ব উন্মুক্ত করল এবং চেখভ তার দশাসই সিরিঞ্জের ৩ ইঞ্চি লম্বা সুইটা সেখানে সেঁধিয়ে দিল। গাব্রিয়েল হাসি আটকানোর ব্যর্থ চেষ্টায় গোঁ গোঁ ধ্বনি উৎপাদন করে চলল, ইসাবেলা কপট রাগে তার মুখের দিকে তাকিয়ে চোখ পাকাতে লাগল। আন্তন তার সুইটা বের করে নিলে ইসাবেলা ফ্রানৎসের ট্রাউজার টেনে তুলে নিতম্বটা ঢেকে দিল। ফ্রানৎস আগের মতোই উপুড় হয়ে চুপচাপ শুয়ে রইল। গাব্রিয়েল সিগারেট ধরাল। আন্তন তাকে বলল, ‘আমার টিউবারকিউলোসিস, এখনই মেরো না আমাকে; দূরে গিয়ে ফুঁকে এসো।’ গাব্রিয়েল ‘পারদোন, পারদোন’ বলতে বলতে সিগারেটে টান দিতে দিতে তলস্তয়ের প্রস্তরমূর্তির পেছন দিকে চলে গেল।

একটু পর ফ্রানৎস উঠে বসল। তার চোখে-মুখে যন্ত্রণার লেশমাত্র নেই।

‘আপনাকে ধন্যবাদ, ডক্টর চেখভ!’ আন্তনের মুখের দিকে তাকিয়ে কৃতজ্ঞস্বরে বলল ফ্রানৎস। আন্তন তাকে বলল, ‘এখন বলো, তুমি রাশিয়ায় এসেছ কেন?’ 

 ‘এটা আবার কেমন কথা?’ চেখভের দিকে তাকিয়ে অবাক হয়ে বলল ইসাবেলা, ‘আন্তন, এমন কথা কি কাউকে মুখের ওপর বলা যায়?’

আন্তন ইসাবেলাকে বলল, ‘তুমি জানো না বুঝি, রাশিয়ার কাউকেই ফ্রানৎসের পছন্দ নয়? আফটার অল, হি ইজ আ জার্মান সৌল। জার্মানরা তো রুশদের দুচক্ষে দেখতে পারে না।’

ফ্রানৎস কাফকা চেখভের মুখের দিকে তাকিয়ে মনঃক্ষুণ্ন স্বরে বলল, ‘আন্তন পাভলোভিচ, আপনার মুখে এই কথা শুনে আমি অবাক না হয়ে পারছি না...’

কাফকার কথা শেষ না হতেই বেজে উঠল একটা গম্ভীর কণ্ঠস্বর, ‘কথাটা দস্তয়েভস্কি বললে ফ্রানৎস অবাক হতো না।’ 

চমকে উঠলাম, কে বলল কথাটা? কার কণ্ঠস্বর এমন সমুদ্রের নিনাদের মতো জলদগম্ভীর?

হঠাৎ আমার চোখ পড়ল ফ্রানৎসের মুখের দিকে, সে তাকিয়ে আছে লিও তলস্তয়ের সেই বিশাল প্রস্তরমূর্তির দিকে, যে আকাশ ঢেকে বসে আছে একটা পাহাড়ের মতো; তাকিয়ে আছে সোজা ফ্রানৎস কাফকার মুখের দিকে। তারপর দেখি, ইসাবেলাও নিষ্পলক তাকিয়ে আছে কালো কষ্টিপাথরে গড়া বিগ্রহটির দিকে, যার নামের প্রথম অংশটার মানে সিংহ।

বিস্ময় নেই শুধু গাব্রিয়েলের চোখে-মুখে; সে তলস্তয়ের দিকে তাকিয়ে নির্বিকারভাবে সিগারেট ফুঁকতে ফুঁকতে বলল, ‘ফ্রানৎস কিন্তু রুশ লেখকদের মধ্যে শুধু শোভিনিস্ট দস্তয়েভস্কিকেই পছন্দ করে।’

