আমি জানতাম এমন কিছুই হবে শেষ পর্যন্ত। শুরুর আগে যেন একটা বড় ক্যানভাসে আঁকা ছবি হয়ে ঘটনাগুলো আমার সামনে স্থির হয়ে ছিল। কিন্তু কখনো কখনো এমন হয়, কিছু করার থাকে না।
মনে পড়ে, ওই দিন সকালে ঘুম ভেঙে আমি স্টাডিরুমের চেয়ারে বসে ছিলাম। খোলা জানালাটার ওধারে আকাশের অনেকটা অংশ দেখা যাচ্ছিল। দুটি চিল উড়ছিল চক্রাকারে। এমনটা দেখিনি আমি আগে, চিল আকাশে একাই ওড়ে স্বভাবত। আমার ধারণা, শিকারের ভাগ ওরা কাউকে দিতে চায় না, তাই একা ওড়ে।
চায়ের কাপ হাতে অনেকক্ষণ আমি চিল দুটির ওড়াউড়ি দেখলাম। তখন কল এল ফোনে।
‘স্যার, আজ আসবেন না অফিসে?’
‘আসব।’
‘সকাল থেকে একটা মেয়ে এসে বসে আছে।’
‘মেয়ে বসে আছে? নাম কী?’
‘স্যার, ওনার নাম কুরুতপা।’
‘আচ্ছা, বসতে বলো।’
আজ আমার কোনো ক্লাস ছিল না। এ জন্যই ভেবেছিলাম, দুপুরের আগে আগে যাব। কিছু কাগজপত্র তৈরি করতে হবে। লাঞ্চের পর সরফুদ্দিন স্যারের কাছ থেকে দাবার পাঠ নেব।
অফিস রুমে ঢুকতেই চেয়ারে বসে থাকা মেয়েটিকে দেখলাম। সাদা শার্টের নিচে সমতল পিঠ। ব্রার স্ট্র্যাপ দেখা যাচ্ছে। চুলগুলো কাঁধের নিচে নামেনি। সেগুলোয় একটু লালচে ভাব। চেয়ারে বসতে বসতে মুখটাও দেখা গেল। লম্বাটে মুখ। নাক–চোখ টানা টানা, ঠোঁটে কি সার্জারি করিয়েছে? একটু বাঁকা আর ফোলামতো। যে মেয়ের নাম কুরুতপা বা কুরুর তপস্যা, তার এমন পশ্চিমা মুখ মানায় না।
‘বলুন, আপনার জন্য কী করতে পারি?’
কোনো রকম ভণিতা না করে মেয়েটি বলল, ‘নিউ জার্সির প্রিন্সটন ইউনিভার্সিটিতে কমপারেটিভ লিটারেচারে পড়ার জন্য একটা স্কলারশিপের আবেদন করব। আপনি কি আমার পেপারগুলো একটু দেখে দেবেন? বিশেষ করে, আইসল্যান্ডিক ফোকলোর রাফকেল সাগা আর রবিনহুডের লোর নিয়ে আমার একটা তুলনামূলক লেখা আছে, ওইটা।’
অচেনা এক ইংরেজি সাহিত্যের অ্যাসোসিয়েট প্রফেসরের কাছে এমন আবেদন করা যায় কি না, আমার জানা নেই। কিছুটা বিরক্তও হলাম। কিন্তু মেয়েটার মধ্যে কেমন এক আকর্ষণী ক্ষমতা! আমি জানতে চাইলাম, ‘কে পাঠিয়েছে আপনাকে? পিএইচডি করবেন?’
