‘গত ১৭ জানুয়ারি শনি কুম্ভ রাশিতে প্রবেশ করেছে। এখানে থাকবে আড়াই বছর। এই আড়াই বছর কুম্ভের জীবনের চরম সময় আসতে চলেছে। পিতৃ-মাতৃবিয়োগসহ নিকটজনের মৃত্যু ঘটতে পারে। ব্যবসায় ক্ষতি, চাকরি চলে যাওয়া, মামলা-মোকদ্দমার মতো পরিস্থিতির শিকার হতে পারে…!’ এই পর্যন্ত দেখে ভিডিওটা বন্ধ করে দেয় রুবাই। তার বুকের ভেতরটা ঢিপ ঢিপ করতে থাকে, পানির পিপাসা বেড়ে যায়। অকাল্ট সায়েন্স কি সত্যি? নাকি তার মতো নিরুপায় মানুষেরা এটা বিশ্বাস করে? গত নভেম্বরে একটা টর্নেডো! তার পর থেকে ওর ব্যবসায় ব্যাপক ধস নেমেছে। এই ব্যবসা ছিল তার জন্য একটা চ্যালেঞ্জ।
বাড়ির সবাই তাকে এই ব্যবসায় আসতে নিষেধ করেছে। ‘ক্রপ সায়েন্সে পড়লেই যে কৃষি নিয়ে ব্যবসা করতে হবে—এমন কোনো মাথার দিব্যি তোমাকে কেউ দেয় নাই মা!’—কথাটা খুব জোর দিয়ে বলেছিলেন মা। মা খুব চাইতেন রুবাই সরকারি চাকরি করবে। তার মতে, মেয়েদের জন্য ওটাই নিরাপদ পেশা। নইলে দেশের বাইরে যাও, আরও পড়ো, গবেষণা করো, কে তোমাকে বাধা দিচ্ছে!
কিন্তু না, রুবাইর জেদ। সে বলে, ‘সবাই চাকরি করলে দেশটা চলবে কীভাবে, মা!’
‘দেশ উদ্ধারের দায়িত্ব তোমাকে কেউ দেয় নাই! তাহলে বরং তুমি রাজনীতি করো, ওটা লাভজনক পেশা!’ অনেকটা ঝাঁজের সঙ্গে কথাটা বলে উঠে চলে গিয়েছিলেন মা।
পরিস্থিতি যখন এমন, তখন বাবা কিছুটা প্রশ্রয় দিয়েছিলেন। বাবা মাকে বোঝালেন, ‘রুবাই উচ্চফলনশীল ব্রিডের গবেষণা করবে, এমন মাছের পোনা ব্রিড করবে, যেটা ভাইরাসের কবলে পড়ে উৎপাদনকারী কৃষককে সর্বস্বান্ত করবে না।’
‘তুমি আমাকে বোকা পাইছ? মেয়ে সারা দিন নেট ঘাঁটে, আমি ভাবতাম সে হয়তো দেশের বাইরে পড়তে যাবে, ওর বন্ধুরা অনেকেই চলে গেছে। আর এখন সে কী বলে! এখন আমি কী শুনতেছি? দেশ উদ্ধার করার দায়িত্ব কান্ধে নিতে চায়! তোমার বুদ্ধিতে সে এই সব করে, আমি বুঝি না মনে করছ?’
