সত্তর দশকে কলকাতার মেয়ে মৈত্রেয়ী রায়ের প্রেমে পড়েছিলেন কবি নির্মলেন্দু গুণ। ৫০ বছর পর, সেই স্মৃতি মনে করে বর্তমানে আই লাভ ইউ নামে আত্মজৈবনিক এক প্রেমের উপন্যাস লিখছেন কবি। ফেসবুকে এখন পর্যন্ত উপন্যাসটির ৩৪ পর্ব লিখেছেন। কবির অনুমতি নিয়ে সেই উপন্যাস থেকে প্রকাশ করা হলো দুটি পর্ব
রাতই হচ্ছে কবিতা লেখার জন্য উৎকৃষ্ট সময়। এটি আমার ধারণা। আমার অধিকাংশ কবিতা আমি গভীর রাতে লিখেছি। আমার চারপাশের সবাই যখন ঘুমিয়ে পড়ে, একটা পিনপতন নীরবতার মধ্যে আমি কবিতা লিখতে বসি। এটি আমার দীর্ঘদিনের অভ্যাস।
মেসে ফিরে আমার জন্য বিশেষ যত্নে ঢেকে রেখে দেওয়া খাবার খেয়ে, আমার রুমমেটের সঙ্গে কিছু অপ্রয়োজনীয় ও অপ্রাসঙ্গিক কথা বলে আমি মৈত্রেয়ীর জন্য কবিতা লেখার খাতাটি নিয়ে বসলাম। ‘তোমাকে এমন হঠাৎ ভাবি কেন’ কবিতাটি পড়লাম। আমার বেশ লাগল কবিতাটি। কবিতাটি একটানে লিখেছি। তাই বেশি কাটছাঁট করতে হলো না। মনে হলো ঠিকই আছে।
আমি যখন কোন কবিতাটি লিখব, তা স্থির করতে পারছিলাম না, তখন আমার মনে হলো কে যেন আমার শিয়রে বসে আমাকে বলছে, ‘লেখো।’
আমি একজন অশরীরী নারীর অস্তিত্ব অনুভব করলাম, যে দেখতে অনেকটাই মৈত্রেয়ীর মতো।
আমি লিখলাম:
‘ভালোবাসা কই, এ তো মৃত্যুর মুখোমুখি
কল্পনা ছুঁয়ে ক্লান্তির কাছে যাওয়া। বাসনার মুখে অঙ্গার জ্বেলে-জ্বেলে ওষ্ঠের লাল অমৃতে চুমু খাওয়া।
ভালোবাসা কই?
এ তো জন্মের প্রবণতা, পাতালের কালো মাটিতে মাখানো শিশু—জীবনকে দেয় জীবনের হাতে তুলে,
এ তো উদাসীনতার এপ্রিলে পাওয়া যিশু।
ভালোবাসা কই?
এ তো ধর্মের চেয়ে প্রিয়।’
কবিতাটি লিখে শেষ করার পর আমার মনে হলো কে যেন আমার মাথার চুলে আদর করে বিলি কেটে দিচ্ছে। বলছে, ‘থামলে কেন? লেখো।’
মন্ত্রমুগ্ধের মতো আমি তখন আবার একটি কবিতা লিখতে শুরু করলাম:
‘গতকাল বড় ছেলেবেলা ছিল
আমাদের চারিধারে।
আমার কপালে একটা দীর্ঘ চুম্বন দিয়ে কে যেন আমাকে বলল, ‘বাহ্ তুমি লেখো, আরও লেখো, আমি এখন যাই।’ ‘আমি যাই মানে? তুমি কে?’ ‘আমি মৈত্রেয়ী।’
দেয়ালের মতো অনুভূতিমাখা মোম
জ্বালিয়ে জ্বালিয়ে আমরা দেখেছি
শিখার ভেতরে মুখ।
গতকাল ছিল জীবনের কিছু মরণের মতো সুখ।
গতকাল বড় যৌবন ছিল শরীরে শরীর লাগা—ফুলের বাগান ঢেকে রেখেছিল উদাসীন গাছপালা।
আমরা দুজন মাটি খুঁড়ে খুঁড়ে
লুকিয়েছিলাম প্রেম,
গতকাল বড় ছেলেবেলা ছিল বুঝিনি কী হারালেম।
গতকাল বড় এলোমেলো চুলে
বাতাস তুলেছে গ্রীবা—
চুমু খেয়ে গেছে কৃষ্ণচূড়ার উজ্জ্বল মধুরিমা।
গতকাল বড় মুখোমুখি ছিল
সারা জীবনের চাওয়া।
চোখের নিমিষে চোখের ভেতরে চোখের বাহিরে যাওয়া।’
আমার কপালে একটা দীর্ঘ চুম্বন দিয়ে কে যেন আমাকে বলল, ‘বাহ্ তুমি লেখো, আরও লেখো, আমি এখন যাই।’
‘আমি যাই মানে? তুমি কে?’