‘না, গ্র্যাজুয়েশন। আমাকে আপনার কথা বলেছেন হিরণ্ময় দত্ত। আপনার কোর্স টিচার ছিলেন মনে হয়।’
হিরণ্ময় স্যারের কথায় আমার মন আরও নরম হলো। উঠতি বয়সে কত সাহায্য করেছেন আমাকে।
এই স্কলারশিপের কাগজপত্র দেখে দেওয়ার মতো তুচ্ছ একটা কাজের সূত্রেই কুরুতপার সঙ্গে পরিচয় হলো। ওই দিন বিকেলের দিকে একটা কফিশপে গিয়ে নর্স কিংবদন্তি রাফকেলকে নিয়ে বিস্তর আলাপ করলাম আমরা। আমাদের বয়সের পার্থক্য বছর দশেকের কম ছিল না, কিন্তু ব্যাপারটা জমে গেল। বিকেল থেকে গভীর রাত পর্যন্ত শহরের এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্তে আমরা ছুটে বেড়ালাম একটা টয়োটা প্রিমিওতে চড়ে।
লালমাটিয়ায় একটা পুরোনো ধরনের দোতলা বাড়ির সামনে এসে গাড়ি থামালাম আমি। কুরুতপা বলল, এই বাড়ি ওর দাদার হাতে তৈরি। বিখ্যাত আর্কিটেক্ট ছিলেন। সেটা অবশ্য জাহাজের ডেকের মতো বিশাল বারান্দাটা দেখেই বুঝে নিলাম। এমন স্থাপনাগুলো ধরে রাখার মতো সুযোগ এই শহরে আর নেই।
গাড়ি থেকে নেমে জানালা দিয়ে আবার মাথাটা গলিয়ে দিল মেয়েটা, ‘এত রাত হয়ে গেছে! আমাদের বাসায় থেকে যান আজ, প্লিজ। রাত জেগে আমরা অনেক আলাপও তো করতে পারব। কী বলেন!’
আমার মন চাইল যে বলি, ‘আজ নয়, আরেক দিন আসব,’ কিন্তু বললাম, ‘গ্যারেজে আমার গাড়িটা পার্ক করার জায়গা আছে তো?’
মূল দরজা দিয়ে ঢুকেই লম্বা একটা করিডর। সবুজ আলো জ্বলছে। একদিকের দেয়ালে পিকাসোর ব্লু পিরিয়ডের ছবি ‘বুড়ো গিটারবাদক’ আর এদভার্দ মুনচের ‘স্ক্রিম’। অন্য পাশে সুলতানের ‘প্রথম বৃক্ষরোপণ’, আর ভ্যান গঘের ‘আলুখোর’। কেমন একটা অস্বস্তি হচ্ছিল এমন আলোর নিচে ছবিগুলোর দিকে তাকিয়ে। বেশ কিছুক্ষণ হাঁটার পর ড্রয়িংরুমে এলাম। দেয়ালজুড়ে বইভর্তি শেলফ আর সেসবের ফাঁক দিয়ে ঝকঝকে সাদা দেয়াল উঁকি মারছে। সেন্টারটেবিলের জায়গায় চৌকো একটা লোহার সিন্দুক রাখা। এক পাশে এল শেপের পুরোনো ধরনের সোফা।
‘তোমাদের বাড়িটা তো এক জাদুঘর দেখছি।’
কুরুতপা শব্দ করে হেসে উঠল, ‘কে জানে, হয়তো এটা জাদুঘরই।’
‘হা হা হা। কে কে আছেন তোমাদের বাসায়?’
‘আপাতত আমি আর আপনি ছাড়া কেউ নেই।’
কিছুক্ষণ অবাক হয়ে মেয়েটার মুখের দিকে তাকিয়ে রইলাম আমি। বুঝলাম যে সত্যি বলছে। অকস্মাৎ কেমন একটা বোধেও যেন আক্রান্ত হলাম, কী করছি আসলে আমি এখানে? এক দিনের পরিচয়ে একটা মেয়ে এমন ডাকল, আর সরাসরি তার বাসায় এসে হাজির হলাম?
