অলংকরণ: এস এম রাকিবুর রহমান
অলংকরণ: এস এম রাকিবুর রহমান

কারফিউর পঞ্চম দিনে বাসায় এসেছিলেন শহীদুল জহির

খুব একটা চমকে উঠি না তাঁকে দেখে। বরং শহীদুল জহিরই চমকে ওঠেন, লজ্জাও পান খানিকটা। পরোটা ভেজে ডিম ভাজার প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম, হাতে পেঁয়াজ-মরিচ দিয়ে ডিম গলানোর পাত্র আমার।

দরজার বাইরে শহীদুল জহির দাঁড়িয়ে থাকেন কিছুক্ষণ, অথচ কপাট সরিয়ে পাশে দাঁড়িয়েছি সেই কখন। কিছুটা নেমে আসা মোটা ফ্রেমের চশমাটা তুলে ধরলেন নাকে, টুকরো হাসি ঠোঁটের কোনায়। সব কোলাহল পেরিয়ে আচমকা থমকে যাওয়া ভঙ্গি তাঁর, ‘দুঘণ্টা সময় হবে আপনার?’

‘ঠিক দুঘণ্টা, না দু–এক মিনিট বেশি?’

মশকরা পছন্দ করেন শহীদুল জহির, বোঝেনও বেশ চমৎকার। দুই ফিতার চপ্পলটা খুলে ভেতরে ঢোকেন অবলীলায়। পকেটে ঢোকানো হাতটা বের করেন, উঁচু গলায় বলেন, ‘ভাবি, ভূতের গলি থেকে হেঁটে এসেছি। লেবু দিয়ে একগ্লাস শরবত দ্যান।’

রান্নাঘর থেকে বউ এসে দাঁড়ায় সামনে। শহীদুল জহিরের হাতের দিকে তাকায় অবাক চোখে, ‘লেবুর শরবত খাবেন ভালো কথা, তার জন্য লেবু নিয়ে আসবেন, জহির ভাই! তা ছাড়া এখন তো নাশতা করার সময়।’

‘আমি নাশতা করে এসেছি—মুড়ি আর চা। বাসায় চিনি নাই, চিনি ছাড়া চা খাইছি আজ।’

রান্নাঘরের দিকে যাচ্ছিল রিনি আবার। খুক করে একটু কেশে শহীদুল জহির বললেন, ‘ভাবি, আমি একটা কাজে এসেছি। কাজটা সেরে দুপুরে ভাত খাব। বাসায় শুঁটকি আছে?’

 ২.

নাশতা করতে করতে শহীদুল জহির বললেন, ‘মাস চারেক আগে একটা জিনিস হারিয়েছে আপনাদের, এই বাসাতেই। অনেক খুঁজেছেন, পান নাই। ওই জিনিসটা আজ আমি খুঁজব, আপনারাও।’ নিচু করে খেতে থাকা শহীদুল জহির মাথা উঁচু করে বলেন, ‘মনে আছে, কোন জিনিসটা হারিয়েছে আপনাদের?’

৩.

ডাইনিং টেবিলের দেয়ালজুড়ে প্রসন্ন জানালা, সেটা পেরিয়ে অপলক দৃষ্টি শহীদুল জহিরের। একটু পর বারান্দায় তাকান হঠাৎ, ‘ফলস ছাদের ফাঁকে এত শুকনো লতাপাতা কেন ভাবি?’

‘কই?’ ফলস ছাদের দিকে তাকায় রিনি, ‘ওমা, ওটা তো পাখির বাসা মনে হচ্ছে!’ উঠে এগিয়ে যায় সে, ‘তাই তো, চিঁ চিঁ শব্দ শুনতে পাচ্ছি। সম্ভবত বাচ্চাও দিয়েছে। ওই যে, বারান্দার গ্রিলে দুটো চড়ুই ছটফট করছে, একটার মুখে খাবারও দেখছি!’

