হৃদয় দান

অলংকরণ: এস এম রাকিবুর রহমান
অলংকরণ: এস এম রাকিবুর রহমান

বছরে একবার সরকারি খরচে ঘোরার সুযোগ হয়। কত জায়গায় যাই। কেন জানি মধুছন্দার কথা মনে থাকে না। সেদিন ইউটিউবে সাহানা বাজপায়ীর গান শুনে মনে পড়ল। মনে পড়ল মীরা বৌদির কথাও। ছলাৎছল একটা আওয়াজ এসে লাগল বুকে। সঙ্গে সঙ্গে কমিটির সেক্রেটারিকে ফোন করলাম। অনেকটা বলে-কয়ে ট্যুর নিলাম। আহা মধুছন্দা! আমার প্রথম প্রেম। প্রথম পোস্টিং। প্রথম মনে হওয়া, জীবনে যা চেয়েছি সব পেয়েছি।

মধুছন্দার ঘাটে একসময় নৌকা ভিড়ত। লঞ্চে করে ঢাকা থেকে এসে নৌকায় কলেজঘাটে নামতাম। এখন পদ্মা সেতু হয়ে সরাসরি ঢাকা থেকে বাস আসে চৌরাস্তায়। তারপর টুকটকে পাঁচ মিনিট। গুলিস্তান থেকে সাকল্যে পাঁচ ঘণ্টার যাত্রা। অবিশ্বাস্য মনে হলো সবকিছু। মাত্র ১৫ বছরে এভাবে পাল্টে যায় একটা জনপদ! মহাভারতের ময়দানবের গল্প শুনতাম দিদার মুখে। ময়দানব ইন্দ্রপ্রস্থ তৈরি করেছিল পাণ্ডবদের জন্য। এখানে কোন ময়দানব এসে ঘাঁটি গেড়েছে, কে জানে।

বৃদ্ধ রমজান প্রিন্সিপালের পিয়ন। আমার সঙ্গে খুব একটা খাতির ছিল না। ছেলে-ছোকরাকে তার বিশেষ একটা পছন্দ নয়। প্রফেসর হবে চুল পাকা গোঁফওয়ালা ভারী শরীরের কেউ। জিনস-গ্যাবার্ডিন পরারা কীভাবে প্রফেসর হয়, সেই হিসাব মেলাতে মেলাতে আমার বদলির অর্ডার হয়ে গেল। সেই রমজান আমাকে দেখে ছুটে এল হাসিমুখে। মাথা জবজব তেলে। মুখভর্তি পান। খয়েরের দাগে কালো হয়ে যাওয়া দাঁতগুলো মেলে ও কী বলল ও-ই জানে, আমি হেসে বললাম, ভালো।

রমজান আলী ছোঁ মেরে আমার ব্যাগটা নিয়ে নিল। ও কোথায় গেল, ও-ই জানে। আমি পড়লাম দ্বিধায়।