বাবার যে এর মধ্যে কোনো ইন্ধন নেই, এটা মাকে কিছুতেই বোঝানো সম্ভব নয়। কারণ, তিনি তার কন্যার আবদার অনুযায়ী তাদের অনেক দিনের পরিত্যক্ত প্রায় ১০ একরের একটা জমি ইতিমধ্যেই প্রজেক্ট করার জন্য দিয়ে দিয়েছেন।
তবে মেয়ের কর্মকাণ্ড দেখে মায়ের দুর্ভাবনা যায় না। তিনি বলতেই থাকেন, ‘যে দেশে ধরা ধরা ছেলেরাই ব্যবসা করতে পারে না, সেখানে রুবাই তো একটা মেয়ে! নিচ থেকে ওপর পর্যন্ত পথে পথে তার পাথর ছড়ানো।’
মায়ের এসব আপত্তি মাথায় নিয়েই রুবাই এরই মধ্যে ছয়টা পুকুর কাটিয়ে ফেলেছে। সেই পুকুরের পাড়গুলোয় ফলের গাছ হিসেবে পেঁপে, মাল্টা ও পেয়ারার গাছও লাগানো হয়েছে। পাশাপাশি উচ্চফলনশীল সবজির চাষ। আর পুকুরগুলোয় ছাড়া হয়েছে গলদা চিংড়ি ও কাঁকড়া।
রুবাই যেহেতু কৃষি নিয়ে খুব উঁচু দরের স্বপ্ন দেখে, তাই সে পণ্য উৎপাদনের সঙ্গে সঙ্গে রপ্তানির একটা যোগাযোগ তৈরি করে ফেলেছিল। সে তার প্রকল্পে যে চিংড়ি-কাঁকড়া উৎপাদন করে, সেই পণ্য আবার বিদেশেও রপ্তানি করতে শুরু করল। চীন ও থাইল্যান্ডে দুজন বায়ার জোটাল। আলিবাবা সাইটে দীর্ঘদিন ঘুরে ঘুরে সে এই দুজন বায়ার ধরতে সক্ষম হয়েছে। যারা অথেনটিক এবং টাকাপয়সা নিয়ে খুব একটা ঝামেলা করেনি। ‘কৃষি নিয়ে ব্যবসা করা মেয়েদের কাজ না’—এই কথাকে রুবাই যখন প্রায় ভুল প্রমাণিত করে ফেলেছে, তখন তার জীবনে এল এক বড় বিপর্যয়!
তুমুল এক ঝড় এসে তার খামারের গাছগুলোকে লন্ডভন্ড করে দিয়েই শুধু ক্ষান্ত হলো না, ভূপৃষ্ঠের প্রায় তিন ফুট ওপর দিয়ে পানি প্রবাহিত হওয়ায় তার চিংড়ি ও কাঁকড়াও খামার ছেড়ে পালাল। তারপরও রুবাই থেমে থাকেনি। অন্য খামারিদের কাছ থেকে মাছ ও কাঁকড়া সংগ্রহ করে রপ্তানির কাজটা ঠিকই করছিল। কিন্তু একদিন কার্গো বিমান ডিলে হওয়ায় তার কনটেইনারের সব কটি কাঁকড়া মরে যাওয়ায় এবং মাছ নষ্ট হয়ে যাওয়ায় যে ক্ষতি হয়েছে, সেটাকে আর পুষিয়ে নেওয়া ওর পক্ষে সম্ভব হয়নি।
পরপর দুটি বিপর্যয়ের পর রুবাই যখন সব শেষ ভেবে একেবারেই ভেঙে পড়েছে, অদ্ভুতভাবে মা তাকে এবার ঘুরে দাঁড়ানোর জন্য খুব উৎসাহ দিতে লাগলেন। এই মা-ই যে তাকে ব্যবসার শুরুতে বাধা দিয়েছিলেন, এটা ভেবে রুবাই এখন অবাকই হয়! মায়ের কথা হলো, ‘যেখান থেকে ক্ষতি হয়েছে, ক্ষতিটা সেখান থেকেই পুষিয়ে নিতে হবে। ক্ষতি হয়েছে বলে হাত-পা গুটিয়ে বসে থাকলে কোনো ব্যবসায়ই তুমি সফল হতে পারবা না।’
কিন্তু এসব কথা মোটিভেশনাল স্পিচে শুনতে যত ভালো শোনায়, বাস্তবে তা নয়। বাস্তব বড় ভয়ংকর! বাস্তব তার ভয়াল নখ-দাঁত দিয়ে প্রতিমুহূর্তে তাকে আঁচড়াতে, কামড়াতে আসে। এত দিন যেসব আত্মীয় ও বন্ধু তাকে খুব উৎসাহ-উদ্দীপনা দিয়ে এসেছে, সময়ে-অসময়ে তার খামারে গিয়ে আউটিং, পিকনিক করে সেসব ছবি সোশ্যাল মিডিয়ায় দিয়ে লাইক-রিঅ্যাক্ট কুড়িয়েছে, সেই তারাও এখন বলছে, ‘রুবাই এই ব্যবসা ছেড়ে তুই বরং বিয়েশাদি, চাকরিবাকরি কর।’ রুবাইয়ের হতে হতে না হয়ে ওঠা প্রেমিক জুলহাস, যে কিনা কানাডায় গিয়ে কৃষি গবেষণা করছে, সে-ও একদিন ভিডিও কল করে বলল, ‘ওদেশে পড়ে থেকে কিছু হবে নারে রু, তুই বরং কানাডায় আসার ট্রাই কর। বলিস তো আমি সব ব্যবস্থা করি?’