‘আপনাদের বাসার সামনে, রাস্তার ওপাশে নতুন দালানটা দেখছেন? পুরা গোলাপি রঙের!’ চায়ে চুমুক দেন শহীদুল জহির।

‘হায় হায়, ওই বিল্ডিংটা কবে উঠল! ও রকম রংই–বা করল কবে! এই সাদাব, তুমি খেয়াল করেছ?’ চেয়ারে বসে রিনিও তাকিয়ে থাকে গোলাপি রঙের দিকে। আমিও। আমাদের চোখে মুগ্ধতা, না বিস্ময়, বুঝতে পারি না তা কেউই।

সামনে রাখা একটা এলাচ মুখে দেন শহীদুল জহির, ‘ভূতের গলি থেকে এখানে হেঁটে আসতে আমার আজ কত মিনিট লেগেছে, জানেন? মাত্র বিয়াল্লিশ মিনিট। অথচ বাসে কিংবা স্কুটারে লাগে কমপক্ষে দেড় ঘণ্টা।’ হাসতে থাকেন শহীদুল জহির, ‘চন্দ্রিমা উদ্যানের কাছে আসতেই এক পুলিশ আমারে জিগায়, “এই কারফিউর ভেতর বাইরে বের হয়েছেন কেন?” আমিও জিগাই, “কারফিউ কি সবার জন্য?” পুলিশ উত্তর দেয়, “হ্যাঁ, সবার জন্য।” আমি আবার জিগাই, “নিজেরে তো কারফিউ দেওয়া যায়, মনেরে দিই কীভাবে? আচ্ছা, অনেকক্ষণ একনাগাড়ে তাকায়া ছিলেন সামনে, কী দেখতেছিলেন আপনি?” শরমিন্দা একটা হাসি দেয় পুলিশ, “কী সুন্দর ফুল ফুটেছে আইল্যান্ডের গাছগুলোয়! এইখানেই ডিউটি দিই অনেক দিন, এত দিন ভালো করে দেখাই হয়নি। যান, যেখানে যাচ্ছিলেন যান, সাবধানে যাবেন।”’

‘জহির ভাই, অনুমতি দিলে একটা কথা জিজ্ঞেস করতে চাই।’ নরম গলা রিনির।

‘অনুমতি দেওয়া হলো না। আরেকটা ঘটনা শোনেন, দুটো মেয়ে হাঁটছিল ইনডোর স্টেডিয়ামের ফুটপাতে, খালি পায়ে। পাশে গিয়ে বলি, “খালি পায়ে হাঁটতে কেমন লাগছে?” লম্বা মেয়েটা উত্তর দিল, “খালি পা শব্দ দুটো বাদ যাক আপাতত। বলুন, হাঁটতে কেমন লাগছে? ওই যে স্টেডিয়ামের পেছনেই বাসা। এখানে এসেই ভার্সিটির বাসে উঠতে হয় আমাদের। বাইশটা বছর কেটে গেল, এ রকম কখনো খালি পাইনি ফুটপাত! কারও না কারও দখলে থাকত জায়গাগুলো—রাত-দিন সব সময়। কিন্তু দুদিন ধরে খেয়াল করছি, আমাদের দেশেও চমৎকার ফুটপাত আছে, খালি পায়ে হাঁটা যায় সেখানে!”’ শহীদুল জহির আবার হাসতে থাকেন, ‘লেবু দিয়া একগ্লাস শরবত দ্যান, ওটা খেয়ে ওই জিনিসটা খুঁজব তিনজন মিলে।’

বাইশটা বছর কেটে গেল, এ রকম কখনো খালি পাইনি ফুটপাত! কারও না কারও দখলে থাকত জায়গাগুলো—রাত-দিন সব সময়। কিন্তু দুদিন ধরে খেয়াল করছি, আমাদের দেশেও চমৎকার ফুটপাত আছে।

৪.

বারান্দা থেকে শুরু করি আমরা। রিনি চিৎকার করে উঠল হঠাৎ, ‘সাদাব দেখে যাও, কী সুন্দর একটা পাকুড়গাছ!’

