অলংকরণ: আরাফাত করিম
অলংকরণ: আরাফাত করিম

গল্প

তুমি আর আমি যাই ক্রমে সরে সরে

বাসায় ঢোকার সময় সে টের পায় যে ফোনটা অনেকক্ষণ ধরে বাজছে। সে ফোন বন্ধ করে রাখার জন্য ব্যাগের ভেতর হাতড়ায়। হাতে উঠে আসে যে ফোন, সে হাত দিয়ে ধরেই বোঝে, তার নয়। মৌয়ের ফোন তার ব্যাগেই রয়ে গেছে। সে সামান্য আফসোস বোধ করে। জানাজার আগে আর পরে তার কয়েকবারই মনে হয়েছিল, ফোনটা মৌয়ের মা কিংবা বাসার অন্য কারও কাছে দিয়ে আসবে। কিন্তু পরে আর মনে থাকেনি। মৌয়ের মা ঘটনার আকস্মিকতায় প্রবলভাবে স্তব্ধ হয়ে গেছেন। তিনি কাঁদছেন না, মুখ শক্ত করে বসে আছেন। ভদ্রমহিলার সামনে যাওয়ার সাহস পায়নি সে।

ঘরে ঢুকেই সে প্রথমে ব্যাগ থেকে নিজের ফোন বের করে সেটা বন্ধ করে। আম্মাকে আর আরাফাতকে ইতিমধ্যে জানানো হয়েছে, সে মৌদের বাসায় রাতে থাকবে। কাজেই ফোনগুলো সাংবাদিকদের কল হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। পরে তাকে ফোনে না পেয়ে উল্টাপাল্টা কিছু লিখে বসলে কী হবে, তা ভাবতে ইচ্ছা করে না তার। যাদের দায়িত্বজ্ঞান নেই, তারা এমনিতেও একজন তরুণী মেয়ের আত্মহত্যার খবর নিজের মনের মাধুরী মিশিয়ে লিখবে। তাদের ঠেকানো যাবে না। সে আর মৌ একই সঙ্গে মিডিয়ায় কাজ করা শুরু করেছিল, একই অফিসে। চাকরির সুবাদে পরিচয় হলে বন্ধুত্ব হয় না, এ কথা যারা বলে, তাদের সঙ্গে সে একমত নয় মোটেও। মৌ তার সহকর্মী থেকে বন্ধু হয়েছিল। কর্মস্থল পাল্টে গেলেও তাদের বন্ধুত্ব অটুট ছিল। আসলেই কি ছিল? তার এখন সন্দেহ হয়। মৌ আত্মহত্যা করবে কিংবা করতে পারে, এ কথা সে জানতে পারল না কেন তাহলে?

জামাকাপড় ছেড়ে একটা লম্বা শাওয়ার নেয় সে। গরম পানির নিচে দাঁড়িয়ে তার হু হু করে কান্না পেয়ে যায়। মৌ বলত, ‘আপা, গরম পানিতে গোসল আসলে অর্গাজমের চেয়ে ভালো।’ জীবন উপভোগ করার জন্য সব সময় মুখিয়ে থাকত মেয়েটা। রাস্তার পাশের স্ট্রবেরিমাখা খেয়ে বলত, ‘মালটা দেখতেও সুন্দর, খাইতেও ভালো’, বলেই চোখ টিপ দিয়ে সে কী হাসি! যেন খুব একটা মজা হলো। স্ট্রবেরিমাখায় ফলগুলো কুচি কুচি করে কাটা হলেও সে মামার ঝুড়ি থেকে একটা আস্ত স্ট্রবেরি হাতে নিয়ে বলেছিল কথাটা, একটা আদিরসাত্মক ভঙ্গি করে। শুধু পুরুষসংক্রান্ত ব্যাপারেই নয়, খাওয়া কিংবা সেজেগুজে যেকোনো উৎসব–অনুষ্ঠানে যাওয়ার ব্যাপারেও তার প্রবল উৎসাহ ছিল সব সময়। মৌয়ের পাল্লায় পড়ে তাকে প্রায় প্রতিবারই পয়লা ফাল্গুন আর পয়লা বৈশাখে চারুকলায় যেতে হতো। নিউজ কাভার করার জন্য সে এতবার গেছে ওসব এলাকায় যে ডেস্কে কাজ শুরু করার পর তাই আর যেতে মন চাইত না। এই পাগলি মেয়ের পাল্লায় পড়ে বের হতেই হতো; অফিস থাকলে সেরে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে না হলেও ধানমন্ডি বা অন্য কোথাও। কিন্তু উৎসবের দিন ঘুমিয়ে কাটাতে রাজি ছিল না পাগলিটা। হয়তো খুব দ্রুত চিরতরে ঘুমিয়ে যাবে বলেই অল্প আয়ুর একটুও অপচয় করতে চাইত না সে। কিছু একটা উপলক্ষ হলেই শাড়ি পরে সেলফি তুলে সেগুলো ফেসবুকে পোস্ট করতে হবে তাকে। মাঝেমধ্যে সে বলত, ‘ইউ আর ওভারশেয়ারিং অন সোশ্যাল মিডিয়া।’ মৌ উত্তর দিত, ‘আমার তো ইনবক্সে ঘর-সংসার নাই আপা, সব নিউজফিডেই খুল্লামখুল্লা।’ কথাটা সে বলেছিল সবার সামনে, সম্ভবত তাকে ইনবক্সে বিরক্ত করা ব্যক্তিদের কেউ কেউ উপস্থিত ছিল সেখানে। পরে আরেকটু ব্যাখ্যাও করেছিল সে; বলেছিল, ‘ডার্কওয়েবে সবার সব গোপন তথ্য পাওয়া যায়, যতই এন্ড টু এন্ড এনক্রিপশন বলো না কেন, কে কোথায় কী শেয়ার করছে, সেসবের আমলনামা লেখা হয়ে যাচ্ছে ঠিকই।’

