হেমন্তের রাতগুলোতে একা আর অসহায় লাগে রোকনের। এমন নয় যে কোনো অসুখ করেছে বা দুর্ঘটনার পর যন্ত্রণায় সে ঘুমাতে পারে না। অসুখ ও অভাব পাশ কাটিয়ে এক অদ্ভুত ব্যথাভার তার মনোজগৎ আচ্ছন্ন করে রাখে।
শীতকালে বিকেলটা গাঢ় হওয়ার আগেই ঝুপ করে সন্ধ্যা নেমে পড়ে। ক্রমশ রাত নামে। শেষ হেমন্তের গা–শিরশিরে ঠান্ডায় পাশের ঘরে ফ্যান চলছে। ল্যাপটপে তামিল সিনেমা দেখছিল রোকন। আচমকা বিরক্তিতে কপাল কুঁচকে আসে।
ঢাকা শহরে এক পরিবারের সঙ্গে সাবলেট থাকে রোকন। তিন রুমের ফ্ল্যাট, যে লোক সাবলেট দিয়েছে, বউ-বাচ্চা নিয়ে তার দুই রুমের সংসার। রোকন অ্যাটাচড বাথরুমের আলাদা ঘরে থাকে, একা।
ছাপোষা চাকুরে লোকটা অফিস শেষে ঘরে রান্না করে খায়। খাওয়া-ঘুম-চাকরির বাইরে তার কোনো জগৎ নেই। লোকটার বউ চার মাস পর গ্রামের বাড়ি থেকে আজই দুপুরের ট্রেনে এসেছে। ওদের ঘর, ওদের ইউটিলিটি বিল, সুতরাং যখন ইচ্ছা ফ্যান ছাড়তেই পারে। কিন্তু ফ্যানটার সমস্যা হয়েছে, অদ্ভুত শব্দ করে।
সিনেমায় এখন মারপিটের দৃশ্য। তামিল সিনেমার এই এক জিনিস। এমন টানে যে এড়ানো যায় না। সেই মুহূর্তে রোকনের কান খাড়া হয়ে গেল। দরজার কাছে না গিয়েই সে টের পায়, পাশের ঘরের খাটের অদ্ভুত শব্দ। কান গরম হয়ে যায়। ল্যাপটপে সাউন্ড বাড়িয়েও সহজ হতে পারে না।
এমন রাতে সিনেমায় মন লাগে, না ঘুম আসে?
প্যান্ট পরেই ছিল। টি–শার্ট গায়ে জড়িয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে পড়ে রোকন। ১১টা ৩২। একটু শীত–শীত লাগে।
দিলু রোডের বাসা থেকে বেরিয়ে সে হাঁটতে থাকে।
বউ চলে গেছে রোকনের। সে অনেকেরই যায়। মেয়েরা ঘর ছেড়ে বেরোলে আবার ফিরেও আসে। বেশির ভাগই ফেরে না। বউ চলে যাওয়ায় আনন্দ হওয়ার কথা। জীবনটাকে নরক বানিয়ে ফেলেছিল মেয়েটা। গেছে, খুব ভালো হয়েছে। কিন্তু ভালো সে বোধ করছে না। চোরাটানের মতো একধরনের কাতর অনুভূতি নিয়ে সে বসে আছে। অথচ হওয়ার কথা ছিল উল্টো। করপোরেট অফিসে ভালো জব করা পুরুষ, দেখতেও খারাপ নয়; তার লে হালুয়া জীবন কাটানোর কথা। অথচ সে কী বেকুব, বিরহী জীবনের ফাঁদে আটকে গেছে।
স্নান সেরে বেরোনোর পর মায়াকে ঘরের মানুষের মতো লাগে। রোকন সহজ হয়ে হাসে। ‘আমার না খুব ক্ষুধা লেগেছে।’ বাইরে মেয়েটা ‘স্যার’ বলে সম্বোধন করেছিল। এখন কী অবলীলায় তুমি করে বলছে।
ইস্কাটন রোডের মুখে একটা রিকশা পেয়ে যায়।
সোনারগাঁওয়ের পাশ দিয়ে রিকশা কারওয়ান বাজারের দিকে ছুটে চলে।
মামা, কোন দিকে যাব?
