অলংকরণ: আরাফাত করিম
অলংকরণ: আরাফাত করিম

গল্প

এবং কালমুড়ি

সখিনা বিয়ের আগে এ গ্রামে কখনোই আসেনি। ওদের হরিপুর গ্রামে টাঙন নদ। সে নদীর পাশে ওর বাবা কৃষিকাজ করত বটে, কিন্তু সখিনা আগে থেকেই গায়ে খাটা মজুরি পছন্দ করত না। ওর কালো পেটা শরীরটাকে সেই বয়সে সবাই ঘুরে ঘুরে একবার করে দেখত। এমনই ওর গর্ব। সে গর্ব নিয়েই মজিদ মিয়ার বিবি হয়ে এ গ্রামে আসে। কিন্তু এসেই দেখে এ গ্রামের একটাই মন্ত্র—কাজ আর কাজ! কাজ ছাড়া অন্য কিছুর ভাবনা ভাবতে গেলেই পিছিয়ে পড়তে হবে সবকিছু থেকে। এ গ্রামে অল্পবয়সী বধূরা বছর বছর কাজের চাপাচাপিতে বেসামাল হয়ে শেষ পর্যন্ত সহ্য করতে না পেরে স্বামী-সংসার, ঘরদোর, জমিজিরাত ফেলে বাপের বাড়িতেই নাকি ফিরে যায়। এ কাহিনি সখিনা এ গ্রামে এসেই জানতে পেরেছে। এ–ও জেনেছে, অনেকে আবার কাজের চাপে শরীরে রোগের মালা পরিধান করে জগৎ-সংসার চিরদিনের মতো ছেড়ে চলে গেছে। কে আর হিসাব রাখে কার!

চৈত্রের খাঁ খাঁ নিদাঘদুপুরে কঙ্কালসার গাছগাছালির শাখা-প্রশাখায় নবকিশলয় উঁকিঝুঁকি মারছে। রাস্তার ডান পাশজুড়ে বাঁশবন। সে বনের মাথার ওপর চৈত্রের ঘনঘোর দাবদাহের দুপুরে ঘষা শ্লেটের মতো আকাশজুড়ে ইতিউতি উড়ছে কয়েকটা চিল। ক্লান্ত এ দুপুরে চি-হি-হি-হি করে চিৎকার করছে চিল। যত সামনে বাড়ছে, ততই অদ্ভুত পরিবেশ। গাছ-লতা-বাঁশবনের প্রকাণ্ড আলো-আঁধারির খেলা দেখে মন শিউরে ওঠে। বড় বড় রেইনট্রিগুলো চারদিকে ছড়িয়ে দিয়েছে ওদের ডালপালা; সেগুলোর ফাঁকে ফাঁকে শিমুলগাছগুলোয় রক্তলাল ফুলের সমারোহ। তার মধ্যে ঘোটকো আর টিয়াপাখির ওড়াউড়ি। নিচে মানুষের বিশ্রামহীন কাজের চাপ। সারা দিন হইহই-রইরই—এমনই গ্রাম বাজনাহার।

মজিদ মিয়ার সঙ্গে অবশ্য সখিনা মানিয়ে নিয়েছিল। কিন্তু বাদ সাধল ভাগ্য। কয়েক দিনের মধ্যেই ক্ষয়রোগে মারা যায় মজিদ। সখিনার জীবনে ঘটল উল্টো ঘটনা। সংসার ছেড়ে সে পালাবে কি, উল্টো স্বামীই পালাল পরকালে। মজিদ মিয়া মানুষের জমিতে আধির কাজ করত। ইতিমধ্যে সখিনার মেয়ে জমিলার বয়স পাঁচ মাস। ওই বয়সেই মজিদ মিয়া মারা যায়। এভাবেই স্বামীর ভিটায় কোনোমতে মেয়ে জমিলাকে নিয়ে জীবন কাটাতে থাকে সখিনা। একদিন নষ্ট মেয়ের অপবাদ জুটে যায় তার কপালে। তবু জীবন থেমে থাকে না। মেয়েকে পরিচর্যা দিয়ে বড় করে তুলতে থাকে সখিনা। সেই জমিলার বয়স এখন ১৬ বছর।

ইদানীং সখিনার চোখে ঘুম কমে গেছে। রাত পোহানোর সঙ্গে সঙ্গে ঘুম থেকে উঠে ঘর থেকে ছাগলটা বের করে ঘরদোর ঝাড়ু দিয়ে পরিষ্কার করে ধান কাটার প্রস্তুতি নেয়। ওর কাজের নানা শব্দে জমিলার ঘুম ভেঙে যায়।

‘কী হলো, আইত্ পোহাইল্ কত আগত্, এখনো নিনেই ভাঙ্গে না তোর? মোর যত জ্বালা!’