পরবর্তী সময়ে তারা দুজনই সেই হাউস ছেড়ে অন্য জায়গায় কাজ নিয়েছিল। কিন্তু মৌয়ের পদত্যাগের আগে জল ঘোলা হয়েছিল অনেকটা। মৌয়ের জন্য ওর মা কাঁদছেন না, এটাও সম্ভবত খুবই স্বাভাবিক। কথায়ই আছে, অধিক শোকে পাথর। এমন উচ্ছল প্রাণবন্ত মেয়ে হুট করে ফ্যানের সঙ্গে ওড়না বেঁধে ঝুলে পড়ল, কী এমন হয়েছিল নতুন করে? সেই অফিসে সেক্সুয়াল হ্যারাসমেন্টের ঘটনা তো বহু পুরোনো। মৌ কয়েক দফা লিখিত অভিযোগ করেও কোনো ন্যায়বিচার পায়নি। অভিযুক্ত ব্যক্তিকে পদোন্নতি দিয়ে অন্য অফিসে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে, তিরস্কারের বদলে সে পেয়েছে পুরস্কার। আর এদিকে মৌ হয়ে গেছে খানিকটা একঘরে। সে জানত, হোয়াটসঅ্যাপ–মেসেঞ্জারে ব্লক মেরে খুব একটা ফায়দা হয়নি। বিভিন্ন অপরিচিত নম্বর থেকে ওই লোক ঠিকই আপত্তিকর মেসেজ পাঠিয়েই যাচ্ছিল। সেই ঘটনার পর অল্প কয়েক মাস সে ওই অফিসে কাজ করেছে। তখন দুই–একজন সহকর্মী শ্লেষমিশ্রিত স্বরে বলত, ‘আরে আপা, শাড়ি পরছেন, সুন্দর লাগতেছে, দেইখেন আবার হ্যাশট্যাগ মি টু কইরা দিয়েন না’ কিংবা ‘আপনারা যারা নারীবাদী, আপনাদের সাথে কথা বলতেই তো ভয় লাগে।’ অথচ তারা খুবই ভালোমতো জানে যে অফিসে মিটু কিংবা অন্য কোনো কিছুর প্রভাবেই হেনস্তা কমেনি। অভিযোগকারিনীকেই ছাড়তে হয়েছে অফিস।

সেই অত দিন আগের ঘটনায় এত দিন ধরে বিষণ্ন ছিল মেয়েটা, এমন তো কখনো মনে হয়নি। সপ্তাহখানেক আগেও কথা হচ্ছিল ইনবক্সে, তার বর্তমান প্রেমিকের ঔদাসীন্য আর হঠাৎ করে টিনএজারদের মতো গোস্টিং করার প্রবণতার বিবরণ শুনে সে বলেছিল, ‘হিউজ রেড ফ্ল্যাগ মৌ, এরে ইগনোর করো, মুভ অন।’ মৌ কিছুক্ষণ কোনো উত্তর না দিয়ে লিখেছে, ‘একবার ডিভোর্স হইলেই একটা মেয়েকে সবাই এত সস্তা মনে করে কেন, আপা?’

