অলংকরণ: আহসান হাবীব
অলংকরণ:  আহসান হাবীব

গল্প

তরমুজ

গত বছর তরমুজ কিনতে গেলাম। তরমুজওয়ালা তরমুজের পাহাড়ের মধ্যে টকটকে লাল গেঞ্জি পরে বসে আছে। কম্বিনেশনটা চমৎকার। বললাম:

—ভাই, আপনার তরমুজ মিষ্টি হবে?

—ছার, আপনার ডায়বেটিস আছে?

আমি একটু অবাক হলাম তাঁর পাল্টা প্রশ্নে।

—আছে।

—তাইলে ছার এই তরমুজ কিইনেন না।

তরমুজওয়ালার সেন্স অব হিউমারে মুগ্ধ হয়ে তরমুজ কিনে বাড়ি ফিরলাম।

এ বছর সেই একই লোক। পাঁচ নম্বর ফুটবলের চাইতেও ছোট একটা তরমুজ দেখিয়ে বললাম, কত?

—আট শ টাকা।

—আমি একটা কিনব। একটার দাম বলেন।

—একটাই আট শ।

—মানে?

—কেজিপ্রতি এক শ। সেই হিসাবে এই তরমুজের দাম ছার আট শ।

তরমুজের দাম শুনে কারও মাইল্ড স্ট্রোক হয়েছে এমন শুনিনি, মনে হলো আমার বোধ হয় হয়ে যাবে। তরমুজ না কিনে বুকে হাত দিয়ে কোনোমতে বাড়ি ফিরে এলাম। একটা বছর তরমুজ না খেলে কী হয়?

তবে সপ্তাহ দুয়েকের মধ্যে তরমুজবিষয়ক সিনারিও যেন উল্টে গেল, যাকে বলে আপসাইড ডাউন। সবাই যেন আমার মতো ভাবতে লাগল, একটা বছর তরমুজ না খেলে কী হয়?

তরমুজ নিয়েই হঠাৎ একটা জোক মনে পড়ে গেল। এক তরমুজ ব্যবসায়ী। তার তরমুজ যেন চুরি না হয়, সে জন্য তরমুজখেতে একটা সাইনবোর্ডে লিখে রেখেছে, ‘এই তরমুজের খেতে একটি তরমুজে বিষ মেশানো আছে।’ দুই দিন পর ওই সাইনবোর্ডের নিচে আরেকজন লিখে দিল ‘আপামর জনসাধারণের স্বার্থে...দ্বিতীয় একটি তরমুজেও বিষ মেশানো হয়েছে...।’ পরে সেই তরমুজ ব্যবসায়ীর কী অবস্থা হয়েছিল জানা যায়নি। তবে ঢাকার তরমুজ ব্যবসায়ীদের কথা এবার জানার চেষ্টা করা যেতে পারে।

সেই একই তরমুজওয়ালা তরমুজের পাহাড়ের পাদদেশে বসে আছে। এই দুই সপ্তাহে তরমুজের পাহাড় এক ইঞ্চিও নিচে নামেনি। আজ সে পরে আছে সবুজ রঙের একটা গেঞ্জি। তার নোয়াপাতি পেটটাকেও মনে হচ্ছে যেন একটা তরমুজ। সেখানে আঙুলে গোঁত্তা দিয়ে এক রসিক কাস্টমার বলল, ‘কী হে তোমার তরমুজ এত নরম কেন? পচা শুরু হইছে নাকি...?’

তরমুজওয়ালা মিনমিন করে বলল: ভাই কি মজা লন নাকি?

—মজা নিব কেন? তুমি তো ফেরাউনের সমকক্ষ হে। মিসরের সম্রাট ফেরাউনেরও নাকি তরমুজের ব্যবসা ছিল। তাঁর লোকজনও কেজি দরে তরমুজ বিক্রি করত। তিনি নিজেও ভীষণ তরমুজ পছন্দ করতেন।

তরমুজওয়ালা প্রাচীন মিসরীয় ইতিহাসের দিকে গেল না। বলল: একটা তরমুজ লন ছার, বিশ টাকা কেজি।

রসিক কাস্টমার মাথা নাড়ল।

—তুমি কি জানো, ওই তরমুজপ্রিয় সম্রাট ফারাওয়ের (আরবরা বলে ফেরাউন) মমি প্যারিসে নেওয়া হয়েছিল ট্রিটমেন্টের জন্য। ফ্রান্সের বিমানবন্দরে এই তরমুজপ্রিয় মমি সম্রাটকে গার্ড অব অনার দেওয়া হয়েছিল। হোক না মমি, সম্রাট তো বটে। তা–ও আবার সভ্যতার সূতিকাগার প্রাচীন মিসরের।

—ছার, একটা তরমুজ লন...তিন লাখ টাকা লসে আছি।

তরমুজওয়ালা ঘ্যান ঘ্যান করে। সেই রসিক কাস্টমারও ইতিহাস নিয়ে ঘ্যান ঘ্যান করেই যাচ্ছে।

—তোমরাও তো সেই সম্রাটের তরমুজকেই গার্ড অব অনার দেওয়ার উচ্চতায় নিয়ে গিয়েছিলে সপ্তাহখানেক আগে। নামালে কেন? বলবে...??

তরমুজওয়ালা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে কী কমু ছার, এক মাঘে তো শীত যায় না...বলে, আমাদের দিকে তাকায়। মাঘ মাস চলে গেছে কবে, তারপরও আমার কেমন যেন শীত শীত লাগে।