থ্রিলার গল্প: এক রাতে
থ্রিলার গল্প: এক রাতে

থ্রিলার গল্প

এক রাতে

এপ্রিল, ১৯৯৯

রাত ১১: ৩০

ঘরটা যেমন অন্ধকার, তেমনই ধোঁয়াচ্ছন্ন।

পুব দিকের জানালার পাশের খাটে শুয়ে আছে আনিস। জানালার পর্দা ভেদ করে বাইরে থেকে সামান্য আলো ঢুকে পড়েছে ঘরে। আবছা আলোয় ফাঁকা দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে আছে সে। পরপর দুটো সিগারেট সাবাড় করার কারণে ধোঁয়ায় ভরে গেছে ঘরটা।

ঘরসংলগ্ন বাথরুম থেকে তোয়ালে দিয়ে ভেজা মুখ মুছতে মুছতে বের হয়ে এল কালচে অবয়বের একজন। ঘুমানোর আগে বাথরুমে গিয়ে হাত-মুখ ধোয়াটা তার স্বভাব।

‘সিগারেট...’ তোয়ালেটা আলনায় রেখে বলল যুবক।

গত বছর শীর্ষ সন্ত্রাসীর তালিকায় নাম ওঠার আগে থেকেই দেহরক্ষী নিয়ে চলাফেরা করে ফেরদৌস। আরও দুজন দেহরক্ষী আছে তার, ওরা সারা দিন থাকলেও রাতে সব সময় আনিসই থাকে। সিগারেটের প্যাকেটটা বাড়িয়ে দিলে সেখান থেকে একটা সিগারেট নিয়ে পশ্চিম দিকে নিজের বিছানার দিকে চলে গেল ফেরদৌস।

আনিস জানে এখন কী করবে এই ছেলে। প্রথমে বালিশটা সরিয়ে নিশ্চিত হয়ে নেবে যে সার্বক্ষণিক সঙ্গী পিস্তলটা আছে কি না, তারপর জানালার সামনে দাঁড়িয়ে চুপচাপ সিগারেট শেষ করবে। দরকার না হলে তেমন কোনো কথা বলবে না, ঘুমিয়ে পড়বে। একদম এপাশ–ওপাশ করবে না।

সেটাই হলো। বালিশ সরিয়ে পিস্তলটা দেখার পর জানালার সামনে চলে গেল ফেরদৌস। হাঁপ ছেড়ে বাঁচল আনিস। এটা নিয়েই বেশি ভয় ছিল তার মধ্যে।

এখন জানালার সামনে দাঁড়িয়ে সিগারেট খাচ্ছে ফেরদৌস। সাধারণত অর্ধেকের মতো খাওয়ার পর ফেলে দেয়, আজ সেটা করল না। দুই আঙুলের ফাঁকে সিগারেটটা রেখে জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে রইল একদৃষ্টে।

 ‘কী হইছে?’ প্রশ্নটা না করে পারল না আনিস।

 ‘কিছু না’ বলে চিন্তিত মুখে তার সামনে চলে এল ফেরদৌস। তার চোখেমুখে ভড়কে যাওয়ার চিহ্ন স্পষ্ট। সচরাচর এমনটা দেখা যায় না। ‘বাইরে একটা গাড়ি...দ্যাখো তো কাহিনি কী...আমার সন্দেহ হইতাছে!’

বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়াল দেহরক্ষী। তাদের জগতে সারাক্ষণই তটস্থ থাকতে হয় পুলিশকে নিয়ে। এর আগে বহুবার পুলিশ-রেইডের শিকার হয়েছে তারা। পুলিশের কারণেই এক জায়গায় বেশি দিন–রাত কাটায় না। বলতে গেলে দু-তিন দিন পরপরই জায়গা বদল করতে হয়। এই যে আজ মিরপুর ১৩ নম্বরের এই তিনতলা বাড়িতে এসেছে দ্বিতীয় দিনের মতো। ধরে নেওয়া যায়, এটাই শেষ রাতÑসব দিক থেকে!