জমিলা আরেকটু পর উঠেই বাসনকোসন ধুয়ে, ঘরদোর–উঠান পরিষ্কার করে উত্তরের তালপুকুরে হাতমুখ ধুয়ে পান্তাভাতের সঙ্গে শুকনা মরিচ আর তেল–নুন মেখে ঝটপট খেয়েই বুক থেকে কোমর পর্যন্ত ওড়না বেঁধে ওর মা সখিনা যেদিকে ধানখেতে কাজ করছে, সেদিকে রওনা দেয়। মাথায় ঘুরপাক খায়, দুপুরের আগে বাড়িতে ফিরে রান্না করতে হবে।

খেত থেকে ফিরে মায়ের জন্য রান্নাবান্না শেষে বিকেলবেলা জমিলা কাঠের তক্তপোশে খানিকটা বিশ্রাম নিতে থাকে। হঠাৎ বাড়ির পাশ দিয়ে নেপাল আসছে গান গাইতে গাইতে। ওর কণ্ঠ শুনে জমিলা দরজা পেরিয়ে বাইরে বেরিয়ে আসে।

‘কুন্ঠে যাছি নেপালদা?’

‘এই তো এংনা ঘুরি বেড়াছোঁ।’

‘ ও...’

‘তুঁই কী করছি?’

‘তোর মতোন তো মোর আর ঘুরি বেড়াবার সময় নাই। ঘরের কামগুলা সারি এই এংনা জিরাই নেছোঁ আরকি।’

‘তোর মা কুন্ঠে?’

‘ওই চৌধুরীর ধানবাড়ি গেইছে। সইন্ধ্যার পর বাড়িত্ আসিবে।’

‘ও আচ্ছা, তাহিলে মুই গেনু।’

‘এত তাড়াহুড়া কর্ছি কেনে? গরিবের বাড়িত্ যখোন আইছি, এংনা বইসেক্। ঘরত্ বসিবা দেছোঁ।’

‘না, থাউক্। অইন্য দিন দেখা যাবে।’

‘ও, হামরা গরিব মানুষ তো। সেই তনে বসিবা চাহেন না।’

‘না, না, সেইটা নাহায়।’

‘তাহিলে?’

‘মোক্ শরম নাগেছে।’

‘শরমের কী আছে? আইছেন যখন, ঘরত্ এংনা বইসো।’

‘না, না। ফের মোক্ ভয় নাগেছে।’

‘ভয় কিসের?’

‘এমনিই ভয় নাগেছে।’

‘আর, হামার নামে কত বদনাম! নিন্দা, কানাঘুঁষা! মোর মার নাকি স্বভাব খারাপ। আইতে-বেরাইতে যেইঠে-সেইঠে যাছে শুতিবা!’

‘ছি! এইলা কেমন কথা কহেচেন?’

‘হ্যাঁ, এইলাই হামাক্ শুনিবা হোচে মানুষেরঠে।’

‘তোর কথার সাথত্ মুঁই পারিম নাই। চল্ তাহিলে ঘরোত্ চল্। তোর তো ফের জাইত্ যাবে নাই?’

‘হামরা গরিব মানুষ, হাতে করি পেটে খাই। হামার জাত-পাতের কী আছে? এইলা ভয় হামরা করি না।’

জমিলা নেপালকে ঘরে নিয়ে এসে তক্তপোশে বসায়। তারপর আহ্লাদে বলে, ‘নেপালদা এংনা বইস্। মুঁই মুড়ি নিয়াইসোঁ।’

‘না, না। মুঁই মুড়ি খাম্ নাই।’

‘আচ্ছা বইস্।’ বলেই জমিলা লালের মোড়ে মুড়ি কিনতে যায়।

জমিলা বিকেলের চিকচিকে রোদে লালের দোকানের দিকে যায়। পেছনে পেছনে বাড়ির ছাগলটা। এই বিকেলেও কী কড়া রোদ! দূরে মাঠে কাজ করছে কৃষক। রাস্তা দিয়ে দু–একজন ব্যাপারী কাঠের ভাঁড় নিয়ে বাজারে যাচ্ছে। জমিলা এক অজানা পুলক নিয়ে লালের দোকানে এসে দাঁড়ায়। সেখানে আমি আর শ্রীপতিদা বসে চা খাচ্ছি। জমিলাকে দেখে আমার নজর যায় সেই দিকে। শ্রীপতিদা জমিলার সঙ্গে কথা বলে, ‘কী নিবা? আলু?’