‘কারণ, ফ্রানৎসও দস্তয়েভস্কির মতোই অসুস্থ।’ তলস্তয়ের গম্ভীর রায়ের শব্দে ছোট্ট উদ্যানখানা গমগম করে উঠল। 

 ‘এখানে দস্তয়েভস্কির ভক্ত আরেকজন আছে।’ তলস্তয়ের দিকে তাকিয়ে এ কথা বলল ইসাবেলা, তারপর সে আমার দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসল। আমি সঙ্গে সঙ্গে চিৎকার করে বলে উঠলাম, ‘দস্তয়েভস্কির প্রতি আমার কোনো ভক্তি নেই!’

গাব্রিয়েল তলস্তয়ের দিকে তাকিয়ে নালিশের সুরে বলল, ‘লেভ নিকোলাইয়েভিচ, হাবিব এক হাজার পৃষ্ঠার ঢাউস এক পত্রিকা বের করেছে শুধু দস্তয়েভস্কিকে নিয়ে! আপনাকে বাদ দিয়ে! ভাবা যায়!’

 ‘হাবিব কমিউনিস্ট, আবার দস্তইয়েফস্কির দ্বারা আক্রান্ত। বেশ স্ববিরোধী একটা চরিত্র, ঠিক দস্তইয়েফস্কির চরিত্রগুলোর মতোই।’ তলস্তয় আমার দিকে তাকিয়ে বলে, আমি তার চোখের কোণে চাপা হাসি দেখতে পাই।

আন্তন একটুখানি কেশে গলা পরিষ্কার করে বলে, ‘হাবিব ঘোষণা করেছে, এরপর সে পত্রিকা বের করবে ফ্রানৎসকে নিয়ে। কিন্তু আমি বলছিলাম, সবার আগে করা উচিত শেক্‌সপিয়ারকে নিয়ে...’

তার কথা শেষ হওয়ার আগেই তলস্তয় গম্ভীর কণ্ঠে বলে উঠল, ‘আন্তন, শেকসপির পিসাল প্লোখা, আ তি পিশিস খুঝে...আন্তন, শেক্‌সপিয়ার খারাপ লিখত, তুমি লেখো তার চেয়ে খারাপ...’

ইসাবেলা হাততালি বাজিয়ে বলে উঠল, ‘বুঝেছি! বুঝেছি! লেভ নিকোলাইয়েভিচ শেক্‌সপিয়ারকে ঈর্ষা করেন!’ 

এই সময় কোত্থেকে আবির্ভূত হলো কলকাতার তনুশ্রী চক্রবর্তী; ওর ডান হাতে একটা রঙিন ছাতা, পায়ের কাছে লেজ নাচাচ্ছে ধবধবে সাদা ও অত্যন্ত লোমশ একটি কুকুর। ওকে এমন সুন্দর দেখাচ্ছে যে আমি বিস্ময়ে বোবা হয়ে গেলাম। ওকে দেখে ফ্রানৎস নড়েচড়ে উঠে বলল, ‘নাতাশা এসে পড়েছে। ও আমাকে দস্তয়েভস্কির প্রেমের গল্প শোনাবে...।’

আমার মাথাটা বনবন করে ঘুরতে লাগল; আমি চোখে শর্ষে ফুল দেখতে লাগলাম। তখন হঠাৎ ইসাবেলা চিৎকার করে উঠল, ‘আইসক্রিম!’

পেছন ফিরে দেখি, পার্ক লাগোয়া রাস্তার সেই কোনায় আইসক্রিমের লরিটা ফিরে এসেছে, নানা বয়সী লোকজন সেদিকে ছুটে যাচ্ছে। তনুশ্রী ফ্রানৎসের একটা হাত ধরেছে, ওরা পাশাপাশি হেঁটে যাচ্ছে আইসক্রিমের লরিটার দিকে।