ফার্মগেট পেরিয়ে একসময় মানিক মিয়া অ্যাভিনিউয়ে রিকশাটা ঢুকে পড়ে।
সে নেমে পড়ে।
অনেক পরে যখন সবকিছু স্বাভাবিক আর স্তিমিত হয়ে আসে, কেউ কিছু মনে রাখে না। দুঃখ, ঈর্ষা কিংবা সন্দেহ—সব ফিকে হয়ে যায়।
মানিক মিয়া অ্যাভিনিউ ধরে হাঁটতে হাঁটতে কথাগুলো মনে আসে রোকনের।
সংসদ ভবনের সামনের পথটা ফাঁকা, নির্জন, অনাথের মতো পড়ে আছে। হঠাৎ একটা–দুটো গাড়ি শাঁই শাঁই করে বেরিয়ে যায়।
সাবধানে রাস্তা পেরিয়ে ফুটপাতে এসে বসে রোকন, অনর্থক। একবার আকাশে তাকায়। আকাশ দেখতে দেখতে সে একসময় শুয়েই পড়ে। তার কেবলই মনে হয়, কী বিশাল আকাশ। তার নিচে আমি কত ক্ষুদ্র মানুষ। কত ছোট আর তুচ্ছ।
মানুষের ভিড় ও কোলাহলে জায়গাটা গমগম করে। এখন আশ্চর্য নীরব।
সে ভূতগ্রস্তের মতো বসে থাকে। একটা সিগারেট ধরাতে ইচ্ছা করে। ভয় হয়, টহল পুলিশ এসে কৈফিয়ত না চায়—এই মিয়া, এত রাতে এখানে কী করেন?
না, কেউ নেই কোথাও।
‘স্যার, চা খাবেন?’
অল্পবয়সী টোকাই বা হাড়–জিরজিরে কোনো লোক চা নিয়ে এসেছে।
প্রথমে এমনই ভেবেছিল রোকন, কিন্তু তা নয়। একটা মেয়ের কাছে চায়ের কথা শুনে সে ভড়কে যায়। বোরকা পরা একটা মেয়ে অদূরে দাঁড়িয়ে আছে। তীব্র চোখ দুটো ছাড়া কিছুই দেখা যায় না।
‘স্যার, চা খাবেন?’ মেয়েটি আবার বলে।
কথার ভঙ্গিতে বোঝা যায় না মেয়েটা কোন অঞ্চলের। শুদ্ধ ও পরিষ্কার উচ্চারণ। ভাষায় এতটুকু আঞ্চলিক টান নেই।
‘না, থাক।’
‘চা না খেলে অন্য কিছুও খেতে পারেন।’
মেয়েটা পায়ে-পায়ে এগিয়ে আসে। দূরত্ব রেখে রোকনের পাশে বসে পড়ে।
‘কী ব্যাপার বলুন তো?’ রোকন জিজ্ঞেস করে।
‘যাবেন?’
‘কোথায়?’
‘আপনি যেখানে আমাকে নিয়ে যাবেন।’
মুহূর্তেই রোকনের কাছে সবকিছু পরিষ্কার হয়ে যায়। ‘না, না, আপনি যা ভাবছেন, তা নয়। ভুল হচ্ছে কোথাও।’
মেয়েটা তেরছা চোখে তাকিয়ে হেসে ওঠে। ‘শোনেন ভাই, লজ্জা পাওয়ার কিছু নেই। রাত হয়েছে। যদি মন চায়, চলেন।’
পাশ ফিরে তাকিয়েও রোকন চোখ ফিরিয়ে নেয়।
‘আপনি মশাই আজিব লোক। প্রথম থেকেই আপনাকে ফলো করছি। দুটো মেয়ে আপনার সামনে দিয়ে গেল-এল, খেয়ালই করলেন না? আশ্চর্য।’
রোকন নীরব। কথাহীন।
‘আপনি কবি, নয়তো শিল্পী। শিল্পীরা এমন রাত জেগে ঘুরে বেড়ায়।’
সাড়া দেবে না ভেবে গাঁট হয়ে বসে থাকে রোকন। কিন্তু মেয়েটার আবেদন এড়াতে পারে না।