সে এর কোনো উত্তর দিতে পারেনি। এসব সামাজিক স্টিগম্যাটাইজেশন তো আর নতুন কিছু না। এসব নিয়েই মেয়েদের জীবন। হয়তো বিবাহিত সহকর্মীর দ্বারা উত্যক্ত হওয়া, অন্যদের তার সামাজিক অবদমন ঠেকাতে, তার বউয়ের কান পর্যন্ত না যাওয়া নিশ্চিত করতে মীমাংসার আশ্বাস এবং শেষ পর্যন্ত কোনো সমাধান না পেয়ে চাকরি ছাড়তে বাধ্য হওয়া—সবকিছুই সে মেনে নিয়েছিল। কিন্তু প্রেমিকের অবহেলা আর সহ্য হয়নি।

বাথরুম থেকে বেরোতে বেরোতে সে ভাবে, আসলেই কি এই জমানায় কেউ প্রেমে প্রতারিত হয়ে আত্মহত্যা করে? তাও এই বয়সে? মৌয়ের মতো মেয়ে, এত পজিটিভ, প্রাণপ্রাচুর্যে ভরপুর, ঘর ফাটিয়ে হাসতে পারা, বন্ধুদের কারও গায়েহলুদ কিংবা দুর্গাপূজার মণ্ডপে গিয়ে উদ্দাম নাচতে পারা, জীবনের কঠিন সময়কে হাসির হুল্লোড়ে উড়িয়ে দিতে পারা মেয়ে কার সঙ্গে অভিমান করে শেষ রাতে ফ্যান থেকে ঝুলে পড়তে পারে? কেমন লাগে ওড়নার ফাঁস যখন কণ্ঠনালিকে চেপে ধরে? তখন কি বাতাসের জন্য আকুপাকু করতে করতে মনে হয়, সিদ্ধান্তটা ভুল ছিল? মৌ কোনো কিছু নিয়েই আফসোস করত না। শুধু বলত, ‘যেটা গেছে, সেটা তো গেছেই, ফিরে আসবে না আর। সেগুলো ভেবে এখনকার মুহূর্তটা নষ্ট করার কোনো মানে হয় না।’ মোটিভেশনাল স্পিকারদের মতো কৃত্রিমভাবে নয়, কথাগুলো সে বলত বিশ্বাস করে। একেক দিন খুব সেজেগুজে অফিসে আসত কোনো উপলক্ষ ছাড়াই। জিজ্ঞেস করলেই বলত, ‘মেজাজ ভালো রাখার জন্য সাজলাম।’

না, শেষ দেখা সে দেখেনি মৌকে। ওর সুন্দর, সজীব আর হাসিমাখা মুখটাই সে মনে রাখতে চায়। ওর ফ্ল্যাটমেটের ফোন পেয়ে সে যখন পড়িমরি দৌড়ে মৌয়ের বাসায় পৌঁছাল, ততক্ষণে পুলিশ এসে লাশ নামিয়ে ফেলেছে। শোবার ঘরের বিছানায় চাদর দিয়ে ঢাকা ছিল ওর নিথর দেহ। ময়নাতদন্ত এড়ানোর জন্য কাঠখড় পোড়ানো হলো কিছুক্ষণ, তারপর কোথা থেকে সিদ্ধান্ত এল, ময়নাতদন্ত করানোটাই নাকি ভালো। অন্তত সন্দেহ থাকবে না। মামলা না করলেও অফিসে কয়েক দফা লিখিত অভিযোগ তো সে করেছিল এক সহকর্মীর নামে। এসব ঘটনায় শত্রু বাড়ে। এখন তার মনে হচ্ছে, আসলেই ময়নাতদন্তের সিদ্ধান্ত ভালো ছিল। নইলে মৌকে যারা চিনত, তারা কেউই বিশ্বাস করতে পারত না যে ও স্বেচ্ছায় এই পৃথিবী ছেড়ে চলে যেতে চাইতে পারে।

