অবরোহণ

এপ্রিল (হেমন্ত)

আমি হাঁটি প্রতিদিন একই রাস্তায়। মোজার দোকান পার হয়ে পুরোনো আসবাব—শতাব্দীর ধূলি গায়ে বসে থাকে। পথকুকুরের জন্য পানি রাখা আছে সামনে। দোকানের দরজার ভেতর, কার্পেটের ওপর মাঝেমধ্যে একজন সম্ভ্রান্ত অফ হোয়াইট হাস্কি বসে থাকে গা এলিয়ে। ট্রাফিক লাইটের কাছে এসে ডান দিকে বাঁক। হাঁটাপথ ঢাল বেয়ে বহুদূর নেমে গেছে দৃষ্টির সীমানা ছাড়িয়ে। পুরোনো বইয়ে পড়া হাবেলির মতন সত্তর দশকের বনেদি বাড়িগুলো রোদে তাপায়, মেঘে আর্দ্র হয়, বৃষ্টিতে ভেজে। আমি দেখি রোজ রোজ রোদ, মেঘ, বৃষ্টি।

ফুটপাতের পাশে একটা জংলা গোলাপের ঝোপ আছে। এই অটামে সাদা গোলাপ ফুটছে, হালকা সুবাস আসে পাশে গেলে। পথের ওপর যখন রোদ বিছিয়ে ছিল, একটা ছাই রঙের বিড়াল উদাসী, ধীরে হাঁটছিল, যেন দুনিয়ার কারও সঙ্গে তার আর কোনো লেনদেন নেই। তার শান্ত পথহাঁটা ছড়াতে থাকে পুরোনো দালানের ইটের খাঁজে, লোহার ব্যালাস্ট্রেড আর ম্যাপলের ছায়ায়। তাকে আমি দেখি আর আমার নিশ্বাস ধীর হয়ে আসে।

গাছের পাতার রং বদলায় ধাপে ধাপে—হলুদ, কমলা, লাল, গেরুয়া। এরপর ঝরে যাবে, এখন রঙিন। একটা লাল টুকটুকে পাতা মিশে থাকে ঘাসে। সেই কোন জনমে পুরোনো বাংলোবাড়ির লাল মেঝেতে বসে সুমী আপা গেয়েছিল, ‘দেবতা চাহে না মোরে, গাঁথে না মালার ডোরে, আমি পথমঞ্জরী ফুটেছি আঁধার রাতে...’, সুরটা সেদিন সাপ তাড়ানো কার্বলিক অ্যাসিড, ধুলো, শেওলা আর কয়েক শ বছরের শূন্যতার গন্ধবাহী বাতাসের সঙ্গে জড়িয়ে ছড়িয়ে পড়ছিল জীর্ণ কড়িবর্গায়। সেই বাড়ি আর নেই, সুমী আপা কোথায় জানি না, গানটা তবু রক্তের ভেতরে ঘুরপাক খায়।

পাতাটা কুড়ালাম।

তুমি বলো, এইটা তো আর ম্যাপল নয়!

না, ম্যাপল তো আশির দশকের সেঞ্চুরি ফেব্রিকস, সোহেল চৌধুরী। তোমার জন্মের আগের।

মজা নিস?

নিলাম নাহয় একটু। বাকি সব তো নিয়ে নিয়েছে অন্যরা!

কী পাতা তাইলে এইটা? পার্সিমনি?

আমি কিছু বলি না, পার্সিমনি তো ফল, তার পাতা জানি কেমন! এইটা একটা হুদাই পাতা, আমি ভাবি। বিনা কারণে লাল হয়, বিনা কারণে ঝরে যায়।

শেষ বিকেলে অফিস থেকে বের হয়ে পার্কিংয়ে যখন দাঁড়াব, দিনটা সন্ধ্যায় ঢলতে থাকবে। বিদায়ী সূর্যের আলোর সঙ্গে মিলবে ফুলের রেণু আর ধুলো। পাশের কনস্ট্রাকশন সাইটের বুলডোজ করা কংক্রিটের পাহাড় আর ঘুমিয়ে থাকা খননযন্ত্রও মায়াময় হয়ে উঠবে নরম আলোর স্পর্শে। একটা গভীর শ্বাস টেনে আমি গাড়িতে উঠব। ধ্বংসস্তূপের ওপরে বসা করুণ সুন্দর ফিলিস্তিনি ছেলেটার ছবি মনে পড়বে আমার। তার মুখের ওপর সূর্যের আলো, আনত চোখ, হয়তো তার আব্বা–আম্মা মারা গেছে বোমা হামলায়, হয়তো শীতের দিকে ধাবমান দুর্বল সূর্যের স্পর্শ ছাড়া তার আর কোনো আশ্রয় নেই।