...রিকশা থেকে নামার পর বাসার গলিতে ঢোকার সঙ্গে সঙ্গে মেয়েটা বোরকা খুলে ফেলে। রোরকার নিচে তাঁর টাইট জিনস ও কামিজ পরা ঢেউখেলানো শরীর; ভয়াবহ সুন্দর।
গেট বন্ধ হয়ে গেছে।
সাবধানে তালা খুলতেই মেয়েটা তাকে ঠেলে ভেতরে ঢোকে।
তিনতলায়; রোকন ফিসফিস করে। কেউ টের পেলে কেলেঙ্কারি হয়ে যাবে।
তালা ঝুলিয়ে দুজনে সিঁড়ি বেয়ে উঠতে থাকে। সামনে মেয়েটা। তার রহস্যময় হাসি, সিঁড়িভাঙা, ভারী নিতম্বের ঢেউ দেখে সে বিচলিত হয়। মনে হয়, মেয়েটা নির্বোধ গণিকা নয়। বয়স কম, তবু শরীরের আবেদন ভয়াবহ।
‘এত ভয় পাওয়ার কী আছে! এসো’—বলেই মেয়েটা রোকনের বাহুটা বুকের সঙ্গে চেপে ধরে। রোকন থরথর করে কেঁপে ওঠে।
অনেক দিন আগে পরান মাস্টারের বেহালা শুনে রোকন খুব কেঁদেছিল। বেহালার সুরে লোকটা জাদু মাখিয়ে দেয়, বুকটা কেমন টাটায়। কত দিন সে হাসে না। কাঁদেও না। মন খুলে কথা বলে না। এই অনিশ্চয়তার রাতে সে আবেগাপ্লুত হয়ে পড়ে। তার চোখ দুটো ভিজে যায়।
সিঁড়ি ভাঙার সময় রোকনের ভেজা চোখ কি দেখে ফেলে মেয়েটা?
ঘরে ঢুকতেই সে রোকনের বুকের সঙ্গে লেপটে থাকে। অদ্ভুত নরম একটা ঘ্রাণ ওর শরীরে। কী পারফিউম মাখে সে, একবার জিজ্ঞেস করতে হবে।
দরজা বন্ধ করতেই মেয়েটা ঘরময় পায়চারি করে। ‘তোমার ঘরটা তো খুব সুন্দর। একটু অগোছালো, এই যা। খাট ও মেঝেতে বই, খাবারের প্যাকেট, ফুলদানি, অ্যাশট্রে। তার চেয়েও এলোমেলো তোমার মন।’
‘আমার আসলে বউ চলে গেছে।’
কথাটা বলার পর মেয়েটির মুখ ফাল্গুনের বিকেলের মতো কোমল হয়ে আসে। সে কাছে এসে রোকনের হাত ধরে। ‘আমার নাম মায়া; নাম তো একবারও জানতে চাইলে না।’
এবার ভালো করে মেয়েটাকে দেখে রোকন। শান্ত ও ভাসা-ভাসা চোখ। খাড়া নাক। ববকাট চুল। মুখটা ফরসা দেখাচ্ছে, তবে মেয়েটা শ্যামলা। বুকটা এত তীব্র যে সরাসরি তাকানো যায় না।
‘একটা মানুষের অভাবে সব শেষ হয় না, বুঝলে তো। জীবনের কিছুই ফুরোয় না।’
রোকন হাসে। হাসতে হাসতে সে একটা দীর্ঘশ্বাস আড়াল করে।
বাথরুম থেকে ফ্রেশ হয়ে বেরোতেই চমকে যায় রোকন। ঘরটা পরম যত্নে চমৎকার সাজিয়ে ফেলেছে মেয়েটা।
তোয়ালে নিয়ে বাথরুমে ঢুকে যায় মায়া। একটু পরেই ঝরনার শব্দ। গুনগুন গানের আওয়াজও শোনা যায়। সে কি স্নান করছে?
‘তোমার একটা শার্ট দাও না, প্লিজ?’ বাথরুমের দরজা একটু ফাঁক করে বলে মায়া।
‘তুমি গোসল করছ নাকি?’