‘মুড়ি।’

‘তোর মা কুন্ঠে?’

‘চৌধুরীর ধানবাড়িত্।’

পূর্ণচোখে জমিলাকে দেখে শ্রীপতিদা। জমিলা চলে গেলে বলে, ‘ওর মা ভালো নাহায়। মানুষের খেতবাড়িত্ কাম করে আর যেইঠে-সেইঠে কী করে না করে! মানুষের মুখত্ কত কথা শুনা যায়।’

জমিলার গল্প থেকে একসময় আমরা বাজনাহারের অতীত ঐতিহ্যে ফিরে যাই। অন্যদিকে সখিনা তখনো ধানখেতে। খেতের কাছেই দাঁড়িয়ে আছে চৌধুরীর ডান হাত কালু। ধান কাটছে সখিনা। একবারও মাথা তুলে না তাকিয়ে আপনমনে ধান কাটছে। ওর রোদে পোড়া চকচকে গাল বেয়ে ফোঁটা ফোঁটা ঘাম নেমে আসে।

দুই.

জমিলার ছাগলের গায়ে একটা কাক এসে বসে। কাকটাকে বহন করে ছাগলটা আমাদের সামনে এসে দাঁড়ায়। ছাগলটাকে দেখেই আমি চিনতে পারি। ছাগলটার ভাবখানা দেখে মনে হচ্ছে, সেও আমাকে চিনতে পেরেছে।

আমার সামনের বারান্দা থেকে মুরগিগুলো কী যেন খুঁটে খুঁটে খাচ্ছিল। কাকটা উড়ে গিয়ে তাদের দলে ভিড়ল। মুরগিগুলো অবশ্য একটু বিরক্ত হলো। কাকটা আবারও আসে। এই বাড়িতে তার খানিকটা অধিকার আছে, এ ধরনের ভাব নিয়ে কিছু ভ্রুক্ষেপ না করে বারান্দা থেকে খুঁটে খুঁটে কী সব খেতে লাগল।

সভার মধ্যে ইতিমধ্যে একটা কালো বিড়াল এসে দাঁড়িয়েছে। মুরগিদের মধ্যে বড় কালো-সাদা ছিটের মুরগিটার এটা পছন্দ হয় না। মুরগিটা বিড়ালটার মাথায় একটা ঠোক্কর লাগিয়ে দেয়। লেজ ফুলিয়ে গায়ের লোম খাড়া করে বিড়ালটা একবার ফোঁস করে উঠল। এমন সময় ভেতরবাড়ি থেকে শ্রীপতিদা এসে দাঁড়ায়। আমি তাকে জমিলার ছাগলটা দেখাই।

‘দাদা, এই ছাগলটা সখিনার মনে হচে?’

‘ঠিকেই ধরিছেন। আর কহেন না, ওইটার ঝামলা লাগিই আছে।’

‘তা–ই নাকি!’

‘শুধু সেইটাই নাহায়, জমিলার মা–ও কম ঝামলা করে না, প্রায়ই আইসে টাকাপাইসা নিবা।’

‘তা–ই নাকি!’

‘হেঁ আইজে আসিবে আইতত্।’

‘কুন্ঠে দেখা হইল্?’

‘ওই যে কাইল্ জমিলাক্ দেখিলেন নাই, সইন্ধ্যার পরপর খেতানবাড়ি থাকি যাওয়ার সমে দেখা হইছোলো।’

আমাদের কথার মধ্যেই একজন কালো চিকন একচোখ কানা লোক দৌড়ে আসে।

‘দাদা শুনিছি, কাইল্ সইন্ধ্যার এংনা আগত্ নেপাল ধরা পইছে সখিনার ঘরোত্! পেচির মা বুদ্ধি করি বাহিরের ছিটকিনিটা নাগাই দিছে। তারপর ওইঠেনায় গাঁয়ের মানুষ বিচার কইছে। বিচারোত্ নেপালের দুই হাজার টাকা জরিমানা আর সাতবার সাঁটা দিয়া মাইছে। আর সখিনাক্ মারিবা কহিচলো পাঁচবার। ওর মা ওক্ পাঁচবার মারিবা যায়া এক্কেবারে ধোলাই দিছে। ওই বিচারোত্ উত্তমও আছোলো।’

‘উত্তম তো একটা দেউনিয়া!’ শ্রীপতিদা বেশ উৎসাহ নিয়ে বলেন।

‘হয়, হয়।’

‘মোঁহোঁ বুঝা পাঁও না। কিন্তু সখিনার সুবিধা হইচে। কিছু মালপানি কামাই কইছে।’

‘সেই তো, বেটিক্ লেলাই দিয়া টাকা কামাইছে খোউব।’

শ্রীপতিদা আর লোকটার কথা আর চেঁচামেচিতে বিড়ালটা ভয়ে পালিয়ে গেল। কাকটা উড়ে গেল। মুরগিগুলোও অদৃশ্য হয়ে গেল। জমিলার ছাগলটাও পালিয়ে যায়। বাড়িটা যেন হঠাৎই নিস্তব্ধ হয়ে যায়।

তিন.