তোমার সঙ্গে কথা হবে না। তোমার ব্যস্ততা আর ক্লান্তি বাড়ে আমার অস্থিরতার তালে তালে।

গ্লেন আইরিস রোডের ওপর অস্তগামী সূর্য মেঘেদের রং করবে—সোনালি, কমলা, গোলাপি। রঙে ফেটে পড়বে পথের পাশের ম্যাপলরা। কয়েকটা লাল–হলুদ পাতা গাছ থেকে ছুটে গিয়ে বাতাসে ভাসতে ভাসতে আমার গাড়ির কাচ পার হয়ে যাবে। সেই ভাসমানতার ভেতরই রাস্তা ছেড়ে আসব আমি, জানতে পারব না আর কত দূর বাতাস তাদের বহন করছিল, ঠিক কোথায় ফেলে গিয়েছিল।

একটা গান গুনগুন করবে আমার ভেতর, ‘আমি মর্মের কথা, অন্তরব্যথা কিছুই নাহি কব…ওহে জীবনবল্লভ…।’ আমার মনে পড়বে ছোটবেলার সন্ধ্যা—ঢাকা ইউনিভার্সিটি কোয়ার্টার্সে শীতকাল। গানের স্যার—আনোয়ার হোসেন, সুরনিকেতন থেকে সেদিনই কিনে আনা হারমোনিয়াম টেনে এই গানই গাইছিলেন। তাঁর গায়ে হাফহাতা চেক শার্ট। অনেক দিন পর জেনেছিলাম, শার্টের নিচে ছিল হাতাকাটা উলের সোয়েটার, বহুদিন ট্রাঙ্কে থাকায় পোকায় কাটছিল। তিনি তাই তাকে চালান দিয়েছিলেন শার্টের নিচে। মাগরিবের আজানের সঙ্গে সঙ্গে বাসার পথে হাঁটতাম। মশারা ঘূর্ণিঝড়ের মতো ঘুরপাক দিত মাথার ওপর। আমার কোনো বন্ধু ছিল না। সব জোড়ার মাঝখানে আমিই একলা দাঁড়িয়ে থাকতাম আলিফের মতন।

এই দুপুরে অফিসে বসে আমি আসন্ন সন্ধ্যা দেখি, রাত দেখি। খুব বেশি উথালপাতাল আর হবে না জীবনে। যা হবে, তা জেনে গেছি।

রাত নামবে। সবাই ফিরবে যার যার দুনিয়ায়। আমার অস্থিরতা টলমল করবে চোখের পাতায়, কিন্তু ঝরে যাবে না। আমি ভাবব রুম্মানা জান্নাতকে—

‘টিপ টিপ পানি আর তোমার ফেরার পথে আমার সমস্ত আয়ু তাকিয়ে আছে। কখনো প্রেম এমন বেরহম কাটে, মনে হয় এই অবলা সন্ধ্যায় মরে গিয়ে দেখি কেমন বেদনা তুমি পাও!’ মিস করি সিনট্যাক্সের বাইরে তোমাকে… সিনট্যাক্স, আগে কেন মনে লাগেনি শব্দটা? আমার সমস্ত প্রেম, সমস্ত না থাকা, সিনট্যাক্সের বাইরেই রইল চিরকাল। মানুষ বদলায়, কান্না থেকে যায়। ত্রিসতেসে দুরেরা তুজোরস… দ্য স্যাডনেস উইল লাস্ট ফরএভার… প্রেম কত সাময়িক, আর ভুলে যাওয়া অসীম… বঁজুর ত্রিসতেসে… জীবনানন্দ মনে আসবেন আমার—

‘একদিন যারে আমি চাহিয়াছি—

দূরের পায়ের শব্দ যার একদিন জাগাত পিপাসা,

তারে আমি ভুলে যাব—ভুলে যাব 

জাগিবার ভাষা!

ঘুমাবার আগে আমি হয়তো ভাবিব একা

একবার কবেকার কথা!

কিন্তু এই পৃথিবীর অসাড়তা—আমারেও 

করিবে অসাড়,

একদিন যারে আমি চাহিয়াছি ফিরে তারে 

চাহিব না আর!’