কিন্তু ততক্ষণে ফুডপান্ডার ডেলিভারিম্যান এসে বেল বাজিয়েছে। অন্তর্গত চিন্তার জগৎ থেকে আমি বেরিয়ে এলাম সহজেই। আমরা রাতের খাবার সারলাম শিশ কাবাব, টার্কিশ ব্রেড আর রেড ওয়াইন দিয়ে। ঢাকায় এমন চমৎকার টার্কিশ খাবারের রেস্তোরাঁ হয়েছে জানা ছিল না।
খেতে খেতে বললাম, ‘এত বড় বাসায় একা থাকো, ভয় লাগে না তোমার?’ কুরুতপা নিঃশব্দে ওয়াইনের গ্লাসে চুমুক দিল। বুঝলাম, উত্তর পাওয়া যাবে না। খাওয়ার সময়টা প্রায় চুপচাপই কেটে গেল। রাস্তা থেকে ভেসে এল পাহারাদারের বাঁশির শব্দ।
গেস্টরুমের মাঝখানে রাখা বিশাল খাট। ওপরে নকশাদার সিলিং ফ্যান শব্দ করে ঘুরছে। আমার মনে হলো, নিজের সময় থেকে পিছিয়ে অন্য আরেক পৃথিবীতে হয়তো চলে এসেছি। ডিমলাইটের লালচে আলোয় গোটা ঘরটাই কেমন অতিপ্রাকৃত হয়ে আছে। এসবের মাঝখানেই কী রকম তীব্র এক কামজ তাড়নায় আমার শরীর–মন অস্থির হয়ে গেল, বুঝিয়ে বলা কঠিন। খুব করে চাইলাম, খোলা দরজায় যেন দ্রুতই কুরুতপার দিঘল শরীরটা দেখা যায়। আর ধীর পায়ে মেয়েটা যেন আমার বিছানায় উঠে আসে। কুরুতপা এল না।
সকালে ঘুম ভেঙে এক নৈঃশব্দ্যের জগতে নিজেকে আবিষ্কার করলাম আমি। এমন শব্দহীনও হতে পারে একটা দিন? অথচ রাতেই মনে আছে, রাস্তা থেকে পাহারাদারের বাঁশি আর গাড়ির শব্দ ভেসে আসছিল। অথচ এখন কেমন সব চুপ! মনে হলো, এই বিশাল বাড়িতে আমি ছাড়া আর দ্বিতীয় কেউ নেই। টয়লেটে ঢুকে ফ্রেশ হলাম। রেডি হয়ে ড্রয়িংরুমে এসে মেয়েটার নাম ধরে কয়েকবার ডাকলাম। সাড়া এল না। ঘুরে ঘুরে বাকি ঘরগুলো দেখব কি না ভাবলাম। মনে হলো যে ঠিক হবে না সেটা।
এক তীব্র মনখারাপ নিয়ে ক্যাম্পাসের পথ ধরেছিলাম আমি সেদিন। বাসায় ফিরতে ইচ্ছা করছিল না। ফোন বাজছিল। কল করছিল আমার স্ত্রী তাসনুভা। তিন বছরের সংসার আমাদের। কিন্তু কুরুতপার বিরহের তাপে আমি পুড়ছিলাম। তাসনুভাকে কোনো দিন ওর কথা আর বলিনি আমি। বলার দরকার ছিল না।
কিন্তু আজ এতগুলো বছর পর অফিস অ্যাসিস্ট্যান্টের ফোন ধরে চমকে উঠলাম। ‘স্যার, একটা মেয়ে এসে বসে আছে আপনার জন্য। অ্যাপয়েন্টমেন্ট নেই।’
‘মেয়ে? কী নাম?’
‘কুরুতপা।’
আমি জানতাম এমন হবে। কুরুতপাদের প্রাচীন বাড়িটা ঠিক আগের মতোই আমার জন্য অপেক্ষা করবে। আর তাদের ভুতুড়ে গেস্টরুমে রাত জেগে কুরুতপার জন্য একটা কামজ অপেক্ষা নিয়ে জেগে থাকব আমি, সে কি এবারও এসে দাঁড়াবে না দরজায়?