‘হুম। জামাটা ভিজিয়ে ফেলেছি। মনে ছিল না।’
স্নান সেরে বেরোনোর পর মায়াকে ঘরের মানুষের মতো লাগে। রোকন সহজ হয়ে হাসে।
‘আমার না খুব ক্ষুধা লেগেছে।’
বাইরে মেয়েটা ‘স্যার’ বলে সম্বোধন করেছিল। এখন কী অবলীলায় তুমি করে বলছে। রোকনের লম্বা শার্টে সুন্দর লাগে মেয়েটাকে। ভেতরে কিছু পরেনি বলে ভারী বুকটা দুলে উঠছে।
ওভেনে খাবার গরম করে মায়াকে খেতে দেয়।
ল্যাপটপে কিছু একটা কাজে মন দেয় রোকন। বলে, ‘কফি খাবে?’ মাথা দুলিয়ে আদুরে ভঙ্গিতে সে মাথা নাড়ে।
খাওয়া শেষে দুজনে বিছানায় মুখোমুখি বসে। মায়া রোকনের হাত ধরে।
সেই মুহূর্তে একটা ফোন আসে রোকনের। সে বারান্দায় চলে যায়। লম্বা সময় ফোনে কথা বলে।
ঘরে ফিরে সে অবাক। মেয়েটা বিছানায় ঘুমিয়ে পড়েছে। মুখটা দেখে খুব মায়া হয়, যেন কত দিন সে ভালো করে ঘুমায় না।
শার্টটা খুলে ফেলেছে মায়া। বুকের ওপর ওড়নাটা আড়াআড়িভাবে রাখা। নিশ্বাসের তালে তার খাড়া বুক ওঠানামা করছে। রোকনের হার্টবিট বেড়ে যায়। সে কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে।
মায়াকে সে আর জাগায় না।
ভোরের দিকে ঘুম ভেঙে যায় রোকনের। অন্ধকারেও টের পায়, সে সোফায় শুয়ে আছে। ‘আমি এখানে কেন?’ ভাবতেই মেয়েটির কথা মনে পড়ে।
ল্যাপটপ ও মানিব্যাগ চুরি করে মায়া পালিয়ে যায়নি তো? টেবিলে খামের ভেতর কিছু টাকাও ছিল।
লাইটটা একবার জ্বেলেই সে নিভিয়ে দেয়।
মায়া গভীর ঘুমে তলিয়ে আছে। সুস্থ ও স্বাভাবিক মানুষ হলে ঘর লুট করে পালিয়ে যেত।
সে কি তাহলে অসুস্থ?
প্রশ্নটা মনের ভেতর ঘুরপাক খায়, উত্তর মেলে না।
মেয়েটাকে এমন করে ভেবে নিজের কাছেই লজ্জা লাগে।
একবিকেলে সংসদ ভবনের সামনে দাঁড়িয়ে ছিল রোকন। জীবনে কোথাও না কোথাও মানুষকে দাঁড়াতে হয়। অপেক্ষা করতে হয় নতুন কোনো সূচনার। সেই দাঁড়ানোটা তেমন নয়, সে আসলে অপেক্ষা করছিল। বন্ধুর বিয়ের অনুষ্ঠানে যাবে উত্তরায়। গাড়ি এসে ওকে তুলে নেবে।
হঠাৎ সে দেখে, তাকে ছেড়ে চলে গেছে যে বউ, স্মৃতি হয়ে যাওয়া সেই প্রাক্তন রিকশা থেকে নামল। সঙ্গে এক সুদর্শন পুরুষ। বউটা রোকনের কাছে আসে।
‘কেমন আছ তুমি?’
এ পর্যন্তই কথা থেমে থাকে। কথা মুখ বাড়ায়। কথা খুব একটা এগোয় না।
রোকনের গলাটা কি সামান্য কেঁপে ওঠে? সে চোখ সরিয়ে নেয়।
অদূরে একটা মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে, ঠিক মায়ার মতো দেখতে। মেয়েটা এগিয়ে আসে না। কথা বলে না। বরং খানিকটা সরে যায়।
পুরোনো বউটা বিদায় নেয়।
কিছুই হয়নি, এমন ভঙ্গিতে মায়া সামনে এসে দাঁড়ায়। রোকন বলল, ‘তোমাকে তো দেখলাম। কথা বললে না যে?’
‘তোমার বউ যদি সন্দেহ করে, ভুল বোঝে তোমাকে?’
‘বউ, আমার? কোথায়?’
ঠোঁটে কী রকম একটা অদ্ভুত ভঙ্গি করে মায়া বলল, ‘বউ না হোক গার্লফ্রেন্ড তো।’
রোকন কথা বলে না। চারপাশে এত মানুষ ও কোলাহল। সে কিছু একটা ভাবে। দ্বিধা ও সংকটে ভাবনারা এগোতে পারে না।
রোকন নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে আকাশে চোখ রাখে। যেন সে কবি, চোখমুখের রং দেখে সে রকমই মনে হয়। আদৌ তা নয়। সে নির্নিমেষ তাকিয়ে থাকে, যেন কতকাল আকাশ দেখেনি।