মৃত্যুর মতো অপেক্ষাহীন একটা ঘুম ঘুমাতে হবে, ভাবব আমি। অস্থিরতা থেকে অবসাদ বেশি সহনীয়।

সেপ্টেম্বর (বসন্ত)

মাঝেমধ্যে ঘুম ভাঙতেই তোমার কথা মনে আসে না। সেসব দিনে আমি ভালো থাকি। তুমি তবু থাকো—আশির দশকের দুপুরবেলায় প্রতিবেশীর রেডিও থেকে ভেসে আসা গানের ডালির মতো আবছা। ঘরের জানালা খোলা ছিল আর সকালের নরম রোদের সঙ্গে ফুলের গন্ধ ঢুকে যাচ্ছিল ঘরে। ভাসতে থাকা ধুলার ওপর আলো লেগে বেহেশতের ভাসমান রাস্তা তৈরি হয়েছিল যেন। প্রতিটি ধূলিকণা নিজ নিজ জায়গায় ঘুরপাক দিতে দিতে ভাসছিল। ধুলারাও নাচে! পাখি ডাকছিল, মনে হয় হলুদ ঠোঁট কালো পাখিটা। এই পাখি মাঝেমধ্যে আমরা ফুল বা ফল তুলতে গেলে বকা দেয়!

আমার মনে হচ্ছিল, ঘাম দিয়ে জ্বর ছাড়ার মতন প্রেম ছেড়ে গেছে। কেমন একটা হালকা হালকা সুখী মন, যেন বহুদিন পরে ভাত খেতে পারব। কবীর সুমন মনে এলেন, ‘ফুলের চেয়ে ভাতের গন্ধ ইচ্ছে করে, আমার দেশে সবার দেশে সবার ঘরে…’। সিঁড়ি দিয়ে নামতে খুব ভালো লাগছিল, এই যে আমি এখানে আছি, আমি এখানেই আছি। আমি ভাবছি না, তুমি এখন কই; আমি ভাবছি না, তুমি কি ঘুমাচ্ছ কি না। আমি কিছু ভাবছি না… সারা বাড়িতে শুধু ওয়াশিং মেশিনের শব্দ। পানি ছাড়ছে, এখনই থেমে যাবে। কাপড়গুলো ধোয়া হয়ে যাবে। আম্মা বোধ হয় কাপড় ধুতে দিয়ে আরেকবার ঘুমাচ্ছে।

আমি ধোয়া কাপড় শুকাতে নিলাম, বাইরে। অরেঞ্জ জেসমিন গাছটায় কুশি কুশি সবুজ পাতা জন্মাচ্ছে আবার, গাছটা বেঁচে উঠছে। দুটো সাদা প্রজাপতি বাতাসে বলড্যান্স দিতে দিতে ফুলে ফুলে ঘুরছে। ফুলগুলো ফুটে উঠছে। এক কোনায় জবা ফুলের গাছে তিনটা জবা; গাঁদা ফুল খুলছে, বেল পেপারগুলো একটা গাঢ় সবুজ রং নিচ্ছে, এরপর লাল হবে। আপেলগাছে লাল আপেল, অ্যাপ্রিকট হলুদ হচ্ছে, প্লামবেগুনি। পাখিদের জন্য পানি রাখা আছে, ওরা গরমের সময় এই পানিতে গোসল করে। আমি এত রঙের মাঝখানে রঙিন কাপড়গুলো মেলতে শুরু করলাম—অনেক রঙের ওড়না, কামিজ, বিছানার চাদর। আমি একটা একটা করে নিয়ে ঝাড়ছি, বাতাসে বিন্দু বিন্দু পানি ছড়িয়ে যাচ্ছে আর সাবান সাবান গন্ধ। রোদ লেগে ঝিকমিক করছে পানির বিন্দু। নিজেকে আমি বলছি, আমার কোনো তাড়াহুড়ো নেই  একটা–একটা করে কাপড় মেলে দেব, টান টান করে। রং মিলিয়ে ক্লিপ লাগাব। বাতাস এসে আমার চুলের মধ্যে বইছে ঝিরি ঝিরি… আমি ভাবছি ইংরেজি ট্রাঙ্কুইল শব্দটা কী সুন্দর, যখন আমার সারা অস্তিত্ব আমার সঙ্গেই থাকে, যখন আমি আমার পারিপার্শ্বিকে ডুবে থাকি। আমার মনটা কী শান্ত, কারণ, তোমার কথা আমি ভাবছি না। আল্লাহকে বললাম, এমনই যেন থাকে, এই রকমই… রাত জেগে আমি ভাবতে চাই না, অস্থির হতেও চাই না, অপেক্ষা করতে চাই না। তোমার যা খুশি করো, আমি জানতে চাই না। আমি চাই, আমি শান্তিমতো ঘুমাব। তুমি থাকবে, দূরে দূরে… যেন আবহসংগীত। তোমার জীবনে তুমি থাকো, আর অন্যের জীবনেও...তোমার জীবনে তুমি থাকো আর ভালো থাকো। আমি তোমাকে ভাবছি না মোটেই, আমি ভালো আছি…