গ্রিলের নিচে সামান্য ফাঁক হয়ে গেছে, কবে হয়েছে দেখিইনি, টেরও পাইনি। ওখানে একটা পাকুড়গাছ গজিয়েছে, ইঞ্চি ছয়েক। চকচক করছে পাতাগুলো।

‘আমি গাছটা বনসাই করব।’ রিনির কথায় উচ্ছলতা।

‘বনসাই করবেন, ভাবি!’ শ্লেষমিশ্রিত গলা শহীদুল জহিরের, ‘আমরা নিজেরাই তো এখন একেকটা বনসাই—চিন্তায় বনসাই, মানসিকতায় বনসাই, সততায় বনসাই, উদারতায় বনসাই, আমাদের বাস করার জায়গা বনসাই, আমাদের পুরো বেঁচে থাকাটাই এই বনসাই! এত সব বনসাইয়ের মধ্যে এই গাছটা বনসাই না করলে কী হয়?’

‘ওকে, বাদ দিলাম। কিন্তু এখানে একটা গাছ জন্মাল, খানিকটা বড় হলো, চোখেই পড়ল না এত দিন। চড়ুইও জায়গা দখল করেছে আমাদের ফ্ল্যাটে, এই বারান্দাতেই!’

দুটো ফুলের টব আছে বারান্দায়। একটার নিচে দুই টাকার একটা কয়েন পেলেন শহীদুল জহির। রিনিকে দিলেন। ও হাতে নিয়ে বলল, ‘এসব এখন অচল।’

‘মানুষের মতো।’ প্রতিক্রিয়া জানালেন শহীদুল জহির।

ঘরে ঢুকে কালো আলমারিটার নিচে হাত দিল, একটা আলু বের করল রিনি। ছোট্ট একটা গাছ গজিয়েছে আলুর গায়ে। পাশে বইয়ের তাক, সেখানে হাত দিয়েই ছোট্ট একটা চিৎকার তার, ‘জহির ভাই, আপনি কখনো টিকটিকির ডিম দেখেছেন?’

পাশ ফিরলেন শহীদুল জহির, ‘ডিমগুলো ছোট, কিন্তু প্রতিটি ডিমে আস্ত একটা প্রাণ আছে। ট্র্যাজেডি হচ্ছে—ফুটে ওগুলো বেরই হবে একদিন মরে যাওয়ার জন্য!’

দেয়ালের লম্বা আয়নাটার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে দেখে নিল রিনি একবার। স্থির হলো একটু, ‘দেখেছ, কতগুলো টিপ জমা হয়েছে আয়নার কাচে!’

‘ব্যবহার করা হয়ে গেলে সবকিছুই মূল্যহীন হয়ে যায়, গুরুত্ব হারায়।’ শহীদুল জহির সোফার দিকে যেতে যেতে বলেন, ‘মানুষও।’

সোফার এক পাশ আমি ধরি, আরেক পাশ শহীদুল জহির। সরিয়ে ফেলি ফুট দুয়েক। তিনটি তেলাপোকা মরে উল্টে আছে, বাতাসে উড়ে গেল খানিকটা। শুকনো একটা বরই পাওয়া গেল কোনায়, তার পাশে সোজা দেয়াল ঠেসে থাকা একটা কাগজ। হাতে নিই ওটা। পাশে এসে দাঁড়ায় রিনি, ‘কী এটা?’

কাগজটা হাতে দিই রিনির। হেসে ওঠে ও শব্দ করে, ‘সঞ্চয়পত্রের এই কাগজটার জন্য কত কী করেছি আমরা। আর সেটা কিনা লুকিয়ে আছে সোফার আড়ালে!’

দুটো পাঁচ টাকার কয়েন, একটা চাবির রিং, দুটো বোতাম আর একগাদা ময়লা বের হলো সোফার নিচ থেকে।

টিভি চলছে সেই সকাল থেকে—একই খবর, বারবার।

‘মানুষ এখনো টিভি দেখে!’ স্বাভাবিক গলা শহীদুল জহিরের, কিন্তু কোথাও একটুকরো তাচ্ছিল্য মেশানো।

‘আমরাও দেখি না। কত দিন পর টিভি চালালাম!’ শহীদুল জহিরের পাশে গিয়ে দাঁড়ায় রিনি, ‘বলুন তো জহির ভাই, আমাদের টিভি দেখার দিনগুলো সুন্দর ছিল, না এখন?’