‘আমি মৈত্রেয়ী।’
‘তুমি এখানে এলে কী করে? আমি তো তোমাকে তোমাদের বাসায় পৌঁছে দিয়ে এসেছিলাম।’
মৈত্রেয়ী বলল, ‘নিরাপদ দূরত্ব বজায় রেখে আমি তোমাকে অনুসরণ করে তোমার এই মেসে চলে এসেছি।’
‘কেউ দেখেনি তোমাকে?’
‘না, দেখবে কেমন করে। তুমিই দেখোনি যখন, তখন অন্য কেউ আমাকে দেখবে কেমন করে?’
‘তার মানে রেস্টুরেন্টে বসে আমি যে গানটি শুনেছিলাম, তুমিও শুনেছ সেই গান?’
মৈত্রেয়ী বলল, ‘শুনিনি শুধু, তোমার প্রিয় সুচিত্রার মতো ওই গানে আমি ঠোঁটও মিলিয়েছি।
‘এই গান আমারও কম প্রিয় নয় কবি। মাই মম স্যাং দিস সং মেনি টাইমস ফর মি। আই লাভ দ্যাট সং।’
আমাদের কথোপকথনের মধ্যেই হঠাৎ আমি দরজার খিল খোলার শব্দ পেলাম।
মনে হলো, কে যেন বেরিয়ে গেল আমার ঘর থেকে।
আমি ঘরের খোলা দরজা দিয়ে দ্রুত বাইরে বেরিয়ে এলাম। কিন্তু কাউকেই দেখতে পেলাম না।
আমি নির্জন আলো–আঁধারি পথ ধরে সামনের দিকে এগোতে থাকলাম। আজিমপুর কবরের গা ঘেঁষে যে সড়কটি বিডিআরের প্রথম গেট হয়ে নিউমার্কেটের সামনে দিয়ে মিরপুর রোডের সঙ্গে গিয়ে যুক্ত হয়েছে, ওই পথ ধরে আমি অগ্রসর হলাম।
একবার আমি আমার মেসে ফিরে যাবার কথা ভেবেছিলাম, কিন্তু পায়ের ওপর আমার নিয়ন্ত্রণ ছিল না। নির্জন পথ ধরে এগোতে থাকলাম ভূতে পাওয়া পথিকের মতো। আমার জীবনানন্দের ওই কবিতার দুটো বিখ্যাত লাইন মনে পড়ল, ‘হাজার বছর ধরে আমি পথ হাঁটিতেছি পৃথিবীর পথে।’
পৃথিবীর পথে হাজার বছর ধরে পথ হাঁটার পেছনের প্রেরণা তিনি কোথায় পেয়েছিলেন, আমি জানি না। আমার মনে হলো, কী জানি, হয়তো বনলতা সেনের সন্ধানেই তিনি পথ হাঁটছিলেন। আমি যেমন ছুটে চলেছি মৈত্রেয়ীর সন্ধানে। কবিতা লেখার ঘোরের ভেতরে আমি যেমন মৈত্রেয়ীর উপস্থিতি ও স্পর্শ অনুভব করেছি, জীবনানন্দের বেলায় এমন কিছু ঘটেছিল কি? কে জানে!