জুলহাস তাকে এই পরামর্শ নতুন দেয়নি, আগেও দিয়েছে। তবে রুবাই এবার ভাবছে অন্য কথা। শুনেছে প্রত্যাখ্যাত প্রেমিকেরা খুব প্রতিহিংসাপরায়ণ হয়। জুলহাস এখন নিশ্চয়ই তার হেরে যাওয়া নিয়ে উপহাস করছে। রুবাই যেহেতু কাজটাকে চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিয়েছিল এবং জুলহাসকে মুখের ওপর ‘না’ করে দিয়েছে। তাই পরোক্ষভাবে এটা জুলহাসেরই জয় হলো, আর তার পরাজয়! সে জুলহাসের কাছে কিছুতেই হার মানতে পারে না। কিন্তু এবার নাটকীয়ভাবে তার বাবা বেঁকে বসলেন। তিনি পৃথিবীর বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে রুবাইর কাগজপত্র সাবমিট করতে লাগলেন। অন্যদিকে রুবাই নাছোড়বান্দা। ব্যবসাটা চালু করতে ৬০ লাখ টাকার একটা ব্যাংক লোনের জন্য জোর চেষ্টা চালাতে থাকে সে।
বাংলাদেশে ক্ষমতার জোর না থাকলে ব্যাংক লোন পাওয়া তো সোনার পাথরবাটি। প্রতিনিয়ত ব্যাংকে সে এ কাগজ সে কাগজ জমা দিতে থাকে রুবাই। এরপর আসে সরেজমিনে তদন্তের পালা। দিনের পর দিন তদন্তের পর তদন্তে সে যখন পর্যুদস্ত, তখন ভবিষ্যতে ব্যবসাটা কীভাবে আবার দাঁড় করাতে পারে—এসব নিয়ে নানা সাইট ঘাঁটছে, এমন সময় ‘ভবিষ্যৎ’ কথাটা কীভাবে যে গ্যাজেটের কানে গেল! তার সামনে ঝাঁপিয়ে পড়ল কিছু অ্যাস্ট্রোলজির ভিডিও। সে কৌতূহলবশত দু-একটা ভিডিওতে ক্লিক করতেই পড়ে গেল ইউটিউবার জ্যোতিষীদের খপ্পরে। অনেকটা মোহাচ্ছন্নের মতো রুবাই ভিডিওগুলো দেখে। কখনো কখনো রাতভর জ্যোতিষীদের বকবকানি শোনে। একেক জ্যোতিষ একেক ধরনের ভবিষ্যৎ বলে। তবে কিছু ভীতি, কিছু আশঙ্কার কথার পর তারা সবাই ইতিবাচক একটা কথা বলে শেষ করে। তাদের আবার কিছু ধারাবাহিক কাজ থাকে—যেমন শনির কথা বলে তারা আবার মঙ্গল, বুধ, বৃহস্পতি ও শুক্রের প্রভাব–কুপ্রভাবের কথাও বলে।
আবার যেমন তারা বলে, কেউ শনির খপ্পরে পড়েছে বলে যে খারাপ ফল হবে, তা নয়। একই কুম্ভ রাশির শতভিষা, ধনিষ্ঠা, ও পূর্বভাদ্রপদ—এই তিন নক্ষত্রের জাতক-জাতিকাদের আবার আলাদা ফল হবে। রুবাই এর মধ্যে গুগলে সার্চ দিয়ে জেনে নেয় যে সে কন্যালগ্ন এবং উত্তর ফাল্গুনী ও শ্রবণা নক্ষত্রের জাতিকা। কিন্তু উত্তর ফাল্গুনী বা শ্রবণা নিয়ে কারও কোনো মূল্যায়ন নেই।