দুই–একটি তাল বা ন্যাড়া বেলগাছ, বেশ কয়েকটা শিমুল, রেইনট্রি, শালবন আর বাঁশের জঙ্গল নিয়ে গড়ে ওঠা এই বাজনাহার গ্রাম। শ্রীপতিদাদের বাড়ির পেছনে-সামনে বাঁশবন। বাঁশগুলো সবই মাক্লা। উঠানের পাশেই একটা পাকুড়গাছ বড় হচ্ছে শিবমন্দিরের ঠিক বাঁ পাশে। সন্ধ্যা হচ্ছে হচ্ছে, এমন সময় বাইরের কাছারিঘরের বারান্দায় চেয়ার নিয়ে বসে আছি। শ্রীপতিদা যেন কোথায় গেছে। দূর থেকে বাঁশ কাটার শব্দ, সন্ধ্যায় কাকদের উচ্চকণ্ঠ প্রলম্বিত হচ্ছে বাতাসে। একটা কুকুর অযথাই ভুকছে। সখিনা আর জমিলার কথাই ভাবছি। ভাবতে ভাবতে সন্ধ্যা ঘন হয়ে আসে। একটা পূর্ণচাঁদ উঠে আসতে থাকে বাঁশবাগানের মাথা থেকে। উঠানে দুধজ্যোৎস্নার ছড়াছড়ি। ভরা জ্যোৎস্নায় একধরনের শূন্যতা জমে ওঠে উঠানজুড়ে। এইমতো শূন্যতার মধ্যে ঘণ্টাখানেক কেটে যায়। সহসাই একটি নারীদেহ এসে আমার পাশে উঠানের থাম জড়িয়ে দাঁড়ায়। কালো ছিপছিপে দেহ। মুখটায় অপুষ্টির ছাপ। সম্ভবত পান চিবোচ্ছে। ধীরে ধীরে জানতে চায়, ‘দাদা, শ্রীপতিদা বাড়িত্ আছে?’

আমার কৌতূহল বাড়ে। আমি ওর পরিচয় জানতে চাই।

এ কী! এ তো সেই সখিনা। তারপর আমি ওকে জানাই, ‘মুঁইও ঘণ্টাখানেক ধরি ওক্ খুঁজি পাছোঁ নাই।’

‘মোক্ যে এংনা আসিবা কহিচলো।’

‘ও, তা–ই নাকি।’

‘হেঁ, তাহিলে মুঁই এংনা বইসো।’

কথাটা বলেই বারান্দায় উঠে থামের পাশেই শরীর এলিয়ে বসে পড়ে সখিনা।

আমি সখিনাকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পর্যবেক্ষণ করি। দু–একবার চোখে চোখ পড়ে যায়। সখিনা পান খাওয়া মুখে টিপে টিপে হাসছে। এ রকম অনেকক্ষণ থাকার পর আমি সখিনার জীবনবৃত্তান্ত জানতে চাই।

সখিনা দীর্ঘশ্বাস ফেলে আমার দিকে তাকায়। তারপর শুরু করে, ‘মোর আর জীবন! মোর বাপের বাড়ি হরিপুর। টাঙন নদের ওপর। মোর বাফও খেত-খামারত্ কাম কইছলো। কিন্তু এই বাজনাহারত্ মোর বিহা হয়া মোর জীবনের তামান সুখ-শান্তি উঠি গেইল্। ভাতারের বাড়ি আসি খাটি খাটি মোর জীবনটা গড়ি গেইল্। শেষত্ ভাতারটাও মরি গেইল্। মোর এংনা বেটি জমিলা। ওঁয় এখোন বড় হইচে, বুঝিবা শিখিছে। দেহাত্ জোরও বাড়ি গেইছে। মোর নামে তো যেইঠে-সেইঠে বদনাম আছেই; কাইল্ ফের মোর বেটিটারও বদনাম ছড়ি গেইল্। ওই নেপাল ছোঁড়াটা নাকি ঘরোত্ সেন্দাই ফস্টিনস্টি কইছলো। বিচার কইছে উত্তম মেম্বার। ওমহারাই বিচার করি হামাক ৫০০ টাকা দিয়া ওমহারাই টাকার বেশির ভাগ নিয়া গেইল্। নেখাপড়া করি নাকি বাকি টাকা দিবে। বেটিটাক্ মুঁই খুবে মানু। ওঁয় এখোন মোর সাথে গোস্বা করি কাথা কহেনা।’

সখিনার বর্ণনার এই পর্যায়ে শ্রীপতিদা হন্তদন্ত হয়ে উঠান পেরিয়ে আমাদের কাছে আসে।

‘কী রে সখিনা, কখোন আলু?’