সামনে বিশাল মাঠ। মাথার ওপর টেপ খাওয়া চাঁদ। শুক্লাদ্বাদশী হবে। পূর্ণিমা হতে এখনো দুদিন। কিন্তু জোছনায় ভেসে যাচ্ছে চরাচর। নদী থেকে আসছে আঁশটে ঠান্ডা বাতাস। গা শিউরে ওঠে। মাঠের ওপর একটা আধিভৌতিক আলো যেন ভাসছে। দূরের লাইটপোস্টগুলো পাণ্ডুর মুখ করে চেয়ে আছে। আমি স্পষ্ট দেখলাম, গরদ শাড়ি পরা গোলগাল এক নারী বসে আছে মাঠের ওপর। না কাটা ঘাসগুলোতে ডুব আছে তার পা। নাহলে আলতার রেখাটা দেখা যেত। গরদের লাল পাড় কাঁপছে বাতাসে। মীরা বৌদির চাঁদপনা মুখটা স্থির হয়ে আছে মধুছন্দার দিকে। এখন উনি গান ধরবেন। ‘আমরা মলয় বাতাসে ভেসে যাব শুধু...’। ডরমিটরির জানলা থেকে আমরা উঁকি দিই। সত্যি সত্যি মলয় বাতাস বয়। উড়ু উড়ু হয়ে ওঠে আমাদের মন। প্রিন্সিপাল কোয়ার্টারের পর্চের ওপর দাঁড়িয়ে উদাস হয়ে তাকিয়ে থাকেন দিলীপ স্যার। তাঁর কায়দা করে সিঁথি করা চুলগুলো বাতাসে ওড়ে। আলো-আঁধারির ভেতরে মানুষটার অভিব্যক্তি বোঝা যায় না। মাঝেমধ্যে মনে হয়, পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী মানুষটা ছায়া হয়ে আছে ওখানে। আবার পরক্ষণেই তাঁর জন্য মন কাঁদে। যতক্ষণ জোছনা থাকবে, মীরা বৌদি বসে থাকবেন মধুছন্দার মুখোমুখি। গুনগুন করে একটার পর একটা গান গাইবেন।

প্রথম যেদিন মধ্যরাতে গানের আওয়াজে আমার ঘুম ভাঙল, মাঝমাঠের মধ্যে এক মধ্যবয়সী মহিলাকে দেখে ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম। দূরে উদাসী একটা কালো ছায়া। কেমিস্ট্রির বদরুল চোখ কচলাতে কচলাতে বলল, আরে ধ্যাৎ, এ তো মীরা বৌদি।

পিঠের ওপর একটা ভারী হাত পড়ল। চমকে উঠলাম। পেছনে দিলীপ স্যার।

চল। মিতবাক নিরাবেগ মানুষটা সেই আগের মতো আছে। ইচ্ছে হচ্ছিল স্যারকে জড়িয়ে ধরি। একটু কাঁদি। সাহস হলো না।

কলেজের যেদিকে তাকাই, মীরা বৌদি ঝলমল করে। কানে বাজে রেডিওর স্টেশন ঘোরানোর শোঁ শোঁ আওয়াজ।...শুরু হচ্ছে সংগীতবিষয়ক অনুষ্ঠান...তারপর মীরা বৌদির কণ্ঠ...‘ঘুমাব কেতকী সুবাস শয়নে চাঁদের কিরণে করিব স্নান...’

কলেজের কোনো ফাংশন হলে সবার শেষে স্টেজে উঠতেন মীরা বৌদি। মুখের দিকে তাকানোর সাহস হতো না। চেয়ে থাকতাম হাত দুটোর দিকে। পাকা গমের রঙের হাত দুটো লাল পলা আর সাদা শাঁখায় আলো ছড়াত। কখনো লজ্জায়, কখনো পাপবোধে ধসে যেতাম ভেতরে-ভেতরে। তবে কি আমি মীরা বৌদির প্রেমে পড়েছি? ছি ছি! কী বিশ্রী ব্যাপার।

পাগল পাগল। বদরুল সিদ্ধান্ত দেয়। আমার না মীরা বৌদির ব্যাপারে ঠিক বোঝা যায় না। মীরা বৌদির মাথায় নাকি কী একটা সমস্যা আছে। মাঝেমধ্যে কানাঘুষা শুনি। আর আমি যে সেই পাগলের জন্য ভেতরে-ভেতরে পাগল, বদরুলের মতো ধুরন্ধরের না বোঝার কথা নয়।

মাঝেমধ্যে বিকেলে দিলীপ স্যার বৌদি আর টোটইকে নিয়ে নদীর পাড় ধরে হাঁটেন। রাশভারী মানুষটা কত প্রাণবন্ত হয়ে ওঠেন তখন। দুপাটি সাদা সাদা দাঁত মেলে হাসেন। দুজনে মিলে হাত নাড়িয়ে গানও গান। বটগাছে পা ছড়িয়ে বসে ঢিল ছোড়েন মধুছন্দার বুকে। যেন দিলীপ স্যারের সব অভিমান পূর্ণিমা আর মধুছন্দার প্রতি।