স্ট্রিট লাইটের আলোয় পথের পাশের কৃষ্ণচূড়াগাছগুলো দেখা যাচ্ছিল। গাছগুলোর ফুলভারে নত ডাল থেকে কিছু কৃষ্ণচূড়া ছিঁড়ে নিলাম আমি।
মনে হলো, মৈত্রেয়ী অস্ট্রেলিয়ায় ফিরে যাবার পর এই ফুলগুলোই তো বাংলাদেশে মৈত্রেয়ীর প্রতিনিধিত্ব করবে।
যত দূর চোখ যায়, আমি চারপাশে তাকিয়ে দেখলাম, কিন্তু একটি মানুষও আমার চোখে পড়ল না।
আমার মনে হলো, আই মাইট বি হ্যালুসিনেটেড বাই মৈত্রেয়ী।
এরই নাম হয়তোবা প্রেম, এরই নাম হয়তো কবির বিভ্রম। কে যেন আমার ভেতর থেকে আমাকে বলল, ‘এবার ফিরে যাও। গো ব্যাক টু ইয়োর হোয়াইট পেজেস অ্যান্ড রাইট ইয়োর পোয়েমস। বাট আই থিঙ্ক, ইউ নিড রেস্ট। ইউ শুড স্লিপ নাউ।’
ইংরেজি–বাংলা মিশিয়ে যে আমাকে এই কথাগুলো বলল, সে তো মৈত্রেয়ী ছাড়া অন্য কেউ হতেই পারে না।
আমি মনে হয় ঠিকই বুঝেছি, মৈত্রেয়ীই এসেছিল। আমি তার প্রেমে পড়েছি কি না; পড়লে কতটা পড়েছি, তা যাচাই করে দেখার জন্য।
আমি বললাম, মৈত্রেয়ী, তুমি কোথায়? আমাকে দেখা দাও। আমাকে আলিঙ্গন করো। তোমাকে বুকে জড়িয়ে ধরে আমি আমার আত্মার অগ্নিকে নির্বাপিত করি। আমি তো আপন অগ্নিতে ভস্ম হয়ে যাব।
কেউ আমার প্রশ্নের উত্তর দিল না। চারপাশ খুঁজে কাউকেই দেখতে পেলাম না আমি। অন্য অনেকবারের মতো তখন আবারও আমার মনে পড়ল সুচিত্রার গাওয়া একটি গানের দুটো কলি:
‘কে যেন আমারে ডাকে, অলখে লুকিয়ে থাকে
ফিরে ফিরে চাই, দেখিতে না পাই।’
আমি বেশ বুঝতে পারলাম, সুচিত্রাকে সরিয়ে দিয়ে মৈত্রেয়ী আমার আত্মার ভেতরে ক্রমশ আসন পেতে বসেছে। তার প্রেমের বন্ধন থেকে আমার মুক্তি নেই।
আমি মৈত্রেয়ীর সঙ্গে প্রেম করতে চেয়েছিলাম। কবিতা লিখে মৈত্রেয়ীকে মুগ্ধ করতে চেয়েছিলাম, কিন্তু মৈত্রেয়ীর প্রেম যে আমার সত্তাকে এভাবে গ্রাস করে নিজের অস্তিত্বকে প্রকাশ করবে, আমাকে ‘তুমি’তে পরিণত করবে, সে কথা আমার ভাবনার মধ্যে ছিল না।
দুদিন আগেও যাকে আমি দেখিনি, যার সঙ্গে আমার কোনো পূর্বপরিচয় ছিল না, এক দিনের ব্যবধানে আমার সব অস্তিত্ব সেই নারীর মধ্যে লীন হয়ে যাবে?
কম ভালোবেসে সে কি আমার সব ভালোবাসাকে দখল করে নিচ্ছে? নাকি কম ভালোবেসে আমিই মৈত্রেয়ীর সব ভালোবাসাকে নিজের সম্পদ করে নিয়েছি?
ভাবতে ভাবতে রণে ভঙ্গ দিয়ে আমি আমার মেসের পথ ধরলাম।
মেসে ফিরে মনে হলো, আমার গভীর রাতে হঠাৎ বাইরে বেরিয়ে যাওয়ার ঘটনাটি কেউ লক্ষই করেনি। লক্ষ করলেও বিষয়টি কেউ আমলে নেয়নি। এ রকম গভীর রাতে মেসের বাইরে আমি আগেও গিয়েছি।
কবিরা তো এ রকমই হয়।
ঘুমাতে যাওয়ার আগে আমি একটা ছোট্ট মজার কবিতা লিখলাম। কবিতার নাম দিলাম ‘তুমির ক্রমবিকাশ’:
‘আমি। আমি। আমি।
আমি। আমি। তুমি।
আমি। তুমি। তুমি।
তুমি। তুমি। তুমি।’
তুমির ক্রমবিকাশকে বোঝাতে গিয়ে এই কবিতায় ছয়বার আমি ও ছয়বার তুমি ব্যবহার করেছি।
আমি আর তুমি এখানে সমান সমান।
প্রেম মনে হয় এ রকমই কিছু হবে। আমাদের পূর্বপুরুষ ও পূর্বনারীরা একটা দারুণ জিনিস আবিষ্কার করেছেন—প্রেম। এই প্রেমকে মহিমামণ্ডিত করেছেন আমাদের আদি কবিরা। রাধা–কৃষ্ণের প্রেমকথা শুধু ভারতবর্ষকেই আলোকিত করেনি, পুরো পৃথিবীতেই আলো ছড়িয়েছে।
‘কৃষ্ণ বলে আমার রাধা বামে যতক্ষণ, নইলে শূন্য জীবন।
নইলে শূন্য জীবন।’