জানালা দিয়ে বাইরে তাকাল আনিস। অন্য সব দিনের মতোই রাস্তাটা সুনসান আর নীরব। এখানকার কম বাড়িতেই পার্কিংয়ের সুবিধা আছে। তাই গাড়ির মালিকেরা বাড়ির সামনের রাস্তায় গাড়ি রাখে, তেমনি বেশ কয়েকটি প্রাইভেট কার পার্ক করে রাখা আছে রাস্তার ফুটপাত ঘেঁষে।

‘কোন গাড়িটার কথা বলতাছ?’ আনিস পেছন দিকে ফিরে তাকাল, কিন্তু আবছা আলোয় দেখতে পেল ফেরদৌস পিস্তল তাক করে রেখেছে তারই দিকে!

‘ক্-কী হইছে?’ ভয়ের একটা শিহরণ বয়ে গেল আনিসের শিরদাঁড়া বেয়ে। বালিশের নিচ থেকে তার নিজের পিস্তলটা কখন নিয়ে নিয়েছে, টেরই পায়নি।

‘কার কাছে বেচলা আমারে...নিজেরে?’

প্রশ্নটা অন্য যে কারও কাছে দুর্বোধ্য শোনালেও আন্ডারওয়ার্ল্ডের মানুষজনের কাছে নয়। ‘কী কও, তুমি?’ অবাক হয়ে জানতে চাইল আনিস। আবছা অন্ধকারেও ফেরদৌসের ক্রূর হাসিটা দেখতে পেল সে।

 ‘আমার পিস্তল ধরছ তুমি’, প্রশ্নের মতো শোনাল না কথাটা।

আরও একবার বিস্মিত হলো আনিস। ‘ভাই, তুমি আমারে ভুল বুঝতাছ...এই সব কী কও তুমি?’

‘আহ’, বিরক্ত হয়ে উঠল শীর্ষ সন্ত্রাসী। ‘ক্যান ধরছ?’

আনিস পুরোপুরি ধন্দে পড়ে গেল এবার, কী বলবে বুঝতে পারল না।

‘কে কিনল তোমারে...সেভেনস্টার...ফাইভস্টার?’ ফেরদৌস বলল। ‘নাকি অন্য কেউ?’

চুপ মেরে রইল আনিস। খুব কাছ থেকে দেখেছে, এই ছেলের সবচেয়ে বড় গুণ তার অসম সাহস নয়, বিপদের গন্ধ আগেভাগে আঁচ করতে পারা। এর ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় সম্ভবত অতিমানবীয় ধরনের। কেমন করে যে বিপদের গন্ধ পেয়ে যায়, আনিস আজও বুঝতে পারেনি, এখনো বুঝতে পারছে না।

 ‘নিজ থিকা সত্যিটা বললে শাস্তি কম হইব’, ফেরদৌস প্রস্তাব দেওয়ার ভঙ্গিতে বলল এবার।

দ্রুত ভেবে গেল আনিস। খুব বেশি দেরি করলে ফেরদৌসের মাথা গরম হয়ে যাবে। আর সেটা হলে তার কোনো সুযোগই থাকবে না। এরই মধ্যে তার বুকে হাতুড়িপেটা শুরু হয়ে গেছে। পাঁচ-ছয় বছর ধরে আছে এই জগতে। শুরু থেকেই বড় বড় সব গ্রুপকে টেক্কা দিয়েছে এই ছেলে। তারাও সুযোগ খুঁজে বেড়াচ্ছে, ওকে ঘায়েল করার জন্য। কিন্তু কয়েক বছরেও সাফল্য পায়নি। আজও তার ব্যতিক্রম হলো না। সম্ভবত তার মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়ে গেছে, এখন শুধু কার্যকর করা বাকি। যাদের প্রস্তাবে রাজি হয়ে আজ সে মরতে বসেছে, তাদের কেন রক্ষা করবে? দরকারটাই বা কী! অবশেষে গভীর করে শ্বাস নিয়ে নিল আনিস।

 ‘সবতে!’

অবাক হলো তার দিকে অস্ত্র তাক করে রাখা যুবক।

 ‘সবাই মিইল্যা ট্যাকা দিছে।’

ফেরদৌসের মুখে প্রশান্তির হাসি দেখা গেল। তার শত্রুদের এভাবে জোট বাঁধতে দেখে একধরনের গর্ব অনুভব করছে সে। ‘জঙ্গলের সবগুলান জানোয়ার এক হইছে!’ তৃপ্তির সঙ্গে বলল ফেরদৌস। ‘কত টাকা দিছে ওরা?’

ঢোক গিলল মৃত্যুপথযাত্রী। ‘দশ লাখ’। তার কণ্ঠস্বর ক্ষীণ আর ভঙ্গুর।

 ‘অ্যাডভান্স দিছে কত?’

