কালো বরফ

অলংকরণ: এসএম রাকিবুর রহমান
অলংকরণ: এসএম রাকিবুর রহমান

নীলুফার প্রথম যখন এ কথা বলেছিল, এতটুকু লজ্জাও আমার হয়নি। আমি জানতাম, নীলুফার যা বলছে, তা সত্য। কিন্তু এ-ও আমি ভাবিনি যে কেউ এ রকম মুখের ওপর কথাটা বলে বসতে পারে।

নীলুফার বলেছিল, ‘আদনান ভাই, আপনার নজর খুব খারাপ!’

মেয়েরা যখন এ কথা বলে, তখন বুঝে নিতে হয়, কথাটা ঠিক কী কারণে বলছে। একটু বড় হওয়ার পর থেকেই মেয়েদের দিকে তাকানোমাত্র আমার চোখ তাদের শরীরের এমন দিকে যেত যে তারা ওড়না কি আঁচল আলগোছেই ঠিক করতে বাধ্য হতো। কৈশোরের সেই আলগা দৃষ্টি পরবর্তী সময়ে পোক্ত হয়েছে আরও। এখন আমি সরাসরি তাকালে মেয়েরা সাধারণত কুঁকড়ে যায়। অফিসেরই বেশির ভাগ মেয়ে আমার সামনে আসতে চায় না বলেই আমার ধারণা। এক শ বার রুমের ভেতর ডাকলে তারা একবার আসে। এসে বসতে বললেও বসে না, একটু দূরে সসংকোচ দাঁড়িয়ে থাকে এবং বেরোনোর সময় প্রায় দৌড়ে বের হয় রুম থেকে। ব্যাপারটা নিয়ে আমার বিন্দুমাত্র হীনম্মন্যতা নেই। আমি বিশ্বাস করি, পুরুষেরা এ রকমই। তাদের এই ছোঁক ছোঁক কুকুর–স্বভাব। কে যেন বলেছিল, মৃত পুরুষও একবার নাকি চোখ তুলে মেয়েদের দিকে তাকায়। তাকালে মেয়েদের কোথায় তাকায়, সে-ও আমার জানা!

কিন্তু কেউ এটা মুখের ওপর বলে?

রুনা অবশ্য বলত।

রুনা আমার বউ। সাত বছরের সংসারে সাত শ বার এ কথা বলেছে। আমার নাকি খবিশের স্বভাব। বাইরে বের হলেই নজর ঠিক থাকে না। কোনো বাছবিচারও নাকি আমার নেই। অন্তত বয়সের। এ কথায় আমি কখনো প্রতিবাদ করিনি অবশ্য। রুনা বলে যেত আর আমি নিজের মতো করে সোফায় ল্যাটকা মেরে শুয়ে টিভি দেখতাম। শেষের দিকে মোবাইলে রিলস। সেখানেও তো ঘুরেফিরে মেয়েরাই আসত। ওদিকে ক্রমাগত চলত রুনার আস্ফালন। একদিন শুধু বলেছিলাম, সাত বছর পর তোমার দিকে তাকানোর মতো কিছু বাকি নেই। কিন্তু তুমি না থাকলে কী হবে, আমি তো আছি। শক্তভাবেই আছি!

পরের মাসে রুনা চলে গিয়েছিল। একেবারে যাওয়া, কিন্তু এতে হঠাৎই আমার এত ভালো লেগেছিল যে বলার মতো নয়। পরে কাগজপত্রের ব্যাপারগুলোও গুছিয়ে নেওয়া হলো। রুনা যে বলে পুরুষ কুকুরের জাত—এটা আমি বিশ্বাস করি। শুধু কুকুরের না, পুরুষ যেকোনো প্রাণীর চেয়ে আলাদা কিছু না। প্রাণিমাত্রই বহু গমনে অভ্যস্ত। পুরুষ কোন বিশেষ প্রাণ যে সে প্রকৃতির বিরুদ্ধে যাবে?

নীলুফার অবশ্য অন্য জিনিস। একটু ঝিমধরা। বিষণ্ন সুন্দরী।

নীলুফারকে এবার জড়িয়ে ধরি আমি। বলা যায়, জাপটেই ধরি। ধরার সঙ্গে সঙ্গেই অনুভব করি শীতলতা।

রাজশাহীতে এসেই প্রথমে তাকে দেখে এটা মনে হলো। থাকতে চেয়েছিলাম হোটেলেই। অফিসের আট দিনের কাজ। কিন্তু রশিদ বলল, বন্ধুর বাড়ি থাকতে হোটেলে উঠবি কেন!

হোটেলেই উঠতাম, কিন্তু রশিদ আমার ফেসবুকেও তো আছে! সেখানে নীলুফারকে কতই-না দেখেছি! চেক ইন তাই রশিদের সাগরপাড়া বাড়ির দোতলায়।

রশিদের ঠিকাদারির কাজ। সমানে পয়সা করেছে। লাল হয়ে যাওয়া যাকে বলে, তা-ই। ঝামেলা একটাই, সংসারটা বড় হচ্ছে না। অথচ নীলুফারের জন্মই যেন হয়েছে মানবজাতিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য! কথাটা তৃতীয় দিনেই পাড়ি। রশিদের আগেই, সন্ধ্যাতেই, বাড়িতে ফিরেছিলাম। নীলুফার চা দিয়ে চলে যাচ্ছিল। বললাম, ‘আপনার মতো সুন্দরী প্রকৃতি কেন তৈরি করে জানেন?’