দূরে দাঁড়িয়ে এসব দেখি আর সংসার করার লোভ জাগে। ডরমিটরিতে টোটই এলে তাকে নিয়ে কাড়াকাড়ি লেগে যায়। পুরো একটা পুতুল। বললেই গান শুরু করে দেয়। ‘মোর বীণা ওঠে কোন সুরে বাজি...’। ও যখন ‘নিখিলেরও হৃদয়স্পন্দে’ বলে হাত বাড়ায়, সবাই হাততালি দিয়ে ওঠে। বাহ্​ বাহ্​ করে।

টোটইর সূত্রে দিলীপ স্যারের বাসায় যাওয়া হতো। আশ্চর্য ব্যাপার, যেদিন যেতাম, কোনো না কোনো মেহমান থাকত বাসায়। এর মধ্যে শাড়ি পরা হালকা সাজুগুজু করা কোনো মেয়ে থাকত নিশ্চিত। মাঝবয়সী কেউ একজন আমার দিকে এগিয়ে এসে খুব ঘনিষ্ঠভাবে ঘরবাড়ির খবর নিতেন। বিষয়টা কেমন সন্দেহজনক মনে হতো। পরে বুঝতাম, মীরা বৌদির সাজানো নাটক। আসলে পাত্র দেখা চলছে। আমার মতো সরকারি চাকুরের খুব চাহিদা এসব পাড়াগাঁয়ে। কন্যার পিতারা কোনোপ্রকারে সঁপে দিতে পারলেই বাঁচে।

আমার কন্যা পছন্দ হয় না দেখে একবার চেপে ধরেছিলেন মীরা বৌদি। কেমন পাত্রী চাও, ঠিক করে বলো।

কিছু না ভেবেই বলেছিলাম, আপনার মতো।

লজ্জায় লাল হয়ে উত্তর করেছিলেন, পাগল।

এই পাগলের মানেও আমি বুঝিনি।

রাতটা কাটতেই আবার দিলীপ স্যারের দেখা। সকালের নাশতা সেরে আমরা দুজন বসলাম সিমুলেশন দেখতে। শিক্ষার্থীরা শিক্ষক সেজে ক্লাস নেয়। একেকটা ১০-১৫ মিনিটের ক্লাস। ক্লাসের সঙ্গে লেসন প্ল্যান মিলিয়ে নম্বর দিতে হয়। পুরো কাজটাই দিলীপ স্যার করেন। আমি দর্শকের মতো বসে থাকি। সিলিং দেখি। ধীরে ঘোরা পাখা। একই পোস্টার কয়েকজন ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখায়, তা দেখি। নার্ভাস মেয়েদের ফ্যাকাশে মুখ। নির্লিপ্ত যুবকের উদ্ধত চাহনি। এর ফাঁকে ফাঁকে কথা হয়। আমার পেটে রাজ্যের জিজ্ঞাসা। কিন্তু ওপারে একটা বাধার দেয়াল। কোনোভাবে সে দেয়াল ভেঙে আসতে চান না দিলীপ স্যার। মানুষটা খুব কাছে এসেও অপ্রকাশিত থেকে যেতে চান। আমার পরিবারের কথা জিজ্ঞেস করেন। বউ, বাচ্চা, মা। বলি। বাহ্​, চমৎকার বলে উত্তর করেন।

স্যার।

বলো।

টোটই কই?