ওদিকে তার লোন পাস হওয়ারও কোনো অগ্রগতি নেই। ব্যাংকের এক কর্মকর্তা এর মধ্যে পরোক্ষভাবে তার কাছে ঘুষ চেয়ে বসে আছে। অথচ এই ব্যাংকে তার লেনদেন নতুন নয়। রপ্তানির যাবতীয় কাজ সে এখান থেকেই করে আসছে। একদিন ওই কর্মকর্তা বলল, ‘আসলে ম্যাডাম, আপনার ব্যবসায় রিস্ক ফ্যাক্টর এত বেশি যে লোনের ব্যাপারটায় ব্যাংককে একটু বেশি চিন্তাভাবনা করতে হচ্ছে। বোঝেনই তো জলবায়ু পরিবর্তনজনিত বিষয়ে এ ধরনের ব্যবসা কত ঝুঁকিপূর্ণ! বিশ্বব্যাংকের ফান্ড থেকে একটা লোন দেওয়া হচ্ছিল, সেই লোন নিয়ে বেশির ভাগ ব্যবসায়ীই সফল হতে পারেনি। কিছুদিন পরপর পেপার কাটিংসহ দরখাস্ত করে বলে, প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে কত কত ক্ষতি তাদের হয়েছে।’
মোহাচ্ছন্নের মতো রুবাই ভিডিওগুলো দেখে। কখনো কখনো রাতভর জ্যোতিষীদের বকবকানি শোনে।
‘কিন্তু আমার লোনের পারপাস তো ভিন্ন’, প্রায় মরিয়া হয়ে বলে রুবাই।
‘ম্যাডাম, বোঝেন না কেন, রপ্তানিতেও আপনার ডিজাস্টার তো কম হয়নি।’
রুবাই বুঝতে পারে, এ–যাত্রা তার লোনটা ফেঁসে যাবে। কিন্তু একটা ভ্যালিড কাজের জন্য সে ঘুষ কেন দেবে? সে তো টাকা পাচার করছে না; বরং এই ডলার–সংকটের কালে দেশে ডলার আনছে। কিন্তু কে শোনে কার কথা!
রুবাই এবার গালভরা ভবিষ্যদ্বাণী নয়, আরও কার্যকর কিছু খোঁজে। এবার সে খোঁজ পায় বাস্তুশাস্ত্র, ফেংসুই ও রেইকি চিকিৎসার।
ইউটিউবে রেইকি মাস্টারদের রমরমা ভিডিও। এরই মধ্যে ভদ্রগোছের একজনকে রুবাই বেছে নেয়। রেইকিবার্তার ভদ্রলোক নানা স্পেল আর মন্ত্র দিতে থাকে। এর মধ্যে একটা হলো, খুব দ্রুত অর্থ হাতে আসার মন্ত্র। ৫২০ ৭৪১ ৮৮৯ ৮—এই সংখ্যাগুলো শরীরের বাঁ দিকে, পানির গ্লাসে, ডায়েরিতে লিখে রাখতে হবে; এবং মনে মনে জপ করতে হবে, তাহলেই দুই দিনের মধ্যে টাকা হাতে এসে যাবে। কিন্তু দুই দিন না, দুই মাসেও টাকা আসার কোনো লক্ষণ দেখা যায় না; বরং তার সব জমানো টাকা খরচ হয়ে যেতে থাকে। এরপর আসে বাস্তুদোষ কাটানোর পালা। রুবাই ততক্ষণে রণে ভঙ্গ দেয়। এত দিনে সে বুঝে গেছে যে এগুলো নিছক ব্যবসা। সে যত এসব ভ্লগ দেখতে থাকবে, তত তার সময় নষ্ট হবে। অন্যদিকে ভ্লগাররা ঠিকই ভিউ বাড়িয়ে বাড়াতে থাকবে নিজেদের রোজগার। মানুষের বিচিত্র সব ব্যবসায়িক বুদ্ধি রুবাইকে যেমন আশান্বিত করে, আবার বিপরীতে দ্বিধান্বিতও করে। অথচ অসংখ্য বক্রী শনিকে অতিক্রম করার শর্তেই না সে ব্যবসা করতে নেমেছিল! কিন্তু গোটা সিস্টেমটা যখন তার সামনে বক্রী, সেখানে সে কী-ইবা করতে পারে? কী করবে এখন রুবাই! বক্রী শনিকে সোজা করার জন্য পথটা একটু বাঁকা করবে? নাকি নেদারল্যান্ডসের ওয়েজেনিংগ্যান বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আসা মেইলটার জবাব দেবে!