টিভির বাঁ পাশে ছোট্ট কেবিনেটটাতে তিন রকমের তিনটা মগ আছে। মগগুলোর দিকে তাকিয়ে শহীদুল জহির বললেন, ‘কখনো পানি খাওয়া হবে না এগুলোতে, অথচ পানি খাওয়ার জন্যই বানানো হয়েছে এসব। অনেকটা কোনো কোনো মানুষের মতো—স্রষ্টা জীবন দিয়েছে তাকে যাপন করার জন্য, অথচ জীবনই শুরু করা হলো না তার।’

রিনি আর আমি একসঙ্গে শহীদুল জহিরের দিকে তাকাই।

আবার হেসে ওঠেন শহীদুল জহির। হাতে নেন একটা মগ। একটু দেখে রেখে আরেকটা হাতে নেন। তারপর স্থির হয়ে তাকিয়ে থাকেন ভেতরটায়। হঠাৎ নীরবতা আর মৌনতায় স্থির হয়ে যাই আমরাও। রিনি একটু এগিয়ে গিয়ে বলল, ‘কী দেখেন, জহির ভাই?’

দুটো আঙুল ঢুকিয়ে দেন শহীদুল জহির মগের ভেতর। একটা কিছু বের করে বাড়িয়ে দেন রিনির দিকে। রিনি চিৎকার করে ওঠে, ‘আমার নাকফুলটা! ওটা এখানে এলো কীভাবে? কত জায়গায় খুঁজেছি, পাইনি। আর এটা কিনা এখানে লুকিয়ে আছে!’

৫.

শহীদুল জহির চলে গেলেন একটু আগে। রাত এগারোটা বেজে পাঁচ। থেকে যেতে বললাম, থাকলেন না।

নাকফুলটা আমার হাতে দিল রিনি, ‘পরিয়ে দাও, কারণ এটা তোমারই পরিয়ে দেওয়ার কথা ছিল।’

খুব কাছাকাছি দাঁড়িয়ে আমি আর রিনি। হঠাৎ কেমন স্থির হয়ে যাই আমি, বাঁ হাতটা ওর ডান চিবুকে রাখি, তর্জনিটা সোজা হয় গাল বরাবর, ছুঁয়ে দেখে মসৃণতা, মাধুর্য আর মিষ্টতার সব আয়োজন। কেমন ঘেমে উঠছে ওর কপালের এক পাশ, লাল হয়ে উঠছে নাকের ডগাটা, কেঁপে কেঁপে থমকাচ্ছে পুরো মুখ, চোখ দুটো বরাবরের মতো ভাষা হারিয়ে কথা বলছে নতুন এক ভাষায়!

‘কী দেখছ ওভাবে?’ ঠোঁট দুটোও কাঁপছে রিনির।

প্রাচীন একটা দাগ আছে রিনির বাঁ গালে, রিনির সব আয়োজনে মুগ্ধতার প্রথম মধ্যমণি, আমার ভালোবাসার শিক্ষানবিশ ধারাপাত—এক এক্কে এক..., দুই এক্কে দুই...।

ড্রেসিং টেবিলের ওপর রাখা মুঠোফোনটা বেজে ওঠে আমার। আমি তাকাই ওদিকে। হাত দিয়ে মুখটা ফিরিয়ে আনে রিনি ওর দিকে, ‘কয় দিন হলো নেট নেই সারা দেশে, আমাদেরও। মোবাইল ছুঁয়ে দেখেছি, বিরক্ত হয়েছি, রেখে দিয়েছি। আরও কিছুক্ষণ ওভাবে থাকো না, অন্তত আরও দুটো দিন। আমরা বারান্দার গাছ দেখি, সুনীল আকাশ দেখি, ডানা মেলা পাখি দেখি, ঘরের কোনায় ঘর বোনা মাকড়সা দেখি, নিজেকে দেখি, নিজেদের দেখি।’ রিনি একটু থেমে বলল, ‘কত দিন ভালো করে সংসারটাই করা হয়নি, আরও দুটো দিন সংসার করি!’

৬.