জানো না, ও তো বিএমএতে।

আর্মিতে! অভিনন্দন স্যার। জানতাম না, সত্যি।

স্যার আমার কথায় কান দেন না। চুষট্টি, নমিতা রানী চুষট্টি...কই গেল, মরছে নাকি।

কেউ উত্তর করে না। স্যার আরও অসহিষ্ণু হয়ে ওঠেন। রেজিস্ট্রেশন করেছে। আগেও পরীক্ষা দিয়েছে। এখন নাই। কালকে আইস্যা দেখবা প্যান প্যান করতেছে। কোনো সিস্টেম নাই। অল কলাপসড।

পরে পঁয়ষট্টিও পাওয়া গেল না। ছেষট্টি সিমুলেশনে উঠে আগের দুজনের ঝাড়ি সে একা খেল। মায়া লাগল ছেলেটার জন্য।

এভাবে লাঞ্চ পর্যন্ত চলল সিমুলেশন।

খেতে খেতে স্যারকে বললাম, স্যার আপনি সফল। টোটই কদিন পর আর্মি অফিসার হবে।

স্যার মুখ থেকে হাতটা নামিয়ে আমার দিকে তাকালেন।

সফল...একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন। যাজ্ঞবল্ক্যের গৃহত্যাগের গল্পটা জানো?

না স্যার।

যাজ্ঞবল্ক্য স্থির করলেন তিনি গৃহত্যাগী হবেন। এর আগে সব সম্পত্তি দুই স্ত্রীকে ভাগ করে দেবেন। স্ত্রী মৈত্রেয়ী সম্পত্তি নিতে রাজি হলেন না। বললেন, যা আমায় অমৃত দেবে না, তা দিয়ে কী করব?

তখন যাজ্ঞবল্ক্য বললেন, মৈত্রেয়ী, তুমি চিরকালই আমার প্রিয় ছিলে, এখন আরও প্রিয় হলে। পতি যে স্ত্রীর কাছে প্রিয়, তার কারণ পতি নয়। পতির ভেতর স্ত্রী তার নিজের আত্মার স্বরূপ খুঁজে পায়। তেমনি পতিও। আসলে আত্মাই পরম প্রিয়। সেই আত্মাটা আমার মরে গেছে। মৃত আত্মার মানুষের সাফল্য আর ব্যর্থতা কী, বলো?

কথাটা শুনে মাথা ঝিম ধরে গেল।

লাঞ্চের পর শুরু হলো ভাইভা।

পড়াশোনা লাটে উঠেছে। ছেলেমেয়েরা সাধারণ বিষয়গুলো পর্যন্ত জানে না। আমি আর দিলীপ স্যার দুজনেই মহাবিরক্ত।

রাশভারী মানুষটা একটা পর্যায় অস্থির হয়ে উঠলেন, এই মিয়া কী করো এমন, একটু পড়ার সময় পাও না!

স্যার চাকরি করি।

কোথায়?

ছেলেটি উত্তর করল।

বিয়ে করেছ?

জি স্যার।

বউ কী করে?

স্যার, তখন বলতে সাহস পাইনি, ওই যে চুষট্টি...নমিতা...ও আমার স্ত্রী।

কোন চুলায় গেছে, এত ডাকলাম এল না।

চিতায় স্যার। পাঁচ মাস আগে ডেলিভারির সময়...

ছেলেটা যেন সপাটে একটা চড় মারল দিলীপ স্যারের গালে। স্যার থতমত খেয়ে গেলেন। আমিও কেমন এলোমেলো হয়ে গেলাম।

বাচ্চাটা কোথায়?

ওর ছোট চাচার কাছে। নানা-নানি নিল না...

ওকে ছেড়ে দাও। কথা বলতে ইচ্ছা হচ্ছে না। দিলীপ স্যার হাত-পা ছড়িয়ে বসে রইলেন।

সুনসান ঘর। আমি কথা খুঁজি, পাই না।

মীরা বৌদি গুনগুন করে গান গেয়ে যান,

কবিতা করিবে আমাকে বীজন

প্রেম করিবে স্বপ্ন সৃজন

স্বর্গের পরী হবে সহচরী

দেবতা করিবে হৃদয় দান...