 ‘দ্-দুই।’

গভীর করে শ্বাস নিল ফেরদৌস। এই ছেলেকে প্রতি মাসে হাতখরচের জন্য পনেরো হাজার টাকা দেয় সে। এ ছাড়া সময়ে–অসময়ে যখনই দরকার পড়ে, বিশ-ত্রিশ হাজার দিতে কার্পণ্য করে না। এমন সোনার ডিম পাড়া হাঁস মেরে একসঙ্গে এই পরিমাণ টাকা নেওয়ার মতো বোকা আনিস নয়। ‘অন্য কাহিনি আছে। তুমি খালি টাকার জন্য রাজি হও নাই।’

আলতো করে মাথা নাড়ল আনিস। কথাটা অসত্য নয়। ‘ওরা কইছে আইজ হোক, কাইল হোক তুমি মরবা...লগে আমিও!’

মুচকি হাসল অস্ত্রধারী। একদিক থেকে কথাটা সত্যি,Ñপ্রতিটি জীবিত প্রাণীকেই মৃত্যুবরণ করতে হয়। ‘এই টাকা নিয়া তুমি কী করবা?’

ভারী করে দীর্ঘশ্বাস ফেলল দেহরক্ষী। ‘ভাবছিলাম মিডল ইস্টে চইল্যা যামু।’

এবার ফেরদৌসের ভেতর থেকে একটা দীর্ঘশ্বাস বের হয়ে এল। তাদের লাইনে সবচেয়ে বিপজ্জনক হলো এসব পলায়নবাদী লোকজন। প্রতিপক্ষের কাছে সহজ শিকারে পরিণত হয় এরা।

 ‘এইটা কোনো লাইফ না’, মাথা নিচু করে আক্ষেপে বলল আনিস। ‘সব সময় পলাইয়া থাকতে হয়, ভয়ে থাকতে হয়...আমি আর পারতাছিলাম না!’ দুচোখ ভিজে গেল তার।

চুপচাপ শুনে গেল শীর্ষ সন্ত্রাসী ফেরদৌস, যেন তার নিজের অন্তরাত্মা কথাগুলো বলছে। ঘরে নেমে এল কয়েক মুহূর্তের নীরবতা।

মুখ তুলে তাকাল আনিস। ‘আমারে মাফ কইরা দিয়ো, ভাই!’ নিঃশব্দে গড়িয়ে পড়ল তার অশ্রু।

‘তোমার জানতে ইচ্ছা করতাছে না, আমি কেমনে বুঝলাম?’ স্থিরচোখে তাকিয়ে থেকে বলল ফেরদৌস।

এবার ঢোক গিলল দেহরক্ষী। সত্যি বলতে খুব জানতে ইচ্ছে করছে। যেহেতু তার নিয়তি ঠিক হয়ে গেছে, পৈতৃক জীবনটা নিয়ে এ ঘর থেকে আজ আর বের হতে পারবে না, মরার আগে কৌতূহলটা মেটাবে কি? ‘ক্-ক্যামনে জানলা, ভাই?’ সামান্য তোতলাল সে।

পরিহাসের হাসি ফুটে উঠল ফেরদৌসের ঠোঁটে, আলতো করে মাথা দোলাল সে। সতর্কতাকে স্বভাবে পরিণত করেছে। তার সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ লোকটিও জানে না, বালিশের নিচে সব সময় পিস্তলটা এমনভাবে রাখে যেন ডানহাত দিয়ে একথাবায় সেটার বাঁট ধরে গুলি করতে পারে। ও রকম দরকারি মুহূর্তে এক সেকেন্ডও অনেক মূল্যবান। তার এই ছোট্ট সতর্কতার বাড়তি একটা সুবিধাও আছে, অন্য কেউ তার অনুপস্থিতিতে পিস্তলে হাত দিলে সে বুঝে ফেলে। যেমন আজ বুঝতে পেরেছে যে পিস্তলটার বাঁট একেবারে বিপরীত দিকে ছিল! লম্বা করে শ্বাস নিল সে। কঠিন একটা সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছে, পিস্তল রাখার এই ব্যাপারটা বাঁচিয়ে রাখবে!

 ‘ওইটা তোমার জানার দরকার নাই।’

স্থিরচোখে তাকিয়ে রইল আনিস। তবে কি সে এ যাত্রায় বেঁচে গেল?