বিছানায় বসে মৌয়ের ফোনটা চালু করে সে। পুলিশ ওর রুম সার্চ করেছে, সুইসাইড নোট, ফোনসহ সবকিছু জব্দ করেছে। এটা মৌয়ের আরেকটা ফোন, ওর ফ্ল্যাটমেটের রুমে থেকে গিয়েছিল। মেয়েটা শকে কিছুটা বিপর্যস্ত, জানাজায় পর্যন্ত গেল না। সেই বাসায়ও সে আর একা থাকতে পারবে না জানাল। বেচারা বাসায় ফিরে তালা খুলে ঘরে ঢুকেছে, আবিষ্কার করেছে মৌয়ের ঝুলন্ত দেহ। সকালবেলায় গ্রামের বাড়ি থেকে ছুটি শেষে ফিরে এই দৃশ্য দেখার জন্য কেউই প্রস্তুত থাকে না। এই ফোন থেকেই মেয়েটা তাকে ফোন করেছিল। তার মানে এই ফোন লক করা নেই। কাঁপা হাতে সে ফোনের হোমস্ক্রিন চেক করে। মৌয়ের ফেসবুক খোলাই ছিল। শেষ পোস্ট এক দিন আগের। বাড়ি থেকে আনা গরুর মাংসের শুঁটকিভুনার ছবি ছিল তাতে। কিন্তু এই ফোনের হোমস্ক্রিনে সে কোনো রকম সোশ্যাল মিডিয়ার অ্যাপ খুঁজে পায় না। তাহলে কি অন্য ফোনে আছে? নাকি আটঘাট বেঁধে সব প্রমাণ লোপাট করেই কাজটা করেছে সে? দুদিন পরপর গোস্টিং করতে থাকা কুলাঙ্গারটার কোনো নামগন্ধ পায়নি সে, আত্মহত্যার খবর জানাজানি হওয়ার পর ছত্রিশ ঘণ্টা কেটে গেলেও কোনো অপরিচিত নম্বর থেকে কোনো ফোন আসেনি তার কাছে। কী যেন নাম ছিল ছেলেটার? সে মনে করতে পারে না বহু চেষ্টা করেও। সাকিব কি? নাহ, সাকিব তো ওর সাবেক স্বামীর নাম, যে মা–বোনের প্ররোচনায় তালাক দিয়েছিল ওকে।

সে ফোনের কল লিস্ট চেক করে। মরে যাওয়ার আগে শেষ ফোনগুলো মৌ কাকে কাকে করেছিল? কল লিস্ট দেখে সে হয়তো সবাইকে চিনতেও পারবে না। মেসেঞ্জার বা হোয়াটসঅ্যাপে যদি এমন কোনো প্রমাণাদিও পাওয়া যায় যে সেই ধান্ধাবাজ প্রেমিক ওকে আত্মহত্যার প্ররোচনা দিয়েছিল, তাহলেই–বা কী এমন হবে? এই মর্মে কি মামলা করা যায়? সে আসলেই একটা খামখেয়ালি যুবককে চৌদ্দ বছরের জন্য জেলে পাঠিয়ে দিতে চায় কি না, সেটাও একটা প্রশ্ন। আর প্ররোচনার কথা যদি আসেই, মা–বোন–ভাই আর বন্ধুদের নামও তো আসতে পারে। সে নিজেও এই তালিকার বাইরে নয়। কেন কারও কাছের মানুষেরা সবাই এত দূরে দূরে চলে যায় যে একজন মানুষ আশ্রয় চাইবার জন্য কাউকেই খুঁজে না পেয়ে জীবন থেকেই পালায়?

সে মৌয়ের ফোন রেখে নিজের ফোনটা চালু করে। আরাফাত কি ঘুমিয়ে গেছে? ওকে কি একটা ফোন করবে এখন? ঘড়ির দিকে তাকায় সে। রাত প্রায় দেড়টা বাজে। যত রাতই হোক, এমন একজন মানুষ হয়তো সবারই থাকা দরকার যাকে ঘুম থেকে ডেকে তুলে কথা বলা যায়। যেকোনো সময়, যেকোনো কারণে।

সে নিশ্চিত, মৌয়ের হুটহাট ডুব মারতে থাকা প্রেমিক শুধু নয়, বাদবাকি বন্ধুরাও সবাই একটু একটু করে এত দূরে সরে গিয়েছিল যে কাউকে ফোন করে ও দুই মিনিট কথা বলতে পারেনি। হয়তো একজন কাউকে ফোনে পেলে এমন নির্দয় কাজ ও করত না নিজের সঙ্গে।

মানুষ মরে গেলে আকাশের তারা হয়ে যায়, এমন রোমান্টিক চিন্তা কেউ আর এখন করে না। তার মনে হয়, জীবিত থাকতেই সব মানুষ একে অপরের থেকে আলোকবর্ষ দূরে ছুটে যায় আসলে। সম্ভবত ক্রমাগত বাড়তে থাকা বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের নিয়মই এটা।