বেজে ওঠে কলবেল, হঠাৎ। ঘড়ির দিকে তাকাই—রাত দেড়টা। দরজা খুলি। শহীদুল জহির দাঁড়িয়ে। ভেতরে আসতে আসতে বললেন, ‘অনেক কিছু দেখা হলো আজ রাতে, কিন্তু একটা জিনিস বলতে ভুলে গেছি আপনাদের।’

বেডরুম থেকে দৌড়ে আসে রিনি, ‘জহির ভাই, কোনো সমস্যা?’

‘শীতাতপনিয়ন্ত্রিত বাড়ির বারান্দায় যে মানুষটিকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলাম একটু আগে, তাকে কিন্তু বন্দীই মনে হয়েছে আমার। মেট্রো স্টেশন ঘেঁষে শুয়ে ছিলেন যে মহিলা, সম্ভবত তিনিও বন্দী। চুপি চুপি প্রাচীরের গ্রিল কাটতে দেখেছি যে নিশিচোরকে, বন্দী তো তাকেও মনে হলো। মাত্র কিছু টাকার জন্য রিকশা নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন যে রিকশাওয়ালা, বন্দী তিনি জীবনের যাবতীয় স্তূপে। রক্তে সুগারের মাত্রা বেড়ে যাওয়ায় যে মানুষকে দৌড়াতে দেখলাম এই মধ্যরাতেও, বন্দিত্ব তার চোখে-মুখেও।’ শহীদুল জহির ম্লান করে ফেলেন চেহারা, ‘মানুষ কি তাহলে ভরদুপুরে রোদে বন্দী কালো কাক—কা কা...! মানুষ কি তাহলে রাত্রিজাগা বন্দী কুকুর—ঘেউ–উ ঘেউ–উ...! মানুষের কি তাহলে জন্ম থেকেই বন্দী হয়ে বন্দিজীবন—ইশ্‌ ইশ্‌...!’ শব্দ করে হেসে ওঠেন এবার শহীদুল জহির, ‘এই যে এত কিছু ঘটে গেল এই কয় দিন—এত দম্ভ; এত ঘৃণা, এত স্ফুলিঙ্গ, স্পর্ধিত হাত, পথে পথে বীভৎস রক্ত-মানচিত্র, জীবনের অপূরণীয় যত্রতত্র অপচয়, লুটের নির্লজ্জ বাটোয়ারা—।’

‘এককাপ চা দিই আপনাকে, জহির ভাই?’ রিনি থামিয়ে দিল শহীদুল জহিরকে।

‘না, অল্প কিছু চিনি দিন, সঙ্গে একটা লেবু। বাসায় গিয়ে চা বানাব, চা খাব—সুরুত সুরুত। আসলে আমি একটা কিছু লিখতে চাই, একটা কিছু লেখার জন্য ছোটাছুটি করছি এখানে–ওখানে। বাইশ বছরের সেই তরুণ, সাহস-দৃঢ়তায় দুহাত মেলেছিল যে ধাতবখণ্ডের সামনে, সে আমাকে প্রহসন করে। সতেরো বছরের যুবক, চার বছরের মেয়ে, ঝরে গেল যারা অকালে! বিদ্রূপে ক্লীব ভাবে আমাকে যখন–তখন। শত তরুণ স্রেফ হঠাৎ মাংসপিণ্ড, বুদ্‌বুদ করে থুতু ছিটায় প্রতিদিন। কী নিঃসীম মনোবৈকল্য আমার! কিছুই লিখতে পারছি না। কিচ্ছু না, কিচ্ছু না। মুগ্ধ নামের ছেলেটা একটু পরপর বলে—পানি লাগবে, পানি? আমি বারবার তার কাছ থেকে পানি নিই, মুখে দিই, কিন্তু আমার আর তৃষ্ণা মেটে না। ছেলেটা বিস্ময় নিয়ে আমার দিকে তাকায়, সহানুভূতির হাত বাড়ায়, কিন্তু আমি স্থির, আমি বুঝে যাই, বুঝে যাই ভীত নিউরনে—ঘরে ঢুকে চোখ বোজা এক অন্ধ মানুষ আমি, হারামজাদা এক বন্দী মানুষ অবিকল!’