তিলোত্তমাকে ক্লান্ত দেখাচ্ছে। বাঁ দিকে একটু খুঁড়িয়ে আস্তে আস্তে হেঁটে বাড়ি যাচ্ছে। এক হাতে কাঁচাবাজারের ব্যাগ, আরেক হাতে সেলফোন। আমি বেশ একটু দূরত্ব রেখে ওর সঙ্গে সঙ্গে যাচ্ছি। এটাই আমার কাজ, তিলোত্তমা সারা দিন কী করে, কোথায় যায়—সবকিছু নোট করে রাখা।
বাড়ি পৌঁছে গেছে তিলোত্তমা, কেঁচি গেট বন্ধ করে সিঁড়ি দিয়ে উঠে যায়। আমি বাইরে দাঁড়িয়ে, ওপরে দোতলার জানালার দিকে তাকিয়ে আছি। ক্ষীণ একটা তালা খোলার শব্দ, এরপর জানালায় জ্বলে ওঠে হলুদ বাতি। তিলোত্তমা ঘরে ঢুকেছে।
আমি ঘড়ি দেখি, এখন বাজে রাত দশটা আটচল্লিশ। আমার রিপোর্ট নিতে হবে রাত বারোটা পর্যন্ত। এরপরের আট ঘণ্টা আমার ছুটি। দুটো গলি পরেই একটা গ্যারেজ ভাড়া নিয়েছি। রাফি স্যার ব্যবস্থা করে দিয়েছেন, সেখানে আমি রাতে ঘুমাই। পরের দিন আবার তিলোত্তমার বাসার সামনে দাঁড়িয়ে যাই, ঠিক সকাল আটটায়। এরপর আবার সারা দিন ছায়া হয়ে থাকি তিলোত্তমার। তবে রাতের আট ঘণ্টার জন্য কি তিলোত্তমার আর কোনো ছায়া আছে? আমার জানা নেই। রাফি স্যার আমাকে কখনো কিছু জানান না। তিলোত্তমার সম্পর্কেও না, নিজের সম্পর্কেও না। আমাদের যোগাযোগ হয় শুধু জিমেইলে, আমি মাস শেষে রিপোর্ট মেইল করে দিই, বেতন নিই। তিলোত্তমার দৈনিক জীবনযাপনের তথ্যগুলো রাফি স্যারের কোন কাজে দেবে, আমার জানা নেই।
তিলোত্তমার সার্টিফিকেটে নাম জোহরা কামাল, ফেসবুকে ফাইরুজ কামাল। ওর ফেসবুক প্রোফাইল ঘাঁটা আমার ডিউটির মধ্যে পড়ে না। মেটাভার্সে ওর অন্য কোনো ছায়াসঙ্গীই থাকার কথা। এই প্রজেক্ট সম্পর্কে আমি কিছুই না জানলেও এটুকু অন্তত বুঝতে পারি যে এর ব্যাপ্তি বিশাল। একটা ইউনিভার্সিটিপড়ুয়া, টিউশন করে একা সংসার চালানো মেয়ের জন্য এত আয়োজন কেন, আমার বোধগম্য হতো না কখনোই। তবে এখন নিজের মতো কিছু কারণ বের করতে পেরেছি। হয়তো তিলোত্তমা অতীতের কোনো ঘটনা থেকে গা ঢাকা দিতেই এখন এই সরলরৈখিক জীবন বেছে নিয়েছে।
রাতে বাড়ি ফিরে আমি মাঝেমধ্যে আমার জোগাড় করা তথ্যগুলোর মধ্যে সেই উত্তর খোঁজার চেষ্টা করি। কিন্তু বেশিক্ষণ পারি না, একটু পরেই ওর ছবিগুলোতে হারিয়ে যাই। তিলোত্তমাকে দিনের পর দিন দেখতে দেখতে আমার নেশা হয়ে গেছে। রাতে ঘুমোতে গিয়ে আমি শুধু ওর কথা ভেবেই মাস্টারবেট করি। সোশাল মিডিয়ার দায়িত্বে না থাকা সত্ত্বেও আমি ওর ফেসবুক আর ইনস্টাগ্রাম আইডি খুঁজে বের করেছি। শুক্রবার আমার ছুটি। সেদিন আমার গ্যারেজ ঘরে তিলোত্তমার টাইমলাইন ঘেঁটে ওর রিভিলিং জামা পরা ছবিগুলো দেখে দেখে কাটিয়ে দিই আমি। আর অন্য কোনো ছায়াসঙ্গী আজ সারা দিন তিলোত্তমার সঙ্গে আছে ভেবে অসহ্য বোধ করি। আমি বাদে কয়জন ছায়াসঙ্গী ওর? চারজন? পাঁচজন? বাকিদেরও কি তিলোত্তমাতে নেশা হয়ে গেছে? রাফি স্যারেরও কি তিলোত্তমাকে নিয়ে এ রকম নেশা আছে?