নীলুফারের দৃষ্টি বেশ প্রখর। ছোটবেলায় দেখা সুচিত্রা সেনের কটাক্ষের মতো। বললাম, ‘প্রকৃতি চায়, আপনার মতো সুন্দর সুন্দর জিনিসে ভরে যাক মানবজাতির ফিউচার!’

নীলুফার বলল, ‘চায়ে চিনি ঠিক আছে, আদনান ভাই?’

এরপর আর কথা থাকে না। অথচ নীলুফারের শরীরময় শুধু ভাষা। মিটশেলফের ওপর থেকে কৌটা নামানো কি শু র‌্যাকের ভেতর থেকে জুতা বের করা—নীলুফার সব ভঙ্গিতেই ষোলো আনা দারুণ!

চতুর্থ দিনও যে আমি সেমিনার মাঝপথে রেখে বাড়িতে ফিরলাম, তার কারণও নীলুফার।

দুপুরবেলা। বোধ হয় ঘুমিয়েছিল নীলুফার। আমি শাওয়ারের পর ভরা পেট নিয়ে বসে থাকলাম ডাইনিংয়ে। নীলুফার এল পোলাওয়ের গন্ধ ও রোস্টের স্বাদ নিয়ে। মুখটা একটু ফুলে আছে তার। চোখ ভরা, কিন্তু এসব দেখা তো দ্বিতীয়। তৃতীয় দেখা শ্যাম্পু করা চুল। ফ্যানের বাতাসে এলোমেলো হচ্ছে। ওদিকে নীলুফার আটকে গেছে আমার প্রথম দেখাতেই। তাকিয়েই আছে আমার দিকে। ফলে আমিও আমার দেখাটা ফিরিয়ে নিয়ে আসি প্রথমে। হ্যাঁ, নীলুফার সুন্দর। অসম্ভব সুন্দর! এ রকম পরিস্থিতিতে মেয়েরা যা করে, আমি জানি, নীলুফারও তা করবে। শাড়ির আঁচলটা টেনে নেবে একটু। তারপর শ্বাস ফেলে চলে যাবে অন্য প্রসঙ্গে, কিন্তু নীলুফার তা করল না। আমাকে যেন দেখতেই দিল সে নিজেকে। অনেকটা ক্ষণ। অবশেষে বলল, ‘আদনান ভাই, আপনার নজর খুব খারাপ!’

লজ্জা পেলাম না। চোখও সরালাম না। তাকিয়েই থাকলাম। কিছুটা বিস্ময় নিয়েই। আমার ৪৩ বছর বয়সে কেউ এ কথা বলেনি। যদিও আমার নজর কোনোকালেই ভালো ছিল না। তাই এ পরিস্থিতিতে কী করা উচিত, সেটা বুঝতে পারলাম না! এটা কি কোনো সিগন্যাল আমার জন্য? আমি নীলুফারকে নিয়ে যা ভাবছি, সে-ও কি তা-ই ভাবছে? পুরুষই শুধু পশুদের মতো হবে কেন, নারীও নিশ্চয় প্রকৃতির বিরুদ্ধে যেতে চায় না! বহুগামিতার সাধ শুধুই কি আমার? নাকি নীলুফার আসলে আমাকে হুমকিতে ফেলে দিচ্ছে? কিন্তু কিসের হুমকি? রশিদের সঙ্গে বন্ধুত্বটা নষ্ট হয়ে যাবে বড়জোর! তা ওকে আমি কবেই-বা আমার জানের দোস্ত ভেবেছি। আমার এমনিতেই কোনো বন্ধু নেই। ছিলও না কখনো। যারা ছিল, তারা শত্রু হয়ে গেছে কবেই। আমি তো মনেপ্রাণে বিশ্বাস করি, বন্ধু হওয়ার আগে আসলে আমার কোনো শত্রু ছিল না! তাহলে আর কী! নীলুফারের কাছে আমার হারানোর কিছু নেই। যদি থাকে, তা শুধু পাওয়ারই!

নীলুফারকে এবার জড়িয়ে ধরি আমি। বলা যায়, জাপটেই ধরি। ধরার সঙ্গে সঙ্গেই অনুভব করি শীতলতা। এতই যে মনে হয়, আঁকড়ে ধরেছি বরফ। আমার শরীর যেন জমে যেতে থাকে। আর তখনই নীলুফার আমার হিম হয়ে ওঠা শরীরে হাত রাখে। রেখেই সামান্য কিছু অনুভব করে তীক্ষ্ণ তাচ্ছিল্যে মৃদু ধাক্কা মারে আমাকে। বলে, ‘শালা, না-পুরুষ!’

ওইটুকু ধাক্কাতেই আমি লুটিয়ে পড়ি জীবনের সঙ্গে। আমার দশ দিক দ্রুত ছুটে আসতে থাকে আমার দিকে। এক নিঃস্ব বিন্দুতে পরিণত হতে থাকি আমি। আমার কানে প্রলাপের মতো বাজতে থাকে নীলুফারের শ্লেষ। নীলুফার হাসে। আমি দেখি, একটা মানুষ চলে যাচ্ছে কেবলই একটা পশুকে ছেড়ে!