‘এই তো এংনা আগত্।’

‘মুঁই আইজ্ খুব ভেজালত্ আছোঁ। তুঁই কয়দিন পরে আয়।’

‘তাহিলে আইজ্ যে আসিবা কহিছিলেন?’

‘আরে বাপু, মুঁই এংনা হঠাৎ ঝামলাত্ পড়ি গেনু।’

‘মোর বেটির কাথা তো শুনিচেন?’

‘কী আর করিবু? ধইয্য ধরেক্। এইলা কিছু হবে নাই। ভালো একটা ছোঁড়া দেখি বিহা দিয়া দে। তখোন নাহয় কিছু টাকা লাগিলে মোঁহোঁ দিম্।’

‘বাবু, বেটিটা মোর খউবে দুঃখ পাইছে।’

‘তা তো পাবেই। ঠিক আছে তুঁই এখোন যা।’

সখিনা চলে যায়। শ্রীপতিদাকে কেমন যেন উদ্​ভ্রান্তের মতো দেখায়। আমি প্রশ্ন করি, ‘কুন্ঠে গেইছিলেন?’

‘আর দাদা কহিবেন না। ওই পাশের গাঁওত্ গেইছুনু। একখান্ জমিজমার বিষয় আছোলো।’

কথাগুলো কেমন যেন অস্তিত্বহীন মনে হয়। আমার সন্দেহ জাগে, সে কি আমার কাছে কিছু গোপন করছে? কী জানি! কিছুই বোঝা যায় না। দূরে কোথাও ঢাকের আওয়াজ বেজে ওঠে। শ্রীপতিদা বলে, ‘চলেন, কবিগান শুনিবা যাই।’

আমরা কবিগান শুনতে চলে যাই।

চার.

খুব সকালবেলা আমার ঘুম ভেঙে যায়। গভীর রাতে খানিকটা বৃষ্টি হয়ে গেছে বোঝা যায়। ঝকঝকে পরিচ্ছন্ন রোদ এসে পড়ছে উঠানে। আমি বারান্দায় এসে দাঁড়াই। এমন সময় সেই কুকুর চিৎকার করে ওঠে। আর একজন লোক দৌড়ে এসে জানায়, জমিলা গলায় দড়ি দিয়েছে। শ্রীপতিদা ঘটনা শুনেই বলে, ‘চলেন এলায় শহরত্ চলি যাই। এইলা ঝুটঝামেলাত্ জড়াই লাভ নাই।’

বিষয়টা আমি মেনে নিতে পারি না। তবু মনের বিরুদ্ধে তার ইস্পাতের গাধা সাইকেলটায় চেপে বসি। পথে আসতে আসতে আমার কাছে বালিকাটির মুড়ি কেনার দৃশ্য ভেসে ওঠে। কী মায়ায় ভরা দুই চোখ, লাবণ্যে ভরে ওঠা মুখ। নেপাল, নাকি অন্য কোনো কুৎসিত মানুষ ওর আগ্রাসী লোভে মেয়েটির শরীরটাকে ছিঁড়ে–খুবলে শেষ করে দিয়েছে। যে কারণে আত্মহত্যার বিকল্প নেই। জমিলা ভয়ে, বিস্ময়ে নিথর হয়ে মরে গেছে। আহা! বালিকাটির আপ্যায়নের মুড়ি যেন কালমুড়িতে রূপান্তরিত হয়েছে। ওর চোখে ভিন্ন একটা জ্যোতি আমি দেখেছিলাম। ইস্পাতের গাধা ছুটে চলেছে। শ্রীপতিদা নির্বিকার, যেন পেডল মেরে চলছে। এই মৃত্যু নিয়ে কোনো কথাই নেই তার মুখে। একটানা পেডল মেরে একটা বাজারের কাছে এসে আমরা থামলাম। শ্রীপতিদা বললেন, ‘মুড়ি খাবেন?’

আমি কিছুই বলি না। কয়েক মুহূর্ত তাকিয়ে থেকে তাকে অনুসরণ করি।