ডিউটি বাদে অন্য কোনো সময় তিলোত্তমার আশপাশে থাকা আমাদের জন্য কঠোরভাবে নিষেধ। তবে সবার মধ্যে আমি ভাগ্যবান। তিলোত্তমাকে সবচেয়ে বেশি সময়ের জন্য কাছে পাই তো আমিই। ওর রিকশার পিছু নিই, ওর সঙ্গে বাসে উঠি, ওর ক্লাসের বাইরে দাঁড়িয়ে থাকি, টিউশনবাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে থাকি। ও কখনোসখনো ঘুরতে যায়, আমি নোট করি—কোথায় যাচ্ছে, সঙ্গে আছে কে কে ইত্যাদি। আমি তাদের ছবি তুলে নিই। তাদের সঙ্গে আড্ডা দেওয়ার সময় তিলোত্তমার অঙ্গভঙ্গি কী রকম, মুখের ভাব কেমন—সবই আমি নোট করি। তিলোত্তমা একটা কোঁকড়া চুলের বেঁটে ছেলের সঙ্গে মাঝেমধ্যেই ঘোরে, ওর বাড়িও যায়। প্রেমিকই হবে। মেয়েটা সেখানে গেলে আমি বাইরের চায়ের দোকানে বসে থাকি, সময় গুনি। বহুক্ষণ পর সেখান থেকে বের হয়ে আসে সে। এ সময় ও থাকে ক্লান্ত-বিধ্বস্ত, আবার কখনো চোখে-মুখে রাগ, কখনো বা হাসি। আমি পর্যবেক্ষণ করি, নোট করে রাখি। সেই সঙ্গে ছেলেটাকেও টার্গেট করে রাখি। মাঝেমধ্যে শুক্রবারে আমি ছেলেটার খোঁজে আসি, কিন্তু তাকে কখনোই পাই না। একদিন খালি বাসায়ও ঢুকে দেখলাম, একটা চেয়ার ছাড়া কিছুই নেই। রাফি স্যারের উচিত এই ছেলেটার জন্যও একটা ছায়া রাখা। তিলোত্তমাকে পাওয়ার পর আমিই রেখে দেব হয়তো। এই মেয়েকে জানতে হলে ছেলেটাকেও জানতে হবে আমার।
মাঝেমধ্যে তিলোত্তমার ফোনে কল আসে। এই মুহূর্তগুলো আমার জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। কোন ফোনালাপের সময় তিলোত্তমার মুখের ভাষা কেমন থাকে, ফোন রাখার পর তার মেজাজ কেমন থাকে, সে কী করে—এসব খুব সাবধানে নোট রাখতে হয়। তিলোত্তমার কল রেকর্ড রাখার জন্যও কোনো ছায়া আছে কি না, আমার জানা নেই। রাফি স্যারের ক্ষমতা আসলে কতটুকু? জানা নেই আমার। তবে তার টাকাপয়সা তো আছে ভালোই, নাহলে আমাদের এত বেতন দিয়ে রাখা সম্ভব হতো না। এই এক বছরের ডিউটি শেষে আমার আর সামনের চার–পাঁচ বছর কাজ না করেও হেসেখেলে চলে যাবে। আমার ইচ্ছা, তখন যেভাবেই হোক, তিলোত্তমাকে নিজের করে নেব আমি। রাজি না হলে তুলে নিয়ে যেতে পারি। ওর সম্পর্কে সব তো জানিই। এই মেয়েকেই আমার চাই।
রাফি স্যার আমাকে কখনো বাকি ছায়াসঙ্গীদের কথা বলেননি। তবে মাঝেমধ্যে আমিই আবিষ্কার করে ফেলি নতুন কাউকে। যেমন গত মাসে বুঝতে পারলাম, তিলোত্তমার টিউশনবাড়ির মানুষগুলো সম্ভবত রাফি স্যারেরই লোক। অন্তত আমার পর্যবেক্ষণ তা–ই বলে। রাফি স্যারই কোনোভাবে তাকে এই টিউশনের ব্যবস্থা করে দিয়েছেন। তিলোত্তমা কি এই পরিকল্পনাগুলো জানে, রাফি স্যারকে চেনে? হতেও পারে যাদের ছবি আমি তুলছি, তাদের মধ্যেও আছে তিলোত্তমার ছায়াসঙ্গীরা। আবার রাফি স্যারের চেহারাও তো আমার অজানা। তিনি তিলোত্তমার আশপাশেরই কেউ হতে পারেন? আমি বা তিলোত্তমা কখনোই সেটা জানতে পারব না; যেমন জানতে পারব না, কেন এই প্রজেক্ট, কী উদ্দেশ্য তার?
তিলোত্তমার ঘরের বাইরে দাঁড়িয়ে আছি। আজ সারা দিন প্রচুর ঘুরেছে মেয়েটা, বাড়ি ফিরতে দেরি করেছে। সারা দিন ওর সঙ্গে থেকে আমিও ক্লান্ত। হাই তুলতে তুলতে দোতলায় দরজার তালা খোলার শব্দ শুনি আমি, জানালার হলুদ বাতি দেখি। হাতঘড়ির দিকে তাকাই, রাত এগারোটা বায়ান্ন বাজে। চলে যাব এখনই। শেষবারের মতো দোতলার জানালার দিকে তাকাই আর চমকে উঠি! আমি কি ভুল দেখলাম? তিলোত্তমার জানালার পর্দায় দুটো ছায়া। একটা তিলোত্তমার, আর ডানে লকারের পাশেরটা কার? একনিমেষে নিচে কোথাও হারিয়ে যায় ছায়াটা।
তিলোত্তমা ঘরে একা থাকে। কোনো বন্ধুবান্ধব বা প্রেমিককেও তো সে সঙ্গে আনেনি আজ। তাহলে ওর ঘরে কে? কার ছায়া?
রাত বারোটা বেজে গেছে। গ্যারেজে ফিরে যাওয়ার জন্য পা বাড়াই আমি। তিলোত্তমার ঘরে ওর অজান্তে যে ছায়ার বসবাস, তার কথা ভেবে হিংসায় আমার সমস্ত শরীর জ্বলে ওঠে।